ব্যাংক ডুবিয়ে জাহাজ ভাসালেন তিনি
রাষ্ট্র
খাতের বেসিক ব্যাংক ডুবিয়ে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু সাগরে ভাসিয়েছেন মাছ ধরার
আটটি জাহাজ। বাচ্চুর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ইডেন ফিশারিজের নামে ছয়টি এবং
তাঁর ভাই শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্নার প্রতিষ্ঠান ক্রাউন ফিশারিজের নামে কেনা
হয়েছে দুটি জাহাজ। এসব জাহাজের বাজারদর প্রায় ১০০ কোটি টাকা। ২০০৯ সালের
সেপ্টেম্বরে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন তিনি। আর জাহাজ কোম্পানি খোলেন
পরের বছরের ডিসেম্বরে। সাগরে চলাচল করা মাছ ধরার নৌযান তদারকির দায়িত্ব
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন নৌবাণিজ্য বিভাগের। এই বিভাগের একজন কর্মকর্তা
জানান, ইডেন ফিশারিজ লিমিটেডের মালিকাধীন ছয়টি জাহাজ হচ্ছে এফভি
ক্রিস্টাল-১, এফভি ক্রিস্টাল-২, এফভি কর্ণতরী, এফভি ইডেন-১, এফভি ইডেন-২,
এফভি সিলভার সি-০১।
ক্রাউন ফিশারিজের মালিকানাধীন জাহাজ দুটি হচ্ছে এফভি
স্পিড-১ ও এফভি স্পিড-২। সাগরে মাছ ধরার জাহাজকে ফিশিং ভ্যাসেল বা এফভি বলা
হয়। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাতীয় পার্টির সাংসদ (সংরক্ষিত
মহিলা আসন) মাহজাবীন মোরশেদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের ছিল এফভি ক্রিস্টাল-১
ও এফভি ক্রিস্টাল-২ নামের দুটি জাহাজ। ২০১২ সালের ৫ জুন ইডেন ফিশারিজের
নামে দুটি জাহাজের মালিকানা স্থানান্তর করা হয়। সাংসদ মাহজাবীন এবং তাঁর
স্বামী চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমের কাছে
বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকের
আগ্রাবাদ শাখা থেকে ২৭৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের কারণে স্বামী-স্ত্রীসহ
পাঁচজনের বিরুদ্ধে গত ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামে দুটি মামলা করে দুর্নীতি দমন
কমিশন (দুদক)। অন্য তিন আসামিদের মধ্যে আছেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক দুই
ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলাম, এবং সাংসদ মাহজাবীনের
ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের আইজি নেভিগেশন লিমিটেডের পরিচালক সৈয়দ মোজাফফর
হোসেন। তবে এই মামলায় বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান বাচ্চুকে আসামি করা
হয়নি। এ ছাড়া দিলকুশা শাখা থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়ার কারণে গত ১৭ জানুয়ারি
আরও একটি মামলা হয়। এ মামলায় আগের আসামিদের সঙ্গে মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমের
ছোট ভাই ফয়সল মুরাদ মোরশেদকেও আসামি করা হয়। এই মামলায়ও ছাড় দেওয়া হয়
বাচ্চুকে। দুটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ
সিরাজুল হক। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে স্পষ্ট করে তিনি কিছু বলতে চাননি।
তাঁর মন্তব্য, তদন্ত চলছে। এর বেশি কিছু বলার নেই। বাচ্চুর কাছে জাহাজ
বিক্রি করার বিষয়ে মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম এবং তাঁর স্ত্রী সাংসদ মাহজাবীনের
বক্তব্য জানতে এক সপ্তাহ ধরে মুঠোফোনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়।
কিন্তু তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। দুজনের মুঠোফোনও বন্ধ রয়েছে। বাচ্চুর
