ধুলোর কী সাহস by সুশান্ত মজুমদার

মধ্যবিত্তের আবার ড্রয়িংরুম, গৃহস্থের ঘরে ওই পোশাকি নামের মাত্র একখানি জায়গা—তিন বেলা এখানেই খাওয়া, অষ্টপ্রহর বসার সুযোগ; আর রাতে প্রয়োজন হলে পা ছড়িয়ে ফ্লোরে টানটান আঠালো ঘুম। রুমের উত্তর-পুব কোণে পাতা একটা ডাইনিং টেবিল, তিনটি অযোগ্য চেয়ার, এপাশে রংজ্বলা মোটা কাপড়ে আঁটা ছোট দুটো সস্তা সোফা।


পেছনের রুমে ঢোকার দরজা লাগোয়া এমন একটা সোফায় ছুটির আয়েশে গা ছেড়ে সুনীল বসা। সিঁড়ি থেকে উঠে আসছে পায়ের শব্দ। দরজা ঠেলে ভেতরে এল দীপু। বয়সের চেয়ে হূষ্টপুষ্ট অপেক্ষাকৃত লম্বা বাসার এই ছোট ছেলেটা বাবার সঙ্গে চোখাচোখি হলে মিষ্টি করে হাসে। পাশ কেটে সে ভেতরের আড়ালে চলে গেল। ব্যাপার কী! ভুরু বেঁকে আসে সুনীলের। ছেলের শরীরে যেন সিগারেটের গন্ধ। গন্ধ ধরতে লম্বা করে সে শ্বাস টানে—হ্যাঁ, নির্ভুল, গন্ধটা সিগারেটেরই। ঘন বিস্ময়ে সুনীল জমে যেতে থাকে—বয়স মাত্র উনিশ, সে-দিনের ছেলে, এখনো মুখ থেকে যার দুধের গন্ধ যায়নি, নিতান্তই অবোধ, এই সে বাবা-মার চোখের আড়ালে দিব্যি সিগারেট টানছে! ভাবতেই সুনীলের মাথার মধ্যে খর প্রশ্ন ছোঁ মেরে যায়—এত তাড়াতাড়ি বয়সে একা একা তো নেশা হয় না। নিশ্চয় সঙ্গদোষ। তা-ই যদি হবে, ছেলে কাদের সঙ্গে মিশছে, বন্ধু-বান্ধব কারা, খোঁজখবর নেওয়া জরুরি হয়ে যাচ্ছে। এ সময় আরতি ভেতর থেকে এসে জলভর্তি জগ এনে টেবিলে রাখে। ছেলের মা এখন সামনে, কথা শোনা ও শোনানোর এই তো মোক্ষম সুযোগ, রাগ জুড়িয়ে যাওয়ার আগে আগে দু-চারটা ঠেসবাক্য হোক। সুনীলের স্বর প্রশ্ন তুলে ধরে—‘তুমি জানো কিছু?’
স্বামীর শক্ত গলার অমন টং আওয়াজে আরতি ঘুরে দাঁড়ায়। হঠাৎ কী জানাজানি—ঘটনা কী! চোখে-মুখে তাঁর জিজ্ঞাসা ফুটে ওঠে—মানুষটা কী বলতে চাইছে?
