মধ্যপ্রাচ্য- ক্রুসেডার ও জায়নবাদী by ইউরি আভনেরি
সম্প্রতি ‘ক্রুসেডার’ ও ‘জায়নবাদী’ শব্দ দুটি জড়াজড়ি করে ব্যবহৃত হচ্ছে। দিন কয়েক আগে আইএসের ওপর নির্মিত একটি তথ্যচিত্র দেখেছি আমি। এতে দেখা যায়, সব ইসলামি যোদ্ধা ও কিশোরই এ শব্দ দুটি ব্যবহার করছে। প্রায় ৬০ বছর আগে আমি ‘ক্রুসেডার ও জায়নিস্ট’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। সম্ভবত এ বিষয়ে সেটিই ছিল প্রথম লেখা। এর ব্যাপক বিরোধিতা শুরু হয়েছিল। বলা হচ্ছিল, ইহুদিরা একটি জাতি, তারা ক্রুসেডারদের (খ্রিষ্টীয় ধর্মযোদ্ধা) মতো নয়। ক্রুসেডাররা বর্বর, তারা সে সময়ের সভ্য মুসলমানদের মতো ছিল না। সে তুলনায় জায়নবাদীরা কৌশলগতভাবে শ্রেয়। জায়নবাদীরা তাদের কায়িক শ্রমের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
১৯৪৮ সালের যুদ্ধে আমার কমান্ডো ইউনিট ইসরায়েলের দক্ষিণে যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধের শেষে ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে এক টুকরা জমি মিসরীয়দের হাতে থেকে গিয়েছিল। আমরা এটার নাম দিলাম ‘গাজা উপত্যকা’, আর এর চারপাশ ঘিরে নজরদারি চৌকি গড়ে তুললাম। তার কয়েক বছর পরে আমি স্টিভেন রানসিম্যানের আ হিস্টরি অব দ্য ক্রুসেডস শীর্ষক ঢাউস বইটি পড়ি। সেখানে উল্লিখিত দুটি ঘটনার কৌতূহলোদ্দীপক ও আকস্মিক যোগাযোগের প্রতি আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। বিষয়টা এ রকম: প্রথম ক্রুসেডের পর সমুদ্রের ধারঘেঁষে একখণ্ড জমি মিসরীয়দের হাতে চলে গিয়েছিল, এর বিস্তৃতি গাজা ছাড়িয়ে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। ক্রুসেডাররা সেখানে একটি দুর্গ নির্মাণ করে সেটা রক্ষার চেষ্টা করে। আজ আমাদের পর্যবেক্ষণ ফাঁড়ি যেখানে অবস্থিত, ঠিক সেখানেই তারা অবস্থান নিয়েছিল।
বইটির তিনটি খণ্ড পড়ার পর আমি এমন কিছু করলাম, যা আমি আগে কখনো করিনি বা তার পরও আর করিনি। লেখকের কাছে আমি একটি চিঠি লিখলাম। চিঠিতে বইটির অনেক প্রশংসা করার পর আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম, আপনি কি তাদের ও আমাদের মধ্যে কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন? তিন দিনের মধ্যেই আমি উত্তর পেলাম। তিনি শুধু এ বিষয়ে একবার ভাবেননি, এ চিন্তা সব সময় তাঁর মাথায় উঁকি দিচ্ছে। তিনি উল্লিখিত বইটির উপশিরোনাম দিতে চেয়েছিলেন এ রকম: ‘আ গাইড ফর জায়োননিস্ট অন হাউ নট টু ডু ইট’। পরবর্তীকালে তাঁর আহ্বানে লন্ডনে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তাঁকে দেখে আমি বেশ অভিভূত হয়েছিলাম। ক্রুসেডার-জায়নবাদীবিষয়ক আলেচনায় ডুব দেওয়ার পর আমাদের সময় যে কীভাবে কেটে গিয়েছিল, তা টেরও পাইনি। চার ঘণ্টা ধরে আমরা ব্যক্তিমানুষ ও ঘটনাগুলোর মধ্যকার তুলনা টেনেছি।
