নেতৃত্বহীন অবস্থা ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জনক by মাসুদ মজুমদার
তরুণ্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। তবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, আদর্শ,
মানসম্পন্ন সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া সেটা কখনো সফল পরিণতি পায় না।
ইতিহাসে
এর সাক্ষ্য শত শত। বাস্তিল দুর্গের পতন হতো না নেতৃত্বের অঙ্গুলী হেলন
ছাড়া। রুশ বিপ্লব মনভোলানো সাম্যবাদের বস্তুবাদী আদর্শ ও লেনিনের নেতৃত্ব
ছাড়া সত্তর আশি বছর টিকে থাকত না। নেতৃত্ব না থাকলে কিছুই হয় না। মাও
সময় মতো লংমার্চ না থামালে গণচীনের পরিণতি কি হতো বলা কঠিন। মাও সেতুং
চিয়াংকাইশেখের পেছনে দৌড়াননি। চিয়াংকাইশেখ ফরমোজা বা আজকের তাইওয়ানে
পালিয়ে যাবার পর চেয়ারম্যান মাও চীন পুনর্গঠনে মনোযোগী হয়েছিলেন। তিনি
জানতেন কোথায় থামতে হয়, কেন যশ থাকতে কীর্তন থামাতে হয়। ঊনসত্তরে রাজপথে
মওলানা ভাসানী, জেলে বঙ্গবন্ধু, মিছিলের সামনে এক ডজন জাতীয় নেতা, সাথে
অগ্রগামীর ভূমিকায় ছাত্রনেতারা। জনতা এক মুহূর্তের জন্যও নেতৃত্বশূন্য ছিল
না। সে কারণে গণঅভ্যুত্থান সফল পরিণতি পেয়েছিল। ইরানের জনগণ মার্কিনি
পুতুল রেজাশাহকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে। সেটা ছিল রাজা
ও রাজ্যশাসনের এবং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবের ডাক। তিউনিসিয়ায় বেন
আলিকে হঠাতে ফুঁসে ওঠা জনতা নেতৃত্ব পেল ধীমান রশীদ ঘানুশির মতো
ব্যক্তিত্বের। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে নেলসন ম্যান্ডেলা নেতৃত্ব দিয়ে সফল
পরিণতি ছিনিয়ে আনলেন। মার্টিন লুথার কিংও ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কালো ও
নিপীড়িত মানুষের কাছে হেমিলনের বংশিওয়ালা। ম্যালকম এক্স-লুই ফারা খানরা
সেটাকেই এগিয়ে নিয়েছেন। মিসরের তাহরির স্কোয়ারের নেতৃত্ব দিয়েছে
‘ভ্রাতৃসঙ্ঘ’। তারা একনায়ক ও স্বৈরশাসক মোবারক সরকার হটিয়ে স্বৈরতন্ত্রের
স্থলে জনগণের প্রতিনিধিত্বের লক্ষ্যে লড়াই করেছে। সম্পূর্ণ স্থিতিশীলতা
ফিরে না এলেও তারা এখন ক্ষমতায়।
পৃথিবীতে কোনো পরিবর্তন নেতৃত্ব ছাড়া হয় না। নেতা ছাড়া কোনো ধর্মও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নেতৃত্বহীন অবস্থা নৈরাজ্যের জন্ম দেয়। নানা ধরনের মতলববাজ জনতাকে ব্যবহার করে, উসকানি দেয়। বিপদ অনিবার্য করে তোলে। তাই নেতৃত্বহীন জনতা ভয়ঙ্কর। যেমন কমাণ্ডারহীন সেনাবাহিনী বিপজ্জনক। