তুমব্রু সীমান্তে উত্তেজনা : আতঙ্কে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীরা
সীমান্তের
ওপারে মিয়ানমারের সেনা সমাবেশকে কেন্দ্র করে শূন্যরেখায় অবস্থানরত
রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। দুই দিন ধরে
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বান্দরবানের নাইক্ষংছড়ির তুমব্রু এলাকায়
কাঁটাতারের বেড়া বরাবর মিয়ানমারের সাজোয়া যান চলাচল এবং অতিরিক্ত সেনা
মোতায়েন করেছে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের বিজিপি বাঙ্কার নির্মাণ করেছে।
রাতে তারা শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে গুলিও ছোড়ে। এ নিয়ে
সীমান্ত এলাকায় নতুন করে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বান্দরবানের
নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে অবস্থানরত প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে
শূন্যরেখা ছাড়তে কয়েক দিন ধরে মিয়ানমার বাহিনী থেকে মাইকিং করছে। রোহিঙ্গা
এবং বার্মিজ ভাষায় শূন্যরেখা ছেড়ে যেতে নানাভাবে হুমকিও দিচ্ছে তারা। এতেও
রোহিঙ্গারা অনড় থাকলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সীমান্তের ওপারে অতিরিক্ত বিজিপি
এবং সেনা সমাবেশ শুরু করে। দুই দিন ধরে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া লাগোয়া
সড়ক দিয়ে সৈন্য বোঝাই সাজোয়া যান এবং সামরিক মহড়া দিতে থাকে। সীমান্তের
একেবারে কাছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বিভিন্ন স্থাপনাও করছে বলে জানান
রোহিঙ্গারা। সীমান্তে মিয়ানমারের এ রকম অস্বাভাবিক সামরিক উপস্থিতির
প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু মিয়ানমারের সেনারা গতকাল
বৃহস্পতিবার রাতে শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ
করে। এমনকি মিয়ানমারের বিজিপির পোশাকে তাদের সেনাবাহিনীর সদস্যরা
শূন্যরেখায় এসে রোহিঙ্গাদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। এদিকে সীমান্তে মিয়ানমার
সেনাবাহিনীর বেপরোয়া মহড়ায় বাংলাদেশীদের মধ্যেও ভীতিজনক অবস্থা বিরাজ করছে।
বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) এ ঘটনার জন্য পতাকা বৈঠকের আহ্বান
জানায় মিয়ানমারে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের
ঘুমধুম সীমান্তে বিকেল ৩টায় পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে গুলির ঘটনা
অস্বীকার করার পাশপাশি অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশের ঘটনাকে নিয়মিত টহলের অংশ
হিসেবে দাবি করেছে মিয়ানমার। তবে শূন্যরেখায় অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের আবারো
তাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। পতাকা বৈঠক শেষে
সংবাদমাধ্যমকে এ কথা জানিয়েছেন বৈঠকে অংশ নেয়া বাংলাদেশে প্রতিনিধিদলের
প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান। শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৩টায়
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের শূন্যরেখার মৈত্রী সেতুসংলগ্ন পয়েন্টে
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বৈঠকটি শুরু হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের পাঁচ সদস্যের
প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বিজিবির ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট
কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান। অপর দিকে মিয়ানমারের পাঁচ সদস্যের
প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের ১নং
ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক অং সু। শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৩টায় শুরু হওয়া বৈঠক চলে
বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে ঘুমধুম বিজিপি ক্যাম্পে
সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলেন, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধান লেফটেন্যান্ট
কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান। তিনি বলেন, আমরা মিয়ানমারের কাছে সীমান্তে
সৈন্য সমাবেশ, গুলি বর্ষণের ঘটনার ব্যাখা দাবি করি। এ সময় তারা গুলিবর্ষণের
ঘটনা অস্বীকার করে। আর সৈন্য সমাবেশের বিষয়টি নিয়মিত টহল আর রুটিন কাজ বলে
জানান। সেই সাথে ঘুমধুম সীমান্তের শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে
নেয়ার আশ্বাসও দেন। এ ছাড়া বৈঠকে দুই দেশের সীমান্তে বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থা