সুনীলের নজর নিচে নেমে আসে—আরতির ডান হাতের তালু হলুদ। ও, রান্না করছে সে। ছোট ছেলের সিগারেট টানাটানি নিয়ে কথা ঘোলা করার সময় এখন না। আরতিকে চলে যেতে সুনীলের ইশারা।
কখনো কি সে সিগারেট টেনেছে—হারানো-ফুরানো স্মৃতি খুঁড়ে তুলতে নিজের স্মরণের ওপর চাপ রাখে সুনীল। না, স্কুল-জীবনে গোঁফের রেখা ফুটে ওঠার আগে-পরে ক্লাসের কেউই ধূমপানে ছিল না। ওপরের ক্লাসের কোনো ছেলেকেও ছুটিছাটায়, কি দুষ্টুমি করে সিগারেট টানতে সে দেখেনি। বয়স হলে পর কেবল বড়রাই বিড়ি-সিগারেট কেউ কেউ খায়, এমন ধারণা চালু ছিল। কলেজে গিয়ে তাও বিএ পড়ার সময় বন্ধুরা আড্ডা মারতে মারতে একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। ঘুরে ঘুরে তার আঙুলে এলে জোরে এক টান দিয়েছিল সুনীল। ব্যস, কণ্ঠার কাছে ধোঁয়া আটকে গেলে শুরু বেজায় খক্খক্ কাশি, জল জমে যায় চোখে। ওই প্রথম ওই শেষ তার সিগারেট টানা। মফস্বলবাসী তার বড় ভাই, সত্তরের কাছাকাছি বয়স হলেও এখনো শক্ত-সমর্থ, আজও বাসার বাজার নিজ হাতে করে, রান্নার কাঠ ফাড়তে কুড়াল তুলে খাড়া হয়ে যায়। কই তার সিগারেট কেন, শখ করে হুক্কা টানার কথাও কখনো শোনা যায়নি। তাহলে! তার বড়-ছোট দুই ছেলে বাপ-জেঠা থেকে কি কিছুই শেখেনি? নাকি তার ভুল, ঠিকঠাক চালচলন, জীবনযাপনের শিক্ষা দিতে সে ব্যর্থ হয়েছে? সুনীলের খুব ভেতরে টানা পড়ে। তাৎক্ষণিক জখম বোধ জেগে উঠতে উঠতে মুছে যায় সহসা মন দখল করা একটা জিদের উদয় হলে। ছেলের সঙ্গে কি ঝাঁজাল বাক্যে বোঝাপড়া করবে, নাকি ঘটনা এবারের মতো এড়িয়ে হাতেনাতে সিগারেট ধরার জন্য সে অপেক্ষা করবে? নাকি কিছুই দেখিনি কিছুই বুঝিনি গোছে মুখ তার নিরীহ রাখবে? আপত্তি করার ভঙ্গিতে নিজে নিজে মাথা নাড়ে সুনীল—না, চুপ থাকার সুবাদে ছেলের সাহস ক্রমাগত বেড়ে যাবে, দেখা গেল, হাত নামমাত্র আড়ালে রেখে কিংবা বাবা যখন থাকবে না বাসাতেই দীপু তখন সিগারেট টানছে। ভাবখানা, ও সিগারেট, বাবা তো জানে; আর মা, ধুস কোনো ব্যাপার হলো। সুনীল টের পায় তার মেজাজে উষ্ণতা ক্রমশ জ্বাল পাচ্ছে! না, কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া যায় না, চূড়ান্ত হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। শাসনে না-রাখলে কাঁচা বয়েস থেকেই ছেলেপেলেদের উচ্ছন্নে যাওয়ার শুরু, এখুনি লাগাম না পরালে সর্বনাশ, কালে কালে আরও দুষ্কার্যে ছেলে সাহসী হয়ে উঠবে। পুরোপুরি নেশা-ভাঙে জড়িয়ে গেলে ভবিষ্যৎ সে পয়মাল করে দেবে। তা হলে ঘরের উড়নচণ্ডে স্বভাবের বড় ছেলে নিপু, পূর্ণ যুবকই এখন, সর্বাঙ্গে ওই সিগারেটের বিকট গন্ধ, যার গা ঘেঁষে শুধু হেঁটে গেলেই যে কারও নেশা হয়ে যাবে, তাকে এত কেন সদয় প্রশ্রয় দেওয়া? ভেন্টিলেটারের গ্লাসভাঙা বারান্দার বাথরুমে রাতে ফস করে ম্যাচ কাঠি জ্বলছে কোন হিম্মতে? বারিধারার ওদিকে পরিচ্ছন্ন বাড়ির এক অ্যাড ফার্মে তার চাকরি। ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে শান্তিনগর থেকে সকালে যায়—রাতে ফেরে। কোনো কোনো রাতে সুনীল ঘুমিয়ে পড়ার পর ছেলে আসে। পরদিন আরতির থমথমে মুখ দেখে সে অনুমান করে—বেসামাল ছিল নিপু। মাসের পয়লা সপ্তাহে মায়ের স্নেহময় হাতে হাজার দশেক টাকা দিচ্ছে বলে তার মৌতাত চড়ানো আরাম দেখেশুনে মৌন থেকে অনুমোদন করা ন্যায্য কথা না। বড় ছেলের এই এলোমেলো চালচরিত্র, কেমনে তার চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট দীপুকে সে গাইড করে? ভাইকে করবে সে দেখভাল? অসম্ভব। পারে তো তিনতলা থেকে দৌড়ে নেমে ফুটপাতের টং দোকান থেকে সিগারেট আনতে ছোট ভাইকে অর্ডার করে। অসাধ্য কিছু না, জ্বলন্ত অর্ধেক সিগারেট দীপুর ঠোঁটেও গুঁজে দিতে পারে। খুব ভেতরের নিবিড় জখম বোধে সুনীল সহসা উতলা হয়ে ওঠে। অবশ্যই তারও অনুচিত হচ্ছে, নিপুর আয়ের অংশে সংসার খরচের সংস্থান হয় জেনে তার তৈরি করা ত্রুটি মুখ সেলাই রেখে দেখে যাচ্ছে। সন্তানের জন্মদাতা সে, এদের ভরণপোষণ শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে বড় করে তোলার দায়িত্ব তার। তুমুল টানাটানির কারণে ক্লান্ত হলেও এই গুরুভার বহনে পারতপক্ষে কার্পণ্য করেনি সে। সন্তানের সাধ-আহ্লাদ-দাবি-চাহিদা—সব আবদার পূরণ করলে তাদের কার্যকলাপের জবাবে ন্যায্য কথা শুনিয়ে দেওয়ারও অভিভাবক সে। মুশকিল হচ্ছে, নিপু তার দোষ ওয়াকিফ বলে আগে থেকেই বাবার মুখোমুখি হওয়ার সাহস হারিয়েছে। কখনো সামনে পড়লে এমন দৌড়চালে সরে যায় যেন বাথরুমে যাওয়ার চাপে আছে সে। ছেলের রুম দিয়ে যেতে যেতে সুনীল থমকে কখনো দৃষ্টি দিলে দেখা গেল নিপু কম্পিউটারে এমন মনোযোগ ধরে রেখেছে যে কোনো মানুষের উপস্থিতি আদৌ টের পাচ্ছে না। ইদানীং দুই কানে সে হেডফোন দিয়েছে। চোখ কম্পিউটারের টার্মিনালে স্থির, বাকি থাকে যে দুই কান তাও গান বা সিনেমার সাউন্ড উপযুক্তভাবে শোনার জন্য ওই হেডফোন দিয়ে ঢাকা। কোনো ডাকাডাকি ছেলের কর্ণকুহরে পৌঁছে না। বেলা যায়, খেতে আসার জন্য মায়ের এত নরম-গরম সরু-মোটা চেঁচামেচি করা স্বর, কিসের কী, সব বৃথা। হেডফোন লাগিয়ে এমন মানুষ অগ্রাহ্য সুনীলের কাছে রীতিমতো বেয়াদবি মনে হয়। ভাবতেই তার মাথা থেকে গরমের চড়া আঁচ নেমে আসে। খানিক ঝিম মেরে নিজের ত্রাণ নিজে ধরে রাখতে সে কৌশল নেয়। তার পজিশন নস্যাৎ করে গোঁয়ার অশিষ্টতা সে দেখাতে যাবে কেন? হোক তার সন্তান, এই জামানার কাণ্ডজ্ঞানহীন ছেলেপেলের সঙ্গে দরকার ছাড়া আলাপ না-করাই উত্তম। এর ফল হয়েছে: বড় ছেলের সঙ্গে সুনীলের বাক্যালাপ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। উভয়ের মধ্যে অদৃশ্য পাতলা একটা দেয়াল