ক্রুসেড ও জায়নবাদের উত্থানের ঐতিহাসিক দুটি ঘটনার মধ্যে ছয় শতাব্দীর ব্যবধান। এমনকি ঘটনা দুটির রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক পরিপ্রেক্ষিতও একদম আলাদা। কিন্তু কিছু সাদৃশ্যও খুব পরিষ্কার। এই ক্রুসেডার ও জায়নবাদী উভয় গোষ্ঠীই পশ্চিম থেকে এসে ফিলিস্তিন আক্রমণ করেছে। তাদের পেছনে ছিল সমুদ্র ও ইউরোপ, আর সামনে ছিল মুসলিম-আরব বিশ্ব। তারা সব সময় যুদ্ধে লিপ্ত থেকেছে। সে সময় ইহুদিরা নিজেদের আরবদের ভাই মনে করত। ক্রুসেডাররা পবিত্র ভূমিতে ফিরে যাওয়ার পথে রাইন নদীর ধারে বহু ইহুদি হত্যা করেছে, এই বিষয়টি ইহুদিদের চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। জেরুজালেম দখল করার পর ক্রুসেডাররা আরও একটি জঘন্য অপরাধ করেছে, তারা সেখানকার সব ইহুদি ও মুসলমান অধিবাসীকে হত্যা করে। নারী ও শিশু কেউই সে যাত্রায় রেহাই পায়নি। ক্রুসেডাররা রক্তে পা ডুবিয়ে হেঁটেছে, একজন খ্রিষ্টান ভাষ্যকার এভাবেই এর বিবরণ দিয়েছেন।
আমি ক্রুসেডারদের ঘৃণা করেই বড় হয়েছি। কিন্তু মুসলমানরাও যে ক্রুসেডারদের এত ঘৃণা করে, তা আমি জানতাম না। আরব-ইসরায়েলি লেখক এমিল হাবিবিকে ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি অংশীদারত্বে স্বাক্ষর করার আহ্বান জানালে আমি বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারি। এতে আমি উল্লেখ করেছিলাম, কীভাবে অতীতে বিভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে হাইফা শহর সমৃদ্ধ হয়েছে। হাবিবি যখন দেখলেন, আমি ক্রুসেডারদের নামও এতে যুক্ত করেছি, তিনি তখন স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি রাগে গড়গড় করতে করতে বলেন, ‘ক্রুসেডাররা নির্মম খুনি’। আরবরা আমাদের (ইসরায়েলিদের) ক্রুসেডারদের সঙ্গে একই কাতারে ফেলে। তারা এটা দ্ব্যর্থহীনভাবেই মনে করে, তাদের দেশে আমরাও বিদেশি এবং অনাহূত প্রবেশকারী—এ দেশ ও অঞ্চলে আমরা আগন্তুক। সে কারণেই এ তুলনা খুব বিপজ্জনক। আরবরা যদি ছয় দশক পরও আমাদের বিরুদ্ধে এরূপ ঘৃণা পোষণ করে, তাহলে আমাদের মিলন হবে কীভাবে? আমরা আসলেই একই রকম কি না, এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে সময় নষ্ট করার চেয়ে আমাদের উচিত হবে, ক্রুসেডারদের ইতিহাস থেকে কিছু শিক্ষা নেওয়া।
প্রথম শিক্ষাটি আমাদের পরিচয়সংক্রান্ত। আমরা কে? আমরা কি ইউরোপীয়, যারা একটি প্রতিকূল অঞ্চলে এসে পড়েছি? আমরা কি ‘এশীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে একটি দেয়াল’, থিওডোর হার্জল যেটা বলেছেন। নাকি এহুদ বারাকের ভাষ্যমতে, আমরা ‘জঙ্গলের মধ্যে মনোরম বসতির মতো’? সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমরা কি নিজেদের ইউরোপীয় মনে করি? নাকি একটি ভুল মহাদেশে আমরা হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। আমার কাছে মনে হয়, এটাই হচ্ছে জায়নবাদের মৌলিক প্রশ্ন—একদম প্রথম দিন থেকে শুরু করে গতকাল পর্যন্ত। আমার পুস্তিকা ‘ওয়্যার অর পিস ইন দ্য সেমিটিক রিজিয়ন’-এর প্রথম বাক্যেই আমি এ প্রশ্ন তুলেছিলাম। ক্রুসেডারদের জন্য এটা কোনো প্রশ্নই নয়। তারা ছিল ইউরোপীয় নাইটদের মুকুটের ফুলের মতো, যারা সারাসেনদের (মুসলমানদের ইউরোপীয় নাম) সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছিল। তারা আরব শাসকদের সঙ্গে সন্ধি করেছে, মূলত দামেস্কের আমিরের সঙ্গে। কিন্তু তাদের মূল শত্রু ছিল মুসলমানরাই।
