ভালো থেকো মারমা মেয়ে by সঞ্জীব দ্রং
হলিউড
ছায়াছবি হোয়াট ড্রিমস্ মে কাম নিশ্চয় খুব কম পাহাড়ি মানুষ দেখেছেন। দেখলেও
ওই ছায়াছবির বিখ্যাত ডায়ালগ ‘সামটাইমস্ হোয়েন ইউ উইন, ইউ লুজ’ মনে থাকার
কথা নয়। মানুষ সাধারণভাবে হারতে চায় না। সবাই সব সময় জয়ী হতে চায়। কিন্তু
মানুষ ভুলে যায় যে কখনো কখনো সে জয়ী হলেও প্রকৃত অর্থে হেরে যায়। আমরা যখন
মানুষকে দুঃখ দিই, ক্ষমতার দম্ভে অন্য মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি, অপমান
করি, তখন আড়ালে মানবতা কাঁদে। তখন মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি,
সম্মান, স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা, সৌজন্য-শ্রদ্ধাবোধ, মায়া-মমতা নীরবে অশ্রু
ফেলে। তখন মনুষ্যত্বের পরাজয় ঘটে। আজ যারা ক্ষমতার দম্ভে দিশেহারা, তাদের
অবশ্যই এই সংলাপ মনে রাখা দরকার: হোয়েন ইউ উইন, ইউ লুজ। বিলাইছড়ির ফারুয়া
অঞ্চলের নির্যাতিত দুই মারমা কিশোরীর প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তাতে
রাষ্ট্রের নির্দয়তা ও দম্ভই প্রকাশিত হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশে যখন
অন্যায়ের বিচার চাইতে গিয়ে চাকমা সার্কেলের রানিসহ পাহাড়ি নারীদের লাঞ্ছিত
হতে হয়, তাঁদের অপমান-অপদস্থ করা হয় এবং তারপরও রাষ্ট্রযন্ত্র নীরব থাকে,
তখন সাধারণ পাহাড়ি মানুষের অসহায়ত্ব আমরা সহজে অনুমান করতে পারি। তখন মনে
হয় এই ভূমি থাকে, দেশ থাকে; কিন্তু গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার
ভূলুণ্ঠিত হয়। গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের হত্যাসহ ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের
বিচার হয়নি। লংগদুর পাহাড়ি মানুষের জীবনে হাহাকার থামেনি। এই ধারা চলতে
থাকলে রাষ্ট্রের কাছে বিচারের আশা ছেড়ে দিয়ে শুধু বিনীতভাবে এই প্রার্থনাই
নিবেদন করতে পারি, মারমা দুই বোন অন্তত যেন ভালো থাকে, নিরাপদে থাকে।
দুই. আমি একবার বিলাইছড়ি গিয়েছিলাম। সম্ভবত ১২ বা ১৩ বছর আগে। তখন এই মারমা বোন দুটির বয়স হয়তো তিন বা পাঁচ বছর। আমার সঙ্গে আমেরিকান এক বন্ধু ছিলেন। বিলাইছড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে, পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে কথা বলে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তখন অবশ্য আশা ছিল পাহাড়দেশে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত হবে, পাহাড়ি মানুষের জীবনে সুখ, শান্তি আর আনন্দ ফিরে আসবে। সাধারণ বাঙালিদের জীবনেও সমৃদ্ধি আসবে। চুক্তির ২০ বছর পরও পাহাড়ে হাহাকার থামেনি। আমার সেই বন্ধুকে এখন আমি কী করে এই বীভত্স গল্প বলি, যেখানে পাহাড়ি দুই বোনকে লাঞ্ছিত হওয়ার পরও বিচারের কোনো আশা দেখি না! ঘটনাটি আমরা এখন সবাই জানি, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে। আমরা গভীর দুঃখ ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, মূলধারার গণমাধ্যম, প্রিন্ট ও টেলিভিশন এই মারমা মেয়েদের নির্যাতনের ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই মূল ভরসা। সাঁওতালদের ওপর যখন বর্বরোচিত হামলা হয় এবং পুলিশ নিজেই আগুন ধরিয়ে দেয় সাঁওতালদের বাড়িঘরে, সেই ভিডিও বিদেশি চ্যানেল প্রচার করার পর আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করে। এই-ই হলো মিডিয়ার অবস্থা এখন। আমরা এক কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আর দেখছি, দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন ও অত্যাচার বাড়ছে, কিন্তু বিচারের আশা দুরাশা। আমরা ৩০ টির বেশি মানবাধিকার সংগঠন মারমা দুই