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি থেকে জিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা পর্যন্ত মাত্র ক’ঘণ্টার ব্যাপার। জাতি ২৫ শের কালোরাত্রীর পর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। নেতৃত্বশূন্যতার এ দিশেহারা মুহূর্তটিতে জিয়ার ঘোষণা জাতিকে দিশা দিয়েছিল। ’৭৫-এর নভেম্বরের প্রথম ক’দিন জাতি সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্বশূন্য ছিল। সিপাহি-জনতার রুদ্ররোষে ও অজানা শঙ্কায় সবার হৃদয় কাঁপছিল। খালেদ মোশাররফের বিতর্কিত ভূমিকা সিপাহি জনতা মেনে নেয়নি। একপর্যায়ে রাজপথে নেমে এসেছিল সিপাহি-জনতা। জিয়াকে মুক্ত করে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েই একটা পরিণতি টানতে হয়েছে। নেতৃত্ব ছিল না বলেই বঙ্গবন্ধুর রক্ত মাড়িয়ে আওয়ামী লীগের এক অংশের ক্ষমতার শপথ নেয়ার দৃশ্য অন্য অংশকে প্রতিবাদী হওয়ার মতো সাহসও জোগাতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রে অকুপায় ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন সাফল্য পায়নি। কারণ গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব ছিল না। যদিও জনগণের আবেগ ছিল সঠিক, টার্গেট ছিল মোক্ষম। জনসংখ্যার একভাগ ধনকুবেরের হাতে তাবৎ সম্পদ শ্রেণী বৈষম্যের পাহাড় সৃষ্টি করেছে। তার বিরুদ্ধেই জনতা ফুসে ওঠেছিল। টার্গেট সঠিক থাকলেও নেতৃত্বের অভাবে সেই আবেগ থিতিয়ে পড়ে। আবার দূরদর্শী নেতৃত্বের অভাবেও আবেগ-উচ্ছ্বাস শেষ পরিণতি পায় না।
দিল্লিতে আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী মঞ্চ সরকারবিরোধী লক্ষ্যাভিষারি ছিল না বলেই শেষ হয়েও শেষ হয়নি। নন্দিগ্রাম, শিঁধুর ও ছত্তিশগড়ের জনতার উচ্ছ্বাসের কিছু অংশ মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতার স্বার্থে লুটেছে, বাকিটা শূন্যে মিলিয়ে গেছে।
কমপক্ষে তিন দিন শাহবাগের টগবগে তারুণ্যের আবেগ ছুঁয়ে দেখতে গেছি। উচ্ছ্বাস বুঝবার চেষ্টা করেছি। তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও নেতৃত্ব সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। তাদের বক্তব্যের গভীরতাও মাফতে চেয়েছি। প্রথম যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ব্লগার হয়ে বাঁশি বাজালেন, তাদের অনুভূতি শ্রদ্ধা করার মতো। ভালো লেগেছে তাদের উপলব্ধির বিষয়টিও। যুদ্ধাপরাধ বিচার-আচারের অসঙ্গতি সরকারের স্ববিরোধী অবস্থান তাদের বিবেককে স্পর্শ করেছে। কিছু একটা করে দেখাবার অনুভূতি থেকে সুকৃতির বাসনাকে নাড়া দিয়েছে। এই সত্য যারা আড়াল করতে চান কিংবা চান অস্বীকার করতে, তাদের জন্য আমাদের বক্তব্য একটাইÑ বাতাসে দাহ্য পদার্থ না থাকলে আগুন জ্বলে না।
এখন ব্লগারদের আবেগ-উপলব্ধি, উচ্ছ্বাস-অনুভূতি সবকিছু হাইজ্যাকের লক্ষ্যে রাজনৈতিক তস্করদের দৌড়ঝাঁপ স্পষ্ট। রাজনৈতিক স্লোগান নিয়ে হাজির হয়েছে গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নকারীরা। রাজনৈতিক তস্করদের সাংস্কৃতিক মুখপাত্ররা মাঠের দখল অনেক আগেই নিয়েছে। তাদের ছাত্রকর্মীদের মাঠে নামিয়েছে অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে। চাঁদা আসছে হাওয়া থেকে। খাবার আসছে আকাশ থেকে। চৌমাথার সব প্রবেশপথ নিরাপদ রেখেছে পুলিশ। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সরকার ও প্রশাসনযন্ত্র স্বাধীন বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই মহড়া উপভোগ করছে। আদালত অবমাননার দগদগে ক্ষত নিয়ে সততার প্রতি দায়বদ্ধ বিচারপতিরা এখন বিবেকের তাড়নায় ছটফট করতে বাধ্য হচ্ছেন।
