রোহিঙ্গা শিশুদের জীবন ব্যর্থ করে দিতে পারি না আমরা by মার্ক পিয়েরসে, অরলা মারফি ও ফ্রেড রিটেভেন
প্রায়ই
রাতে জেগে ওঠা, জোরে শ্বাস ফেলা, বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ এবং চৌকির নিচে
দৈত্যের নানা ধরনের শব্দ ও বড় রুমের ভেতরে কোনো অনধিকার প্রবেশকারীÑ নিজের
শিশুকালের এমন স্মৃতি কি আপনি স্মরণ করতে পারেন? তারপর যখন রাত শেষ হয়, তখন
শিশুসুলভ ভয়গুলোও দূর হয়ে যায় এবং রাতের আতঙ্কও ভুলে যাওয়া হয়। হাজার
হাজার শিশু- যারা বর্তমানে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমস্যাসংকুল শরণার্থী
শিবিরগুলোতে বাস করছে, তাদের ভয় সূর্য ওঠার পরও যায় না। তাদের রাতগুলো অনেক
লম্বা এবং প্রতিটি দিন তাদের জন্য নতুন আতঙ্ক নিয়ে আসে। নিজেদের বাড়ির
স্বাচ্ছন্দ্য থেকে এসব শিশুর বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে থাকার ৬ মাস পূরণ হয়েছে
আজ। যে আতঙ্ক তারা দেখে এসেছে, তার এবং ভীতিকর ও অপরিচিত এ স্থানের বিষয়ে
তাদের মাঝে বোধ তৈরির ৬ মাস চলছে। ১২ বছর বয়সী এক শিশুর ভাষ্য- ‘এখানে আমরা
বন্দি জীবন কাটাচ্ছি। এখানে আমাদের খেলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। আমরা
যা করতে চাই তার কিছুই করতে পারি না।’ গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে যেসব
শরণার্থী বাংলাদেশে পৌঁছেছে তাদের ৬০ শতাংশের বয়সই ১৮ বছরের নিচে। এদের
মধ্যে ৩ লাখ ৭৮ হাজার শিশু। এসব শিশুর অনেকে বর্বর সহিংসতা ও হত্যা দেখে
এসেছে। কিছু শিশু দেখে এসেছে, তাদের গোটা গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে
মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। ২ হাজার ৬৮০-এর বেশি শিশু তাদের বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন
হয়ে গেছে।
হয় তারা এতিম হয়ে গেছে নতুবা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার
বিশৃঙ্খলার মাঝে পিতামাতাকে হারিয়ে ফেলেছে। এটি হচ্ছে শিশুদের জন্য
স্বাভাবিক পরিস্থিতির অভাবের সর্বোচ্চ সংকট। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, সেভ
দ্য চিলড্রেন ও ওয়ার্ল্ড ভিশন রোহিঙ্গা সংকটের ক্ষতির শিকার ২০০ শিশু ও ৪০
জন মায়ের জন্য বড় ধরনের একটি সিরিজ কনসালটেশন আয়োজন করেছে ডিসেম্বর মাসে।
শিশুদের বাল্যকাল তীব্রভাবে ব্যাহত হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। রোহিঙ্গা
শরণার্থী সংকটের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরতে ‘ভয়েসেস’ উদ্বোধন করা হচ্ছে আজ,
যাতে আমরা তাদের ঘটনাগুলো শেয়ার করে পরিবর্তন আনতে পারি। সেখানকার শিশুরা
কী বলতে চায়, তা আমাদের শোনা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারাই ধ্বংসাত্মক এ সংকটে
সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। শিশুরা আমাদের বলেছে, তাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে
গেছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ছিল, রুটিনমাফিক ও নিরাপত্তার সঙ্গে খেলার জন্য মাঠ
ছিল এমন একটি বাসস্থান থেকে বিশৃঙ্খল, জনাকীর্ণ ও ভীতিকর একটি স্থানে চলে
আসতে হয়েছে তাদের। শিশুদের অনেকে তাদের বাড়ি ও মালিকানাধীন জিনিসের জন্য
আকুতি জানিয়েছে, এমনকি নিহত বা নিখোঁজ আত্মীয়দের জন্য কান্নাকাটি করছে।
কিছু শিশু আপনজনদের জন্য রাতভর কান্নাকাটি ও চিৎকার করে দিনের বেলায় শান্ত
হয়। রোহিঙ্গা শিশুসংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভয় মহামারী হয়ে পড়েছে
এবং অনেক শিশু দিনের বেলায়ও উচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকে। বিশেষত, অন্ধকারে
ছিনিয়ে নেয়া শিশুদের ঘটনাবলি শুনে তারা অপহরণনের শিকার হওয়ার ভয়ে আছে।
আন্তর্জাতিক অভিভাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্যানুযায়ী, আমরা এখন পর্যন্ত
ক্যাম্পগুলোতে ৩২টি পাচারের ঘটনার রেকর্ড সম্পর্কে অবগত। তবে রেকর্ড না
হওয়া ঘটনা আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা। ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়,
যেখানেই জরুরি অবস্থার মাঝে শিশুদের আটকে রাখা হয়, সেখানেই ক্ষতিগ্রস্ত ও
ঘটনার শিকারদের ওপর থাবা বসানোর মানুষগুলো আশপাশে থাকে। মেয়েরা আমাদের
