পারিবারিক হত্যাকাণ্ড : শেষ কোথায়?

দেশে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পত্র-পত্রিকার পাতা খুললে এখন হরহামেশাই দেখা যায়, সন্তানের হাতে বাবা খুন, বাবা কিংবা মায়ের হাতে সন্তান কিংবা ভাইয়ের হাতে ভাই খুন- এমন সংবাদ। অথচ পরিবার হল মানুষের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এখন পরিবারের মধ্যেও নিরাপত্তা খুঁজে পাওয়া দায় হয়ে পড়েছে। সামাজিক অবক্ষয়ে পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধ হ্রাস পাওয়ায় ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বন্দ্বে^ আপনজনের প্রাণ কেড়ে নেয়ার ঘটনা তাই প্রায়ই ঘটছে। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে সারা দেশে তিন হাজার ৬১টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে রাজধানীতে খুন হয়েছে ১৭২ জন, যার মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক কারণে খুন হয়েছে ১৬২ জন। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, দাম্পত্য কলহ, অর্থলিপ্সা, মাদকাসক্ত ও অবৈধ দৈহিক সম্পর্কের কারণে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা।
স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের হাতে গত পাঁচ বছরে এক হাজার ১৭৫ জন নারী প্রাণ হারিয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আগের মতো বাংলাদেশে যৌথ পরিবার প্রথা নেই। মানুষ ক্রমেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে প্রযুক্তি ও বিত্ত-বৈভব মানুষের আবেগ ও মূল্যবোধে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এখন মানুষ যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এসব কারণে আপন মানুষকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করছে না।
আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, যৌন হয়রানি, নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধের মূল কারণ নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়। বিশেষ করে তরুণ ও যুবসমাজের অবক্ষয় এতটা মারাত্মক রূপ লাভ করেছে, তা কেবল আইন বা শাস্তি দিয়ে দূর করা যাবে না। কারণ এ সমস্যা যতটা না শারীরিক, তার চেয়েও বেশি মনস্তাত্ত্বিক। এ ব্যাধি দূর করতে হলে অবশ্যই আমাদের পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অবাধ আগ্রাসন রোধ করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে আমাদের ঐতিহ্যময় ধর্মীয় অনুশাসন ও পারিবারিক মূল্যবোধ। এক্ষেত্রে সরকারই পারে সবচেয়ে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে। কারণ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধ করা কেবল রাষ্ট্রশক্তির পক্ষেই সম্ভব।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, দ্রুত পরিবর্তনশীল এ সমাজের সঙ্গে মধ্যবিত্ত সমাজ খাপ খাওয়াতে পারছে না। পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে, বিভিন্ন ধারার সংস্কৃতির নেতিবাচক দিকগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাংলার আবহমান সংস্কৃতিতে। অভিভাবকরা সন্তানদের ভাষা বুঝতে পারছেন না, আবার অনেক সময় তারাও সন্তানের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করছেন না। সহনশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন না। ফলে সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। আগে গ্রামে বা শহরে শিশু-কিশোররা কী করছে, সে সম্পর্কে পাড়া-প্রতিবেশীরা খবর রাখতেন। শিশুদের সামাজিকীকরণ হতো খোলা মাঠে। কিন্তু এখন আর সে সুযোগ নেই। শিশুরা বাড়ি থেকে স্কুল, স্কুল থেকে কোচিং সেন্টারে যাচ্ছে। সন্তান কাদের সঙ্গে মিশছে, অভিভাবকরা তা জানতে পারছেন না। এরই ধারাবাহিকতায় পরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। পারিবারিক হত্যাকাণ্ড দেশের আইন-শৃংখলার জন্য যেমন অশনি সংকেত হয়ে দেখা দিচ্ছে, তেমনি অবক্ষয়ের চরম অবস্থারই জানান দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে।
ইফতেখার আহমেদ টিপু
chairman@ifadgroup.com

No comments

Powered by Blogger.