ত্রিমাত্রিক ভারসাম্য প্রয়োজন by মে. জে. (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক
ঘটনা মানুষের জন্য অপো করে না; ঘটনা ঘটে যায় মানুষ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। অর্থাৎ ঘটনা হলো ক্রিয়া, তারপরে মানুষ যা করে সেটা হলো প্রতিক্রিয়া। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সুযোগ্য কন্যা শারমিন আহমদ, অথবা মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রধান সেনাপতি বা কমান্ডার ইন চিফ তৎকালীন কর্নেল এম এ জি ওসমানীর সরাসরি অধীনে ‘ডেপুটি চিফ অব স্টাফ’ হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী, তৎকালীন গ্র“প ক্যাপটেন এ কে খন্দকারÑ উভয়ে তাদের বিখ্যাত ঐতিহাসিক বই লেখার ও প্রকাশ করার আগে কারো অনুমতি নিয়েছেন বলে জানা নেই। তিন সপ্তাহ আগে নিউ ইয়র্ক মহানগরীতে, টাঙ্গাইল সমিতির অনুষ্ঠানে যেসব ধর্মবিরোধী-দেশবিরোধী-আওয়ামী লীগ বিরোধী কথাবার্তা বলেছেন তৎকালীন মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, সেগুলো বলার আগে তিনি কারো অনুমতি নিয়েছেন বলে জানা নেই। ১৩ অক্টোবর ইন্তেকাল করেছেন অতি সুপরিচিত অধ্যাপক ও জনপ্রিয় টকশো ব্যক্তিত্ব, প্রফেসর পিয়াস করিম। তার লাশ শহীদ মিনারে নিতে দেয়া হয়নি। এই নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে এবং আরো কয়েক দিন হবে বলে মনে হয়। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চাচ্ছি, পত্রিকার কলাম লেখকদের জন্য, টেলিভিশন টকশোতে আলোচনার জন্য, রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে প্রতিবাদী বক্তব্য দেয়ার জন্য বিষয়ের কোনো অভাব হয় না। বেশির ভাগ আলোচনা তখন অতীতের ঘটনাবলি নিয়ে হয়; কিন্তু শুধু অতীত নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না। মানুষকে বাঁচতে হয় অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ, এই তিনকালের সমন্বিত প্রভাবে বা কল্পনায়। যাদের বয়স ৬০ বা ৭০ বা ৭৫ বছর তারা এবং যাদের বয়স ১৮ বা ২০ বা ২৫ বছর, তাদের চিন্তার গতিপ্রকৃতি কোনো দিনই একরকম হতে পারে না। এর মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। এসব নিয়েই আজকের নাতিদীর্ঘ কলাম।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে, তৎকালীন মোগল সাম্রাজ্যের বর্ধিষ্ণু বাংলা নামক প্রদেশ (আধা স্বাধীন, আধা দিল্লির অধীন) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির করতলগত হয়েছিল। পরবর্তী এক শ’ বছর কলকাতাকে রাজধানী করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত শাসন করেছিল। একটি কথা আরেকবার উল্লেখ করছি। বাংলা প্রদেশের েেত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে এবং ভারতবর্ষের অন্য কিছু জায়গার েেত্র মোগল সম্রাটের প্রতিনিধিদের পরাজিত করেই তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের শাসন মতা অর্জন করতে থাকে। অতি স্বাভাবিকভাবেই নবাব বা বাংলার নবাব বা মোগল সম্রাট যে গোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মালিক ও কর্মকর্তা কর্মচারীরা ওই গোষ্ঠীর প্রতিপ হয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ ইংরেজরা হলো মুসলমানদের প্রতিপ। অপর দিকে, মোগল শাসনামলে যারা মতায় ছিল না, প্রজা ছিল, ওই মানুষগুলো ইংরেজদের বন্ধু হয়ে গেল। অতি প্রাচীন একটি নীতি হলো, ‘তোমার শত্র“র শত্র“ তোমার বন্ধু হবে’। অর্থাৎ, ওই আমলে মুসলমানদের শত্র“ ছিল ইংরেজরা। মুসলমানদের শত্র“ না হলেও অবান্ধব সম্পর্কে ছিল শিখ-হিন্দু প্রভৃতি। অতএব শিখ-হিন্দুরা হয়ে উঠেছিলেন ইংরেজদের বন্ধু। যে সময়ের কথা বলছি সেটা হলো ১৮৫৭ সাল থেকে শুরু করে, অতীতের এক শ’ দেড় শ’ বছর।
১৮৫৭ সালে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। কেউ বলেন সিপাহি বিদ্রোহ। কেউ বলেন স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ; কিন্তু এই ঘটনার পর মোগল সাম্রাজ্যের সূর্য চূড়ান্তভাবেই ডুবে যায়। ১৮৫৭ সালের পরে ভারতের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা একটু একটু করে বিকশিত হতে থাকে। মুসলমানদের জন্য শিক্ষাপ্রসারে উদ্যোগ নেয়া হতে থাকে। ১৮৮০-এর দশকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস নামক রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। হিন্দু-মুসলমান-শিখ মোটামুটিভাবে সবাই এই রাজনৈতিক দলটিকে কম হোক বেশি হোক নিজের বা আপন মনে করে নেয়; কিন্তু পরিস্থিতি সবার জন্য অনুকূল থাকেনি। না থাকাতে তৎকালীন ভারতের মুসলমানেরা নিজেদের জন্য আলাদা রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ৩০ নভেম্বর ১৯০৬ সালে এই ঢাকা শহরে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ নামে একটি নতুন দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই রাজনৈতিক দলটি ভারতে, ক্রমান্বয়ে, ন্যাশনাল কংগ্রেসের পাশাপাশি সমান্তরাল শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ ঐতিহাসিক লাহোর নগরীতে, মুসলিম লীগের সম্মেলনে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছিল। এটি পাকিস্তান প্রস্তাব নামে পরিচিত। এর সংপ্তি সার হলো, তৎকালীন ভারতবর্ষের পশ্চিমাংশে বা পূর্বাংশে বা অন্যত্র যেসব ভূখণ্ডে জনগণের মধ্যে মুসলমানেরা মেজরিটি, ওইসব এলাকায় একটি করে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। এই মুসলমান অধ্যুষিত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো ছাড়া সমগ্র ভারতবর্ষের বাকি অংশ, তথা অমুসলমান অংশ, আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে। নবাব বা মহারাজা শাসিত রাজ্যগুলো হয় স্বাধীন থাকবে অথবা তাদের ইচ্ছা মোতাবেক কোনো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে যোগ দেবে। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ সাল, এই সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য উত্তাল ছিল। ভারতও ব্যস্ত ছিল। তখনকার অনেক ঘটনার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা হলো, মুসলিম লীগের জ্যেষ্ঠতম নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং অন্য কয়েকজনের বিশেষ আগ্রহে বা পরিকল্পনায় লাহোর প্রস্তাবটি সংশোধিত হয়ে যায়। মুসলিম অধ্যুষিত একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিবর্তে সমগ্র ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মেজরিটি এলাকাগুলো নিয়ে একটি মাত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের পে প্রস্তাব সংশোধিত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে পাকিস্তান নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৫ আগস্ট তারিখ থেকে ভারত নামক স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নেয়। ভারত নামক রাষ্ট্র, পাকিস্তানের সৃষ্টিতে খুশি হয়নি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অনেক মানুষও ওই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট হয়নি। তারা চিন্তা করেছিল ‘এখন কী করণীয়’? এর উত্তর ছিল, ‘ধৈর্য ধরো, ধীরে ধীরে আগাও’। এখন ২০১৪ সালে এত বছর পরে ১৯৪৭-এর আগে চল্লিশের দশকের কথা বা ত্রিশের দশকের কথা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা এবং মূল্যায়ন করা অতি কঠিন কাজ এবং অনেকের কাছে অপ্রয়োজনীয়, আবার অনেকের কাছে প্রয়োজনীয়। যা হোক, ১৯৪৭-এর আগস্টে স্বাধীনতা পাওয়া পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের দু’টি প্রদেশ ছিল। একটি পশ্চিম পাকিস্তান, আরেকটি পূর্ব পাকিস্তান। এই দুই প্রদেশের জনগণের মধ্যে যেসব বন্ধন ছিল সেগুলো বেশির ভাগই ছিল দুর্বল বা ঠুনকো। সবচেয়ে বড় বন্ধন ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস। অর্থাৎ ধর্মীয় পরিচয়ে পাকিস্তানের মেজরিটি জনগণ ছিলেন মুসলমান।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে, শাসক গোষ্ঠীর অন্যায় ও অত্যাচারের কারণে ক্রমান্বয়ে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণ তাদের ওপর সৃষ্ট বঞ্চনা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে থাকে। প্রতীকী অর্থেই বলতে পারি যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকেই শুরু। বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই চিন্তা করছিলেন যে, আমাদের স্বাধীন হওয়া উচিত। আবার অনেকেই চিন্তা করছিলেন, স্বাধীন না হয়ে একই পাকিস্তানের ভেতরে আরো মতাশীল হওয়া উচিত। একটি ক্ষুদ্র অংশের মনে এমন চিন্তা হচ্ছিল যে, আমরা পাকিস্তানেও থাকা উচিত না, স্বাধীনও হওয়া উচিত না, বরং আমরা ঐতিহাসিক বঙ্গ প্রদেশের অবস্থায় ফিরে যাওয়া এবং বৃহত্তর ভারতের অঙ্গীভূত হওয়া উচিত।
সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পে ও বিপে গণভোটের ফলাফল সবাই জানে। এখন থেকে পঞ্চাশ বছর বা ষাট বছর আগে ফিরে যাই। দেশে দেশে মানুষ স্বাধীনতা যেমন চেয়েছে, তার বিকল্পও চিন্তা করেছে। স্কটল্যান্ডের কথা একটু আগেই বললাম। কানাডার বিখ্যাত প্রদেশ কিউবেক বা কুইবেক। এই প্রদেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য একাধিকবার রেফারেন্ডাম বা গণভোটের সুযোগ পেয়েছে। কুইবেকের জনগণ স্বাধীনতার পে যায়নি, তারা কানাডার সাথেই থাকতে চেয়েছে। নাইজেরিয়া হচ্ছে পশ্চিম আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ একটি বিখ্যাত দেশ। মুসলমান ও খ্রিষ্টান এখানে প্রধান জনগোষ্ঠী। ১৯৭০ সালের দিকে নাইজেরিয়ার পূর্বাংশের একটি প্রদেশ, যার নাম