‘পদ্মাবত’ সিনেমায় ইতিহাস কেন আসামি? by ফারুক ওয়াসিফ
বলিউডি
সিনেমা পদ্মাবত নিয়ে বিতর্কের রণাঙ্গন এখন শান্ত। রাজপুতরা শান্ত,
বিজেপিমনারাও শান্ত। রাজপুত ও হিন্দুসম্প্রদায়ের রাজা-রানিদের বীরত্ব ও
মর্যাদা খাটো করার আলামত না পেয়ে তারা খুশি। আপত্তিটা যেদিক থেকে ওঠার কথা,
সেই ভারতীয় মুসলমানরাও নীরব। কিন্তু নীরব নন মোগল ভারত বিষয়ের নামকরা
ইতিহাসবিদেরা। সিনেমাটিতে দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির চরিত্র, ইতিহাস ও
অবদান বিকৃত করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ভারতের অগ্রণী ইতিহাসবিদ রোমিলা
থাপার, ইরফান হাবিব, রুচিরা শর্মা প্রমুখ। আলাউদ্দিন খিলজির জীবৎকালের
আড়াই শ বছর পর মালিক মুহাম্মদ জয়সী রচনা করেন পদ্মাবত কাব্য। এই কাল্পনিক
কাহিনি ধরে পরে আরাকান রাজসভার বাঙালি কবি আলাওল লেখেন পদ্মাবতী। কিন্তু
তাঁরা কেউই দাবি করেননি যে ইতিহাস লিখছেন। বিজেপি সমর্থকদের দাবি,
পদ্মাবত-এ যে আলাউদ্দিন খিলজিকে দেখানো হয়েছে, তা সত্য ইতিহাস। ইতিহাসবিদ
রুচিরা শর্মার দাবি, আলাউদ্দিন খিলজি ভিলেন তো ননই, বরং তাঁর কাছে ভারত
ঋণী। তিনি ভারতের ঐক্য আনেন, পাঁচবার মোঙ্গল আক্রমণ ঠেকিয়ে ভারতকে ধ্বংস
থেকে বাঁচান। মোঙ্গলদের দখলে গেলে ভারতের পরিণতি হতো পারস্যের মতো: গণহত্যা
ও নগর ধ্বংস। আলাউদ্দিন দিল্লিকেন্দ্রিক ছোট একটি রাজ্য থেকে বিশাল
সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেই ঐক্যবদ্ধ ভারতই মোগলদের হাত হয়ে ব্রিটিশ ও
তারপর স্বাধীন ভারত হিসেবে টিকে আছে। সম্রাট হিসেবে আলাউদ্দিন খিলজি
নিষ্ঠুর হতে পারেন, কিন্তু রাজ্যস্পৃহা থাকলেও তাঁর নারীস্পৃহার কথা শোনা
যায় না। খিলজির বাহিনীতে বেশ কজন দাস-জেনারেল ছিলেন। তাঁর প্রশাসনে
যোগ্যতার ভিত্তিতে নিম্নশ্রেণির মানুষদের উঠিয়ে আনা হতো। এতে হিন্দু-মুসলিম
অভিজাতেরা নাখোশ হয়। তাঁর চালু করা করব্যবস্থা বিশ শতক পর্যন্ত চালু ছিল।
এই সংস্কারে মধ্যস্বত্বভোগীদের উচ্ছেদের ঘটনাটা রাজপুতদের খেপিয়ে তোলে।
গঙ্গা-যমুনা মধ্যবর্তী দোয়াব অঞ্চলের অনেক সুফির করমুক্ত জমির অধিকারও তিনি
বাতিল করেন। সেই সুফিদেরই অনুসারী হিসেবে খিলজির ওপর চটা ছিলেন পদ্মাবত-এর
কবি জয়সী। আড়াই শ বছর পর পদ্মাবতী কাব্যে তিনি খিলজিকে পদ্মাবতীর প্রতি
লোলুপ হিসেবে দেখান। জয়সীর পৃষ্ঠপোষকেরা রাজপুত অভিজাত হওয়ায় তাঁদের খুশি
করার দায় এই কবির ছিল। তা না হয় হলো, কিন্তু খিলজির চিতোর অভিযানের সময়
পদ্মাবতী বলে তো কোনো রাজপুত রানি ছিলেন না। মেবার রাজ্যের দরবারি
ইতিহাসবিদ শ্যামল দাস একবার পদ্মাবতীর কথা এনেছিলেন, তবে সেটা সম্পূর্ণ
ভিন্ন প্রসঙ্গে। আলাউদ্দিন খিলজির সঙ্গে পদ্মাবতীর কোনো দিন দেখাই হয়নি।