ইসরায়েলও ঠিক একই অবস্থায় আছে। এটা সত্য, আমরা কখনো স্বীকার করি না যে আমরা যুদ্ধ চাই; বরং বলি যে আরবরা শান্তি চায় না। কিন্তু সেই প্রথম দিন থেকেই ইসরায়েল রাষ্ট্র তার সীমানা নির্ধারণে টালবাহানা করছে। উল্টো তারা প্রতিদিনই বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের সীমানা বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছে—ক্রুসেডাররা ঠিক যা করেছিল। আজ আমাদের ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৬৬ বছর পরও ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যমে অর্ধেকের বেশি খবর থাকে আরবদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ নিয়ে। ইসরায়েল নিরাপত্তা আতঙ্কে ভুগছে, এর মূল অনেক গভীরে প্রোথিত, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে আবার নানাভাবেই। কিন্তু ইসরায়েলের সফলতা দৃষ্টি আকর্ষক, তার সামরিক শক্তিও বিশ্বমানের। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে এই শঙ্কার বিষয়টি সত্যিই আজগুবি—বোধগম্য নয়। আসলে যে অঞ্চলে আমরা বাস করছি, সেখানে আমাদের নাড়ি পোঁতা নেই। অন্য কথায়, আমরা মনে করি, ইসরায়েল জঙ্গলের মধ্যে ঘর বানিয়ে থাকছে।
আরকেটি শিক্ষা হচ্ছে, অভিবাসন নিয়ে ঐকান্তিকভাবে চিন্তা করা। ক্রুসেডারদের সমাজে সব সময়ই যাওয়া-আসা ছিল। ইসরায়েলের উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা পরিবারসহ বার্লিন ও অন্যান্য ইউরোপীয় এবং মার্কিন শহরের উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করছে। সময় এসেছে হিসাব মেলানোর, কতজন মানুষ সেমিটীয় বিরোধিতার জ্বালায় ইসরায়েলে এসেছে, আর কতজন ডানপন্থী চরমপন্থা ও যুদ্ধের কারণে ইউরোপে ফেরত যাচ্ছে। এটাই হচ্ছে ট্র্যাজেডি। হ্যাঁ, ক্রুসেডারদের হাতে পরামাণবিক বোমা ও জার্মান সাবমেরিন ছিল না। যখন আইএস ও অন্য আরবরা ক্রুসেডার শব্দবন্ধটি ব্যবহার করে, তখন তারা শুধু মধ্যযুগের হামলাকারীদের প্রতিই ইঙ্গিত করে না। তারা সব মার্কিন ও ইউরোপীয় খ্রিষ্টানকেও এর মধ্যে ফেলে। আর যখন জায়নবাদীদের সম্পর্কে বলে, তখন তারা সব ইসরায়েলি ইহুদি ও কখনো কখনো সব ইহুদিকেই বুঝিয়ে থাকে। আমি মনে করি, এই দুটি শব্দের মধ্যে মেলবন্ধন খোঁজার ব্যাপারটি খুবই বিপজ্জনক। আইএসের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে আমি মোটেও ভীত নই, কিন্তু তাদের মতাদর্শের শক্তি নিয়ে শঙ্কিত। তাদের সামরিক শক্তি খুবই নগণ্য পর্যায়ের। কিন্তু কোনো মার্কিন বোমারু বিমানই বোমা মেরে এই মতাদর্শ ধ্বংস করতে পারবে না।