বায়াফ্রা, স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। নাইজেরিয়া সরকার সেই ঘোষণাকে মেনে নেয়নি এবং ওই বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন করার জন্য সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। প্রায় তিন বছর যুদ্ধ চলে। এতে বিদ্রোহী বা একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণাকারী, বায়াফ্রার বাহিনী পরাজিত হয়। ইন্দোনেশিয়া নামক মুসলমানপ্রধান দেশে বড় ছোট হাজারের অধিক দ্বীপ আছে। ইন্দোনেশিয়ার দূর পূর্বাংশে অবস্থিত একটি দ্বীপের নাম তিমুর যার একটি অংশ খ্রিষ্টান অধ্যুষিত। এই অংশ ইন্দোনেশিয়া থেকে স্বাধীন হওয়ার জন্য প্রায় ৯ বছর যুদ্ধ করে। অতঃপর তারা স্বাধীন হয়। তাদের স্বাধীনতায় জাতিসঙ্ঘ এবং প্রতিবেশী দেশ অস্ট্রেলিয়া সহায়তা করেছে। এখন থেকে প্রায় ৩৪-৩৫ বছর আগে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের জনগণের একটি অংশ, ভারত থেকে স্বাধীন হয়ে নতুন একটি রাষ্ট্র (নাম : খালিস্তান) প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিল। তাদের এ সংগ্রাম ও আন্দোলনে আধ্যাত্মিক ও গোপন রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল অমৃতসর শহরের স্বর্ণমন্দির। একপর্যায়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে স্বর্ণমন্দিরের অভ্যন্তরের স্বাধীনতাকামী বা বিদ্রোহী বা রাষ্ট্রদ্রোহীদের দমন করে। বর্তমান ভারতের উত্তর পশ্চিম অংশে একটি প্রদেশের নাম জম্মু কাশ্মির। সেখানকার জনগণের একটি অংশ ৫০-৬০ বছর ধরে সংগ্রাম করছে ভারত থেকে স্বাধীন হওয়ার জন্য। কোনো সময় সংগ্রাম তীব্র হয় কোনো সময় সংগ্রাম ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত স্বাধীন হয় তখন বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরপূর্বে ভারতীয় ভূখণ্ডে, মাত্র একটি প্রদেশ ও দু’টি মহারাজা শাসিত রাজ্য ছিল। পুরো এলাকাটি ছিল একটি প্রদেশ যার নাম ছিল আসাম এবং মহারাজা শাসিত রাজ্যগুলোর নাম ছিল ত্রিপুরা ও মনিপুর। এখন বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে, ভারতের সাতটি রাজ্য বা প্রদেশ আছে। ১৯৫২ সালে প্রথম নাগাল্যান্ড (তখনো প্রদেশ হয়নি) স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের ঢেউ লেগে অনেক জায়গায় সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। ভারত সরকার তাদেরকে স্বাধীনতা না দিয়ে দেশের মর্যাদা দেয়। এখনও উত্তর-পূর্ব ভারতে আসাম বা নাগাল্যান্ড ইত্যাদি অঞ্চলে ভারত থেকে স্বাধীনতা চায় এমন মানুষ একদম নেই বললে ভুল হবে। তবে আন্দোলন এখন ম্রিয়মাণ।
বাংলাদেশের সর্বদণি পূর্বে অবস্থিত রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানÑ এই তিনটি জেলাকে সম্মিলিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বলা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের একটি অংশ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়নি। তারা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছিল। এই পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের একটি অংশ তথা সর্ববৃহৎ উপজাতি ‘চাকমা’দের বৃহদাংশ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি বরং পাকিস্তানের সাফল্যই কামনা করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত প্রকাশ্যে ঘোষিতভাবে সেই পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রবিরোধী ও সরকারবিরোধী সশস্ত্র বিদ্রোহ পরিচালিত হয়েছে। বিদ্রোহ পরিচালনাকারী দলের গোপন দলের নাম ছিল ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ এবং তাদের সশস্ত্র অংশের নাম ছিল ‘শান্তিবাহিনী’। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহীরা প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেনি সত্য; কিন্তু অপ্রকাশ্যে তারা স্বাধীনতার জন্যও যুদ্ধ করছিল। দীর্ঘ দিন গুরুত্বপূর্ণ পদে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরি করার সুবাদে, এ মন্তব্য করছি। মওলা ব্রাদার্স কর্তৃক প্রকাশিত, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ-পরিস্থিতির মূল্যায়ন’ নামে আমার লেখা ৩৮৫ পৃষ্ঠার বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে এ বিষয়ে। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র আন্দোলন, কৌশলগতভাবে ম্রিয়মাণ; কিন্তু ভিন্ন আঙ্গিকে পরিচালিত হচ্ছে।