এমনকি কবির লেখা কাহিনির বাইরে গিয়ে খিলজির হাত থেকে বাঁচতে পদ্মাবতীকে
স্বামীর চিতায়ও তুলেছেন বলিউডি পরিচালক সঞ্জয় লীলা বানসালী। মূল কাহিনিতে
পদ্মাবতী খিলজির ভয়ে নয়, প্রথা অনুযায়ী স্বামীর চিতায় সতীদাহ হন। রাজপুত
রাজারাও বীর কিছু ছিলেন না। আফিমাসক্তি আর সাবেকি রণকৌশলের কারণে তাঁরা
মাহমুদ গজনি, ঘুরি, খিলজি, মারাঠা, আকবর সবার কাছেই যুদ্ধে হেরেছেন। রানা
প্রতাপ কিংবা শিবাজির বীরত্বেরও তেমন উদাহরণ নেই। সে সময়ের যুদ্ধ ও শাসনকেও
সাম্প্রদায়িকভাবে দেখার সুযোগ কম। রাজপুতপক্ষে মুসলিম সেনাপতি এবং খিলজির
পক্ষে রাজপুত সেনাপতিরাও লড়েছেন। আকবরের সেনাপতি মানসিংহ রাজপুত ছিলেন।
আবার মুসলিম শাসকেরা নিজেদের মধ্যেও যুদ্ধ কম করেননি। সম্রাট আকবর রাজপুত
নেতা ও অভিজাতদের বিভিন্ন অঞ্চলের মনসবদার ও জায়গিরদার বানান। সুতরাং খিলজি
বা মোগল বংশের শাসন রাজপুত তথা দেশীয় হিন্দু রাজরাজড়াদেরও শাসন। তাই
সেকালের সাম্রাজ্যের যুদ্ধকে ধর্মীয় বা দেশপ্রেমিক দাবি করা কাল্পনিক গরুড়
পাখিকে প্রাচীনকালের বিমান বলে দাবি করার মতোই হাস্যকর। মোগলেরা
সাম্প্রদায়িক হলে রাজপুতরা মোগল শাসনের প্রধান সহযোগী হলেন
কীভাবে?বিজেপি-শাসিত ভারতে ইতিহাসের সত্যের চেয়ে বড় করা হচ্ছে কল্পনার
সত্যকে। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে লাগবে জনগণকে সাম্প্রদায়িকতায় মাতানোর মসলা।
বাহুবলীর পর পদ্মাবত তারই এক চমৎকার জোগান। তার জন্য দক্ষ শাসক ও সেনানায়ক
আলাউদ্দিন খিলজিকে পাশবিক ও নারীলোলুপ করে দেখাতে হয়েছে। এমনকি আজকের
পাকিস্তানের পতাকার সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর পতাকাকে চাঁদ আঁকা সবুজ করা হয়েছে।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব আমাদের জানাচ্ছেন, খিলজির বাহিনী এ ধরনের
পতাকা ব্যবহার করত না। বিজেপির জাতীয়তাবাদ একটা মানসিক বিকার বা ট্রমায়
ভুগছে যে কী করে ভারতবর্ষ ‘বিদেশি’ মুসলমানদের দ্বারা অধিকৃত হলো? এই
ইতিহাস যেহেতু মোছা যাবে না, সেহেতু তাদের প্রচারকেরা মুসলিম শাসকদের
ভাবমূর্তি নষ্টের কৌশল নিয়েছেন। অথচ ভারতবর্ষে দেশপ্রেমের ধারণা আনেন
মুসলমান কবি ও শাসকেরা। গৌতম বুদ্ধের সময় ভারত বলে রাজনৈতিকভাবে অখণ্ড কোনো
সাম্রাজ্য ছিল না। সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে বর্ণিত জম্বুদ্বীপ ছিল অনেক
ছোট এলাকা নিয়ে গঠিত। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে কলিঙ্গ রাজা ‘ভারত’ নামের
আওয়াজ দেন, সেটাও ছিল সীমিত এলাকা নিয়ে। ‘হিন্দুস্তান’-বন্দনা প্রথম করেন
ফারসি কবি আমির খসরু তাঁর নুহ সিফির কাব্যে (১৩১৮ সালে প্রকাশিত)। সেখানে
তিনি বলেন, হিন্দ তাঁর ‘জন্মভূমি, বাসভূমি ও দেশ’।
তিনি বলেন, ‘দেশপ্রেম