অথচ অজানা শঙ্কা ও ভবিষ্যতের অনিশ্চিত ভাবনায় পুরো জাতি এখন বিব্রত। এই অবস্থা সৃষ্টির জন্য একক দায় সরকারের। তারা এর প্রমোটর। এই প্যান্ডোরার বাক্স খোলার কারিগরও তারা। চাবিও তাদের হাতে। তাদের প্রভুদের উদ্দেশ্যও স্পষ্ট। যুদ্ধাপরাধীর বিচার ইস্যুর মতো জনগুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল একটি ইস্যুকে নিয়ে সরকার পূর্বাপর তামাশা দেখিয়েছে। চালাকি দেখাবার চেষ্টা করেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের জন্য পরিকল্পনা ফেঁদেছে। প্রতিহিংসার আগুন জালাতে অপচেষ্টা চালিয়েছে। ক্ষমতার জন্য এমন ন্যক্কারজনক ও নোংরা রাজনীতির দৃষ্টান্ত বিরল। কারণ, এখন রায় দেবে অন্য কেউ, আদালত নয়। বিচার হবে অপরাধের নয়, ব্যক্তির। মূল আসামিদের নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও আন্তর্জাতিক মানরক্ষা করে বিচারের জন্য সরকারের হাত পা ধরতে বাকি আছে। কারো কথা আমলে নেয়নি সরকার। যেনতেন একটা রায় দিয়ে রাজনৈতিক আত্মতুষ্টি হাসিলের যাত্রাভঙ্গ করতে সরকার ছাড়া অন্য কেউ সক্ষম হয়নি। ব্লগাররা দেশবাসী ও বিশ্বসম্প্রদায়ের চোখ খুলে দিল। তবে পদ্ধতিগত ত্রুটি ও মতলববাজদের কারণে আজ ট্রাইব্যুনালের কাজকর্ম, প্রসিকিউশন, বিচারকের দেয়া রায় প্রশ্নবিদ্ধ। পুরো বিচারব্যবস্থা শাহবাগের কাঠগড়ায়। আদালত অবমাননার বোবা কান্না গুমরে মরছে।
আইন বানাল সরকার, ট্রাইব্যুনাল বানাল সরকার, প্রসিকিউটর ও বিচারপতি নিয়োগ দিল সরকার। সরকারই বিচারের আগে রায় ঘোষণা করে অভিযুক্তকে হাত কড়া পরিয়ে আবার বিচারে সোপর্দ করল। এখন তারা সালিশ মানে বিচার মানে না। তাহলে ‘জুডিশিয়াল কিলিং’-এর যে প্রশ্ন উঠেছে তাই কি বিচারের নামে সরকার করতে আগ্রহী! অভিযুক্তদের পক্ষে ‘মানি না মানব না’ শুনলে আমাদের অসহ্য ঠেকতেই পারে। তবে মন্ত্রীরাসহ যারা বছরের পর বছরজুড়ে রাজপথে আদালত বসাচ্ছেন, ফাঁসির রায় দিচ্ছেন, রায় কখন হবে বলে দিচ্ছেনÑ তাদের জন্য নীতিনিষ্ঠ ব্লগারদের বার্তা কি তা জানা খুবই জরুরি। সরকারের দ্বিমুখী আচরণে জনগণ বিব্রত। বিব্রত বিচারকেরা। সম্ভবত সরকারও ফাটা বাঁশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে কিংবা বানরের মতো করাতিগিরি করতে গিয়ে নিজেরা নিজেদের তৈরি করা ফাঁদে আটকে গেছে। এখন পথ ছাড়লে বন ও মনের বাঘে খাবে, না ছাড়লে গৃহযুদ্ধ বাধবে।
