অগণিত নথি পরিবেশের ক্ষতি by মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী
নথির
পাহাড় অফিসে অফিসে। নথি মানেই কাগজের স্তূপ। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায়ও কাগজের
ব্যবহার সীমিত হচ্ছে না। নথি ব্যবস্থাপনা অফিসের মেরুদণ্ড, কিন্তু রিমে
রিমে কাগজ কিনে অফিস হয়ে যাচ্ছে কচুরিপানা ভর্তি দীঘির মতো। সারি সারি
কম্পিউটারের সমান্তরালে চলছে বস্তায় বস্তায় কাগজের ব্যবহার। নথিতে জমে থাকে
অদৃশ্য শত্রু ডাস্ট। এতে সৃষ্টি হয় অ্যাজমা, ব্রংকাইটিসের মতো মারাত্মক
স্বাস্থ্যঝুঁকি। অন্যদিকে নথি চালাচালিতে সৃষ্টি হয় স্নায়ুবিক চাপ। নথি
ঘিরে ঘটছে পোকামাকড়, ইঁদুর ও বিভিন্ন অনুজীবের বংশ বিস্তার। শুধু নথিতে
প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট হারানোয় এক সরকারি দফতরের কাছে পাওনা অর্থ পেতে ৭ বছরে
বিপুল শ্রম, অর্থ, সময় ও ঘাম ঝরিয়ে অন্তত ২০০ বার অফিসে ছুটেছেন
সংশ্লিষ্টরা। ই-মেইলে বার্তা বা মোবাইলে মেসেজ প্রেরণের পরও বাহক দিয়ে এক
অফিস থেকে আরেক অফিসে পাঠাতে হয় চিঠি। ওয়েবসাইটে তথ্য প্রদানের পরও
পৃথকভাবে সংবাদপত্রে ছাপাতে হয় বিপুল অর্থ ব্যয়ে বিজ্ঞপ্তি। বিদ্যুৎ
সেক্টরে এক প্রতিষ্ঠানের ২ বছরে ৫০টি বোর্ড সভার কার্যবিবরণীর জন্য কাগজ
লেগেছে সোয়া ২ লাখ পৃষ্ঠা (৪৫০ রিম), সভা শেষে ৯০ শতাংশ কাগজের গন্তব্য
হয়েছে আঁস্তাকুড়ে। অপর এক সংস্থায় এক বছরে লেগেছে ৫৯৭ রিম কাগজ। রোবটিক
যুগে অগ্রসরমান পৃথিবীকে আমরা ভরে দিচ্ছি কাগজে। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের সদর
দফতরে ১৯০০ সাল থেকে ভূ-সম্পত্তি সংক্রান্ত নথি পড়ে আছে। হাউজ বিল্ডিং
ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের এক আঞ্চলিক অফিসে ৪০ বছরের বেশি পুরনো ভলিউম
রক্ষিত, অথচ ডাটাবেজ নেই। এভাবে অগণিত নথি সৃষ্টি করছে সম্পদ ও সময় অপচয়ের
সংস্কৃতি। গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড ডিজিটাল আর্কাইভভুক্ত করে অপ্রয়োজনীয় নথির
পাহাড় আইনি প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করে রিসাইক্লিং-এ পাঠানো না হলে কাগজের স্তূপই
এক সময় ভয়াবহ সমস্যা সৃষ্টি করবে।
তাই কাগজের ব্যবহার হ্রাস এবং কাগজ
উৎপাদন রিসাইক্লিংয়ের আওতায় না আনলে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা যাবে না।
কারণ কাগজ উৎপাদনে প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল (পাল্প, বনজ বাঁশ, গাছ)
এবং বিদ্যুৎ ও পানি। এতে অনিবার্যভাবে আক্রান্ত হচ্ছে হাইড্রোলজি,
টপোগ্রাফি, মেটোরিওলজি এবং সর্বাংশে প্রকৃতি। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় পাল্প
ও কাগজ তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দূষণকারী, এতে প্রতি বছর ১০০ মিলিয়ন কেজি
বিষাক্ত বর্জ্য তৈরি হয়। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী কাগজ ও পাল্প কারখানা পঞ্চম
