মেলাশেষের গল্প by ড. ফজলুল হক সৈকত
বইমেলার
বাইরে উদ্যানের পথ ধরে হাঁটছি। চার পাশে শুকনো পাতার ওড়াউড়ি চোখে পড়ছে।
লোকেরা যাচ্ছে, আসছে। কেউ মেলার দিকে, কেউ উদ্যানের, কেউবা খাবারের দোকানের
দিকে। তিনজন মানুষ- একজন মধ্যবয়সী পুরুষ, বাকি দু’জন তরুণী। তাদের মধ্যে
সম্পর্ক কী, তা আঁচ করা কঠিন। পাতা দিয়ে ছোট্ট হাঁড়িতে চা তৈরি করে শেয়ার
করছেন। কী আর করা- গভীর বন যখন নেই ধারে-কাছে, তখন এখানে, এই উদ্যানেই
ক্যাম্প করে বসেছেন। ব্যাপার একেবারেই সাময়িক। কিন্তু আনন্দটা অসীম। সময়কে
তারা কেবল যাপন না করে সত্যি সত্যি উদযাপন করতে চান। একটু সামনে এগোলেই
মেলায় প্রবেশের পথ। নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা। পথের ধারে সিনেমার শুটিং। ওপাশে
উন্মুক্ত মঞ্চে নাটকের শো। ভেতরে ঢুকতেই কানে ভেসে এলো নতুন বইয়ের মোড়ক
উন্মোচনের ঘোষণা। চার পাশে লোকদের ব্যস্ত পদচারণা। কেউ কেউ সেলফি তোলায়
মগ্ন। মিডিয়ার মানুষ ক্যামেরা তাক করে তার টানাটানি করছে। দু-একজন
সেলিব্রেটি ফটোসেশনে সময় দিচ্ছেন। শিশু চত্বরে শিশুরা দেখে দেখে বই কিনছে।
অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা অথবা সাথে থাকা অভিভাবক শিশুদের প্রভাবিত
করছেন কিংবা বই নির্বাচনে সহায়তা করছেন। আমার এক বন্ধু-প্রকাশক আপ্যায়নের
জন্য নিয়ে গেলেন রেস্তোরাঁয়। প্রচণ্ড ভিড়। তিনি বললেন- ‘স্টলে তেমন লোক না
পাওয়া গেলেও এখানে দেখবেন সবসময় সরগরম। বসার জায়গা পাবেন না আপনি।’ অবশ্য
মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পর বসার জায়গা মিলল। খাবার তো মানুষের এক নম্বর
মৌলিক চাহিদা। আর বই সম্ভবত পাঁচ নম্বর। যদি জ্ঞান বা শিক্ষার উপাদান
হিসেবে বইকে বিবেচনা করি। আর বিনোদনের মাধ্যম ধরলে আরো পরে যাবে এর
অবস্থান। কাজেই লোকেরা বেশি বই কেনে না; বেশি খায়- এমন অভিযোগ না করাই
ভালো। ছাপাখানা আবিষ্কারের ঘটনাটা ছিল বিশ্ব-সভ্যতার জন্য এক বিরাট
আশীর্বাদ। মানুষের অভিব্যক্তি প্রকাশে এই মাধ্যমটি যেভাবে প্রভাব ফেলেছে
অন্য কোনো মাধ্যম আর সেভাবে পারেনি। লেখা প্রকাশের ফলে সাহিত্য নামের বিশেষ
ধারণাটিতে আমরা পৌঁছাতে পেরেছি এই ছাপাখানারই সুবাদে।
শিক্ষা এবং ধর্মের
(বিশেষত নীতিকথার) প্রচার-প্রসারের পাশাপাশি সাহিত্য কালক্রমে আমাদের
নির্মল আনন্দের ভুবনে পৌঁছে দিয়েছে। দর্শন এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে
মানুষের রুচিবোধ পাল্টেছে। মূল্যবোধ-বিষয়ক লেখা আর লেখকের পরিবেশনশৈলীটা
পাঠককে সাধারণত আকৃষ্ট করে থাকে। আর সাধারণ পাঠক ধর্ম কিংবা দর্শন, সমাজ
অথবা রাজনীতি, বিজ্ঞান কিংবা প্রকৃতি সম্বন্ধে লেখকের স্পষ্ট ধারণা এবং
বিষয়ের সারকথা প্রত্যাশা করে। একুশের বইমেলা ঘিরে সারা মাস হই চই থাকে।
আনন্দ থাকে। ব্যবসা থাকে। দেখা-সাক্ষাৎ পরিচয়-পরিণয় থাকে। আর থাকে
জ্ঞানাকাশে বিচরণের সুযোগ। অবশ্য এই হই-হুল্লোড় প্রধানত ঢাকাকেন্দ্রিক।
সারা দেশের পাঠকেরা এখানে তেমন একটি সমবেত হওয়ার সুযোগ পায় না। আবার ঢাকার
সব প্রান্তের মানুষ যে নিয়মিত মেলায় আসতে পারেন, তাও নয়। তাই
টিএসসিকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে এই মেলা। প্রচার মাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগের
মাধ্যমে অবশ্য এর একটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রূপ আমরা পেয়ে যাই। সব মিলিয়ে