সময় বয়ে যাচ্ছে, আমাদের উচিত হবে ক্রুসেডারদের থেকে বিযুক্ত হওয়া, তা সে প্রাচীন বা আধুনিক যা-ই হোক না কেন। ফিলিস্তিনের মাটিতে প্রথম কোনো আধুনিক জায়নবাদী পা রেখেছেন আজ থেকে ১৩২ বছর আগে, নিজেদের ঠিকুজি ঠিক করার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; ইন্টারনেট থেকে নেওয়া
ইউরি আভনেরি: ইসরায়েলি লেখক।
১৯৪৮ সালের যুদ্ধে আমার কমান্ডো ইউনিট ইসরায়েলের দক্ষিণে যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধের শেষে ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে এক টুকরা জমি মিসরীয়দের হাতে থেকে গিয়েছিল। আমরা এটার নাম দিলাম ‘গাজা উপত্যকা’, আর এর চারপাশ ঘিরে নজরদারি চৌকি গড়ে তুললাম। তার কয়েক বছর পরে আমি স্টিভেন রানসিম্যানের আ হিস্টরি অব দ্য ক্রুসেডস শীর্ষক ঢাউস বইটি পড়ি। সেখানে উল্লিখিত দুটি ঘটনার কৌতূহলোদ্দীপক ও আকস্মিক যোগাযোগের প্রতি আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। বিষয়টা এ রকম: প্রথম ক্রুসেডের পর সমুদ্রের ধারঘেঁষে একখণ্ড জমি মিসরীয়দের হাতে চলে গিয়েছিল, এর বিস্তৃতি গাজা ছাড়িয়ে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। ক্রুসেডাররা সেখানে একটি দুর্গ নির্মাণ করে সেটা রক্ষার চেষ্টা করে। আজ আমাদের পর্যবেক্ষণ ফাঁড়ি যেখানে অবস্থিত, ঠিক সেখানেই তারা অবস্থান নিয়েছিল।
বইটির তিনটি খণ্ড পড়ার পর আমি এমন কিছু করলাম, যা আমি আগে কখনো করিনি বা তার পরও আর করিনি। লেখকের কাছে আমি একটি চিঠি লিখলাম। চিঠিতে বইটির অনেক প্রশংসা করার পর আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম, আপনি কি তাদের ও আমাদের মধ্যে কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন? তিন দিনের মধ্যেই আমি উত্তর পেলাম। তিনি শুধু এ বিষয়ে একবার ভাবেননি, এ চিন্তা সব সময় তাঁর মাথায় উঁকি দিচ্ছে। তিনি উল্লিখিত বইটির উপশিরোনাম দিতে চেয়েছিলেন এ রকম: ‘আ গাইড ফর জায়োননিস্ট অন হাউ নট টু ডু ইট’। পরবর্তীকালে তাঁর আহ্বানে লন্ডনে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তাঁকে দেখে আমি বেশ অভিভূত হয়েছিলাম। ক্রুসেডার-জায়নবাদীবিষয়ক আলেচনায় ডুব দেওয়ার পর আমাদের সময় যে কীভাবে কেটে গিয়েছিল, তা টেরও পাইনি। চার ঘণ্টা ধরে আমরা ব্যক্তিমানুষ ও ঘটনাগুলোর মধ্যকার তুলনা টেনেছি।
ক্রুসেড ও জায়নবাদের উত্থানের ঐতিহাসিক দুটি ঘটনার মধ্যে ছয় শতাব্দীর ব্যবধান। এমনকি ঘটনা দুটির রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক পরিপ্রেক্ষিতও একদম আলাদা। কিন্তু কিছু সাদৃশ্যও খুব পরিষ্কার। এই ক্রুসেডার ও জায়নবাদী উভয় গোষ্ঠীই পশ্চিম থেকে এসে ফিলিস্তিন আক্রমণ করেছে। তাদের পেছনে ছিল সমুদ্র ও ইউরোপ, আর সামনে ছিল মুসলিম-আরব বিশ্ব। তারা সব সময় যুদ্ধে লিপ্ত থেকেছে। সে সময় ইহুদিরা নিজেদের আরবদের ভাই মনে করত। ক্রুসেডাররা