মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারির সাফল্য ও ব্যর্থতা by মাসুম বিল্লাহ

বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ধনী দেশের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদ হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্থান দখল করলেন ম্যাসাচুসেটসের দীর্ঘ দিনের সিনেটর ও কয়েক দশক ধরে পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক কমিটিতে দায়িত্বরত জন কেরি।
যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু গোটা বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতির সাথেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত, তাই এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং জন কেরির মতো অভিজ্ঞ কূটনীতিকেরই প্রয়োজন এই পদে। জন কেরি সম্পর্কে বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন যথার্থই বলেছেন, ‘মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দায়িত্ব দক্ষ হাতেই পড়েছে’। দায়িত্ব ছেড়ে দিতে কষ্ট হলেও তার বিশ্বাস, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কূটনীতিক হিসেবে চমৎকার কাজ করবেন তার উত্তরসূরি কেরি। হিলারি বলেন, ‘জন কেরি সফল সিনেটর। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও সাফল্য পাবেন। তার বিবেচনাবোধ, অভিজ্ঞতা ও দর্শন রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজের পারিবারিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার বাবাও এ দফতরে কাজ করেছেন। তিনি জানেন কূটনীতিতে কী প্রয়োজন হয়।’

যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন শেষ অফিস করেছেন গত ১ ফেব্রুয়ারি। তিনি বিদায়ের আগের দিন কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসকে বলেন, ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্র দু’টি যুদ্ধে জড়িয়েছিল। অর্থনৈতিক মন্দা ছিল। মার্কিন বন্ধুপ্রতিম কয়েকটি ছোট দেশ বিগড়ে গিয়েছিল। বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেয়ার সামর্থ্য নিয়ে উঠেছিল গুঞ্জন। চার বছর পর পরিস্থিতির অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। যদিও বিপজ্জনক ও জটিল পরিস্থিতি এখনো রয়েছে, কিন্তু এ সময়ে আমরা মার্কিন কূটনীতিকে জোরদার এবং বন্ধুপ্রতিম জোটগুলোকে আগের চেয়ে শক্তিশালী করতে সমর্থ হয়েছি।

হিলারিকে মার্কিন ইতিহাসের অন্যতম সফল পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বা জেমস বেকারের সমপর্যায়ের বলে মনে করেন অনেকে। তাদের মধ্যে আছেন বারাক ওবামা। তিনি বলেন, হিলারির মেধা, নিয়মানুবর্তিতা, পরিশ্রম করার মানসিকতার কারণেই তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তিনি প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম আর মার্কিন স্বার্থকে এগিয়ে নেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করেছেন। বিশ্বপরিস্থিতির এক কঠিন সময়ে হিলারি দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত সফলতার সাথে পররাষ্ট্রনীতিকে একটি দৃঢ় অবস্থানে নিয়ে এসেছিলেন। ওবামার প্রথম মেয়াদের মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মন্ত্রী হিসেবেই অবসরে গেলেন হিলারি কিনটন। এ সাফল্যই তাকে পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থিতার লড়াইয়ে অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বীর অবস্থানে নিয়ে গেছে। তিনি অবশ্য এ ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেননি বলে জানান।

বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান হিলারির সাফল্য ও ব্যর্থতাকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা দিয়েছে। স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যারন ডেভিড মিলার বলেন, হিলারির বিরামহীন প্রচেষ্টা বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ও প্রভাব বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সময়ে তিনি ২১ শতকের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন এজেন্ডা নিয়েও কাজ করেছেন। একে মানবতাবাদের কাজ বলব। মিলার ছয়জন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীনে কাজ করেছেন এবং তাদের কাজের মূল্যায়নে সুযোগ পেয়েছেন।

নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়াশিংটন শাখার উপপরিচালক সারাহ মারগন বলেছেন, হিলারি পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলেন নারী অধিকারের বিষয়টিকে। তার আগ্রহের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছিল। তিনি সুধীসমাজের নানা গোষ্ঠীর সাথে মতবিনিময় করতেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, পররাষ্ট্রনীতি শুধু সরকারগুলোর মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সব বিষয়ই এর আওতায় পড়ে। সাব-সাহারান আফ্রিকার সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বিশ্লেষক জেনিফার কুক বলেন, কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ব্যাপারে জবাবদিহিতার প্রতিষ্ঠায় চাপ দেন হিলারি। কেনিয়া, আইভরি কোস্ট, সেনেগালÑ প্রতিটি ক্ষেত্রেই এ ধরনের বিষয় নিয়ে কাজ করে যাওয়ার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার চিহ্ন রেখেছেন তিনি।

লিবিয়ার স্বৈরশাসক গাদ্দাফিকে উৎখাতের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সেনা পাঠানোর ব্যাপারে হিলারির নেয়া উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে। গত ৫০ বছরের মধ্যে প্রথম মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি মিয়ানমার সফর করেন। ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা, ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি সফলতা দেখিয়েছেন। ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহার ও যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের সাথে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল অসামান্য। তিনি তৃতীয় নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ১১২টি দেশ সফর করেন। মেডিলিন অলব্রাইট ৯৮টি দেশ সফর করেছিলেন অর্থাৎ হিলারিই সবচেয়ে বেশি দেশ সফর করেছেন। মিয়ানমারকে গণতন্ত্রের পথে নেয়া, চীনের ভিন্ন মতাবলম্বী নেতা চেন গুয়াং জেকে মুক্ত করা, এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্ব বাড়ানো হিলারির অন্যতম সাফল্য। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, হিলারির সময়ে ইউরোপের সাথেও সম্পর্ক জোরদার হয়েছে।

তবে লিবিয়ার বেনগাজিতে মার্কিন কনস্যুলেটে হামলায় রাষ্ট্রদূতসহ চার মার্কিন কর্মকর্তার মৃত্যু তার সময়ের একটি বহুল আলোচিত ব্যর্থতা। হিলারি অস্থিতিশীল সিরিয়া, আরব বসন্তের পর সৃষ্ট নতুন বিশ্ব পরিস্থিতি, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং মধ্যপ্রাচ্য শান্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে তেমন কাজ করতে পারেননি।

হিলারি মনে করেন, তার কাজের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। এ কাজেই তিনি এবার পূর্ণ মনোনিবেশ করবেন। তার ভাষায়, ‘দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পশ্চাতে ফেলে শক্তিশালী অর্থনীতি নির্মাণ বা স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বোকামি। বেশির ভাগ দেশে আজো নারীদের ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী বলে মনে করা হয়। আর যেসব দেশে সম্মান দেয়া হয় সেখানেও নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের চেয়ে বেশি মর্যাদা জোটে না। তাদের রাজনৈতিক অধিকার নেই। ভয়াবহ সহিংসতা সহ্য করেও মুখ বুজে থাকতে হয়।’

যুক্তরাষ্ট্রের ৬৮তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন জন কেরি। দেশের সর্বোচ্চ কূটনীতিক হিসেবে কেরিকে শপথ করান যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি অ্যালেনা কাগান। গত চার বছর সিনেটের শক্তিশালী পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন কেরি। গত মাসে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সিনেটে ১৯৮৪ সাল থেকে দায়িত্ব পালনকারী জন কেরির নাম ঘোষণা করেন। ২০০৪ সালে ডেমোক্র্যাট থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন কেরি। আমরা আশা করব, হিলারি মানবকল্যাণে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, জন কেরি সেসব কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে শেষ করবেন এবং পৃথিবীতে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত বন্ধে সত্যিকারের ভূমিকা রাখবেন। পৃথিবীর মানুষ যুদ্ধ চায় না, শান্তি চায়।

লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি

masumbillah65@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.