সামরিক ইতিহাসের একজন ছাত্র এবং অধুনা সমকালীন রাজনীতির একজন ছাত্র হওয়ার সুবাদে আমার মূল্যায়ন হলো, যেখানেই স্বাধীনতা এসেছে বা স্বাধীনতার সংগ্রাম হয়েছে, সেখানেই কিছু কাজ অপ্রকাশ্যে হয়েছে, কিছু কাজ প্রকাশ্যে হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক ও বাস্তব। যেখানেই কোনো না কোনো জনগোষ্ঠী তাদের জন্য স্বাধীনতা চেয়েছে, সেখানেই প্রতিবেশী জনগোষ্ঠী আনুষ্ঠানিকভাবে বা অনানুষ্ঠানিকভাবে হয় সাহায্য-সহযোগিতা করেছে অথবা অসহযোগিতা করেছে। কোনো একটি জনগোষ্ঠী বা কোনো একটি দেশ তার প্রতিবেশী একটি জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতা কামনায় বা স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করবে, নাকি অসহযোগিতা করবে, এর পেছনে অনেক কারণ থাকে। যেটা করলে তার লাভ, সেটাই করা হয়। যেমন স্কটল্যান্ড যেন স্বাধীন না হয়, তার জন্য ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশির ভাগ দেশই আধা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় প্রকাশ্যেই, পরোভাবে, স্কটল্যান্ডবাসীর স্বাধীনতার পরে অংশকে নিরুৎসাহিত করেছে। যখন ষাটের দশক পুরা এবং সত্তরের দশকের শুরুর দিকে, উত্তর ভিয়েতনামভিত্তিক ভিয়েতকং বাহিনী, আমেরিকা-বান্ধব দণি ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল, একটি কমিউনিস্ট ভিয়েতনাম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছিল, তখন ভিয়েতনামের উত্তরের বৃহৎ প্রতিবেশী চীন তাদেরকে প্রভূত সাহায্য করেছিল। একপর্যায়ে দণি ভিয়েতনাম মার্কিন প্রভাবমুক্ত এবং একক ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পরের পনেরো-বিশ বছর যেকোনো কারণেই হোক না কেন, চীন ও ভিয়েতনামের সম্পর্কে অবনতি আসে। অপরপে ৯ বছর গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া মাত্রই পূর্ব তিমুর নামক রাষ্ট্রটি তাদের সাবেক শাসক ইন্দোনেশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব গভীর থেকে গভীরতর করেছে। যা হোক ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাই।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি অংশ স্বাধীনতা চাচ্ছিলেন এবং এ জন্য গোপন প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। তারা কৌশলী পদপে নিচ্ছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত সেই প্রস্তুতিতে গোপনে বা আধা প্রকাশ্যে সাহায্য করছিল। অপর ভাষায়, আমাদের স্বাধীনতাকামীরা সহযোগিতা নিচ্ছিলেন ও পাচ্ছিলেন। এর বিস্তারিত বিবরণ কোনো দিনই প্রকাশিত হয়নি। না হওয়ারই কথা। এখন ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হচ্ছে ইচ্ছায় হোক বা ঘটনাক্রমে হোক। এই কলামের প্রথম অনুচ্ছেদে দু’টি বইয়ের উল্লেখ করেছি, যেই দু’টি বইয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও তার পূর্ব-প্রস্তুতি নিয়ে আলোচিত হয়েছে। এই দু’টি বই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এই মুহূর্তে অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আলোচনার বিষয়বস্তু, ১৯৬০-এর দশকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য, তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতারা বা আওয়ামীপন্থী রাজনীতিবিদেরা কী কী পদপে নিয়েছিলেন; বিশেষ করে ভারতের সাথে সহযোগিতার ত্রে কিভাবে বিস্তৃত করা হচ্ছিল; কিন্তু ওই আমলের সরকারি গোয়েন্দা বা ওই আমলের স্বাধীনতাকামীদের প্রতিপ রাজনৈতিক শক্তি, ওই রূপ ভারতীয় সাহায্য-সহযোগিতা এবং ভারতীয় উৎসাহের কথা জানত। এখন ২০১৪ সালে, পেছনের দিকে তাকিয়ে আমরা কেউ কেউ প্রশ্ন করছি এবং কেউ কেউ উত্তর দিচ্ছি যে, ওই রূপ ভারতীয় সাহায্য-সহযোগিতার পরিমাণ বা ব্যাপ্তি কতটুকু ছিল? যেকোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি চূড়ান্ত ল্য ও রোডম্যাপ থাকে। যদি রাজনৈতিক আন্দোলনের ল্য হয় স্বাধীনতা, তাহলে তার চূড়ান্ত ধাপের প্রস্তুতি ও কর্ম কী হবে বা কী হতে পারে সেটা অনেক দিন পর্যন্ত অনিশ্চিত থাকে। অনিশ্চিত শব্দটি অপছন্দ হলে আমরা অপ্রকাশিত বলতে পারি। আমাদের বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, ষাটের দশকের শেষে, সত্তরের দশকের শুরুতে রাজনৈতিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি হয়েছিল সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ। নিরস্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সশস্ত্র স্বাধীনতার যুদ্ধ, এই দু’টির মধ্যে সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য; কিন্তু দুয়ের পরিচয় আলাদা। বাংলাদেশের েেত্র সশস্ত্র যুদ্ধ হয়েছিল প্রকাশ্যে, পৃথিবীকে সাী রেখে। বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী ছিল প্রতিবেশী ভারত। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত কি সব কিছু নিঃস্বার্থভাবে, নির্মোহভাবে, প্রতিদানের আশা না করেই সাহায্য করেছিল? নাকি প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত শর্তে, স্বার্থ উদ্ধারের ল্েয এবং প্রতিদান পাওয়ার পরিকল্পনায় এই সাহায্য করেছিল? নাকি কিছুটা স্বার্থ কিছুটা নিঃস্বার্থভাবে করেছিল? এসব প্রশ্নের আলোচনা আমাদের করা প্রয়োজন।