পবিত্র ভূমিতে ফিরে যাওয়ার পথে রাইন নদীর ধারে বহু ইহুদি হত্যা করেছে, এই বিষয়টি ইহুদিদের চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। জেরুজালেম দখল করার পর ক্রুসেডাররা আরও একটি জঘন্য অপরাধ করেছে, তারা সেখানকার সব ইহুদি ও মুসলমান অধিবাসীকে হত্যা করে। নারী ও শিশু কেউই সে যাত্রায় রেহাই পায়নি। ক্রুসেডাররা রক্তে পা ডুবিয়ে হেঁটেছে, একজন খ্রিষ্টান ভাষ্যকার এভাবেই এর বিবরণ দিয়েছেন।
আমি ক্রুসেডারদের ঘৃণা করেই বড় হয়েছি। কিন্তু মুসলমানরাও যে ক্রুসেডারদের এত ঘৃণা করে, তা আমি জানতাম না। আরব-ইসরায়েলি লেখক এমিল হাবিবিকে ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি অংশীদারত্বে স্বাক্ষর করার আহ্বান জানালে আমি বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারি। এতে আমি উল্লেখ করেছিলাম, কীভাবে অতীতে বিভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে হাইফা শহর সমৃদ্ধ হয়েছে। হাবিবি যখন দেখলেন, আমি ক্রুসেডারদের নামও এতে যুক্ত করেছি, তিনি তখন স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি রাগে গড়গড় করতে করতে বলেন, ‘ক্রুসেডাররা নির্মম খুনি’। আরবরা আমাদের (ইসরায়েলিদের) ক্রুসেডারদের সঙ্গে একই কাতারে ফেলে। তারা এটা দ্ব্যর্থহীনভাবেই মনে করে, তাদের দেশে আমরাও বিদেশি এবং অনাহূত প্রবেশকারী—এ দেশ ও অঞ্চলে আমরা আগন্তুক। সে কারণেই এ তুলনা খুব বিপজ্জনক। আরবরা যদি ছয় দশক পরও আমাদের বিরুদ্ধে এরূপ ঘৃণা পোষণ করে, তাহলে আমাদের মিলন হবে কীভাবে? আমরা আসলেই একই রকম কি না, এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে সময় নষ্ট করার চেয়ে আমাদের উচিত হবে, ক্রুসেডারদের ইতিহাস থেকে কিছু শিক্ষা নেওয়া।
প্রথম শিক্ষাটি আমাদের পরিচয়সংক্রান্ত। আমরা কে? আমরা কি ইউরোপীয়, যারা একটি প্রতিকূল অঞ্চলে এসে পড়েছি? আমরা কি ‘এশীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে একটি দেয়াল’, থিওডোর হার্জল যেটা বলেছেন। নাকি এহুদ বারাকের ভাষ্যমতে, আমরা ‘জঙ্গলের মধ্যে মনোরম বসতির মতো’? সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমরা কি নিজেদের ইউরোপীয় মনে করি? নাকি একটি ভুল মহাদেশে আমরা হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। আমার কাছে মনে হয়, এটাই হচ্ছে জায়নবাদের মৌলিক প্রশ্ন—একদম প্রথম দিন থেকে শুরু করে গতকাল পর্যন্ত। আমার পুস্তিকা ‘ওয়্যার অর পিস ইন দ্য সেমিটিক রিজিয়ন’-এর প্রথম বাক্যেই আমি এ প্রশ্ন তুলেছিলাম। ক্রুসেডারদের জন্য এটা কোনো প্রশ্নই নয়। তারা ছিল ইউরোপীয় নাইটদের মুকুটের ফুলের মতো, যারা সারাসেনদের (মুসলমানদের ইউরোপীয় নাম) সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছিল। তারা আরব শাসকদের সঙ্গে সন্ধি করেছে, মূলত দামেস্কের আমিরের সঙ্গে। কিন্তু তাদের মূল শত্রু ছিল মুসলমানরাই।