উঠছে। ছেলের জন্য এটা দারুণ সুবিধার—বাবা তো কিছু বলছে না, ইচ্ছামতো রাতে সে বাসায় ফিরছে। তার যাওয়া-আসা দিনযাপনের সঙ্গে বাবার কোনো সম্পর্ক নেই। কী মজা! যত ঘোরালো-প্যাঁচালো কথা হোক, কি স্বরের ঝাঁজ ছড়িয়ে কিছু আদায় করার মতলববাজি হোক, সব তার মায়ের সঙ্গে। আরতিও ছেলের পর্ব স্বামীর কাছে তোলে না। সে জানে নিপু-প্রসঙ্গ পেশ করলে সুনীলের এক কথা—‘ভাত বন্ধ করে দাও।’ আরতি তখন কোন্দল করা অসন্তোষ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়—‘তুমি দাও, তোমার বাসা, আমার কী, ছেলে তো আমার একার না।’ এর পরই আরতির স্বরে মেঘোদয় হয়—‘গত জন্মে মনে হয় পাপ করেছিলাম। এ-জন্মে তার প্রায়শ্চিত্ত করছি।’ বোঝ এবার, ঘরের বউয়ের খেদ-আক্ষেপের হাঁ-হুতাশে যদি জোর বাড়ে, তার চিল-চেঁচানি আশপাশের জানালার ফাঁকে উড়ে যায় তবে মানুষজন ভাববে কী—স্বামীটা নির্ঘাৎ ইতর, বউয়ের সঙ্গে খালি দুর্ব্যবহার করে।
সুনীলের মলিন ভাড়াবাসাটা শান্তিনগরের তিনতলায়। সিলিং-দেয়াল-বাথরুম-রান্নাঘর সবখানে এখন বাসিগন্ধের প্রলেপ। স্বাস্থ্যহানিকর দাগি বাসাটা ছেড়ে অন্য কোথাও একখানা আরাম কুরসিতে বসবে এমন সামর্থ্য তার নেই। এদিকে পরিচয়দানে অযোগ্য যে চাকরির কলম পিষে কালো চুল সাদা করে এনেছে সেখানে বেতন আর বাড়ছে না। হাজার হাজার বেকার থেকে সুলভে অফিসে লোক পাওয়া দুষ্কর না। মালিক মহোদয় এখনো তাকে এই বয়সেও কাজে রেখে বেতন দিয়ে যেন ধন্য করছেন। ভাবখানা: পুরোনো কর্মচারী, পয়লা থেকে আছে—কী আর করা!
কয়েক গজ দূরে পাশের নতুন বিল্ডিংয়ের তিনতলার ছিমছাম যে ফ্ল্যাট ওই বাসার ফরসা ভদ্রলোক সম্প্রতি চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন। পেনশন বাবদ মোটা অঙ্ক—লাখ লাখ টাকা তিনি পাবেন। শুনে আরতি স্বামীর কাছে জানতে চেয়েছিল তার অফিসেও এমন সুব্যবস্থা আছে কি না। বছরে দুবার সুনীলের চাকরিতে বেতনের সিক্সটি পার্সেন্ট বোনাস ছাড়া আর কোনো আর্থিক সুবিধা নেই। বউয়ের কৌতূহলের সামনে ঠোঁটে আঠা জমিয়ে চুপ করে আছে দেখে শুরু হয় আরতির ঠেসবাক্য। তা হলে আগামী দিনগুলো সচল বলো কি জীবিত বলো নির্ভর করতে হচ্ছে নিপুর চাকরির পর। দাঁড়াচ্ছে কী, ছেলের পেছনে খরচ করেছি এখন অন্নজলের জোগান দিক সে। ছেলে তখন চাটি মারলেও হজম করো। ধুর, তীব্র-আপত্তি সুনীলের মাথার কুঠুরিতে শোর তোলে। মেরুদণ্ড বাঁকা কুঁজো জীবন তার কাম্য নয়। আচ্ছা, এই সংসারে মাত্র চারটি প্রাণী, চার চরিত্র—এদের এত দ্বন্দ্ব! ভাবতেই, নিপুর আর এক দোষ উঠে এসে সুনীলের সামনে খাড়া হয়। নিজের মর্জি হলে সবকিছুতেই ছেলের তাড়াহুড়া। এত ডাকাডাকি, আসে না আসে না, হঠাৎ খাওয়ার টেবিলে এসে হামলে পড়ে সে। কাকস্নান সেরে হাফপ্যান্ট পরা নিপু টেবিলে খাওয়ার কী কী আছে সব ঢাকনা তুলে তদন্ত করে। মেঘবাদল