আবারও র্যাব বিলুপ্তির আহ্বান হিউম্যান রাইটস ওয়াচের
আরও একবার র্যাবকে ভেঙে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। তারা বলেছে, বিরোধী দলে থাকার সময় আওয়ামী লীগ বলেছিল তারা র্যাবকে বিলুপ্ত করবে। যারা ক্রসফায়ারে ও অন্যান্য হত্যার জন্য দায়ী তাদের বিচার করবে। কিন্তু তারা যখন ক্ষমতায় এলো তারপর থেকে কয়েক শ’ হত্যাকাণ্ড ঘটার পরও আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে গুরুতর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এ সংস্থা থেকে সব সামরিক কর্মকর্তা ও সদস্যকে প্রত্যাহার করে সেক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ বেসামরিক শক্তি নিয়োগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ। ঝালকাঠিতে র্যাবের হাতে গুলিবিদ্ধ যুবক লিমন এখনও সুবিচার পায়নি। তার বিরুদ্ধে যে মামলা ছিল তা প্রত্যাহার করা হলেও যারা তাকে গুলি করেছিল সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ‘বাংলাদেশ: নো জাস্টিস ফর উন্ডেড চাইল্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এইচআরডব্লিউ আরও বলেছে, ২০১১ সালে তখনকার বালক লিমন (১৬)-এর ওপর হামলা হয়। এতে তাকে হারাতে হয় একটি পা। এ ঘটনায় র্যাবের যেসব সদস্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারের নির্দেশ দেয়া উচিত বলে দাবি করেছে এইচআরডব্লিউ। রাজনৈতিক উদ্দেশে লিমনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত তা প্রত্যাহার করেছে। একটি আনাড়ি অপারেশন চালাতে গিয়ে লিমনকে গুলি করে র্যাব সদস্যরা। ওই সময় লিমন ছিল কলেজ ছাত্র। তার বসবাস বাংলাদেশের দক্ষিণের ঝালকাঠি জেলায়। আধাসামরিক বাহিনী ২০১১ সালের ২৩শে মার্চ তাকে অপরাধী অভিযোগে খুব কাছ থেকে গুলি করে। এর চারদিন পরে তার জীবন বাঁচাতে একটি পা কেটে ফেলা হয়। চিকিৎসার কারণে সে ৬ মাসেরও বেশি সময় বাড়ি যেতে পারেনি। এ বিষয়ে এইচআরডব্লিউ-এর এশিয়া বিষয় পরিচালক ব্রাড এডামস বলেছেন, লিমনের বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার প্রত্যাহার করেছে। এটা ভাল। র্যাবের গুলিতে লিমন স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে। র্যাবের যে সব সদস্য তাকে গুলি করেছিল তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া উচিত বাংলাদেশ সরকারের। একই সঙ্গে যারা লিমনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে যারা বিচারকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। লিমনকে গুলি করার পরপরই র্যাবের তখনকার মহাপরিচালক বলেছিলেন, র্যাব ও অপরাধী চক্রের মধ্যে গুলি বিনিময়ের সময় দুর্ঘটনাক্রমে গুলির শিকার হয় লিমন। কিন্তু তাকে যারা গুলি করেছে তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপই নেয়নি পুলিশ। এর পরিবর্তে লিমনের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অপরাধের অভিযোগ আনে তারা। এর উদ্দেশ্য র্যাবকে জবাবদিহি থেকে নিরাপদ আশ্রয় দেয়া। এ ঘটনা নিয়ে দেশে ও বিদেশে তীব্র উত্তেজনা, সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ২০১১ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ঘটনায় র্যাব সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেন। তিনি আরও বলেছিলেন, তখনকার চলমান অনুসন্ধানে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, লিমন কোন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। লিমনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর এমন বিবৃতি ও গুলি করার ঘটনার তদন্তের নির্দেশ বাংলাদেশী মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হওয়া সত্ত্বেও কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে সরকার ওই বিবৃতি প্রত্যাহার করে চার ঘণ্টার মধ্যে। পক্ষান্তরে লিমনের পরিবার ৬ র্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে মামলা করে ২০১১ সালের ১০ই এপ্রিল। এ অভিযোগের সরকারি তদন্ত এখনও সম্পন্ন হয়নি। এমনকি যারা তাকে গুলি করেছিল তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও গঠন করা হয়নি। ২০১২ সালের ১৪ই আগস্ট পুলিশ একটি রিপোর্ট দেয়। তাতে বলা হয়, লিমনকে গুলির সঙ্গে র্যাব জড়িত থাকার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে শ’ শ’ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য র্যাব দায়ী- হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অন্যরা এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রামাণ্য তথ্য উপস্থাপন করছে। প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও এসব অভিযোগের জন্য কোন র্যাব সদস্যকে এখন পর্যন্ত সফলভাবে বিচার করা হয়নি। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ বছরের মে মাসে নারায়ণগঞ্জে ৭ ব্যক্তিকে হত্যার জন্য দায়ী র্যাবের কিছু সদস্য। তাদেরকে বিচার করে দায়মুক্তি দেয়ার রীতি ভাঙতে হবে সরকারকে। ওই ঘটনায় মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারের ফলে র্যাবের কমপক্ষে ৩ সদস্যকে আটক করা হয়েছে। এটা হয়েছে দৃশ্যত, ঘটনার শিকার ব্যক্তিরা সুপরিচিত রাজনৈতিক পরিবারের বলে। ২০০৪ সালে অপরাধ ও সন্ত্রাসবিরোধী ফোর্স র্যাব গঠন করা হয়। এতে রয়েছেন সামরিক বাহিনী ও পুলিশের সদস্য। এর মাধ্যমে সেনা সদস্যদের বেসামরিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় জড়িত করা হয়। গত এক দশকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), তারপরে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার এ বাহিনীকে দায়মুক্তির সুবিধা দিয়েছে। এর ফলে তারা গুরুতর ও পর্যায়ক্রমে আইন লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। ১৮ই অক্টোবর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পার্লামেন্ট র্যাবের হাতে গুম, হত্যাকাণ্ড ও চলমান নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ব্রাড এডামস বলেন, র্যাব একটি ডেথ স্কোয়াড। একে সংস্কার করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা র্যাবের আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে শূন্য সহনশীলতা দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি শূন্য বুলি হবে যদি তিনি সার্বিকভাবে র্যাব বিলুপ্তিতে পদক্ষেপ না নেন।
No comments