এই শাহবাগ কালের সাক্ষী। এখান থেকে মুসলিম লীগের জন্ম হয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছে। শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী-বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ছিলেন। কলকাতার বিদ্বেষ ঠেলে শাহবাগের কোলটি ঘেঁষে আমাদের আত্ম পরিচয়ের অহঙ্কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়িয়েছে। শাহবাগের বর্ধিত পরিসরে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে পরিবর্তিত নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের মন্ত্র শুনিয়েছেন। আরো অনেক ঘটনার সাক্ষী এই শাহবাগ, যা কিনা ঢাকার নবাবদের বাগানবাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল।
তারুণ্যের দ্রোহের মূল প্রেরণা আসে সৎ কাজের প্রতি আহ্বানের আকুতি থেকে। অসত্য, অসুন্দর, অন্যায়কে অস্বীকার ও প্রতিরোধের তীব্রদাহ এবং অনুভূতি থেকে। মিডিয়া গোষ্ঠীগুলোর প্রত্যেকের নিজস্ব অ্যাজেন্ডা আছে। পুঁজির দাসত্বের বিষয় থাকবে। তাদের প্রচারণা ও প্রতারণায় আপ্লুত হলে কোনটি প্রোপাগান্ডা কোনটি সংবাদ তা আড়ালে থেকে যাবে। আমরা চাইব আইন আদালতের স্বাধীনতার প্রতি কটাক্ষ না করে জাগ্রত তারুণ্যের দ্রোহের আগুনে অসত্য জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাক। মুক্তিযুদ্ধের মতো অহঙ্কারের সার্বজনীন বিষয় নিয়ে ক্ষমতার রাজনীতি ও দ্বন্দ্ব নিপাত যাক। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী শক্তির আগ্রাসন ও আস্ফালন থেমে যাক। জাতিকে বিভক্তকারী সব রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির উপসর্গের পতন ঘটুক। দ্রোহের আগুন দুর্নীতিকে ভাসিয়ে নিক। মানবতা, মানবাধিকার ও স্বাধীন বিচারকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখুক। জালেমের মোকাবেলায় মজলুমের বিজয়কে নিশ্চিত করুক। তবেই না নতুনের কেতন উড়বে। সেই জনতা জাগবে। তার ওপর সত্য সমাগত হবে। অসত্য বিতাড়িত হবে। সত্যের জয়গানে কোটি জনতার প্রাণ বন্যা সব কিছুকে ছুঁয়ে যাবে।
কারো ভুলে যাওয়া উচিত নয়, বাতাসে দাহ্য পদার্থ না থাকলে দিয়াশলাই জ্বালালেও আগুন জ্বলে না। সাগর-রুনির আত্মা কাঁদছে। বিশ্বজিতের মায়ের হাহাকার থামেনি। রেলের কালো বিড়াল এখনো সুযোগ বুঝে মিউ মিউ করে। পদ্মা সেতু নিয়ে নোংরা খেলা বন্ধ হয়নি, ইলিয়াস আলীর কন্যার মাতম ও দীর্ঘশ্বাস এখনো বাতাসকে ভারী করে রাখছে। ব্যাংক লুণ্ঠন, দুর্নীতির বিষাক্ত ছোবলের দগদগে ক্ষত, শেয়ারবাজারের দীর্ঘশ্বাস চোখ বন্ধ করলেও মনে ভেসে ওঠে। অথচ সরকার ভাবছেÑ তারা এভাবেই কিস্তিমাত করবে। সরকার ফ্যাসিবাদ দিয়ে ক্ষমতার স্বপ্ন কোন দিন অর্জন করতে পারবে না। তাছাড়া রাজপথে কোনো আন্দোলনের সুফল সরকার পায় না, বাঁক ঘুরে সেটা বিরোধী দলের ঘরেই উঠে যায়। ব্যাপারটা শুধু অপেক্ষার।