বোনের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদ জানিয়ে সমাবেশ করেছিলাম। সমাবেশ চলাকালীন আরও ১০ টির বেশি সংগঠন সংহতি জানিয়েছিল। আমরা তখন বলেছিলাম, আমাদের বিভিন্ন বাহিনীর নানা কাজের সুনাম রয়েছে দেশে ও বিদেশে। শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবতার কাজে এসব বাহিনীর সদস্যরা প্রশংসনীয় অবদান রাখছেন। কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের দায় প্রতিষ্ঠান নিতে পারে না। আমরা চাই ঘটনার যথাযথ তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক।
তিন. মারমা মেয়ে দুটির ভবিষ্যৎ জীবন যেন কোনোভাবেই ছারখার না হয়। তাদের মনোবল জাগিয়ে তুলতে হবে। তাদের পাশে পার্বত্য নারীসমাজসহ সবাইকে দাঁড়াতে হবে। সরকারকে এই পরিবারের নিরাপত্তাসহ সব প্রয়োজনে এগিয়ে আসতে হবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তদন্ত করবে বলে জেনেছি। তদন্ত রিপোর্ট অনেক সময় জানা যায় না। এই ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে এবং এর সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নে তদারক করতে হবে। এই মারমা পরিবার কি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে? জুমচাষ করে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারবে? মেয়ে দুটির পড়াশোনা বা পুনর্বাসনের কী হবে? চাকমা রানির সঙ্গে যে অশোভন ও নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে, তার বিচারের জন্য সরকার নিজে কি এগিয়ে আসবে? সত্যি বলতে কি, আমি বিদ্যমান বাস্তবতায় কোনো আশা দেখি না। প্রেরণার কথা হলো রানি নিজে শক্ত আছেন এবং বলেছেন তিনি হাল ছাড়বেন না। মনে রাখা দরকার, যারা তাঁকে অপমান করেছে, পরাজিত হয়েছে তারাই। মানুষের ধিক্কার ও ঘৃণা বেড়েছে তাদের প্রতি। আর রানির প্রতি বেড়েছে মানুষের ভালোবাসা। বিরসা মুন্ডাকে নিয়ে আজও মানুষ গান গায়, কবিতা লেখে। নিপীড়ক শাসককে নিয়ে কোনো দিন কোনো গান ও কবিতা রচিত হবে না। তাই এই ক্রান্তিকালেও মানুষের শক্তির কাছে আস্থা রাখি। অশুভ শক্তি চায় আমরা যেন হাল ছেড়ে দিই। কিন্তু ওরা জানে না, পাহাড়ে বারবার বসন্ত আসে, বনে ফুল ফোটে, পাখি গান গায়, ছমছম রাতের আঁধার চিরে দিনের আলো দেখা যায়। আপনি নদীতে ঢেউ দেখতে চান, নদীর ঢেউ হয়তো মিলিয়ে যায়। কিন্তু একসময় নদীতে আবার জোরে বাতাস বইবে, ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভরে উঠবে নদী। রাষ্ট্র যদি মানুষের পাশে না দাঁড়ায়, মানুষ দাঁড়াবে মানুষের পাশে। এই আশায় প্রিয় মারমা দুই বোন আমার, পাহাড়দেশে ভালো থেকো, নিরাপদে থেকো। মনে রেখো, কিছু মানুষ নির্দয় হলেও সবাই নয়। এই পাহাড়, এই জন্মভূমিতে তোমাদের আছে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার।
সঞ্জীব দ্রং: সংস্কৃতিকর্মী ও কলাম লেখক
sanjeebdrong@gmail.com
দুই. আমি একবার বিলাইছড়ি গিয়েছিলাম। সম্ভবত ১২ বা ১৩ বছর আগে। তখন এই মারমা বোন দুটির বয়স হয়তো তিন বা পাঁচ বছর। আমার সঙ্গে আমেরিকান এক বন্ধু ছিলেন। বিলাইছড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে, পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে কথা বলে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তখন অবশ্য আশা ছিল পাহাড়দেশে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত হবে, পাহাড়ি মানুষের জীবনে সুখ, শান্তি আর আনন্দ ফিরে আসবে। সাধারণ বাঙালিদের জীবনেও সমৃদ্ধি আসবে। চুক্তির ২০ বছর পরও পাহাড়ে হাহাকার থামেনি। আমার সেই বন্ধুকে এখন আমি কী করে এই বীভত্স গল্প বলি, যেখানে পাহাড়ি দুই বোনকে লাঞ্ছিত হওয়ার পরও বিচারের কোনো আশা দেখি না! ঘটনাটি আমরা এখন সবাই