ছাত্রদলে নেতৃত্বের লড়াই by আলফাজ আনাম
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল মাঠে নেমেছে। তবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নয়, নিজেদের বিরুদ্ধে। ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণার পরদিন থেকে পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কয়েক শত ছাত্র-তরুণ বিক্ষোভ করেছেন। অনেক দিন পর ছাত্রদলের এত বড় মিছিল ও উপস্থিতি দেখা গেল। বিক্ষোভকারী নেতাকর্মীদের দাবি, নতুন গঠিত কমিটি ভেঙে দিতে হবে। কারণ, যারা কমিটিতে স্থান পেয়েছেন তাদের অনেকে ত্যাগী নেতা নন। কেউ কেউ নাকি সরকারের এজেন্ট। কেউ আবার ছাত্রলীগ থেকে ছাত্রদলে অনুপ্রবেশ করেছেন। ফলে কমিটি ভেঙে দিয়ে দলের প্রতি আনুগত্য আছে এমন নেতাদের নিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। বাস্তবতা হলো, যারা আজ আন্দোলন করছেন তাদেরকে যদি কমিটিতে রাখা হতো তাহলে আরো একটি পক্ষ একই ধরনের প্রতিবাদ বিক্ষোভ করত। কারণ ছাত্রনেতা হওয়ার সাথে আর্থিক লাভালাভের যোগ আছে। আর গত পাঁচ বছর ধরে ছাত্রলীগের নেতা ও পাতি নেতারা যেভাবে টাকা-পয়সা, গাড়ি- ফ্যাটের মালিক বনে গেছেন তা দেখে ছাত্রদলের নেতা হওয়ার জন্য যারা লাইনে আছেন, তারাও চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছেন। এ কারণে কমিটি যাদের দিয়েই হোক না কেন, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হতোই। বিএনপির কোটারি স্বার্থের সাথে জড়িত অনেক নেতা কোনো-না-কোনো পক্ষকে ইন্ধন দিতেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এ বিষয়গুলো বোঝেন না এমন নয়।
এ কমিটি গঠনের আগে বেগম খালেদা জিয়া ছাত্রদলের নেতা হওয়ার প্রতিযোগিতায় আছেন, এমন সবার সাথে মতবিনিময় করেছিলেন। সেখানে তিনি অনেকের বক্তব্য শুনেছেন। কিছু কিছু প্রশ্নও করেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন এদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন ২৯ ডিসেম্বর বিএনপির মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি কর্মসূচির দিনে তারা কোথায় ছিলেন। বেশির ভাগের জবাব ছিল তারা জরুরি কারণে ঢাকায় ছিলেন না। কারো কারো নাকি পেটের পীড়াজনিত রোগ হয়েছিল। কেউ আবার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। চাইলে হয়তো এক দিনের মধ্যে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট এনে দিতে পারতেন। কয়েকজন হাতেগোনা ছাত্র বলেছেন তারা জেলে ছিলেন। ২৯ ডিসেম্বর ভোরে কয়েকটি বালুর ট্রাক দিয়ে খালেদা জিয়ার বাড়ি আটকে দেয়া হয়েছিল। তিনি পতাকা হাতে বাসা থেকে বের হলেও গেট পার হতে পারেননি। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন। সেদিন ঢাকা শহর কড়া নিরাপত্তায় ছিল। ঢাকার বাইরে থেকে যানবাহন চলাচল সীমিত করা হয়েছিল।
