বেতন কমিশনের সুপারিশ ও বাস্তবতা by আলী ইমাম মজুমদার

সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি সংবাদে বলা হয়েছে, বেতন ও চাকরি কমিশন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করবে। তাদের সুপারিশে থাকবে বিভিন্ন স্তরে সর্বোচ্চ ৭০ হাজার, সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা বেতন নির্ধারণ। বিদ্যমান কাঠামোয় ২০টি গ্রেডের অষ্টম ও নবম আর একাদশ ও দ্বাদশ ধাপকে একীভূত করে ১৮টি করার প্রস্তাব তারা করবে বলে সে খবরেই জানা গেছে। আরও জানা যায়, তারা স্বাস্থ্যবিমা, জীবনবিমা ও দুর্ঘটনাজনিত অক্ষমতা বিমার সুপারিশও করতে যাচ্ছে। তারা সরকারি কর্মচারীদের ২০ জনের জন্য একটি প্লট এবং বিনা সুদে বাড়ি তৈরির ঋণ দেওয়ার সুপারিশও করতে পারে। অবসরসুবিধা, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, যাতায়াত, আপ্যায়ন, প্রেষণ, মহার্ঘ, উৎসব ও শ্রান্তি বিনোদন, ধোলাই ভাতা, টেলিফোন, গাড়ি ও মুঠোফোনবিষয়ক আর্থিক সুবিধা এবং রেশনসুবিধা-সংক্রান্ত ভাতাদি যৌক্তিকীকরণের প্রস্তাবও তাদের সুপারিশে থাকবে বলে জানা গেছে। সেই সুপারিশে আরও থাকবে টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড ও ইনক্রিমেন্টের ক্ষেত্রে বর্তমান অসংগতি দূর করা। এসব প্রস্তাবিত সুপারিশের কয়েকটি সম্পর্কে কমিশনের চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের ধারণা দিয়েছেন। বেশির ভাগ তথ্যই অন্যান্য সূত্র থেকে সংগৃহীত। কেননা, এখনো বিষয়গুলোর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। যুগবাহিত ধারাবাহিকতায় গত বছরের ২৪ নভেম্বর এ কমিশন গঠিত হয়। সাধারণত প্রতি পাঁচ বছর পর পর এরূপ হয়ে থাকে। তারা সরকারের সামর্থ্য আর কর্মচারীদের চাহিদার সঙ্গে সংগতি বিধানের প্রচেষ্টা নেয়। বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী ১৪ ডিসেম্বর। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে এ কমিশন। তিনি একজন প্রাজ্ঞ, কর্মনিষ্ঠ ও সজ্জন ব্যক্তি। কমিশন ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রশ্নমালা বিতরণ ও উত্তর সংকলন করেছে। কমিশনের সদস্যরা কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সুপারিশ নিতে। এই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে নিজদের প্রজ্ঞার আলোকে তঁাদের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। সংশ্লিষ্ট সবাই আশা করছেন, আলোচ্য প্রতিবেদনটি তাঁদের প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে। ইতিমধ্যে সংবাদপত্রে যেটুকু তথ্য এসেছে, তাতে স্বাস্থ্যবিমা, জীবনবিমা কিংবা অক্ষমতাজনিত বিমার প্রস্তাবগুলো প্রশংসনীয়। এ ধরনের উদ্যোগ আগে নেওয়া হয়নি। বাড়ি করার জন্য ২০ জনকে একটি প্লট আর সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব সরকারি কর্মচারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

