সি চিন পিং ‘চেয়ারম্যান ফর এভরিথিং’? by মার্ক লিওনার্ড
চীনের
কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) এ সপ্তাহে সরকারের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বের
মেয়াদ উঠিয়ে দিল। মনে হচ্ছে এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সামনে
কেবল ‘সবকিছুর চেয়ারম্যান’ হওয়া নয়, বরং ‘চিরকালীন চেয়ারম্যান’ হওয়ার দরজা
খুলে দেওয়া হলো। চীনের এই উদ্যোগ বিশ্বজুড়ে হতাশা ও আতঙ্কের অনুভূতি তৈরি
করেছে। একই সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা খুব বেশি থাকা, নাকি
খুব কম থাকা দেশটির জন্য হুমকি, তা চীনা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে চলমান বিতর্ক
আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই প্রশ্নের জবাবে একেকজনের অবস্থান একেক রকম। দেখতে
হবে প্রশ্নটি যিনি তুলছেন তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ নাকি
প্রযুক্তিবিদ, নাকি অন্য কিছু। যেমন অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আইনজ্ঞ এই
পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরছেন, কারণ তাঁরা ১৯৭৯ সালে সিপিসির
প্রতিষ্ঠা করা যৌথ নেতৃত্বকে সিপিসির এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর একটি
বলে মনে করেন। মাও যুগে ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ এবং ‘কালচারাল রেভল্যুশন’-এর
মতো বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের অসীম
ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করার উদ্দেশ্যেই যৌথ নেতৃত্বের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
১৯৭৯ সাল-পরবর্তী বিধিবিধান দলের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাভাবনার লড়াইকে
অনুমোদন দিয়েছিল। বিশেষ করে পূর্ণাঙ্গরূপে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি
পরিচালিত করার পক্ষ নেওয়া ইয়ং কমিউনিস্ট লিগ এবং উদার অর্থনীতির পক্ষ নেওয়া
এলিটদের মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব এই বিধিবিধান অনুমোদন করেছিল। নানা দিক থেকে
চীন হয়তো রুদ্ধ সমাজ জারি রেখেছে। কিন্তু শীর্ষ নীতিনির্ধারকেরা এখন নতুন
নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো এবং ভুল করা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার
ব্যাপারে খোলা মনে তাঁদের সম্মতির কথা বলছেন। অনেক অর্থনীতিবিদ অবশ্য
প্রেসিডেন্টকে সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়ায় কম উদ্বিগ্ন। কারণ তাঁদের মতে,
প্রয়োজনের সময় দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোয় রদবদল আনতে পারবে না—এমন দুর্বল
সরকার বরং চীনের জন্য আরও ক্ষতিকর। হু জিন তাওয়ের দুই মেয়াদের
প্রেসিডেন্টের দায়িত্বের শেষ দিকে ২০১৩ সালে অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন, যৌথ
নেতৃত্বের মডেল কায়েমি স্বার্থপন্থী গোষ্ঠীর রাশ টেনে ধরা, বৈষম্য সামলানো
এবং জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। প্রকৃতপক্ষে
২০০৭ সালের শুরুর দিকে হু জিন তাওয়ের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও এই
সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, চীনের অর্থনৈতিক যাত্রাপথ ‘অস্থিতিশীল,
ভারসাম্যহীন, সমন্বয়হীন ও ভঙ্গুর’। কিন্তু দেখা গেল, সি চিন পিং সিপিসিকে
একটি ‘অধিকতর পরিচ্ছন্ন দল’ হিসেবে গঠনের জন্য এসবের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু
করলেন।
তিনি বড় ধরনের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালালেন এবং এর মধ্য দিয়ে দলের
সব পর্যায় থেকে হাজার হাজার দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকে জেলে পুরে তৃণমূল
পর্যায়ে সিপিসির ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনলেন। অর্থনীতিবিদেরা একমত হবেন, সি এই
অভিযানের মধ্য দিয়ে দলের মধ্যে থাকা তাঁর প্রতিপক্ষের অনেককেই সরিয়ে দিতে
পেরেছেন। এখন আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার ক্ষমতা পাওয়ায় তিনি স্বাধীনভাবে
প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিয়ে টেকসই নীতি খুব সহজে নিতে পারবেন। অর্থনীতিকে
আরও দ্রুত বর্ধনশীল করার জন্য প্রয়োজনীয় ঝুঁকি নিতে এখন তাঁর বেগ পেতে হবে
না। এর জন্য এখন তাঁকে পুরো জাতিকে কড়া নজরদারির আওতায় আনতে হবে। অবশ্য
ইতিমধ্যেই সে প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। নাগরিকদের আচরণ, আশা-আকাঙ্ক্ষা,
আশঙ্কা জানার জন্য তাঁদের মধ্যে কারা সরকার সমর্থক ও কারা ভিন্নমতাবলম্বী,
তা বোঝার জন্য সরকার ক্রমান্বয়েই সিসি টিভি, তথ্য–উপাত্ত ও কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়াচ্ছে। সি চিন পিংয়ের আমলেই অনলাইনে ‘সোশ্যাল
ক্রেডিট’ ডেটাবেইস দাঁড় করানো হয়েছে। এর মাধ্যমে নাগরিকেরা অনলাইনে কেমন
আচরণ করে, তাদের গড় বয়স কত, দলের প্রতি তাদের আনুগত্যের মাত্রা কেমন
ইত্যাদি বিষয়ে সরকার ধারণা নেয়। চিন পিং অনলাইন তথ্যপ্রযুক্তিসহ অন্য
মাধ্যমে জনমনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আগেভাগে স্বচ্ছ ধারণা রাখতে চান। কারণ তিনি
জানেন, পৃথিবীর বহু একনায়কের পতনের মূল কারণ ছিল জনগণ কী ভাবছে তার আসল
চিত্র তাঁদের কাছে পৌঁছাত না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদেরা একটি
বিষয়ে একমত হবেন। সেটি হলো নিজের অবস্থান সুসংহত করতে চিন পিং ইতিহাসের
সবচেয়ে কড়া নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যাচ্ছেন। তবে ট্রাম্পের মতো চিন
পিংয়ের ‘মেক চায়না গ্রেট অ্যাগেইন’ মনোভাব চীনকে কতটুকু শক্তিধর করে তুলতে
পারবে, সেটা সময় বলে দেবে। চীন এখন যে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং
নানা ধরনের অবকাঠামো বানিয়েছে তার প্রভাব দীর্ঘদিন ধরেই অনুভব করা যাবে।
ধরা যায়, চিন পিং এখনই ‘চেয়ারম্যান ফর এভরিথিং’-এর আসনে বেশ পাকাপোক্তভাবেই
বসলেন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশনসের পরিচালক
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশনসের পরিচালক
No comments