এর মধ্যে মালিবাগে ছাত্রশিবির একটি মিছিল বের করেছিল। সেখানে পুলিশের গুলিতে একজন শিবিরকর্মী নিহত হন। ‘দেশ গড়েছেন শহীদ জিয়া,নেত্রী মোদের খালেদা জিয়া’ স্লোগান দেয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি; বরং পুলিশ-বেষ্টনীর মধ্যে বেকুবের মতো ‘নারায়ে তকবির’ স্লেøাগান দিয়ে একজনের প্রাণহানি হয়েছিল। কিন্তু মালিবাগে আরো অনেকের আশার কথা ছিল, তারা কেউ আসেননি। বাসায় বসে টেলিভিশনে খালেদা জিয়ার বন্দিদশা দেখে তাদের রক্ত টগবগ করেছে; কিন্তু বাসার নিচে নামার সাহস হয়নি। এর আগে খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে বিতাড়িত করার পরও ছাত্রদলকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বলা হয়ে থেকে আপসহীন নেত্রীর চোখে পানি এ দেশের মানুষ মাত্র দুইবার দেখেছিল। একবার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর, দ্বিতীয়বার স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার পর। নেত্রীর চোখে পানি দেখার পর ছাত্রদলের তরুণেরা আবেগতাড়িত হয়ে প্রতিরোধের শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। সেদিনও ঢাকা শহরে একটি মিছিলও হয়নি।
কোনো প্রকার প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ছাড়াই যখন সরকার এ দু’টি কাজ সমাধা করতে পারে, সে সরকারের কাছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন খুব বড় কোনো সমস্যা ছিল না। হ্যাঁ সমস্যা হয়েছিল, তবে ঢাকার ছাত্রদলের নেতাদের নিয়ে নয়, গ্রামের মানুষকে নিয়ে; যারা প্রকৃতপক্ষে খালেদা জিয়াকে ভালোবাসেন। খালেদা জিয়ার চোখে পানি দেখে তাদের চোখও ভিজে গিয়েছিল। এই গ্রামের মানুষই বারবার সর্বাধিক ভোটে তাকে বিজয়ী করেন, যারা জিয়াউর রহমানকেও এখনো ভুলে যাননি। বেগম খালেদা জিয়ার কথায় তারা ভোট বর্জন করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ভোট প্রতিরোধ করেছিলেন।
দলীয় প্রধানের সর্ব্বোচ্চ বিপদে যে ছাত্রসংগঠনের নেতারা মাঠে নামতে পারেন না, তারা কিভাবে দাবি করতে পারেন খালেদা জিয়ার অনুমোদিত কমিটি দিয়ে আন্দোলন হবে না। তাদের এই দাবি যদি সত্যি বলেও প্রমাণ হয়, তারপরও তারা নৈতিকভাবে এ কথা বলার অধিকার রাখেন না। পল্টনে একজন বিদ্রোহী নেতা বলেছেন, তারা নাকি রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন ঘটাবেন। এর আগে তারা নিজেদের ঘড় ঠিক করবেন। এরা যে কার ঘড় শক্ত করছেন পুলিশের ভূমিকা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। পল্টনের অফিসে যেখানে বিএনপির সিনিয়র নেতারা চেয়ার নিয়ে বসতে পারেন না; অফিসের দরজা ভেঙে পঙ্গু রুহুল কবির রিজভীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়Ñ সেখানে এক সপ্তাহ ধরে রাস্তা বন্ধ করে মিছিল-স্লেøাগান হয়, ককটেল ফাটে; কিন্তু পুলিশ নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ছাত্রদলের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পুলিশ এখন সহযোগী। বাহ্ চমৎকার!