ইমানের অঙ্গ’। ভারতবর্ষের ‘হিন্দ’ ও ‘হিন্দুস্তান’ নামকরণও আরব-পারস্যেরই
দেওয়া। ১৩৫০ সালে কবি ইসামি ভারতবন্দনা কাব্যে ভারতবর্ষকে স্বর্গের বাগানের
চেয়েও সুন্দর বলেন। সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) মন্ত্রী আবুল ফজলও
হিন্দুস্তানের প্রতি ভালোবাসা জানান তাঁর আইন-ই-আকবরিতে। আকবরের সময়ই
রাজবংশের ইতিহাসের বাইরে গিয়ে ছয়টি রাজ্যের ভূমি ও মানুষনির্ভর ইতিহাস রচিত
হয়। আবুল ফজল বৃহৎ ভারতের ধারণা আনেন। ১০৩৫ সালে লেখা বিজ্ঞানী ও দার্শনিক
আলবেরুনির কিতাব আল হিন্দ ভারতপ্রেমে ভরপুর। সম্রাট আকবর কৃষির বিকাশ
ঘটান, সতীদাহ ও বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করেন এবং মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে
কন্যাসন্তানের বঞ্চনার বিপক্ষে দাঁড়ান। আকবরনামা সাক্ষ্য দেয়, আকবর ভারত ও
এর মানুষকে কতটা ভালোবাসতেন।আকবরের সময়ের ভারতের তুলনা হতে পারে ইউরোপীয়
রেনেসাঁর সঙ্গে। তাঁর সময় প্রাচীন ভারতের শিল্প-সংগীত-দর্শনের হারিয়ে যাওয়া
ঠেকানো হয়। পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সংস্কৃত ভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো
হয়, অনুবাদ করা হয় শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলো। মানবতাবাদ, শিল্প ও আইনের বিকাশ
ঘটে। আকবর বিশ্বাসের জায়গায় যুক্তির শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করেন। ‘সুলহ-ই-কুল’ বা
পরম শান্তি নামে সহনশীলতার রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণ করা হয়। একজন ডাকহরকরার
বদলির সিদ্ধান্ত ওই সামান্য কর্মচারীর স্ত্রীর আপত্তিতে স্থগিত করার ঘটনা
নারীদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার প্রমাণ। তাঁর সময়ে এসব গুণ বিশ্বেই ছিল বিরল।
দেশপ্রেম ছিল তাঁর দরবারের ঘোষিত নির্দেশনা। আকবরের দেশের ধারণা ছিল মানুষ ও
ভূমিকেন্দ্রিক। কিন্তু ইংরেজ আমলে ব্রিটিশমাতা ব্রিটানিয়ার আদলে গড়ে ওঠে
ভারতমাতার ধারণা। যা হোক, বহিরাগত আগ্রাসী আলেক্সান্ডার হন ‘দ্য গ্রেট’ আর
ভারতে বসতি করে ভারতবর্ষের উন্নতিতে অবদান রাখা সুলতান ও সম্রাটেরা হলেন
ভিলেন। মোগল ভারত পৃথিবীর অন্যতম সেরা ধনী দেশ ছিল। এ ইতিহাস অস্বীকার করে
রূপকথা লেখার ফল ভারতের জন্যই আত্মঘাতী হতে পারে। খিলজি থেকে আকবর যা
করেছেন, তা ‘আনডু’ করার অর্থ হলো প্রগতিকে অস্বীকার করা। ইতিহাসকে আসামি
বানালে বর্তমানই মিথ্যা ও হিংসায় বন্দী হয়ে পড়বে।
ফারুক ওয়াসিফ : প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
faruk.wasif@prothom-alo.info
ফারুক ওয়াসিফ : প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
faruk.wasif@prothom-alo.info
No comments