বৃহত্তম জ্বালানি সম্পদ ভোগকারী। কাগজ উৎপাদনে নির্গত হয় নাইট্রোজেন
ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড, যা এসিড বৃষ্টি,
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনে কাগজ কারখানাগুলো
কর্মসংস্থানে যত বিশাল ভূমিকা রেখেছে, তার বিপরীতে ওই এলাকার নদীগুলো দূষিত
বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। একইভাবে চীনের ইয়েলো নদীর অদূরে একটি হ্রদের
পাড়ে দুই কাগজকলের ভয়ানক দূষণে হ্রদটির পানি সয়াসসের রঙ ধারণ করে। এক সময়
অতিবর্ষণে হ্রদটি ফুলে-ফেঁপে এক গ্রামের ৫৭টি বাড়ি তলিয়ে যায়। এমন
দুর্ঘটনার শঙ্কা আমাদের দেশেও আছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭
অনুযায়ী কাগজ কারখানা র্যাংকিং-এ চরম সীমায় দূষণকারী (লাল শ্রেণী)।
দূষণবিরোধী অভিযানের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ)
ছাড়া প্রচুর কারখানা গড়ে উঠেছে। কার্যকর বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্রের অভাবে এসব
কারখানার দূষিত বর্জ্যরে চূড়ান্ত গন্তব্য কর্ণফুলী, মেঘনা ও শীতলক্ষ্যার
উদরে। এ ছাড়া রাতের আঁধারে কত বর্জ্য ফেলা হয়, তা রাতের অভিযানে না নামলে
কখনও জানতাম না। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে একসঙ্গে তিন কারখানায় অভিযান চালিয়ে
একটিতেও বর্জ্য শোধনাগারের চিহ্ন পাইনি। দূষণের মাত্রা এত তীব্র ছিল, যেন
নদী ভর্তি রক্ত প্রবাহ, ওই স্থানে দ্রবীভূত অক্সিজেন ছিল মাত্র ০.৭
মিলিগ্রাম/লিটার। এটি দূষণ প্রমাণের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যারোমিটার। এ অবস্থায়
নদীতে মাছ শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পেরে উপরে উঠে আসে বা তীরে চলে আসে।
দৈনিক ১ টন কাগজ তৈরিতে পানির ব্যবহার হয় ৮ হাজার ঘন মিটার। এভাবে কাগজ
কারখানাগুলোর সৃষ্ট কোটি কোটি লিটার বর্জ্য দেশের ৭৫ শতাংশ পানির উৎস
নদ-নদীকে ‘বিষাক্ত’ করছে। উন্নত মানের কাগজ তৈরিতে পেপার ফাইবার বেশি
রিসাইক্যাল করা যায় না, ফলে তা পরিবেশের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। শেষ
পর্যন্ত ফুড চেইনের মাধ্যমে নদ-নদীর বিষাক্ত পানির ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে
আমাদের কিডনি, লিভার, পরিপাকতন্ত্রে। পরিবেশের ওপর এ অত্যাচার সৃষ্টি করছে
মরণব্যাধি ক্যান্সার। দূষণের সব প্যারামিটার অতিক্রম করায় বুড়িগঙ্গা,
তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা নদী আজ সংকটাপন্ন। এই চার নদী দূষণের কারণে আজ
ঢাকার ৩৩ কিলোমিটার দূরে পদ্মা নদী থেকে বিশাল অর্থ ব্যয়ে ওয়াসাকে বিশুদ্ধ
পানি সরবরাহের প্রজেক্ট নিতে হয়েছে। দুরন্ত স্রোতের নদ-নদীগুলো আজ পঙ্কিল
স্রোতে পরিণত। হারিয়ে গেছে দেশি প্রজাতির মাছ, গাঙচিল, সাদা বক ও বেলে
হাঁস। পরিবেশগত ক্ষতি ব্যক্তির একার নয়। এ ক্ষতি সমগ্র জাতির,