এমন পরিস্থিতির জন্য শুধু বিদ্রোহীরা দায়ী তা নন, পদবঞ্চিত নেতারা ছাত্রদলের সাবেক দুই সভাপতি শহীদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানি ও সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে স্লেøাগান দিয়েছেন। এই দুই নেতা ছাত্রদলের কমিটি গঠনে কমবেশি ভূমিকা রেখেছেন। এখন তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা এড়িয়ে যাওয়ার নয়। এ দ্ইু নেতার বিরুদ্ধে নানা ধরনের দুর্নীতির গুঞ্জন রয়েছে। ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকের কারণে যদি সংগঠনে বিভেদ-বিভাজন বাড়তে থাকে তাহলে সে অভিভাবকত্ব কী কাজে লাগবে? প্রকৃতপক্ষে যাদের ওপর দল গঠনের দায়িত্ব পরে তারা যদি কোটারি স্বার্থে সংগঠনকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন তাহলে তা শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহে রূপ নেয়া স্বাভাবিক। কারণ, বিএনপি ক্যাডারভিত্তিক কোনো সংগঠন নয় কিংবা আওয়ামী লীগের মতো কর্তৃত্ববাদী দলও নয়। ছাত্রদলের সাবেক কয়েকজন সভাপতি যেভাবে ধন-সম্পদের মালিক বনে গেছেন, তাতে ছাত্রদলের কমিটির সদস্য হওয়া অনেকের কাছে ক্যারিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ছাত্রদলের বিদ্রোহীরা অভিযোগ করেছেন নতুন কমিটিতে নাকি ছাত্রলীগ ঢুকে পড়েছে। যদি ছাত্রলীগ ঢুকে পড়ে বিএনপির জন্য তাতেও কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হয় না। কারণ, যারা প্রকৃত ছাত্রদলের বলে দাবি করছেন তারাই বা গত সাত বছরে ছাত্রলীগের মোকাবেলায় কী করেছেন? তাহলে ছাত্রলীগ ঢুকল, না অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী ঢুকল তাতে কী-ই বা আসে-যায়। এ ছাড়া বিএনপির কোনো কোনো নেতা তো বিএনপির নামে আওয়ামী লীগের রাজনীতি চালু করতে চান। দলের নাম বিএনপি হলেও রাজনীতি হবে আওয়ামী লীগের সেকুলার রাজনীতি। এতে নাকি বিদেশী সমর্থন নিয়ে দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়া যেত। এরাই খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুরে থাকা অবস্থায় শাহবাগের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছিল। পিয়াস করিমের মৃত্যুর পরের ঘটনা থেকে হয়তো তারা উপলদ্ধি করতে পারছেন, উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে আওয়ামী সেকুলারিজম এক ঘোরতর মৌলবাদী বিশ্বাসে রূপ নিয়েছে। এখানে যতই আওয়ামী লীগের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করা হবে ততই আওয়ামী লীগ তাদের গুরুত্বহীন করবে, এমনকি সামাজিক মর্যাদাও দেবে না। ছাত্রলীগের কর্মীরা যদি ভোল পাল্টিয়ে ছাত্রদলে যোগ দেন তাহলে এদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার মতো নেতার অভাব হবে না।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে যখন ছাত্রদল গঠন করেন, তখন তার রাজনৈতিক ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য ছাত্রসংগঠন গঠনের প্রয়োজন ছিল না। তখন তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৭২-৭৪ সালের দুঃশাসন ও গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য মানুষ একজন রাষ্ট্রনায়ক খুঁজছিল। ৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সেই রাষ্ট্রনায়কের আবির্ভাব ঘটেছিল। রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণের পর তিনি বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের সাথে খুব সহজভাবে মিশেছেন। গণমানুষকে সাথে নিয়ে তার মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা এই কাজকে আরো সহজ করে দিয়েছিল। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন রাষ্ট্রনেতা হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মের ব্যাপারে তিনি সমান মনোযোগী ছিলেন। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলতেন। এ জন্য তাদের জন্য আয়োজন করেছিলেন নৌবিহারের।
