ভয় দেখিয়ে কণ্ঠ রোধ করা যায় না by আলফাজ আনাম

বাংলাদেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এখন বিপন্ন। ফ্যাসিবাদী চিন্তাধারায় একনায়কত্ববাদী শাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভিন্ন মতের কণ্ঠ রোধ করা।
গত কয়েক দিন ধরে ক্ষমতাসীন দলের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজধানীর কেন্দ্রস্থল শাহবাগে কিছু তরুণ কয়েকটি সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল এবং বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও বর্জনের ডাক দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে নয়া দিগন্ত, আমার দেশ ও সংগ্রাম সহ কয়েকটি সংবাদপত্র পোড়ানো হয়েছে। বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে দিগন্ত টেলিভিশন ও সোনার বাংলা  ব্লগ। এই হুমকির পর সরাসরি নয়া দিগন্ত অফিস ও প্রেসে হামলা করা হয়। শাহবাগে কিছু তরুণের ফ্যাসিবাদী প্রচারণার প্রভাবে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে।

আগুন দেয়ার এ ঘটনার আগে পুলিশ ও ছাত্রলীগকর্মীরা একসাথে বিরোধী দলের কর্মীদের নয়া দিগন্ত অফিসের আশপাশের অলিগলিতে খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে কিছু তরুণ অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর আগে অফিসে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। মতিঝিলের অফিসে আগুন দেয়ার দুই ঘণ্টা পর জুরাইনে নয়া দিগন্তের প্রেসে অস্ত্রধারী তরুণেরা এসে আগুন দেয়। এ থেকে প্রমাণিত হয় সুপরিকল্পিতভাবে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে এ আগুন দেয়া হয়। মতিঝিলে নয়া দিগন্ত অফিসে যখন আগুন দেয়া হয়, তখন পুলিশ সামান্য দূরে অবস্থান করছিল। তারা ইচ্ছে করলে দুষ্কৃতকারীদের গ্রেফতার করতে পারত। আগুন দেয়ার খবর শোনার পর যখন সাংবাদিক-কর্মচারীরা নিচে নেমে আসেন, তখন দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। পত্রিকা অফিসে আগুন দেয়ার ঘটনাটি প্রশাসনের চোখের সামনে ঘটেছে। ঘটনার পর উল্টো পুলিশ নয়া দিগন্ত অফিসে তল্লাশি চালিয়েছে। একজন প্রেসকর্মীকে ধরে নিয়ে গেছে। তাকে আবার রিমান্ডেও নেয়া হয়েছে।

আজকে রাষ্ট্রীয় সমর্থনে যেভাবে সংবাদপত্রের ওপর হামলা করা হচ্ছে, তার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ভিন্ন মতকে দমন করা। দেশে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে, সরকারের বন্দনা ও সাফল্যের কীর্তন প্রচার ছাড়া আর কোনো খবর প্রচার করা যাবে না। শাহবাগে যুদ্ধাপরাধের ফাঁসি দাবির আন্দোলনে হারিয়ে গেছে পদ্মা সেতুর দুর্নীতি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, কুইক রেন্টালের দুর্নীতির খবর। খুন, অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন, গুলি কোনো কিছুই এখন আর খবর নয়। একধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আর এ প্রচারণার আড়ালে ভিন্ন মত দলনের প্রক্রিয়া চলছে। সেখান থেকে গণমাধ্যমের ওপর আঘাত হানার আহ্বান জানানো হচ্ছে।

শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে নয়া দিগন্ত  ও আমার দেশ বিক্রি করতে বাধা দেয়া হচ্ছে। কেবল অপারেটরদের চাপ দিয়ে দিগন্ত টেলিভিশনের প্রচার বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। আজকে যারা সংবাদপত্র বন্ধ ও বর্জনের ডাক দিচ্ছে, তারাই আবার নিজেদের প্রগতিশীল ও মুক্তমনা বলে নিজেদের তুলে ধরছেন। যারা ভিন্ন মতকে সহ্য করতে পারেন না, তারা কিভাবে উদার মনের মানুষ হতে পারেন? এদের অনেকে আবার গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষেও সোচ্চার বলে দাবি করেন। এরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে শুধুই নিজের মত প্রকাশের অধিকারকে বুঝে থাকেন, যাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে নিজের মতামত অন্যর ওপর চাপিয়ে দেয়া। যারা এসব দাবি করছেন, প্রকৃতপক্ষে তাদের ভেতরে লুকিয়ে আছে হিংস্রতা। কেন এই আক্রমণ? উত্তর খুবই সহজÑ এই সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল সত্য তুলে ধরছে। একচোখা সংবাদ প্রচার না করে প্রকৃত তথ্য পাঠককে জানানোর চেষ্টা করছে। আর এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে কায়েমি স্বার্থবাদী মহলটি। এই ক্ষোভ থেকে শুধু সংবাদপত্র অফিসে হামলা ও আগুন দেয়া হচ্ছে না; এর আগে একাধিক পত্রিকার সম্পাদককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আমার দেশ  সম্পাদক এখনো পত্রিকার অফিসে অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছেন। প্রকৃতপক্ষে সত্য এখন তাদের প্রধান শত্রু। সত্য প্রকাশের অপরাধে এসব হামলা, গ্রেফতার ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের বড় একটি অংশ সরকারের ফ্যাসিবাদ কায়েমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব সংবাদপত্র ও অনলাইন মিডিয়া থেকে অব্যাহতভাবে নয়া দিগন্ত, আমার দেশ ও দিগন্ত টেলিভিশনের বিরুদ্ধে অসত্য প্রচারণা চালানো হয়েছে। সরকারের তল্পিবাহক এসব গণমাধ্যম সাংবাদিকতার ন্যূনতম নীতিমালা মেনে চলছে না। খবর প্রচারের আগে সংশ্লিষ্টদের কোনো বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করেনি। তাদের এ ধরনের প্রবণতা দেখে ইতালি ও জার্মানির ফ্যাসিস্ট শাসনে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার সাথে কেবল তুলনা করা যায়। হিটলারের উগ্র জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডে তৎকালীন জার্মানির বুদ্ধিজীবীদের প্রবল সমর্থন ছিল। কার্ল শ্মিট নামে একজন আইনবিশারদ ও মার্টিন হিডেগার নামে আরেকজন খ্যাতনামা দার্শনিক দারুণভাবে সমর্থন দিয়ে গেছেন নাজি পার্টির তৎপরতায়। তারা হিটলারকে একজন অতিমানব হিসেবে তুলে ধরেন। শুধু বুদ্ধিজীবীদের সমর্থনের ওপর ভিত্তি করে যে ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডে পুরো জার্মান জাতির সমর্থন আদায় করা সম্ভব হবে না, তা হিটলারের প্রচারবিশারদ গোয়েবলস ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। এ কারণে তিনি সংবাদপত্র ও রেডিওকে যথেচ্ছ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো কোনো সংবাদপত্র রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়, কোনোটাতে তাদের পছন্দের লোকদের বসানো হয়, আবার তাদের উপযোগী সংবাদ যাতে প্রচার করা হয় সে জন্য আর্থিক সহায়তাও দেয়া হয়। ঘরে ঘরে রেডিও ব্যবহারের জন্য সস্তায় রেডিও সরবরাহ করা হয়। এভাবে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ফ্যাসিস্ট শাসনের প্রতি গণসমর্থন সৃষ্টি করা হয়। বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ এখন এ কাজটিই করে যাচ্ছে। কিন্তু তারা ভুলে গেছে ফ্যাসিবাদের দন্তনখর এতই হিংস্র যে একসময় তাদের ওপর এ আঘাত আসতে পারে। আজকে ভিন্ন মতের সংবাদমাধ্যমে আঘাত হানা হচ্ছে, ধীরে ধীরে সামান্যতম পেশাদারিত্ব দেখানোর কারণে তাদের ওপরও আঘাত আসবে। কণ্ঠ রোধের যাঁতাকলে আরো অনেককে পড়তে হবে।

কিন্তু আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ভয় দেখিয়ে আগুন লাগিয়ে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার বন্ধ করা যাবে না। ইতালি ও জার্মানির ফ্যাসিস্টদের এখন মানুষ ঘৃণার সাথে স্মরণ করে। এখন যারা ক্ষমতার মদমত্ততায় সংবাদমাধ্যমের ওপর আঘাত হানছেন তাদেরও ইতিহাস সেভাবেই স্মরণ করবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার সম্ভাবনা ধ্বংস হয়েছিল একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার এই মনোবৃত্তির কারণে। তখনো এভাবে সব সংবাদপত্রকে ক্ষমতাসীনদের প্রচারযন্ত্রে পরিণত করা হয়েছিল। চারটি সংবাদপত্র ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

১৯৭২-৭৪ সালের ইতিহাস এ দেশের মানুষ গণতন্ত্র হত্যা ও সংবাদপত্র দলনের ইতিহাস হিসেবে স্মরণ করে। এখনো একই ঘটনা ঘটছে শুধু ভিন্ন উপায়ে। তখনো এসব সিদ্ধান্ত নেয়ার জনগণের আকাক্সার দোহাই দিয়ে। এ ছাড়া ফ্যাসিবাদের একধরনের পপুলার ভিত্তি থাকে। তাকে জনদাবি হিসেবে হাজির করে ভিন্ন মতের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা চালানো হয়। এখনো সে ঘটনাই ঘটছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভিন্ন মত দমনের এসব প্রক্রিয়া সফল হয় না। কারণ একসময় জনগণ এসব দুরভিসন্ধি সহজেই উপলব্ধি করতে পারে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে মানুষ দাঁড়ায়।

নয়া দিগন্তের বড় সম্পদ সাধারণ পাঠকেরা। তাদের ভালোবাসা নিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে পত্রিকাটি। নয়া দিগন্তে আগুন দেয়ার পর দেশ-বিদেশের বহু পাঠক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সাধারণ পাঠক ছাড়াও রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা নয়া দিগন্ত অফিসে এসে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। ফোন করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। তাদের প্রতি নয়া দিগন্ত পরিবার কৃতজ্ঞ। পাঠকদের ভালোবাসা ও সহমর্র্মিতাকে পুঁজি করে নয়া দিগন্ত তার দায়িত্ব পালন করে যাবে। কণ্ঠ রোধের এ প্রচেষ্টা সফল হবে না।

alfazanambd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.