ইসরায়েলও ঠিক একই অবস্থায় আছে। এটা সত্য, আমরা কখনো স্বীকার করি না যে আমরা যুদ্ধ চাই; বরং বলি যে আরবরা শান্তি চায় না। কিন্তু সেই প্রথম দিন থেকেই ইসরায়েল রাষ্ট্র তার সীমানা নির্ধারণে টালবাহানা করছে। উল্টো তারা প্রতিদিনই বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের সীমানা বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছে—ক্রুসেডাররা ঠিক যা করেছিল। আজ আমাদের ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৬৬ বছর পরও ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যমে অর্ধেকের বেশি খবর থাকে আরবদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ নিয়ে। ইসরায়েল নিরাপত্তা আতঙ্কে ভুগছে, এর মূল অনেক গভীরে প্রোথিত, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে আবার নানাভাবেই। কিন্তু ইসরায়েলের সফলতা দৃষ্টি আকর্ষক, তার সামরিক শক্তিও বিশ্বমানের। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে এই শঙ্কার বিষয়টি সত্যিই আজগুবি—বোধগম্য নয়। আসলে যে অঞ্চলে আমরা বাস করছি, সেখানে আমাদের নাড়ি পোঁতা নেই। অন্য কথায়, আমরা মনে করি, ইসরায়েল জঙ্গলের মধ্যে ঘর বানিয়ে থাকছে।
আরকেটি শিক্ষা হচ্ছে, অভিবাসন নিয়ে ঐকান্তিকভাবে চিন্তা করা। ক্রুসেডারদের সমাজে সব সময়ই যাওয়া-আসা ছিল। ইসরায়েলের উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা পরিবারসহ বার্লিন ও অন্যান্য ইউরোপীয় এবং মার্কিন শহরের উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করছে। সময় এসেছে হিসাব মেলানোর, কতজন মানুষ সেমিটীয় বিরোধিতার জ্বালায় ইসরায়েলে এসেছে, আর কতজন ডানপন্থী চরমপন্থা ও যুদ্ধের কারণে ইউরোপে ফেরত যাচ্ছে। এটাই হচ্ছে ট্র্যাজেডি। হ্যাঁ, ক্রুসেডারদের হাতে পরামাণবিক বোমা ও জার্মান সাবমেরিন ছিল না। যখন আইএস ও অন্য আরবরা ক্রুসেডার শব্দবন্ধটি ব্যবহার করে, তখন তারা শুধু মধ্যযুগের হামলাকারীদের প্রতিই ইঙ্গিত করে না। তারা সব মার্কিন ও ইউরোপীয় খ্রিষ্টানকেও এর মধ্যে ফেলে। আর যখন জায়নবাদীদের সম্পর্কে বলে, তখন তারা সব ইসরায়েলি ইহুদি ও কখনো কখনো সব ইহুদিকেই বুঝিয়ে থাকে। আমি মনে করি, এই দুটি শব্দের মধ্যে মেলবন্ধন খোঁজার ব্যাপারটি খুবই বিপজ্জনক। আইএসের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে আমি মোটেও ভীত নই, কিন্তু তাদের মতাদর্শের শক্তি নিয়ে শঙ্কিত। তাদের সামরিক শক্তি খুবই নগণ্য পর্যায়ের। কিন্তু কোনো মার্কিন বোমারু বিমানই বোমা মেরে এই মতাদর্শ ধ্বংস করতে পারবে না।
সময় বয়ে যাচ্ছে, আমাদের উচিত হবে ক্রুসেডারদের থেকে বিযুক্ত হওয়া, তা সে প্রাচীন বা আধুনিক যা-ই হোক না কেন। ফিলিস্তিনের মাটিতে প্রথম কোনো আধুনিক জায়নবাদী পা রেখেছেন আজ থেকে ১৩২ বছর আগে, নিজেদের ঠিকুজি ঠিক করার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; ইন্টারনেট থেকে নেওয়া
ইউরি আভনেরি: ইসরায়েলি লেখক।
No comments