মাসখানেক চলে আনন্দের যোগাযোগ। বইমেলাতো ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ এলেই শেষ হয়।
কিন্তু মেলার সময়-পরিসর, স্টল-বিন্যাস, লেখার বিষয়, প্রকাশনার মান,
লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক, মিডিয়ার প্রভাব- এসব নিয়ে কথা যেন শেষ হয় না। অনেকের
ধারণা এই মেলা ৭ থেকে ১৫ বাড়ানো যেতে পারে। কারণ প্রথম ১০ দিন তো তেমন জমে
না। আর বেশির ভাগ নতুন বইও আসে ১৩ থেকে ২১ তারিখের মধ্যে। স্টল গোছগাছের
জন্য প্রথম সপ্তাহটা প্রায় পার হয়ে যায়। মূলত মেলাটা জমে ওঠে পহেলা
ফাল্গুনকে ঘিরে। তাই মেলার মেয়াদ বা সময়-পরিসর আরো বাড়ানো হতে পারে। স্টল
ঠিকঠাকের জন্য নিশ্চয় মেলাকালীন সময় বরাদ্দ করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
স্টল-বিন্যাস আরো সুন্দর কীভাবে করা যেতে পারে, তাও ভেবে দেখা দরকার। নতুন
নতুন বিষয়ে লেখা তেমন একটা চোখে পড়ে না। কয়েকজন লেখকের বই-এর বাইরে পাঠকেরা
নতুন লেখকের বই কিনতে খুব একটা আগ্রহীও নয়। বিশেষ করে শিশু-মনস্তত্ত্ব
বিষয়ক বই-এর বড়ো অভাব। ছবি, রঙ আর হালকা ঢঙের গল্প দিয়ে সাজানো বেশির ভাগ
শিশু-কিশোরতোষ গ্রন্থ। সম্ভবত শিশু-সাহিত্যিকরা পাঠকের রুচি, চাহিদা এবং
তাদের সম্ভাবনাগুলোকে তেমন একটা বিবেচনায় রাখেন না। শিশুর কল্পনাভুবনকে
নাড়া দিতে পারে, সমৃদ্ধ করতে পারে তাদের চিন্তাশক্তিÑ এমন বইয়ের চাহিদা আছে
অনেক। মেলাকেন্দ্রিক প্রকাশনার একটা হিড়িক থাকায় মান ঠিক রাখা কঠিন হয়ে
পড়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই। ছাপাখানায়, বাঁধাই কারখানায় চাপ থাকে।
প্রচ্ছদ-অলঙ্করণে তাড়াহুড়া লেগে থাকে। আর বিশেষ করে ভাষা-সম্পাদনার
ব্যাপারটি আমাদের এখানে এখনও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পেল না। এসব ক্ষেত্রে
আয়োজক প্রতিষ্ঠান নতুন করে ভাবতে পারে। যেমন তারা বলে দিতে পারে,
মেলা-পরবর্তী সময়ে সারা বছর প্রত্যেক প্রকাশনীকে প্রতি মাসে অন্তত দু’টি
গ্রন্থ প্রকাশ করতে হবে এবং এই বিষয়ক চুক্তিপত্র বছরে ২ বার একাডেমিতে জমা
দেয়ার নিয়মও করা যেতে পারে। আর নতুন লেখক ও প্রকাশকের ক্ষেত্রে
ভাষা-সম্পাদনার বিষয়ওটি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে অপেক্ষাকৃত নবীন লেখক ও
অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞ প্রকাশকদের প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রতিটি গ্রন্থে
বিষয়-সম্পাদক ও ভাষা-সম্পাদকের মুখবন্ধ প্রকাশ বাধ্যতামূলক করার কথা ভেবে
দেখা যায়। কোনো কোনো প্রকাশক প্রায় প্রতি বছরই বলেন- বেচাবিক্রি ভালো না,
গত বছরের তুলনায় এবার মেলা খুব খারাপ যাচ্ছে। কিন্তু তারা প্রতিবছরই মেলায়
অংশগ্রহণ করেন। আবার কেউ কেউ মেলার সময় বাড়ানোর জন্য তাগিদ অনুভব করে
থাকেন। প্রশ্ন হলো- যদি মেলায় ভালো বিক্রি না-ই হয়, তাহলে প্রতিবছর স্টলের
সংখ্যা বাড়ছে কেন। কেউ কেউ কৌশলে একাধিক স্টলও দিয়ে থাকেন। যেমন কোনো কোনো
প্রকাশকের শিশুতোষ গ্রন্থের জন্য আলাদা প্রকাশনা ও স্টল রয়েছে। তাহলে,
মোটের ওপর ভালো বাণিজ্য যে হচ্ছে, তা অস্বীকার করি কী করে? আর লেখকদের
অবস্থান যে মেলা আয়োজনের ঠিক কোন পর্যায়ে তা আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি। হতে
পারে এটা আমার ব্যর্থতা। লেখকরা কীভাবে বই প্রকাশের সাথে যুক্ত আছেন?