মালিকানাধীন ইডেন ফিশারিজের স্থানীয় কার্যালয় প্রথমে ছিল চট্টগ্রাম নগরের
সদরঘাট এলাকার ৩৩১, স্ট্র্যান্ড রোডের মনোয়ার টাওয়ারের তৃতীয় তলায়। বছর
দুয়েক আগে কার্যালয়টি আগ্রাবাদের আখতারুজ্জামান সেন্টারের অষ্টম তলায়
স্থানান্তর করা হয়। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সেখানে গিয়ে কার্যালয়টি বন্ধ পাওয়া
যায়।
বাণিজ্যিক এই ভবনের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত এক কর্মী প্রথম আলোকে
জানান, ইডেন ফিশারিজের কার্যালয়টি বেশ কয়েক মাস ধরে বন্ধ রেখেছে এর
মালিকপক্ষ। তবে কার্যালয়ের ভাড়া পরিশোধ করা হয় নিয়মিত। মুঠোফোনে যোগাযোগ
করা হলে ইডেন ফিশারিজের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের এক্সিকিউটিভ (অপারেশন) সালাহ
উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, পরিচালনাসংক্রান্ত ঝামেলার কারণে ইডেন ফিশারিজের
জাহাজগুলো দিয়ে সাগরে আপাতত মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে পান্না সাহেবের
জাহাজ দিয়ে মাছ ধরা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, তাঁদের কোম্পানির (ইডেন) জাহাজ
ছয়টি নয়, সাতটি। আবদুল হাই বাচ্চু, তাঁর স্ত্রী শেখ শিরিন আখতার, পুত্র শেখ
সাবিদ হাই অনিক ও মেয়ে শেখ রাফা হাই-এর নামে ইডেন ফিশারিজ লিমিটেড খোলা
হয়। এ প্রতিষ্ঠানের নামে একটি ব্যাংকে খোলা হিসাবে মাত্র ১১ মাসেই জমা হয়
১৩ কোটি টাকা। এই তথ্য ব্যাংক সূত্র থেকে পাওয়া। চট্টগ্রাম সামুদ্রিক মৎস্য
অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গভীর সাগরে মাছ ধরার জাহাজ ইস্পাতের কাঠামো (স্টিল
বডি) দিয়ে তৈরি হয়। বাংলাদেশে এ ধরনের জাহাজ রয়েছে ১১৬টি। গভীর সাগরে এসব
জাহাজ একটানা সর্বোচ্চ ২৮ দিন অবস্থান করে মাছ নিয়ে ফিরে আসে। বাচ্চু ও
তাঁর ভাই পান্নার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের জাহাজগুলো ইস্পাতের তৈরি।
প্রতিটি জাহাজের বর্তমান বাজারদর ১০-২৫ কোটি টাকা। গভীর সাগর থেকে ধরে আনা
মাছের পাইকারি ক্রেতাদের সংগঠন কর্ণফুলী ফিশ মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের
সভাপতি আবু ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, আবদুল হাই বাচ্চু ও তাঁর ভাই পান্না
পাঁচ-ছয় বছর আগে জাহাজ কিনে সমুদ্রে মাছ ধরছেন। তাঁদের সংগঠনের মাধ্যমেই ওই
জাহাজগুলোর মাছ বাজারজাত করা হয়। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৪
জুলাই পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন বাচ্চু। তাঁর সময়ে কোনো
নিয়মনীতি ও বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা
লুটপাট হয় ব্যাংক থেকে। এর আগ পর্যন্ত রাষ্ট্র খাতের সবচেয়ে ভালো ব্যাংক
হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই ব্যাংকটির এখন ডুবন্ত অবস্থা। বেসিক ব্যাংকে ঋণ
কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদকের করা ১৮ মামলার কোনোটিতেই বাচ্চুকে আসামি করা
হয়নি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও ব্যাংকটিতে ‘হরিলুটের’ পেছনে
আবদুল হাই জড়িত বলে একাধিকবার উল্লেখ করেন। উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগের কারণে
তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
No comments