তিনি উপলদ্ধি করেছিলেন একটি আধুনিকমনস্ক, জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত ছাত্রসংগঠন গড়ে উঠবে। এ কারণে আমরা দেখছি ৮০-এর দশকে মেধাবী ও আধুনিক উদ্যমী অনেক তরুণকে ছাত্রদলে যোগ দিতে। তার এই অনুপ্রেরণায় গড়া ছাত্রসংগঠনের সুফল পাওয়া গেছে গোটা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদলের সরব উপস্থিতি। সে সময় অনেক ছাত্রদল নেতাকর্মী ত্যাগ স্বীকার করেছেন। পঙ্গু হয়েছেন, দীর্ঘ সময় জেল খেটেছেন। সেই ছাত্রদল এখন আদর্শহীন রাজনীতির উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রদলের নামে পল্টনে জিয়াউর রহমানের মুর্যালে যখন আঘাত করা হয়, তখন কবর থেকে জিয়াউর রহমান হয়তো আক্ষেপ করেন, এই তরুণদের জন্য কী ছাত্রসংগঠন গড়ে এসেছিলাম? বাস্তবতা হলো, এই ছাত্রদল জিয়াউর রহমানকে ভুলে গেছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ওপর পাঁচ লাইনের বক্তব্য দেয়া অনেকের পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না। দুর্ভাগ্য, এরাই এখন ছাত্রদলের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছেন। তবে বলতেই হবে, ছাত্রদলের এই পরিস্থিতির জন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের দায় নিতে হবে। কেন সবাই ছাত্রদলের নেতা হতে চায়, তা আগে অনুধাবন করা দরকার। আওয়ামী লীগের রাজনীতি যদি বিএনপি নেতারা প্রমোট করতে চান, তাহলে ছাত্রদলের অবস্থা আগামী দিনে ছাত্রলীগের চেয়েও খারাপ হবে।
alfazanambd@yahoo.com
এ কমিটি গঠনের আগে বেগম খালেদা জিয়া ছাত্রদলের নেতা হওয়ার প্রতিযোগিতায় আছেন, এমন সবার সাথে মতবিনিময় করেছিলেন। সেখানে তিনি অনেকের বক্তব্য শুনেছেন। কিছু কিছু প্রশ্নও করেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন এদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন ২৯ ডিসেম্বর বিএনপির মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি কর্মসূচির দিনে তারা কোথায় ছিলেন। বেশির ভাগের জবাব ছিল তারা জরুরি কারণে ঢাকায় ছিলেন না। কারো কারো নাকি পেটের পীড়াজনিত রোগ হয়েছিল। কেউ আবার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। চাইলে হয়তো এক দিনের মধ্যে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট এনে দিতে পারতেন। কয়েকজন হাতেগোনা ছাত্র বলেছেন তারা জেলে ছিলেন। ২৯ ডিসেম্বর ভোরে কয়েকটি বালুর ট্রাক দিয়ে খালেদা জিয়ার বাড়ি আটকে দেয়া হয়েছিল। তিনি পতাকা হাতে বাসা থেকে বের হলেও গেট পার হতে পারেননি। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন। সেদিন ঢাকা শহর কড়া নিরাপত্তায় ছিল। ঢাকার বাইরে থেকে যানবাহন চলাচল সীমিত করা হয়েছিল।
এর মধ্যে মালিবাগে ছাত্রশিবির একটি মিছিল বের করেছিল। সেখানে পুলিশের গুলিতে একজন শিবিরকর্মী নিহত হন। ‘দেশ গড়েছেন শহীদ জিয়া,নেত্রী মোদের খালেদা জিয়া’ স্লোগান দেয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি; বরং পুলিশ-বেষ্টনীর মধ্যে বেকুবের মতো ‘নারায়ে তকবির’ স্লেøাগান দিয়ে একজনের প্রাণহানি হয়েছিল। কিন্তু মালিবাগে আরো অনেকের আশার কথা ছিল, তারা কেউ আসেননি। বাসায় বসে টেলিভিশনে খালেদা জিয়ার বন্দিদশা দেখে তাদের রক্ত টগবগ করেছে; কিন্তু বাসার নিচে নামার সাহস হয়নি। এর আগে খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে বিতাড়িত করার পরও ছাত্রদলকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বলা হয়ে থেকে আপসহীন নেত্রীর চোখে পানি এ দেশের মানুষ মাত্র দুইবার দেখেছিল। একবার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর, দ্বিতীয়বার স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার পর। নেত্রীর চোখে পানি দেখার পর ছাত্রদলের তরুণেরা আবেগতাড়িত হয়ে প্রতিরোধের শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। সেদিনও ঢাকা শহরে একটি মিছিলও হয়নি।