আগামি নির্বাচনকে সামনে রেখে যারা মাঠ সাজিয়ে তুষ্ঠি পাচ্ছেন তাদের জন্য কোনো সুসংবাদ অপেক্ষা করবে না। যারা হঠকারি হয়ে সময় জ্ঞান হারিয়ে রাষ্ট্র শক্তির অপব্যবহার করছেন কিংবা তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে পথ চলতে চাচ্ছেন তাদেরকেও অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ ভাবতে হবে। জনগণের অর্জন, তারুণ্যের উচ্ছ্বাসকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যায় না। যদিও সেই অর্জন ও উচ্ছ্বাস ছিনতাই করার জন্য রাজনৈতিক তস্কররা ওৎ পেতে বসে আছে। সরকার বগল বাজিয়ে বলছে ও ভাবছে তাদের অ্যাজেন্ডা তরুণ সমাজ বাস্তবায়ন করে দিচ্ছে। আর প্রতিপক্ষ ভাবছে সব ঝুটা হ্যায়। কোনো মূল্যায়ন ও ভাবনাই সঠিক নয়। মিডিয়ায় হামলা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একটা শেষের পর আরো শেষ আছে। সেই ‘শেষ’ রাজনীতিবিদদের খোড়া গর্তে রাজনীতিবিদরাই পড়তে যাচ্ছেন। ঘাড়ে তোলা সত্য ঘাড় মটকায়। যেমন ওঝা মরে সাপ খেলায় বিষধর সাপের দংশনে। রাজনীতিকে যেভাবে বিষাক্ত ও অসহিষ্ণু করে তোলা হচ্ছে তার বিপরীতে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের জন্য শুধু দুঃসংবাদই অপেক্ষা করছে।
digantaeditorial@gmail.com
পৃথিবীতে কোনো পরিবর্তন নেতৃত্ব ছাড়া হয় না। নেতা ছাড়া কোনো ধর্মও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নেতৃত্বহীন অবস্থা নৈরাজ্যের জন্ম দেয়। নানা ধরনের মতলববাজ জনতাকে ব্যবহার করে, উসকানি দেয়। বিপদ অনিবার্য করে তোলে। তাই নেতৃত্বহীন জনতা ভয়ঙ্কর। যেমন কমাণ্ডারহীন সেনাবাহিনী বিপজ্জনক। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি থেকে জিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা পর্যন্ত মাত্র ক’ঘণ্টার ব্যাপার। জাতি ২৫ শের কালোরাত্রীর পর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। নেতৃত্বশূন্যতার এ দিশেহারা মুহূর্তটিতে জিয়ার ঘোষণা জাতিকে দিশা দিয়েছিল। ’৭৫-এর নভেম্বরের প্রথম ক’দিন জাতি সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্বশূন্য ছিল। সিপাহি-জনতার রুদ্ররোষে ও অজানা শঙ্কায় সবার হৃদয় কাঁপছিল। খালেদ মোশাররফের বিতর্কিত ভূমিকা সিপাহি জনতা মেনে নেয়নি। একপর্যায়ে রাজপথে নেমে এসেছিল সিপাহি-জনতা। জিয়াকে মুক্ত করে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েই একটা পরিণতি টানতে হয়েছে। নেতৃত্ব ছিল না বলেই বঙ্গবন্ধুর রক্ত মাড়িয়ে আওয়ামী লীগের এক অংশের ক্ষমতার শপথ নেয়ার দৃশ্য অন্য অংশকে প্রতিবাদী হওয়ার মতো সাহসও জোগাতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রে অকুপায় ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন সাফল্য পায়নি। কারণ গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব ছিল না। যদিও জনগণের আবেগ ছিল সঠিক, টার্গেট ছিল মোক্ষম। জনসংখ্যার একভাগ ধনকুবেরের হাতে তাবৎ সম্পদ শ্রেণী বৈষম্যের পাহাড় সৃষ্টি করেছে। তার বিরুদ্ধেই জনতা ফুসে ওঠেছিল। টার্গেট সঠিক থাকলেও নেতৃত্বের অভাবে সেই আবেগ থিতিয়ে পড়ে। আবার দূরদর্শী নেতৃত্বের অভাবেও আবেগ-উচ্ছ্বাস শেষ পরিণতি পায় না।