চারটি স্কেলকে একীভূত করে দুটিতে আনার বিষয়টি একটু ভেবে দেখার আছে। স্বাধীনতার আগে এ দেশে কয়েক হাজার বেতন স্কেল ছিল। ১৯৭৩ সালে হয় ১০টি। আর ১৯৭৭ সালে সেটা ২০টিতে উন্নীত হয়। এযাবৎ তা-ই আছে। বড় রকমের কোনো সমস্যার সৃষ্টি না হলে এ ধরনের সমন্বয়ে আপত্তি থাকার কথা নয়। এখন নবম ধাপ প্রথম শ্রেণির পদের সূচনাস্তর। একীভূত হলে সেই স্তর হবে বর্তমানের অষ্টম ধাপ। ভাতার যৌক্তিকীকরণ কোনটিকে কীভাবে করবেন, তার সুপারিশ জানা না গেলে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তবে সরকারি বাড়ি থাকা সত্ত্বেও সেখানে না থেকে বেশ কিছু কর্মকর্তা বাড়িভাড়ার ভাতা নিচ্ছেন। বিশেষ করে জেলা ও উপজেলায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। কেউ কেউ সার্কিট হাউস, ডাকবাংলো, রেস্ট হাউসে নামমাত্র ভাড়ায় ইচ্ছা করেই থাকছেন মাসের পর মাস। তাঁদের বাড়িভাড়ার ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা কার্যকরভাবে বন্ধ করা সংগত হবে। যাঁরা রেশন–সুবিধা ভোগ করছেন, তাঁরা তা করবেন। পাশাপাশি বেসামরিক নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের এ সুবিধার আওতায় আনা যৌক্তিক ও সময়ের দাবি। ঝুঁকিভাতা নিচ্ছেন অনেকেই। পার্বত্য অঞ্চলের জন্য রয়েছে পাহাড়ি ভাতা। কিন্তু সুদূর দ্বীপাঞ্চলে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের সবাইকে ঝুঁকি ভাতার আওতায় আনাও ন্যায়সংগত হবে। তবে গাড়ির প্রাধিকারের মতো অনেক বিষয় নতুন করে উন্মোচন করা হলে নিষ্পত্তি কঠিন হবে।
উল্লেখ্য, কমিশনের সুপারিশ সরকার আর্থিক সীমাবদ্ধতার জন্য পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারে না। তা ছাড়া চাকরিঘটিত সুপারিশে নীতিগত দিকও থাকে। সাম্প্রতিক কালের রেওয়াজ হচ্ছে, প্রতিবেদন পাওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি সচিব কমিটি এর আর্থিক সংশ্লেষ পর্যালোচনা করে। বিবেচনায় রাখে সরকারের সম্পদের বিষয়টি। এর ভিত্তিতে তাদের সুপারিশ যায় মন্ত্রিসভায়। তখন মন্ত্রিসভা যেভাবে যৌক্তিক মনে করে, সেভাবেই এটাকে অনুমোদন দিতে পারে। যেকোনো ধরনের সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রের আবশ্যক হন সামরিক ও বেসামরিক বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী। স্বাভাবিকভাবে তাঁদের জীবনের মৌলিক চাহিদার বিষয়টি সব সরকারের বিবেচনাতেই থাকে। আর সেই চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে বেতন-ভাতাদিসহ অন্যান্য সুবিধা দিতে হয়। এগুলো সময়ে সময়ে নির্ধারণের জন্য সুপারিশ করতে আমাদের দেশে গঠন করা হয় বেতন কমিশন। অনেক দেশে স্থায়ী বেতন কমিশন আছে। কোথাও আছে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সংগতি রেখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেতন বাড়ার পদ্ধতি। আমাদের এখানে স্থায়ী বেতন কমিশন করার জন্য বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কিন্তু এবার তারা তা করল না। বর্তমান কমিশন স্বীয় বিবেচনায় সুপারিশ করতে পারে, চূড়ান্তভাবে ধার্যকৃত বেতন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৃদ্ধি পাবে। এটি ন্যায়বিচার ও যুক্তির কথা। বেতন কমিশন গঠিত হলেই কেউ কেউ বলতে থাকেন মূল্যস্ফীতি হবে। সরকারের মোট ব্যয়ের কমবেশি ১৪ শতাংশ যায় কর্মচারীদের বেতন-ভাতার খাতে। সুতরাং এ ব্যায়ের একটি অংশ বাড়লে তেমন মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা থাকবে বলে মনে হয় না।