তাদের সাথে প্রকাশকদের বাণিজ্যিক সম্পর্কটা কেমন হওয়া উচিত? এসব বিষয়েও
মেলা কর্তৃপক্ষ কোনো ভূমিকা রাখতে পারে কিনা, তা চিন্তা করার সময়ও হয়তো এসে
গেছে। একসময় ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা’র আসর বসত। এখন আর সেই মেলা নেই।
কেন বন্ধ হলো, কারা বন্ধ করল জানি না। যদি ওই মেলা আর আয়োজন করা না যায়,
তাহলে অমর একুশে বইমেলাকে আন্তর্জাতিক রূপ দেয়া যায় কিনা, ভেবে দেখা দরকার।
একুশে ফেব্রুয়ারিতো এখন কেবল বাংলাদেশের শহীদ দিবস নয়- পৃথিবীজুড়ে
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। কাজেই এই মেলা-প্রাঙ্গণকে
সারা দুনিয়ার লেখক-প্রকাশক-ক্রেতার, সমালোচক-মিডিয়া-ব্যক্তিত্বের
মিলনমেলায় পরিণত করার সময় হয়েছে সম্ভবত। আর একটি কথা। কথাটা হয়তো কারো কারো
কাছে খারাপ শোনাবে। কিন্তু সত্যি না বলে পারছি না।- চলচ্চিত্রে যেমন
সেন্সরবোর্ড আছে; সিনেমা রিলিজ করার আগে তাদের মতামত নিতে হয়। ঠিক এমন
ফরমেটে নতুন প্রকাশিত বই মেলায় প্রবেশের আগে যদি সেন্সর করা যেত। জানি না
এটা সম্ভব কিনা। হলে কিভাবে সম্ভব? হয়তো কেউ কেউ ভাববেন লেখকের সৃজনশীলতা
কিংবা স্বাধীনতা এতে ক্ষুণœ হবে। কিন্তু ভাবুন তো এত এত বইয়ের কী প্রয়োজন?
আর মওসুমি লেখকদের পেশাদার লেখক হতেও বোধ করি প্রয়োজনীয় পরামর্শ বা উৎসাহ ও
স্বীকৃতি দিতে পারে প্রস্তাবিত এই বোর্ড। আর শৌখিন ও প্রযোজক-লেখকদের
(যারা নিজের টাকা দিয়ে বই ছাপেন) জন্য এই বোর্ড হতে পারে বিশেষ কর্তৃপক্ষ ও
অভিভাবক। আর হ্যাঁ, মিডিয়া তো আমাদের সবচেয়ে বড় প্রচারক ও সহায়ক। মিডিয়ার
বৈপ্লবিক উন্নতির ফলে বইমেলায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে নিঃসন্দেহে। পত্রিকা
ও টিভি বইমেলা বিষয়ে দারুণ কাভারেজ দেয়। এটা লেখক-প্রকাশকদের বাড়তি পাওয়া।
তবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু প্রচার-কৌশল এবং বিশেষ করে
ক্রেতা-আকর্ষণ প্রক্রিয়া মাঝে মধ্যে বিরক্তির উদ্রেক করে। বিব্রত করে।
যেমন- যদি কেউ তার টাইমলাইনে ও ওয়ালে পোস্ট দেন- ‘প্লিজ আমার বইটা কিনুন’,
অথবা ‘আজ আমি মেলায় থাকব। বই কিনে অটোগ্রাফ নেবেন কে কে?’, তখন লেখকের
বিপন্নতা অনুভব করি আমি। অবশ্য এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত মন্তব্য। কিন্তু
আমার মনে হয় লেখার দায়িত্ব লেখকের; প্রকাশক প্রডাকশনের মান এবং বিপণনের
দায়িত্ব পালন করবেন; আলোচক-সমালোচক এবং মিডিয়া বইকে প্রমোট করবেন; পাঠক
দেখে-বুঝে-শুনে ক্রয়ের জন্য বই নির্বাচন করবেন- এমনটা হলে পুরো ব্যাপারটি
আরো চমৎকার ও নান্দনিক হয়ে উঠবে। সবশেষে এ কথা না বললেই নয় যে, বইমেলা
আমাদের জন্য অপার আনন্দের কিছু প্রহর বয়ে নিয়ে আসে। জ্ঞানকাণ্ডে কিছু
সমাচার যোগ করে। যোগাযোগের নতুন ভুবন তৈরি করে দেয়। আর সাহিত্যের আসরে
যুক্ত করে নতুন নতুন দিক ও চেতনা।
No comments