বজায় রাখাসহ সীমান্ত চোরাচালান বন্ধের বিষয়ে আলোচনা হয় বলে লেফটেন্যান্ট
কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান জানান।
এ ছাড়া সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক
রাখতে বৈঠকে আলোচনা করা হয় বলেও জানান তিনি। তারপরও সীমান্তে যেকোনো ধরনের
পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিজিবি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানান লে. কর্নেল
মঞ্জুরুল। পতাকা বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট
মঞ্জুরুল হাসান খান ও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন দেশটির সীমান্ত
পুলিশের লেফটেন্যান্ট সোয়োজাই লিউ। উল্লেখ্য, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির
ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী পুলিশ বিজিপির
টহল জোরদার, সৈন্য সমাবেশ, গুলিবর্ষণ ও শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গাদের
বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আজ এ বিজিবি-বিজিপি পতাকা বৈঠক
অনুষ্ঠিত হলো। ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় প্রায় সাড়ে পাঁচ
হাজার রোহিঙ্গা তাঁবু টাঙিয়ে বাস করছে। বান্দরবান সংবাদদাতা জানান,
সীমান্তে জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গা মুসলিমদের লক্ষ্য করে
গুলিবর্ষণের কথা অস্বীকার করেছে মিয়ানমার। একই সাথে তারা জানিয়েছে, সীমান্ত
ঘেঁষে সৈন্যসমাবেশ তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
আজ শুক্রবার সকাল থেকে মিয়ানমার বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির
তুমব্রু সীমান্তের জিরো পয়েন্ট ঘেঁষে সৈন্যসমাবেশ করে। একপর্যায়ে তারা
রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মিয়ানমারের
সৈন্যসমাবেশের পাল্টা হিসেবে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিও সতর্ক
অবস্থান নেয়। উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে শুক্রবার বিকেলে ঘুমধুম সীমান্তের
জিরো পয়েন্টে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী
বাহিনী বিজিপির মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে বিজিপির ব্যাটালিয়ন
অধিনায়ক লে. কর্নেল সোজা লিং বিজিবিকে বলেন, সীমান্তে গুলিবর্ষণের কোনো
ঘটনা ঘটেনি। তবে কাঁটাতারের বেষ্টনী ঘেঁষে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয়। এ নিয়ে বাংলাদেশের হুমকি কিংবা
আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বৈঠকে সাত সদস্যের বিজিবি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব
দেন ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান। আর মিয়ানমারের
বিজিপির নেতৃত্ব দেন ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল সোজা লিং। বৈঠকে
বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সৈন্য বৃদ্ধি ও ফাঁকা গুলিবর্ষণ করলে
সীমান্তের পরিবেশ অশান্ত হয়। এ জন্য ভবিষ্যতে সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক
রাখতে এ ধরনের কিছু করার আগে তারা (মিয়ানমার) যেন বিজিবিকে অবহিত করে।
বিষয়টিতে সম্মতি দিয়ে এ সময় সহযোগিতা চান বিজিপির ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে.
কর্নেল সোজা লিং। তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলকে বলেন, রোহিঙ্গা
প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি বিজিবিও যেন তাদের সব ধরনের
সহযোগিতা করে। পতাকা বৈঠক শেষে ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল
হাসান খান সাংবাকিদের জানান, অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মিয়ানমার আমাদের যতই
আশ্বস্ত করার চেষ্টা করুক, আমরা সতর্ক রয়েছি। সীমান্তে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি
করে পরিস্থিতির ভারসাম্য রক্ষায় সচেষ্ট থাকব। তিনি বলেন, নো ম্যান্স
ল্যান্ডে আপাতত কোনো আতঙ্ক নেই। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে দুই দেশের
উচ্চপর্যায়ের আলোচনা হচ্ছে। আশা করি, শিগগিরই তারা নিজ দেশে ফেরত যেতে
পারবে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু
সীমান্তের জিরো পয়েন্টে ঢুকে হামলা ও ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে মিয়ানমারের
সেনাবাহিনী। পরে রোহিঙ্গারা জবাব দিলে পিছু হটে সেনা সদস্যরা। তবে এতে
হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
No comments