একজন ভালো মানুষের গল্প by মুহাম্মদ মিজানুর রহমান
সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা ছোট্ট একটি গ্রাম। নাম মধুপুর। সত্যিই মায়া-মমতায়
ঘেরা ছোট্ট এই গ্রামটি। কৃষক, জেলে, তাঁতি আর কামার কুমোরের মিলনমেলা
স্বর্গের ছোঁয়ায় অপরূপ এ গ্রামখানি।
প্রাকৃতিক
সৌন্দর্যে অতুলনীয়। মানুষে মানুষে এখানে ভালোবাসার কী অপরূপ বন্ধন।
বিপদে-আপদে সবাই সবার অকৃত্রিম বন্ধু। অথচ দারিদ্র্য এখানে মানুষের
নিত্যসঙ্গী। তবুও শিশু-কিশোরদের প্রতি কারো ভালোবাসার কমতি নেই। এ যেন
রূপকথার এক অপরূপ গ্রাম। রাফি দরিদ্র এক কৃষক পরিবারের ছেলে। অভাব তাদের
পিছু ছাড়ছে না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা রাফিকে তুখোড় মেধা দিয়েছে। রাফিকে
নিয়ে তার বাবার অন্তহীন ভাবনা। এ যেন সোনার টুকরো ছেলে। সাত রাজার ধন।
অভাবকে সে জয় করেছে। রাফির মতো একটা হীরের টুকরো ছেলে পেয়ে। রাফি নম্র
ভদ্র। আলাপ ব্যবহারে সে সবার থেকে একটু আলাদা। কিছুটা ভাবুক প্রকৃতির।
শিশুরা সাধারণত এমন হয় না। সে মানুষের ভালোবাসার মান দিতে জানে। সে সব
সময় নিজেকে সত্যিকারের মানুষ গড়ার স্বপ্ন দেখে। সে ভাবে কিভাবে বাবাকে
দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা যায়। সে বাবার মুখে এক রাশ হাসি দেখতে
চায়। যে হাসি আনন্দের। সার্থকতার হাসি। দারিদ্র্যের কশাঘাতে বাবার মলিন
মুখে সে হাসি ফুটাবেই। এই তার পণ। রাফির খুব ভালো বন্ধু রনি। তার বাবা অনেক
বড় লোক। মাত্র কিছু দিন হয়েছে ওর মা মারা গেছে। ওরা দু’জনেই সরকারি বালক
উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র। রনির বাবা একজন সরকারি চাকরিজীবী। তিনি বিচারক।
মাত্র বছর খানেক হলো ওর বাবা এখানে বদলি হয়ে এসেছে। রনি খুব অমায়িক।
আভিজাত্য ওকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। সাদাসিধে জীবন ওর। হঠাৎ করে রাফির
বাবা মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তার দুটো পা-ই হারাল। রাফির পরিবারে নেমে
এলো শোকের ছায়া। একে তো পরিবারটি দরিদ্র। তার ওপর তাদের একমাত্র অবলম্বন
তার বাবা। সেও আজ বিছানায় পড়ে আছে। তার মা ভেবে ভেবে অস্থির। কিছুই সে
বুঝে উঠতে পারছে না। কী করে সে যে সংসারটা চালাবে। কোথায় পাবে সে অর্থ।
কিভাবে সে তার ছেলের লেখাপড়ার খরচ জোগাবে। কী করবে এখন সে? রাফির মায়ের
একটাই কথা, আমার ছেলেকে আমি মানুষ করবই। আমাকে যত পরিশ্রম করতে হোক না কেন।
রাফির মা কোনো উপায় না দেখে মানুষের বাসায় ঝিয়ের কাজ শুরু করল। ঘরে
অসুস্থ স্বামী। সংসার খরচ। ছেলের লেখাপড়া। তাকে তো একটা কিছু করতেই হবে।
রনি রাফির ভালো বন্ধু ঠিকই। কিন্তু রাফি কখনো তার পারিবারিক অবস্থার কথা
রনিকে বলেনি। ইদানীং রনির কাছে রাফিকে যেন কেমন মনে হচ্ছে। মনমরা মনমরা
ভাব। রনি রাফির বাবাকে একনজর দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিল। রাফির বাবার পা
হারানোর খবরটা সে জানে। কিন্তু রাফির পারিবারিক অবস্থার কথা সে জানে না।