প্রকাশিত খবরের আলোকে কয়েকটি বিষয় আলোচনার দাবি রাখে। সংবাদপত্রে যেটুকু দেখা যায়, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন স্তরের মাঝে বেতনের অনুপাত ৭ ঃ১ করার জন্য কমিশন সুপারিশ করবে। বিষয়টি স্পর্শকাতর। সর্বনিম্ন স্তরের মৌলিক চাহিদা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। পাশাপাশি সর্বোচ্চ স্তরকে আকর্ষণীয় রাখার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আগে এ অনুপাত অনেক বেশি ছিল। ইদানীং ১০ ঃ১-এর কাছাকাছি। ভারতে ১২ ঃ ১। বর্তমান অনুপাত থেকে বিচ্যুতির জনপ্রিয় দাবি থাকতে পারে। কিন্তু যৌক্তিকতা দেওয়া খুবই কঠিন। একটি মাঝারি মানের ব্যাংকের এমডি লাখ পাঁচেক টাকা বেতন পান। সেখানে সর্বনিম্ন স্তরের সঙ্গে অনুপাতটা কত? অন্য অনেক বেসরকারি সংস্থার অবস্থাও তা-ই। এসব বিষয় আবেগবর্জিতভাবে দেখা প্রয়োজন। সরকারি চাকরিতে মেধাশূন্যতার অভিযোগ সবাই করেন। অথচ এটা দূর করতে যা করা আবশ্যক, তা কেউ করছেন না। এই মেধাশূন্যতার একটি কারণ অনাকর্ষণীয় বেতন। একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগ স্তরে এখন ১১ হাজার টাকা মূল বেতন পান। ভাতাদিসহ সাকল্যে ২০ হাজারের নিচে। এই বেতন কিছু বেসরকারি সংস্থার কম্পিউটার অপারেটর কিংবা রিসিপশনিস্টদের চেয়েও কম। এ স্তরটির বেতনকাঠামো সম্ভাব্য সর্বোচ্চ অনুপাতে বৃদ্ধির দাবি রাখে। কেননা, তাঁদের কেউ কেউ ভবিষ্যতে বিভিন্ন শীর্ষ পদে যাবেন। আমাদের সুশীল সমাজ রাষ্ট্রীয় খাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যৌক্তিক বেতন-ভাতা দিলে অনেকেই দুর্নীতি করবেন না, এটা বলা যায়। সুতরাং সরকারি কর্মচারীদের উপযুক্ত বেতনকাঠামোর দাবিতে সুশীল সমাজের জোর সমর্থন থাকা সংগত।
আসছি পেনশন প্রসঙ্গে। যাঁরা মাসে মাসে পেনশন নিচ্ছেন, তাঁদের পেনশনও আনুপাতিক হারে একই সময়ে বাড়ার কথা। আর যাঁরা একবারে সমগ্র অর্থ নিয়ে পেনশন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁরা এক বৈষম্যমূলক করনীতির শিকার। পেনশন আয়করমুক্ত। অথচ একবারে সেই পেনশন তুলে নিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে মুনাফায় পুরো আয়কর দিতে হয়। একসময় উৎসে কর কিছুটা কেটে একেবারে নিষ্পত্তি করা হতো। এসব হতভাগ্য পেনশনজীবীর আয়কর আগের নিয়মে কাটার ব্যবস্থা কমিশন সুপারিশ করতে পারে। পরিশেষে বলতে হয়, কমিশনের সুপারিশ সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। অতীতেও কখনো পারেনি। তা সত্ত্বেও যে কঠোর নিষ্ঠা ও উদ্যম নিয়ে বর্তমান কমিশন কাজ করছে, তা প্রশংসনীয়। আশা রইল তাদের সুপারিশে সরকারি কর্মচারীদের যৌক্তিক দাবি অনেকাংশে পূরণ হবে। সমৃদ্ধ হবে সরকারের প্রশাসনযন্ত্র।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.