জীববৈচিত্র্যের এবং পুরো সভ্যতার।
পৃথিবীর সব প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে
ভূতাত্ত্বিকভাবে নদী ও সমুদ্রই অর্থনৈতিকভাবে বেশি সমৃদ্ধ। বাংলাদেশে
প্রবাহিত নদ-নদীগুলো বছরে গড়ে ১ হাজার ৩৫০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানিসম্পদ
বহন করে। উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, নগরায়ন ও শিল্পায়নের নামে
নদীগুলোর এলাইনমেন্ট কিভাবে ভাঙছে। ফলে পূর্ণ গভীরতা, সৌন্দর্য ও লাবণ্যের
নদী কোথাও আর নেই। আতঙ্কজনক খবর হল, টোকিও, লন্ডন, মিয়ামি, ইস্তাম্বুল,
মেক্সিকো সিটি, মস্কো, জাকার্তা, কায়রো, বেইজিংয়ের মতো বড় বড় শহরগুলো
অচিরেই পানিশূন্যতার কবলে পড়ছে। নদ-নদী ও জলসম্পদ শুধু মানুষের ভোগের জন্য
নয়, এ সম্পদে সব সৃষ্টির অধিকার আছে। নতুন প্রজন্ম, উদ্যোক্তা এবং সচেতন
নাগরিকদের বুঝতে হবে, কাগজের অতি ব্যবহারে প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাস, নদ-নদীর
সর্বনাশ। কাগজের প্রাচুর্য সৃষ্টি করছে অমিতব্যয়িতা। শিল্প বিপ্লবের
ক্রমবিবর্তনের ধারাবাহিকতায় কর্পোরেট পুঁজিবাদ পরিবেশ ধ্বংসের উন্মাদনায়
নেমেছে, যার শুধু লক্ষ্য ‘মুনাফা ও ভোগ’। একজন মানুষের দৈনিক ১৬০০ (প্রায়)
ক্যালরির বেশি প্রয়োজন নেই, অথচ অনৈতিক ভোগবাদিতায় কিছু অন্ধ মানুষ
অক্টোপাসের মতো সব গিলে খেতে চাচ্ছে। পুঁজিবাদ শাসিত ভোগবাদিতা মানুষের
জীবনের সরলতাকে জটিলতায় রূপান্তর করছে। পরিবেশ ও অর্থনীতির অপরিমেয় ক্ষতি
কমাতে কাগজের অপচয় ও দূষণ বন্ধ করতে হবে। যে শিল্পায়ন পরিবেশ-প্রকৃতি মানে
না, তা অপরিপক্ব শিল্পায়ন। টেকসই উন্নয়নের ধারণায় আনতে হবে কাগজের সীমিত
ব্যবহারের যৌক্তিকতা, নতুবা ‘পরিবেশ’ পরাজিত হবে, বিজয়ী হবে ‘মুনাফা’।
শিল্প বর্জ্যরে ভারে যেদিন স্তব্ধ হবে নদ-নদীর উত্তাল ঢেউ, সেদিন স্তব্ধ
হবে সভ্যতার স্পন্দন। নদী বয়ে আনে পলি আর জলরাশি; নদীতে বসবাস করে হাজারও
প্রজাতির প্রাণি। নদী জীববৈচিত্র্যের আধার, সম্পদে ভরা প্রকৃতির অনন্য
উপহার। মানুষের শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য ও মৃত্যু আছে।
কিন্তু নদী চির যৌবনা, চির গতিময়, চির সঞ্চরণশীল। অথচ নদীকে দখলে পদানত
করে, দূষণে নিঃশেষ করে আমরা মুমূর্ষু অবস্থায় এনেছি। মানব ধমনীতে রক্ত
প্রবাহের মতোই নদী অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নদী ও
জীবন-জীবিকা, নদী ও সভ্যতা অবিচ্ছিন্ন তরঙ্গে বাঁধা। নদী রক্ষায় চাই কঠোর
প্রতিজ্ঞা, সদিচ্ছা।
মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী : মহাপরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন; সাবেক পরিচালক, পরিবেশ অধিদফতর
mmunirc@gmail.com
মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী : মহাপরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন; সাবেক পরিচালক, পরিবেশ অধিদফতর
mmunirc@gmail.com
No comments