বুধবার স্কুল একটু তাড়াতাড়ি ছুটি হলো। রনি বলল, রাফি আজ তো আমার হাতে
অনেক সময়। চলো তোমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। রাফি, তোর বাসা কত দূর রে।
রাফি বলল, এখান থেকে কাছেই। রাফি কী যেন ভাবছে। রনি বলল, এই রাফি তুই কী
ভাবছিস। তোর বাসায় যাব, এতে ভাবাভাবির কী আছে। চল, বলে রনি একটা রিকশায়
চেপে বসল। কী আর উপায়। রাফি রনিকে নিয়ে ওদের বাসায় গেল। রাফির মা বলল,
বাবা এই ভাঙা ঘরে তোমায় কোথায় বসতে দেবো। রনি বলল, আন্টি আপনি কী বলছেন।
আমিও তো আপনাদের মতো রক্ত মাংসের একজন মানুষ। হতে পারে আমার বাবার অনেক
টাকা আছে; আছে সামাজিক মর্যাদা। তাই বলে আমিও তো মানুষ। আন্টি ইদানীং
রাফিকে কেমন যেন বিমর্ষ মনে হয়। ও আধমরা হয়ে থাকে। তাই হঠাৎ চলে এসে
আপনাকে বিরক্ত করলাম। রনিকে আপ্যায়ন করার মতো রাফিদের বাসায় তেমন কিছু
ছিল না। এক গ্লাস সাদা পানি আর দু’মুঠো শুকনো মুড়ি ছাড়া। তাই বলে
ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না এই ভাঙা কুঁড়েঘরে। আন্টি রাফির কী হয়েছে?
বাবা, ও আগের মতো এখন আর হাসে না। বাবা ও এমন ছিল না। ওর বাবা ঘরে অসুস্থ।
তিন মাস ধরে স্কুলের মাইনে দিতে পারছে না। ঠিকমতো তিন বেলা পেটভরে খেতে
পারছে না। বলো বাবা, কিভাবে ওর মন ভালো থাকবে? রাফি বলল, মা তুমি কী বলছ?
থামো তো। আন্টি আপনি বলুন। আমাকে তো সবই জানতে হবে। বাবা আমি রাফির কোনো
প্রয়োজনই পুরোপুরি মেটাতে পারি না। দারিদ্র্য আমাদের গ্রাস করেছে। কেড়ে
নিয়েছে আমাদের মুখের হাসি। হে দারিদ্র্য! আমিও তোমায় দেখে নেবো। এই বলে
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল রাফির মা। রাফির মায়ের মুখে সব শুনে রনি আর কোনো কথা
না বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। তখন রনিকে খুব রাগান্বিত মনে হচ্ছিল। আজ
দু’দিন হলো ওরা দু’জন স্কুলে এসেছে। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। রাফি বলল,
আমি জানতাম এমনটাই হবে। তোমার আমার মাঝে তো অনেক ব্যবধান। তখন রনি রাফিকে
বলল, তোমায় বন্ধু ভাবতে আমার কষ্ট হয়। যে বন্ধু অন্য বন্ধুর কাছে তার
মনের কষ্টকে শেয়ার করতে পারে না, তার বন্ধুর মন আছে নাকি! রনি তুই রাগ
করিস না। তোকে বলব বলব বলেও আর বলা হয়নি। কেন যেন আমি বলতে পারিনি। প্লিজ,
তুই আমায় মা কর। রনি বলল, আমি তোকে এক শর্তে মা করতে পারি। বল, তুই আমার
শর্তে রাজি। হ্যাঁ বাবা, আমি তোর সব শর্ত মেনে নিলাম। তুই আমার কাছ থেকে আর
কিছুই লুকাবি না। আর আমাকে কোনো কাজে বাধাও দিতে পারবি না। দেখ, রাফি
দরিদ্র হয়ে জন্মগ্রহণ করা অপরাধ না। দারিদ্র্যের কাছে পরাজিত হওয়া
অন্যায়। পরদিন রনি রাফিকে লাঞ্চের আগে ডেকে নিলো। তারা এক সাথে বসে লাঞ্চ
করবে। রাফি তুমি কিছু মনে করো না। আমরা আগামীকাল থেকে এক সাথে প্রতিদিন
লাঞ্চ করব। রাফি তোমাকে আর বাসা থেকে কষ্ট করে দুপুরের খাবার আনতে হবে না।