তবে ‘আমাদের’ বলতে কাকে বোঝাই, এটি একটি কঠিন প্রশ্ন। আমার বয়স ৬৫ শেষ হয়ে ৬৬ মাত্র শুরু হলো। আমি ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা। যারা আজকে তরুণ, যাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আগামী দিনের বাংলাদেশের প্রকৃতির ওপর, তারা ইতিহাসের জন্য কতটুকু সময় দেবে? এর থেকেও বড় প্রশ্ন, কতটুকু সময় আমরাই বা তাদের কাছে চাইতে পারি ইতিহাস শোনার জন্য? কথাগুলো এ জন্য বললাম যে, মাঝে মধ্যেই বাংলাদেশের বড় বড় পত্রিকার কলাম লেখার জায়গাগুলো এবং টেলিভিশন টকশোর বিষয়বস্তু এই প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎÑ এই তিনটির মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রয়োজন। ব্যবসায়িক উন্নয়ন, রাজনৈতিক উন্নয়ন ও সামরিক উন্নয়নÑ এই তিনটির মধ্যে ভারসাম্য প্রয়োজন। অতীতের বন্ধু, বর্তমানের বন্ধু ও ভবিষ্যতের বন্ধু, এই তিনটির মধ্যেও ভারসাম্য প্রয়োজন। অর্থাৎ ত্রিমাত্রিক ভারসাম্য প্রয়োজন।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে, তৎকালীন মোগল সাম্রাজ্যের বর্ধিষ্ণু বাংলা নামক প্রদেশ (আধা স্বাধীন, আধা দিল্লির অধীন) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির করতলগত হয়েছিল। পরবর্তী এক শ’ বছর কলকাতাকে রাজধানী করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত শাসন করেছিল। একটি কথা আরেকবার উল্লেখ করছি। বাংলা প্রদেশের েেত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে এবং ভারতবর্ষের অন্য কিছু জায়গার েেত্র মোগল সম্রাটের প্রতিনিধিদের পরাজিত করেই তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের শাসন মতা অর্জন করতে থাকে। অতি স্বাভাবিকভাবেই নবাব বা বাংলার নবাব বা মোগল সম্রাট যে গোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মালিক ও কর্মকর্তা কর্মচারীরা ওই গোষ্ঠীর প্রতিপ হয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ ইংরেজরা হলো মুসলমানদের প্রতিপ। অপর দিকে, মোগল শাসনামলে যারা মতায় ছিল না, প্রজা ছিল, ওই মানুষগুলো ইংরেজদের বন্ধু হয়ে গেল। অতি প্রাচীন একটি নীতি হলো, ‘তোমার শত্র“র শত্র“ তোমার বন্ধু হবে’। অর্থাৎ, ওই আমলে মুসলমানদের শত্র“ ছিল ইংরেজরা। মুসলমানদের শত্র“ না হলেও অবান্ধব সম্পর্কে ছিল শিখ-হিন্দু প্রভৃতি। অতএব শিখ-হিন্দুরা হয়ে উঠেছিলেন ইংরেজদের বন্ধু। যে সময়ের কথা বলছি সেটা হলো ১৮৫৭ সাল থেকে শুরু করে, অতীতের এক শ’ দেড় শ’ বছর।
১৮৫৭ সালে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। কেউ বলেন সিপাহি বিদ্রোহ। কেউ বলেন স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ; কিন্তু এই ঘটনার পর মোগল সাম্রাজ্যের সূর্য চূড়ান্তভাবেই ডুবে যায়। ১৮৫৭ সালের পরে ভারতের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা একটু একটু করে বিকশিত হতে থাকে। মুসলমানদের জন্য শিক্ষাপ্রসারে উদ্যোগ নেয়া হতে থাকে। ১৮৮০-এর দশকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস নামক রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। হিন্দু-মুসলমান-শিখ মোটামুটিভাবে সবাই এই রাজনৈতিক দলটিকে কম হোক বেশি হোক নিজের বা আপন মনে করে নেয়; কিন্তু পরিস্থিতি সবার জন্য অনুকূল থাকেনি। না থাকাতে তৎকালীন ভারতের মুসলমানেরা নিজেদের জন্য আলাদা রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ৩০ নভেম্বর ১৯০৬ সালে এই ঢাকা শহরে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ নামে একটি নতুন দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই রাজনৈতিক দলটি ভারতে, ক্রমান্বয়ে, ন্যাশনাল কংগ্রেসের পাশাপাশি সমান্তরাল শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ ঐতিহাসিক লাহোর নগরীতে, মুসলিম লীগের সম্মেলনে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছিল। এটি পাকিস্তান প্রস্তাব নামে পরিচিত। এর সংপ্তি সার হলো, তৎকালীন ভারতবর্ষের পশ্চিমাংশে বা পূর্বাংশে বা অন্যত্র যেসব ভূখণ্ডে জনগণের মধ্যে মুসলমানেরা মেজরিটি, ওইসব এলাকায় একটি করে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। এই মুসলমান অধ্যুষিত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো ছাড়া সমগ্র ভারতবর্ষের বাকি অংশ, তথা অমুসলমান অংশ, আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে। নবাব বা মহারাজা শাসিত রাজ্যগুলো হয় স্বাধীন থাকবে অথবা তাদের ইচ্ছা মোতাবেক কোনো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে যোগ দেবে। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ সাল, এই সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য উত্তাল ছিল। ভারতও ব্যস্ত ছিল। তখনকার অনেক ঘটনার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা হলো, মুসলিম লীগের জ্যেষ্ঠতম নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং অন্য কয়েকজনের বিশেষ আগ্রহে বা পরিকল্পনায় লাহোর প্রস্তাবটি সংশোধিত হয়ে যায়। মুসলিম অধ্যুষিত একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিবর্তে সমগ্র ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মেজরিটি এলাকাগুলো নিয়ে একটি মাত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের পে প্রস্তাব সংশোধিত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে পাকিস্তান নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৫ আগস্ট তারিখ থেকে ভারত নামক স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নেয়। ভারত নামক রাষ্ট্র, পাকিস্তানের সৃষ্টিতে খুশি হয়নি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অনেক মানুষও ওই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট হয়নি। তারা চিন্তা করেছিল ‘এখন কী করণীয়’? এর উত্তর ছিল, ‘ধৈর্য ধরো, ধীরে ধীরে আগাও’। এখন ২০১৪ সালে এত বছর পরে ১৯৪৭-এর আগে চল্লিশের দশকের কথা বা ত্রিশের দশকের কথা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা এবং মূল্যায়ন করা অতি কঠিন কাজ এবং অনেকের কাছে অপ্রয়োজনীয়, আবার অনেকের কাছে প্রয়োজনীয়। যা হোক, ১৯৪৭-এর আগস্টে স্বাধীনতা পাওয়া পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের দু’টি প্রদেশ ছিল। একটি পশ্চিম পাকিস্তান, আরেকটি পূর্ব পাকিস্তান। এই দুই প্রদেশের জনগণের মধ্যে যেসব বন্ধন ছিল সেগুলো বেশির ভাগই ছিল দুর্বল বা ঠুনকো। সবচেয়ে বড় বন্ধন ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস। অর্থাৎ ধর্মীয় পরিচয়ে পাকিস্তানের মেজরিটি জনগণ ছিলেন মুসলমান।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে, শাসক গোষ্ঠীর অন্যায় ও অত্যাচারের কারণে ক্রমান্বয়ে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণ তাদের ওপর সৃষ্ট বঞ্চনা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে থাকে। প্রতীকী অর্থেই বলতে পারি যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকেই শুরু। বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই চিন্তা করছিলেন যে, আমাদের স্বাধীন হওয়া উচিত। আবার অনেকেই চিন্তা করছিলেন, স্বাধীন না হয়ে একই পাকিস্তানের ভেতরে আরো মতাশীল হওয়া উচিত। একটি ক্ষুদ্র অংশের মনে এমন চিন্তা হচ্ছিল যে, আমরা পাকিস্তানেও থাকা উচিত না, স্বাধীনও হওয়া উচিত না, বরং আমরা ঐতিহাসিক বঙ্গ প্রদেশের অবস্থায় ফিরে যাওয়া এবং বৃহত্তর ভারতের অঙ্গীভূত হওয়া উচিত।
সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পে ও বিপে গণভোটের ফলাফল সবাই জানে। এখন থেকে পঞ্চাশ বছর বা ষাট বছর আগে ফিরে যাই। দেশে দেশে মানুষ স্বাধীনতা যেমন চেয়েছে, তার বিকল্পও চিন্তা করেছে। স্কটল্যান্ডের কথা একটু আগেই বললাম। কানাডার বিখ্যাত প্রদেশ কিউবেক বা কুইবেক। এই প্রদেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য একাধিকবার রেফারেন্ডাম বা গণভোটের সুযোগ পেয়েছে। কুইবেকের জনগণ স্বাধীনতার পে যায়নি, তারা কানাডার সাথেই থাকতে চেয়েছে। নাইজেরিয়া হচ্ছে পশ্চিম আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ একটি বিখ্যাত দেশ। মুসলমান ও খ্রিষ্টান এখানে প্রধান জনগোষ্ঠী। ১৯৭০ সালের দিকে নাইজেরিয়ার পূর্বাংশের একটি প্রদেশ, যার নাম বায়াফ্রা, স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। নাইজেরিয়া সরকার সেই ঘোষণাকে মেনে নেয়নি এবং ওই বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন করার জন্য সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। প্রায় তিন বছর যুদ্ধ চলে। এতে বিদ্রোহী বা একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণাকারী, বায়াফ্রার বাহিনী পরাজিত হয়। ইন্দোনেশিয়া নামক মুসলমানপ্রধান দেশে বড় ছোট হাজারের অধিক দ্বীপ আছে। ইন্দোনেশিয়ার দূর পূর্বাংশে অবস্থিত একটি দ্বীপের নাম তিমুর যার একটি অংশ খ্রিষ্টান অধ্যুষিত। এই অংশ ইন্দোনেশিয়া থেকে স্বাধীন হওয়ার জন্য প্রায় ৯ বছর যুদ্ধ করে। অতঃপর তারা স্বাধীন হয়। তাদের স্বাধীনতায় জাতিসঙ্ঘ এবং প্রতিবেশী দেশ অস্ট্রেলিয়া সহায়তা করেছে। এখন থেকে প্রায় ৩৪-৩৫ বছর আগে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের জনগণের একটি অংশ, ভারত থেকে স্বাধীন হয়ে নতুন একটি রাষ্ট্র (নাম : খালিস্তান) প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিল। তাদের এ সংগ্রাম ও আন্দোলনে আধ্যাত্মিক ও গোপন রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল অমৃতসর শহরের স্বর্ণমন্দির। একপর্যায়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে স্বর্ণমন্দিরের অভ্যন্তরের স্বাধীনতাকামী বা বিদ্রোহী বা রাষ্ট্রদ্রোহীদের দমন করে। বর্তমান ভারতের উত্তর পশ্চিম অংশে একটি প্রদেশের নাম জম্মু কাশ্মির। সেখানকার জনগণের একটি অংশ ৫০-৬০ বছর ধরে সংগ্রাম করছে ভারত থেকে স্বাধীন হওয়ার জন্য। কোনো সময় সংগ্রাম তীব্র হয় কোনো সময় সংগ্রাম ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত স্বাধীন হয় তখন বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরপূর্বে ভারতীয় ভূখণ্ডে, মাত্র একটি প্রদেশ ও দু’টি মহারাজা শাসিত রাজ্য ছিল। পুরো এলাকাটি ছিল একটি প্রদেশ যার নাম ছিল আসাম এবং মহারাজা শাসিত রাজ্যগুলোর নাম ছিল ত্রিপুরা ও মনিপুর। এখন বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে, ভারতের সাতটি রাজ্য বা প্রদেশ আছে। ১৯৫২ সালে প্রথম নাগাল্যান্ড (তখনো প্রদেশ হয়নি) স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের ঢেউ লেগে অনেক জায়গায় সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। ভারত সরকার তাদেরকে স্বাধীনতা না দিয়ে দেশের মর্যাদা দেয়। এখনও উত্তর-পূর্ব ভারতে আসাম বা নাগাল্যান্ড ইত্যাদি অঞ্চলে ভারত থেকে স্বাধীনতা চায় এমন মানুষ একদম নেই বললে ভুল হবে। তবে আন্দোলন এখন ম্রিয়মাণ।
বাংলাদেশের সর্বদণি পূর্বে অবস্থিত রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানÑ এই তিনটি জেলাকে সম্মিলিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বলা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের একটি অংশ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়নি। তারা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছিল। এই পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের একটি অংশ তথা সর্ববৃহৎ উপজাতি ‘চাকমা’দের বৃহদাংশ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি বরং পাকিস্তানের সাফল্যই কামনা করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত প্রকাশ্যে ঘোষিতভাবে সেই পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রবিরোধী ও সরকারবিরোধী সশস্ত্র বিদ্রোহ পরিচালিত হয়েছে। বিদ্রোহ পরিচালনাকারী দলের গোপন দলের নাম ছিল ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ এবং তাদের সশস্ত্র অংশের নাম ছিল ‘শান্তিবাহিনী’। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহীরা প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেনি সত্য; কিন্তু অপ্রকাশ্যে তারা স্বাধীনতার জন্যও যুদ্ধ করছিল। দীর্ঘ দিন গুরুত্বপূর্ণ পদে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরি করার সুবাদে, এ মন্তব্য করছি। মওলা ব্রাদার্স কর্তৃক প্রকাশিত, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ-পরিস্থিতির মূল্যায়ন’ নামে আমার লেখা ৩৮৫ পৃষ্ঠার বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে এ বিষয়ে। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র আন্দোলন, কৌশলগতভাবে ম্রিয়মাণ; কিন্তু ভিন্ন আঙ্গিকে পরিচালিত হচ্ছে।
সামরিক ইতিহাসের একজন ছাত্র এবং অধুনা সমকালীন রাজনীতির একজন ছাত্র হওয়ার সুবাদে আমার মূল্যায়ন হলো, যেখানেই স্বাধীনতা এসেছে বা স্বাধীনতার সংগ্রাম হয়েছে, সেখানেই কিছু কাজ অপ্রকাশ্যে হয়েছে, কিছু কাজ প্রকাশ্যে হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক ও বাস্তব। যেখানেই কোনো না কোনো জনগোষ্ঠী তাদের জন্য স্বাধীনতা চেয়েছে, সেখানেই প্রতিবেশী জনগোষ্ঠী আনুষ্ঠানিকভাবে বা অনানুষ্ঠানিকভাবে হয় সাহায্য-সহযোগিতা করেছে অথবা অসহযোগিতা করেছে। কোনো একটি জনগোষ্ঠী বা কোনো একটি দেশ তার প্রতিবেশী একটি জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতা কামনায় বা স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করবে, নাকি অসহযোগিতা করবে, এর পেছনে অনেক কারণ থাকে। যেটা করলে তার লাভ, সেটাই করা হয়। যেমন স্কটল্যান্ড যেন স্বাধীন না হয়, তার জন্য ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশির ভাগ দেশই আধা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় প্রকাশ্যেই, পরোভাবে, স্কটল্যান্ডবাসীর স্বাধীনতার পরে অংশকে নিরুৎসাহিত করেছে। যখন ষাটের দশক পুরা এবং সত্তরের দশকের শুরুর দিকে, উত্তর ভিয়েতনামভিত্তিক ভিয়েতকং বাহিনী, আমেরিকা-বান্ধব দণি ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল, একটি কমিউনিস্ট ভিয়েতনাম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছিল, তখন ভিয়েতনামের উত্তরের বৃহৎ প্রতিবেশী চীন তাদেরকে প্রভূত সাহায্য করেছিল। একপর্যায়ে দণি ভিয়েতনাম মার্কিন প্রভাবমুক্ত এবং একক ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পরের পনেরো-বিশ বছর যেকোনো কারণেই হোক না কেন, চীন ও ভিয়েতনামের সম্পর্কে অবনতি আসে। অপরপে ৯ বছর গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া মাত্রই পূর্ব তিমুর নামক রাষ্ট্রটি তাদের সাবেক শাসক ইন্দোনেশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব গভীর থেকে গভীরতর করেছে। যা হোক ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাই।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি অংশ স্বাধীনতা চাচ্ছিলেন এবং এ জন্য গোপন প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। তারা কৌশলী পদপে নিচ্ছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত সেই প্রস্তুতিতে গোপনে বা আধা প্রকাশ্যে সাহায্য করছিল। অপর ভাষায়, আমাদের স্বাধীনতাকামীরা সহযোগিতা নিচ্ছিলেন ও পাচ্ছিলেন। এর বিস্তারিত বিবরণ কোনো দিনই প্রকাশিত হয়নি। না হওয়ারই কথা। এখন ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হচ্ছে ইচ্ছায় হোক বা ঘটনাক্রমে হোক। এই কলামের প্রথম অনুচ্ছেদে দু’টি বইয়ের উল্লেখ করেছি, যেই দু’টি বইয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও তার পূর্ব-প্রস্তুতি নিয়ে আলোচিত হয়েছে। এই দু’টি বই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এই মুহূর্তে অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আলোচনার বিষয়বস্তু, ১৯৬০-এর দশকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য, তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতারা বা আওয়ামীপন্থী রাজনীতিবিদেরা কী কী পদপে নিয়েছিলেন; বিশেষ করে ভারতের সাথে সহযোগিতার ত্রে কিভাবে বিস্তৃত করা হচ্ছিল; কিন্তু ওই আমলের সরকারি গোয়েন্দা বা ওই আমলের স্বাধীনতাকামীদের প্রতিপ রাজনৈতিক শক্তি, ওই রূপ ভারতীয় সাহায্য-সহযোগিতা এবং ভারতীয় উৎসাহের কথা জানত। এখন ২০১৪ সালে, পেছনের দিকে তাকিয়ে আমরা কেউ কেউ প্রশ্ন করছি এবং কেউ কেউ উত্তর দিচ্ছি যে, ওই রূপ ভারতীয় সাহায্য-সহযোগিতার পরিমাণ বা ব্যাপ্তি কতটুকু ছিল? যেকোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি চূড়ান্ত ল্য ও রোডম্যাপ থাকে। যদি রাজনৈতিক আন্দোলনের ল্য হয় স্বাধীনতা, তাহলে তার চূড়ান্ত ধাপের প্রস্তুতি ও কর্ম কী হবে বা কী হতে পারে সেটা অনেক দিন পর্যন্ত অনিশ্চিত থাকে। অনিশ্চিত শব্দটি অপছন্দ হলে আমরা অপ্রকাশিত বলতে পারি। আমাদের বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, ষাটের দশকের শেষে, সত্তরের দশকের শুরুতে রাজনৈতিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি হয়েছিল সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ। নিরস্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সশস্ত্র স্বাধীনতার যুদ্ধ, এই দু’টির মধ্যে সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য; কিন্তু দুয়ের পরিচয় আলাদা। বাংলাদেশের েেত্র সশস্ত্র যুদ্ধ হয়েছিল প্রকাশ্যে, পৃথিবীকে সাী রেখে। বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী ছিল প্রতিবেশী ভারত। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত কি সব কিছু নিঃস্বার্থভাবে, নির্মোহভাবে, প্রতিদানের আশা না করেই সাহায্য করেছিল? নাকি প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত শর্তে, স্বার্থ উদ্ধারের ল্েয এবং প্রতিদান পাওয়ার পরিকল্পনায় এই সাহায্য করেছিল? নাকি কিছুটা স্বার্থ কিছুটা নিঃস্বার্থভাবে করেছিল? এসব প্রশ্নের আলোচনা আমাদের করা প্রয়োজন।
তবে ‘আমাদের’ বলতে কাকে বোঝাই, এটি একটি কঠিন প্রশ্ন। আমার বয়স ৬৫ শেষ হয়ে ৬৬ মাত্র শুরু হলো। আমি ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা। যারা আজকে তরুণ, যাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আগামী দিনের বাংলাদেশের প্রকৃতির ওপর, তারা ইতিহাসের জন্য কতটুকু সময় দেবে? এর থেকেও বড় প্রশ্ন, কতটুকু সময় আমরাই বা তাদের কাছে চাইতে পারি ইতিহাস শোনার জন্য? কথাগুলো এ জন্য বললাম যে, মাঝে মধ্যেই বাংলাদেশের বড় বড় পত্রিকার কলাম লেখার জায়গাগুলো এবং টেলিভিশন টকশোর বিষয়বস্তু এই প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎÑ এই তিনটির মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রয়োজন। ব্যবসায়িক উন্নয়ন, রাজনৈতিক উন্নয়ন ও সামরিক উন্নয়নÑ এই তিনটির মধ্যে ভারসাম্য প্রয়োজন। অতীতের বন্ধু, বর্তমানের বন্ধু ও ভবিষ্যতের বন্ধু, এই তিনটির মধ্যেও ভারসাম্য প্রয়োজন। অর্থাৎ ত্রিমাত্রিক ভারসাম্য প্রয়োজন।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
No comments