দিল্লিতে আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী মঞ্চ সরকারবিরোধী লক্ষ্যাভিষারি ছিল না বলেই শেষ হয়েও শেষ হয়নি। নন্দিগ্রাম, শিঁধুর ও ছত্তিশগড়ের জনতার উচ্ছ্বাসের কিছু অংশ মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতার স্বার্থে লুটেছে, বাকিটা শূন্যে মিলিয়ে গেছে।
কমপক্ষে তিন দিন শাহবাগের টগবগে তারুণ্যের আবেগ ছুঁয়ে দেখতে গেছি। উচ্ছ্বাস বুঝবার চেষ্টা করেছি। তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও নেতৃত্ব সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। তাদের বক্তব্যের গভীরতাও মাফতে চেয়েছি। প্রথম যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ব্লগার হয়ে বাঁশি বাজালেন, তাদের অনুভূতি শ্রদ্ধা করার মতো। ভালো লেগেছে তাদের উপলব্ধির বিষয়টিও। যুদ্ধাপরাধ বিচার-আচারের অসঙ্গতি সরকারের স্ববিরোধী অবস্থান তাদের বিবেককে স্পর্শ করেছে। কিছু একটা করে দেখাবার অনুভূতি থেকে সুকৃতির বাসনাকে নাড়া দিয়েছে। এই সত্য যারা আড়াল করতে চান কিংবা চান অস্বীকার করতে, তাদের জন্য আমাদের বক্তব্য একটাইÑ বাতাসে দাহ্য পদার্থ না থাকলে আগুন জ্বলে না।
এখন ব্লগারদের আবেগ-উপলব্ধি, উচ্ছ্বাস-অনুভূতি সবকিছু হাইজ্যাকের লক্ষ্যে রাজনৈতিক তস্করদের দৌড়ঝাঁপ স্পষ্ট। রাজনৈতিক স্লোগান নিয়ে হাজির হয়েছে গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নকারীরা। রাজনৈতিক তস্করদের সাংস্কৃতিক মুখপাত্ররা মাঠের দখল অনেক আগেই নিয়েছে। তাদের ছাত্রকর্মীদের মাঠে নামিয়েছে অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে। চাঁদা আসছে হাওয়া থেকে। খাবার আসছে আকাশ থেকে। চৌমাথার সব প্রবেশপথ নিরাপদ রেখেছে পুলিশ। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সরকার ও প্রশাসনযন্ত্র স্বাধীন বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই মহড়া উপভোগ করছে। আদালত অবমাননার দগদগে ক্ষত নিয়ে সততার প্রতি দায়বদ্ধ বিচারপতিরা এখন বিবেকের তাড়নায় ছটফট করতে বাধ্য হচ্ছেন।
অথচ অজানা শঙ্কা ও ভবিষ্যতের অনিশ্চিত ভাবনায় পুরো জাতি এখন বিব্রত। এই অবস্থা সৃষ্টির জন্য একক দায় সরকারের। তারা এর প্রমোটর। এই প্যান্ডোরার বাক্স খোলার কারিগরও তারা। চাবিও তাদের হাতে। তাদের প্রভুদের উদ্দেশ্যও স্পষ্ট। যুদ্ধাপরাধীর বিচার ইস্যুর মতো জনগুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল একটি ইস্যুকে নিয়ে সরকার পূর্বাপর তামাশা দেখিয়েছে। চালাকি দেখাবার চেষ্টা করেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের জন্য পরিকল্পনা ফেঁদেছে। প্রতিহিংসার আগুন জালাতে অপচেষ্টা চালিয়েছে। ক্ষমতার জন্য এমন ন্যক্কারজনক ও নোংরা রাজনীতির দৃষ্টান্ত বিরল। কারণ, এখন রায় দেবে অন্য