বলেছে, যৌন হয়রানি ও নিগৃহীত হওয়ার ভয়ে বাথরুমে যাওয়ার জন্য তাঁবু ছাড়তেও
তারা ভীতসন্তস্ত্র থাকে, বিশেষত রাতের বেলায়। পাশের বনটিও ভীতিকর স্থান
হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
সেখানে রান্নার কাঠ জোগাড় করার জন্য যেতে ভয় পাচ্ছে
তারা। কারণ ‘ফরেস্ট ম্যান’রা তাদের হামলা করতে পারে। ১১ বছর বয়সী একটি
মেয়ে আমাদের বলেছে, ‘আমরা রাতের বেলায় বনে যেতে পারি না, কারণ এটি খুবই
ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে রাতের বেলায় জ্বালানোর লাকড়ি সংগ্রহ করতে গিয়ে একটি
মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে’। এছাড়া প্রায়ই শিশুরা হারিয়ে যাচ্ছে। এমনকি
অভিজ্ঞ সাহায্যকর্মীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে বিপজ্জনক মনে করছেন। তীব্র
আঁকাবাঁকা এবং ত্রিপল ও বাঁশের গোলকধাঁধার মতো ক্যাম্পগুলোতে সামান্য দিক
নির্দেশনামূলক চিহ্ন রয়েছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের জন্যই এটি হতভম্ব ও
বিমূঢ় করে দেয়ার মতো জায়গা, একটি শিশুর জন্য তো অবশ্যই আতঙ্কজনক। শিশুরা
আমাদের বলেছে, তারা সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ অনুভব করে এবং রোগাক্রান্ত
হওয়ার ভয়ে থাকে। তারা ডায়রিয়া, কাশি ও ঠাণ্ডা, শ্বাসজনিত সমস্যা, চক্ষু ও
চর্ম সমস্যার মুখে পড়েছে। ৫ হাজারের বেশি ডিপথেরিয়ার ঘটনা ঘটেছে, যাতে
অন্তত ২৪টি শিশু মারা গেছে। খাবারও একটি নিয়মিত চিন্তার বিষয় সেখানে।
পরিবারগুলোকে প্রতি ১৫ দিনের জন্য ২৫ কেজি চাল দেয়া হয়। অনেক পরিবারকে দেয়া
হয় রেশন। তারা একই ধরনের মসুর ডাল ও ভাত খায় এবং বেড়ে ওঠা ও শক্তির জন্য
প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবের মধ্যে আছে। শিশুরা তাদের বাড়ির মতো সবজি, মাছ ও
মাংস খেতে চায়। পাচার বা শিশুশ্রমের মতো শোষণ এবং নিপীড়ন থেকে বাঁচার
অন্যতম মাধ্যম শিক্ষা নেয়ার সুযোগ খুব কম শিশুরই রয়েছে। তারা আমাদের বলেছে
ভবিষ্যতে তাদের সহায়ক হবে এমন দক্ষতা অর্জন ও শিক্ষার জন্য তারা স্কুলে
যেতে চায়। অথচ একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্যই জায়গাটি কষ্টের, একটি শিশুর জন্য
তো এটি আস্ত এক দুঃস্বপ্ন। এমন একটি ভয়ানক স্থান হওয়ার কারণে সেখানে
স্বাচ্ছন্দ্য আছে সামান্যই।
শিশুরা বলেছে দিনে পাঁচবার নামাজের আজান তাদের
নিরাপত্তা এবং স্থানীয় আশ্রয়দাতা সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযুক্তির অনুভূতি এনে
দেয়। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি তাদের আস্থা এনে দেয়, এমনকি তারা
তখন স্বচ্ছন্দে থাকে। তারা আমাদের বলেছে, সাহায্যকর্মীরা নিরাপদ অনুভব করতে
তাদের সহায়তা করে। সর্বশেষ শুরু হওয়া রোহিঙ্গা সংকট যখন ৬ মাসে প্রবেশ
করছে, তখন শিশুরা নিরাপদ পরিবেশে খেলাধুলা, শিক্ষা ও নিরাপত্তার সঙ্গে
বাঁচার জন্য মুক্ত অনুভব করছে- এটি নিশ্চিত করাই এখন অগ্রাধিকার। যখন
প্রশ্ন করা হয় নিজেদের জীবনমান উন্নত করার জন্য কী প্রয়োজন- শিশুরা তাতে
খুবই স্পষ্ট জবাব দেয়, তারা খেলতে ও শিখতে চায়, নিরাপদ থাকতে চায়,
স্বাস্থ্যকর জীবন ও খাওয়া চায় এবং নিজেদের পরিবারের জন্য আয় করতে চায়। কেউ
কেউ তো রাতে নিরাপদে টয়লেটে যাওয়ার জন্য আরও ভালো আলোর ব্যবস্থার মতো
বাস্তব উন্নয়নও চেয়েছে। কিছু শিশু আরও বড় বাসস্থান চেয়েছে ব্যক্তিগত
গোপনীয়তা আরেকটু বাড়ানোর জন্য। প্রায় সবাই চেয়েছে স্কুলে যেতে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সামনের সপ্তাহ ও মাসগুলোতে এসব শিশুর জন্য আরও বেশি
কিছু করার লক্ষ্যে আমাদের সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। আমরা তাদের ব্যর্থ করে দিতে
পারি না। তাদের কথা আমাদের অবশ্যই শুনতে হবে।
আলজাজিরা থেকে অনুবাদ : সাইফুল ইসলাম
মার্ক পিয়েরসে, অরলা মারফি ও ফ্রেড রিটেভেন : যথাক্রমে সেভ দ্য চিলড্রেন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর ও ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের ন্যাশনাল ডিরেক্টর
মার্ক পিয়েরসে, অরলা মারফি ও ফ্রেড রিটেভেন : যথাক্রমে সেভ দ্য চিলড্রেন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর ও ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের ন্যাশনাল ডিরেক্টর
No comments