কোনো প্রকার প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ছাড়াই যখন সরকার এ দু’টি কাজ সমাধা করতে পারে, সে সরকারের কাছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন খুব বড় কোনো সমস্যা ছিল না। হ্যাঁ সমস্যা হয়েছিল, তবে ঢাকার ছাত্রদলের নেতাদের নিয়ে নয়, গ্রামের মানুষকে নিয়ে; যারা প্রকৃতপক্ষে খালেদা জিয়াকে ভালোবাসেন। খালেদা জিয়ার চোখে পানি দেখে তাদের চোখও ভিজে গিয়েছিল। এই গ্রামের মানুষই বারবার সর্বাধিক ভোটে তাকে বিজয়ী করেন, যারা জিয়াউর রহমানকেও এখনো ভুলে যাননি। বেগম খালেদা জিয়ার কথায় তারা ভোট বর্জন করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ভোট প্রতিরোধ করেছিলেন।
দলীয় প্রধানের সর্ব্বোচ্চ বিপদে যে ছাত্রসংগঠনের নেতারা মাঠে নামতে পারেন না, তারা কিভাবে দাবি করতে পারেন খালেদা জিয়ার অনুমোদিত কমিটি দিয়ে আন্দোলন হবে না। তাদের এই দাবি যদি সত্যি বলেও প্রমাণ হয়, তারপরও তারা নৈতিকভাবে এ কথা বলার অধিকার রাখেন না। পল্টনে একজন বিদ্রোহী নেতা বলেছেন, তারা নাকি রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন ঘটাবেন। এর আগে তারা নিজেদের ঘড় ঠিক করবেন। এরা যে কার ঘড় শক্ত করছেন পুলিশের ভূমিকা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। পল্টনের অফিসে যেখানে বিএনপির সিনিয়র নেতারা চেয়ার নিয়ে বসতে পারেন না; অফিসের দরজা ভেঙে পঙ্গু রুহুল কবির রিজভীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়Ñ সেখানে এক সপ্তাহ ধরে রাস্তা বন্ধ করে মিছিল-স্লেøাগান হয়, ককটেল ফাটে; কিন্তু পুলিশ নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ছাত্রদলের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পুলিশ এখন সহযোগী। বাহ্ চমৎকার!
এমন পরিস্থিতির জন্য শুধু বিদ্রোহীরা দায়ী তা নন, পদবঞ্চিত নেতারা ছাত্রদলের সাবেক দুই সভাপতি শহীদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানি ও সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে স্লেøাগান দিয়েছেন। এই দুই নেতা ছাত্রদলের কমিটি গঠনে কমবেশি ভূমিকা রেখেছেন। এখন তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা এড়িয়ে যাওয়ার নয়। এ দ্ইু নেতার বিরুদ্ধে নানা ধরনের দুর্নীতির গুঞ্জন রয়েছে। ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকের কারণে যদি সংগঠনে বিভেদ-বিভাজন বাড়তে থাকে তাহলে সে অভিভাবকত্ব কী কাজে লাগবে? প্রকৃতপক্ষে যাদের ওপর দল গঠনের দায়িত্ব পরে তারা যদি কোটারি স্বার্থে সংগঠনকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন তাহলে তা শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহে রূপ নেয়া স্বাভাবিক। কারণ, বিএনপি ক্যাডারভিত্তিক কোনো সংগঠন নয় কিংবা আওয়ামী লীগের মতো কর্তৃত্ববাদী দলও নয়। ছাত্রদলের সাবেক কয়েকজন সভাপতি যেভাবে ধন-সম্পদের মালিক বনে গেছেন, তাতে ছাত্রদলের কমিটির সদস্য হওয়া অনেকের কাছে ক্যারিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ছাত্রদলের বিদ্রোহীরা অভিযোগ করেছেন নতুন কমিটিতে নাকি ছাত্রলীগ ঢুকে পড়েছে। যদি ছাত্রলীগ ঢুকে পড়ে বিএনপির জন্য তাতেও কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হয় না। কারণ, যারা প্রকৃত ছাত্রদলের বলে দাবি করছেন তারাই বা গত সাত বছরে ছাত্রলীগের মোকাবেলায় কী করেছেন? তাহলে ছাত্রলীগ ঢুকল, না অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী ঢুকল