জানি, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে। আমরা গভীর দুঃখ ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, মূলধারার গণমাধ্যম, প্রিন্ট ও টেলিভিশন এই মারমা মেয়েদের নির্যাতনের ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই মূল ভরসা। সাঁওতালদের ওপর যখন বর্বরোচিত হামলা হয় এবং পুলিশ নিজেই আগুন ধরিয়ে দেয় সাঁওতালদের বাড়িঘরে, সেই ভিডিও বিদেশি চ্যানেল প্রচার করার পর আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করে। এই-ই হলো মিডিয়ার অবস্থা এখন। আমরা এক কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আর দেখছি, দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন ও অত্যাচার বাড়ছে, কিন্তু বিচারের আশা দুরাশা। আমরা ৩০ টির বেশি মানবাধিকার সংগঠন মারমা দুই বোনের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদ জানিয়ে সমাবেশ করেছিলাম। সমাবেশ চলাকালীন আরও ১০ টির বেশি সংগঠন সংহতি জানিয়েছিল। আমরা তখন বলেছিলাম, আমাদের বিভিন্ন বাহিনীর নানা কাজের সুনাম রয়েছে দেশে ও বিদেশে। শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবতার কাজে এসব বাহিনীর সদস্যরা প্রশংসনীয় অবদান রাখছেন। কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের দায় প্রতিষ্ঠান নিতে পারে না। আমরা চাই ঘটনার যথাযথ তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক।
তিন. মারমা মেয়ে দুটির ভবিষ্যৎ জীবন যেন কোনোভাবেই ছারখার না হয়। তাদের মনোবল জাগিয়ে তুলতে হবে। তাদের পাশে পার্বত্য নারীসমাজসহ সবাইকে দাঁড়াতে হবে। সরকারকে এই পরিবারের নিরাপত্তাসহ সব প্রয়োজনে এগিয়ে আসতে হবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তদন্ত করবে বলে জেনেছি। তদন্ত রিপোর্ট অনেক সময় জানা যায় না। এই ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে এবং এর সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নে তদারক করতে হবে। এই মারমা পরিবার কি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে? জুমচাষ করে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারবে? মেয়ে দুটির পড়াশোনা বা পুনর্বাসনের কী হবে? চাকমা রানির সঙ্গে যে অশোভন ও নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে, তার বিচারের জন্য সরকার নিজে কি এগিয়ে আসবে? সত্যি বলতে কি, আমি বিদ্যমান বাস্তবতায় কোনো আশা দেখি না। প্রেরণার কথা হলো রানি নিজে শক্ত আছেন এবং বলেছেন তিনি হাল ছাড়বেন না। মনে রাখা দরকার, যারা তাঁকে অপমান করেছে, পরাজিত হয়েছে তারাই। মানুষের ধিক্কার ও ঘৃণা বেড়েছে তাদের প্রতি। আর রানির প্রতি বেড়েছে মানুষের ভালোবাসা। বিরসা মুন্ডাকে নিয়ে আজও মানুষ গান গায়, কবিতা লেখে। নিপীড়ক শাসককে নিয়ে কোনো দিন কোনো গান ও কবিতা রচিত হবে না। তাই এই ক্রান্তিকালেও মানুষের শক্তির কাছে আস্থা রাখি। অশুভ শক্তি চায় আমরা যেন হাল ছেড়ে দিই। কিন্তু ওরা জানে না, পাহাড়ে বারবার বসন্ত আসে, বনে ফুল ফোটে, পাখি গান গায়, ছমছম রাতের আঁধার চিরে দিনের আলো দেখা যায়। আপনি নদীতে ঢেউ দেখতে চান, নদীর ঢেউ হয়তো মিলিয়ে যায়। কিন্তু একসময় নদীতে আবার জোরে বাতাস বইবে, ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভরে উঠবে নদী। রাষ্ট্র যদি মানুষের পাশে না দাঁড়ায়, মানুষ দাঁড়াবে মানুষের পাশে। এই আশায় প্রিয় মারমা দুই বোন আমার, পাহাড়দেশে ভালো থেকো, নিরাপদে থেকো। মনে রেখো, কিছু মানুষ নির্দয় হলেও সবাই নয়। এই পাহাড়, এই জন্মভূমিতে তোমাদের আছে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার।
সঞ্জীব দ্রং: সংস্কৃতিকর্মী ও কলাম লেখক
sanjeebdrong@gmail.com
No comments