রাফি আমি তোমাকে আগেই বলেছি, তুমি আমার কোনো কাজে বাধা দিতে পারবে না। বাবা
আমাকে প্রতিদিন পঞ্চাশ টাকা হাত খরচ দেন। এখন থেকে এ টাকাগুলো আমি আর খরচ
করব না। আমার একটু সেকরিফাইস তোমার অনেক উপকারে আসবে। এ টাকাগুলো একত্র
করলে নিশ্চয়ই তোমার টিউশন ফি ও স্কুলের বেতন জোগাড় হয়ে যাবে। আমার
বিশ্বাস তুমি এক দিন অনেক বড় হবে। তোমার মতো ছেলেরা কখনো অনাদরে অবজ্ঞায়
পড়ে থাকে না। তুমি আমাকে কথা দাও কোনো দিন যদি তোমার কাছে কিছু চাই তুমি
না করবে না। আর তুমি গরিব, দুঃখী ও অভাবী মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াবে।
তবেই আমার এ সেকরিফাইস সার্থক হবে। রনির কথাগুলো শুনে রাফি হতবাক হয়ে গেল।
রনির ভেতরটা এত বড়। সে তো অনেক বড় মনের অধিকারী। রাফি ঠিকই বুঝতে পারল
রনির প্রথম শর্তটা তার হিনম্মন্যতা দূর করার জন্য। বাকিটা তার স্বভাবজাত
বৈশিষ্ট্য। রাফি বলল, বন্ধু আমি তোমাকে দেয়া আমার প্রতিশ্র“তি চির দিন মনে
রাখব। তুমি আজীবন বেঁচে থাকবে আমার মাঝে। রাফি আমি পড়ালেখায় তোমার মতো
ভালো নই। তবে মেধাবীর সংস্পর্শে এসে কিছুটা মেধাবী হওয়া যায় কিনা। রাফি
পড়ালেখায় আগের চেয়ে আরো বেশি মনোযোগী হলো। রাফির মাকে রাফিকে নিয়ে এখন
তেমন টেনশন করতে হয় না। সংসারও সে ভালোয় ভালোয় চালিয়ে নিচ্ছে। দেখতে
দেখতে ছয়টি বছর কেটে গেল। পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণী তারা এক সাথে কাটাল।
এসএসসি পরীায় রাফি গোল্ডেন এ প্লাস পেল। রনি পেল এ প্লাস। রাফি অঙ্কে খুব
দ। বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাস করেছে সে। রাফির একটাই স্বপ্ন তাকে অনেক বড়
হতে হবে। নিজেকে স্বনির্ভর হতে হবে। তাই পরীার পর সে একটু বাজে সময়ও
নষ্ট করল না। সে পুরোদমে টিউশনি করাতে লাগল। ফিরে পেল জীবনের গতি। ইতোমধ্যে
রনির বাবার ট্রান্সফার অর্ডার এলো। শুরু হলো দুই বন্ধুর দুঃখের দিনগুলো।
রাফি তো একেবারেই ভেঙে পড়ল। যে বন্ধু তাকে নতুন জীবন দান করেছে, সে তাকে
ছেড়ে চলে যাবে। এই দুঃখ কী সহ্য করা যায়। এ কথা ভাবতেই রাফির দু’চোখ ভিজে
যায়। রনির মনেও অনেক কষ্ট। কিন্তু রাফিকে ধরা দেয় না। আজ শনিবার রনিরা
নতুন গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হবে। তাই খুব ভোরেই রাফি চলে এলো। রাফি
নির্বাক। ভাষা সে হারিয়ে ফেলেছে। রওনার আগে রাফি নির্বাক দৃষ্টিতে রনির
দিকে তাকিয়ে আছে। রনি ইশারায় রাফিকে ডাকল। সে কিছুই রাফিকে বলতে পারছে
না। হাউমাউ করে কাঁদছে। আর রাফি তো কিছুই বলছে না। রনি বিদায়ের আগে রাফিকে
বলল, বন্ধু ভুলো না আমায়। মানুষ মানুষের জন্য। তাই তো আমি তোমার জন্য।
আমি তোমারই ছিলাম আর চিরকাল তোমারি পাশে থাকব। তুমিও মানুষ হয়ে চিরকাল
মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবে। মধুপুর গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোর কথা ভাববে।
আমার শিাকে তুমি যদি ধরে রাখতে পারো, তাহলে আমি মনে করব সত্যিই তুমি আমায়
ভালোবেসেছ।
No comments