কেউ, আদালত নয়। বিচার হবে অপরাধের নয়, ব্যক্তির। মূল আসামিদের নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও আন্তর্জাতিক মানরক্ষা করে বিচারের জন্য সরকারের হাত পা ধরতে বাকি আছে। কারো কথা আমলে নেয়নি সরকার। যেনতেন একটা রায় দিয়ে রাজনৈতিক আত্মতুষ্টি হাসিলের যাত্রাভঙ্গ করতে সরকার ছাড়া অন্য কেউ সক্ষম হয়নি। ব্লগাররা দেশবাসী ও বিশ্বসম্প্রদায়ের চোখ খুলে দিল। তবে পদ্ধতিগত ত্রুটি ও মতলববাজদের কারণে আজ ট্রাইব্যুনালের কাজকর্ম, প্রসিকিউশন, বিচারকের দেয়া রায় প্রশ্নবিদ্ধ। পুরো বিচারব্যবস্থা শাহবাগের কাঠগড়ায়। আদালত অবমাননার বোবা কান্না গুমরে মরছে।
আইন বানাল সরকার, ট্রাইব্যুনাল বানাল সরকার, প্রসিকিউটর ও বিচারপতি নিয়োগ দিল সরকার। সরকারই বিচারের আগে রায় ঘোষণা করে অভিযুক্তকে হাত কড়া পরিয়ে আবার বিচারে সোপর্দ করল। এখন তারা সালিশ মানে বিচার মানে না। তাহলে ‘জুডিশিয়াল কিলিং’-এর যে প্রশ্ন উঠেছে তাই কি বিচারের নামে সরকার করতে আগ্রহী! অভিযুক্তদের পক্ষে ‘মানি না মানব না’ শুনলে আমাদের অসহ্য ঠেকতেই পারে। তবে মন্ত্রীরাসহ যারা বছরের পর বছরজুড়ে রাজপথে আদালত বসাচ্ছেন, ফাঁসির রায় দিচ্ছেন, রায় কখন হবে বলে দিচ্ছেনÑ তাদের জন্য নীতিনিষ্ঠ ব্লগারদের বার্তা কি তা জানা খুবই জরুরি। সরকারের দ্বিমুখী আচরণে জনগণ বিব্রত। বিব্রত বিচারকেরা। সম্ভবত সরকারও ফাটা বাঁশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে কিংবা বানরের মতো করাতিগিরি করতে গিয়ে নিজেরা নিজেদের তৈরি করা ফাঁদে আটকে গেছে। এখন পথ ছাড়লে বন ও মনের বাঘে খাবে, না ছাড়লে গৃহযুদ্ধ বাধবে।
এই শাহবাগ কালের সাক্ষী। এখান থেকে মুসলিম লীগের জন্ম হয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছে। শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী-বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ছিলেন। কলকাতার বিদ্বেষ ঠেলে শাহবাগের কোলটি ঘেঁষে আমাদের আত্ম পরিচয়ের অহঙ্কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়িয়েছে। শাহবাগের বর্ধিত পরিসরে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে পরিবর্তিত নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের মন্ত্র শুনিয়েছেন। আরো অনেক ঘটনার সাক্ষী এই শাহবাগ, যা কিনা ঢাকার নবাবদের বাগানবাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল।
তারুণ্যের দ্রোহের মূল প্রেরণা আসে সৎ কাজের প্রতি আহ্বানের আকুতি থেকে। অসত্য, অসুন্দর, অন্যায়কে অস্বীকার ও প্রতিরোধের তীব্রদাহ এবং অনুভূতি থেকে। মিডিয়া গোষ্ঠীগুলোর প্রত্যেকের নিজস্ব অ্যাজেন্ডা আছে। পুঁজির দাসত্বের বিষয় থাকবে। তাদের প্রচারণা ও প্রতারণায় আপ্লুত হলে কোনটি প্রোপাগান্ডা কোনটি সংবাদ তা আড়ালে থেকে যাবে। আমরা চাইব আইন আদালতের স্বাধীনতার প্রতি কটাক্ষ না করে জাগ্রত তারুণ্যের দ্রোহের আগুনে অসত্য জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাক। মুক্তিযুদ্ধের মতো অহঙ্কারের সার্বজনীন বিষয় নিয়ে ক্ষমতার রাজনীতি ও দ্বন্দ্ব নিপাত যাক। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী শক্তির আগ্রাসন ও আস্ফালন থেমে যাক। জাতিকে বিভক্তকারী সব রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির উপসর্গের পতন ঘটুক। দ্রোহের আগুন দুর্নীতিকে ভাসিয়ে নিক। মানবতা, মানবাধিকার ও স্বাধীন বিচারকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখুক। জালেমের মোকাবেলায় মজলুমের বিজয়কে নিশ্চিত করুক। তবেই না নতুনের কেতন উড়বে। সেই জনতা জাগবে। তার ওপর সত্য সমাগত হবে। অসত্য বিতাড়িত হবে। সত্যের জয়গানে কোটি জনতার প্রাণ বন্যা সব কিছুকে ছুঁয়ে যাবে।
কারো ভুলে যাওয়া উচিত নয়, বাতাসে দাহ্য পদার্থ না থাকলে দিয়াশলাই জ্বালালেও আগুন জ্বলে না। সাগর-রুনির আত্মা কাঁদছে। বিশ্বজিতের মায়ের হাহাকার থামেনি। রেলের কালো বিড়াল এখনো সুযোগ বুঝে মিউ মিউ করে। পদ্মা সেতু নিয়ে নোংরা খেলা বন্ধ হয়নি, ইলিয়াস আলীর কন্যার মাতম ও দীর্ঘশ্বাস এখনো বাতাসকে ভারী করে রাখছে। ব্যাংক লুণ্ঠন, দুর্নীতির বিষাক্ত ছোবলের দগদগে ক্ষত, শেয়ারবাজারের দীর্ঘশ্বাস চোখ বন্ধ করলেও মনে ভেসে ওঠে। অথচ সরকার ভাবছেÑ তারা এভাবেই কিস্তিমাত করবে। সরকার ফ্যাসিবাদ দিয়ে ক্ষমতার স্বপ্ন কোন দিন অর্জন করতে পারবে না। তাছাড়া রাজপথে কোনো আন্দোলনের সুফল সরকার পায় না, বাঁক ঘুরে সেটা বিরোধী দলের ঘরেই উঠে যায়। ব্যাপারটা শুধু অপেক্ষার।
আগামি নির্বাচনকে সামনে রেখে যারা মাঠ সাজিয়ে তুষ্ঠি পাচ্ছেন তাদের জন্য কোনো সুসংবাদ অপেক্ষা করবে না। যারা হঠকারি হয়ে সময় জ্ঞান হারিয়ে রাষ্ট্র শক্তির অপব্যবহার করছেন কিংবা তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে পথ চলতে চাচ্ছেন তাদেরকেও অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ ভাবতে হবে। জনগণের অর্জন, তারুণ্যের উচ্ছ্বাসকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যায় না। যদিও সেই অর্জন ও উচ্ছ্বাস ছিনতাই করার জন্য রাজনৈতিক তস্কররা ওৎ পেতে বসে আছে। সরকার বগল বাজিয়ে বলছে ও ভাবছে তাদের অ্যাজেন্ডা তরুণ সমাজ বাস্তবায়ন করে দিচ্ছে। আর প্রতিপক্ষ ভাবছে সব ঝুটা হ্যায়। কোনো মূল্যায়ন ও ভাবনাই সঠিক নয়। মিডিয়ায় হামলা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একটা শেষের পর আরো শেষ আছে। সেই ‘শেষ’ রাজনীতিবিদদের খোড়া গর্তে রাজনীতিবিদরাই পড়তে যাচ্ছেন। ঘাড়ে তোলা সত্য ঘাড় মটকায়। যেমন ওঝা মরে সাপ খেলায় বিষধর সাপের দংশনে। রাজনীতিকে যেভাবে বিষাক্ত ও অসহিষ্ণু করে তোলা হচ্ছে তার বিপরীতে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের জন্য শুধু দুঃসংবাদই অপেক্ষা করছে।
digantaeditorial@gmail.com
No comments