তাতে কী-ই বা আসে-যায়। এ ছাড়া বিএনপির কোনো কোনো নেতা তো বিএনপির নামে আওয়ামী লীগের রাজনীতি চালু করতে চান। দলের নাম বিএনপি হলেও রাজনীতি হবে আওয়ামী লীগের সেকুলার রাজনীতি। এতে নাকি বিদেশী সমর্থন নিয়ে দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়া যেত। এরাই খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুরে থাকা অবস্থায় শাহবাগের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছিল। পিয়াস করিমের মৃত্যুর পরের ঘটনা থেকে হয়তো তারা উপলদ্ধি করতে পারছেন, উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে আওয়ামী সেকুলারিজম এক ঘোরতর মৌলবাদী বিশ্বাসে রূপ নিয়েছে। এখানে যতই আওয়ামী লীগের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করা হবে ততই আওয়ামী লীগ তাদের গুরুত্বহীন করবে, এমনকি সামাজিক মর্যাদাও দেবে না। ছাত্রলীগের কর্মীরা যদি ভোল পাল্টিয়ে ছাত্রদলে যোগ দেন তাহলে এদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার মতো নেতার অভাব হবে না।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে যখন ছাত্রদল গঠন করেন, তখন তার রাজনৈতিক ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য ছাত্রসংগঠন গঠনের প্রয়োজন ছিল না। তখন তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৭২-৭৪ সালের দুঃশাসন ও গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য মানুষ একজন রাষ্ট্রনায়ক খুঁজছিল। ৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সেই রাষ্ট্রনায়কের আবির্ভাব ঘটেছিল। রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণের পর তিনি বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের সাথে খুব সহজভাবে মিশেছেন। গণমানুষকে সাথে নিয়ে তার মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা এই কাজকে আরো সহজ করে দিয়েছিল। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন রাষ্ট্রনেতা হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মের ব্যাপারে তিনি সমান মনোযোগী ছিলেন। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলতেন। এ জন্য তাদের জন্য আয়োজন করেছিলেন নৌবিহারের।
তিনি উপলদ্ধি করেছিলেন একটি আধুনিকমনস্ক, জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত ছাত্রসংগঠন গড়ে উঠবে। এ কারণে আমরা দেখছি ৮০-এর দশকে মেধাবী ও আধুনিক উদ্যমী অনেক তরুণকে ছাত্রদলে যোগ দিতে। তার এই অনুপ্রেরণায় গড়া ছাত্রসংগঠনের সুফল পাওয়া গেছে গোটা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদলের সরব উপস্থিতি। সে সময় অনেক ছাত্রদল নেতাকর্মী ত্যাগ স্বীকার করেছেন। পঙ্গু হয়েছেন, দীর্ঘ সময় জেল খেটেছেন। সেই ছাত্রদল এখন আদর্শহীন রাজনীতির উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রদলের নামে পল্টনে জিয়াউর রহমানের মুর্যালে যখন আঘাত করা হয়, তখন কবর থেকে জিয়াউর রহমান হয়তো আক্ষেপ করেন, এই তরুণদের জন্য কী ছাত্রসংগঠন গড়ে এসেছিলাম? বাস্তবতা হলো, এই ছাত্রদল জিয়াউর রহমানকে ভুলে গেছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ওপর পাঁচ লাইনের বক্তব্য দেয়া অনেকের পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না। দুর্ভাগ্য, এরাই এখন ছাত্রদলের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছেন। তবে বলতেই হবে, ছাত্রদলের এই পরিস্থিতির জন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের দায় নিতে হবে। কেন সবাই ছাত্রদলের নেতা হতে চায়, তা আগে অনুধাবন করা দরকার। আওয়ামী লীগের রাজনীতি যদি বিএনপি নেতারা প্রমোট করতে চান, তাহলে ছাত্রদলের অবস্থা আগামী দিনে ছাত্রলীগের চেয়েও খারাপ হবে।
alfazanambd@yahoo.com
No comments