না-থাকলে প্রতি ভোরে সুনীল হাঁটতে বের হয়—অনেক দিনের অভ্যাস। রমনা পার্কে চক্কর মেরে ফেরার সময় বেইলি রোডে বসা ভাসমান বাজারের মাছ-তরকারি সে প্রায়ই কিনে থাকে। তরকারির দাম নাগালের মধ্যে থাকলেও তার মতো নির্দিষ্ট উপার্জনের মানুষের মাছ কেনার ক্ষমতা দিনে দিনে ক্ষয়ে আসছে। সাধারণ গুঁড়ো মাছের দাম পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে এখন। খদ্দেরদের ওপর মাছওয়ালাদের এমন দৃষ্টি—কিনবেন না, বেশ, মাছের ওপর চোখ দেওয়ার কারণে পারলে কিছু পয়সা দিয়ে যান। নাগালের মাছ ছাড়া কী কিনবে সে! দেখো, তেলাপিয়া মাছের রান্না উঁহু, ধুস মুখে ভেংচি রেখে নিপু নিজস্ব অপছন্দের আওয়াজ রুমের মধ্যে ছুড়ছে।—‘এসব হাবিজাবি খাওয়া যায়? ছুটিছাটার দিনে কোথায় বেটার কিছু থাকবে।’ অবাধ্য এক উত্তেজনা মুহূর্তে সুনীলকে দখল করে; আর তা কণ্ঠ হয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে পাথুরে শব্দ হয়ে যায়।—‘ভালো কিছু বাজার থেকে আনলে হয়। কখনো তো দেখলাম না।’ শ্লেষবাক্যের জবাবে জোর পদক্ষেপে নিপু রুম ছেড়ে যায়। এ-সময় ভাতের গামলা হাতে আরতি কেবল রুমে ঢুকেছে। বড় ছেলে অমন অন্ধকার মুখে চলে যাচ্ছে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে স্বামীর ওপর সে চাহনি দেয়। তার খরখরে স্বরের ধারে সুনীল এবার চেরাই হতে থাকে।—‘ছেলেটার পেটে আছে কিছু, সেই সকালে এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট খেয়েছে, এখন খাবে ভাত, তা না, ছেলেটাকে তাড়িয়ে ছেড়েছে।’ ভয়ংকরী রূপ ধরে আরতিও ভেতরে যায়।
এ ঘটনার পর সাত-আট দিন গেছে। বাবার মুখোমুখি কখনো পড়লে নিঃশব্দে নিপু পাশ কেটেছে—কথা বলেনি। হতে পারে, তার ভেতরে বলার মতো কোনো কথা জমা নেই। তবে চেহারা-ছবিতে পরিষ্কার সন্তোষ, আগের মতোই স্বাভাবিক। যথারীতি নিত্য অভ্যাসে দীপু কথার ফোয়ারা চালু রেখেছে। আজগুবি থেকে নির্ভেজাল কত তার নানা কথাবার্তা।—‘বুঝলে বাবা, আর দুই সপ্তাহ দুই দিন বাকি অ্যালান টিউরিংয়ের জন্মশতবার্ষিকীর।’ হঠাৎ ভিন্ন এক প্রসঙ্গ আর টিউরিং, কার নাম বলছে—সুনীল হাঁ-মুখে স্থির চেয়ে থাকে। কোন কথা থেকে কোন কথায় যে চলে যায় ছেয়েটা। বাবার অবুঝ ফাঁপা-চাহনি দেখে মোলায়েম করে দীপু হাসে—‘মাই ওল্ড ড্যাড। অ্যালান টিউরিংকে তুমি ক্যামনে জানবে! হান্ড্রেড ইয়ারস হলো, লন্ডনের প্যাডিংটন হসপিটালে কম্পিউটার সায়েন্সের এই ফাদারের জন্ম। দুঃখ কী জানো, বয়স বিয়াল্লিশ হওয়ার আগে সুইসাইড করে সে। তার ডেডবডির পাশে কাপড় দেওয়া একটা আপেল পাওয়া যায়। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট: আপেলের সঙ্গে সায়ানাইড মেশানো ছিল।’ হঠাৎ দীপুর কম্পিউটার সায়েন্টিস্টের সুইসাইডের কথা কেন? আগেও কখনো কখনো কথাচ্ছলে জানা-অজানা মানুষের মৃত্যু নিয়ে সে বলেছে। ফিজিক্স হচ্ছে দীপুর প্রিয় সাবজেক্ট। ফিজিক্সের উদাহরণই সে বেশি বেশি টেনে আনে। দাঁড়াল কী, সুনীলের গত ও বর্তমান মিলিয়ে আটপৌরে জীবন, জানাজানি কম, শ্রোতা হওয়া ছাড়া কথকের খুব একটা সুযোগ তার হয় না। কিন্তু সুইসাইডের বিভিন্ন উদাহরণ তুলে প্রকারান্তরে সুনীলকে কি ভয় দেখায় দীপু? ছেলের মুখে আত্মহত্যার গল্প শুনলে ধীরে ধীরে শরীরে তার হিম ভেঙে আসে।
ছুটিছাটার দিনেই দুপুরে একসঙ্গে হয় চার চেহারা। হঠাৎ ছুটির কোনো ঝকঝকে দুপুরে টেবিলের চেয়ার একটা ফাঁকা থাকে। বড় ছেলের শখ নয়ন-নন্দন ছবি তোলা। ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে ফিরতে ফিরতে তার দুপুর গড়িয়ে যায়। নিজের রুমে এসে কোথায় বিশ্রাম করবে, তা না, কম্পিউটারের সামনে বসে পড়ো, ছোট ভাইকে পেলে তো শুরু হয় তার উচ্ছ্বাসময় অনর্গল কথা—‘বুঝলি, অফিসার্স ক্লাবের চৌমাথায় দাঁড়িয়ে অন করেছি, ওমা, পাশে দেখি উৎসুক মানুষ, ক্যামেরা দেখলেই ভিড়।’ নিপু গ্রাফিকসে মাস্টার্স। তার এক্সট্রা যোগ্যতার জন্য ডিএসএলআর ক্যামেরা চাই। ভালো, তার বেতনের টাকা জমিয়ে সে ক্যামেরা কিনবে—কিনুক। কিন্তু দাঁড়াল কি, সংসারের এ-খরচ ও-খরচ ছাঁটাই করে হাজার দশেক টাকা ছেলের ক্যামেরার জন্য সুনীলকে দিতে হলো। কষ্টের এই ভোগ সে কি বোঝে? বাবার মন ভেজাতে কিছু টাকা মাসে মাসে সে ফিরিয়ে দেবে বললেও ছেলের কথার ওপর সুনীল আস্থা রাখেনি।
ছোট হলেও দীপুর কথায় থাকে বিভিন্ন মোচড়, চালচলনে কোথায় জানি তার সেয়ানা ভাব। তার চাহিদা সে গচ্ছিত রেখেছে ভবিষ্যতের কাছে। তবে বড় কোনো আকাঙ্ক্ষা এখনো তৈরি হয়নি বলে বাবার ওপর বর্তমানে তার প্রেশার নেই। দীপুর দাবি কী? ও-লেভেল পাসের পর সে এ-দেশে আর নেই। এশিয়া-ইউরোপ না, উত্তর আমেরিকায় উড়ে যাবে, সেটেল সে ওখানে হতে চায়। ওয়ার্ক পারমিট জোগাড় হলে কাজের ফাঁকে লেখাপড়া করবে। কানাডার এডুকেশন নাকি বেটার, ভ্যালু আছে, লেখাপড়া জানলে সব সহজ ওখানে। খুশি খুশি ভাব নিয়ে একাধিকবার বাবাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে সে—কাস্টমসের রিটায়ার্ড কোন বন্ধু আছে কোথায়, তার মেয়ে আছে টরেন্টো ইউনিভার্সিটিতে, যোগাযোগ রেখো, কাজে লাগবে। দীপুর ধারণা: এ-দেশে চরম ডার্ক এজ চলছে, কোনো উন্নতির সম্ভাবনা নেই—ফিউচার জিরো। বিস্ময়ে ছোট ছেলের ওপর থেকে সুনীল চোখ সরাতে পারে না। এসব কি দীপুর নিজস্ব কথা? দীপু জানে না, ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর কোনো সামর্থ্য তার বাবার নেই। বড়লোকের ছেলেপেলেরা বন্ধু হলে তাদের যাবতীয় সঙ্গদোষ মধ্যবিত্তের মনে চালান হয়ে আসে। মেজাজ-মর্জি, চালচলন সব তখন ফুলে-ফেঁপে ঢোল। নিজের সীমা নিয়ে সঠিক ধারণা থাকে না।
টিভি অন করে সুনীল। সাউন্ড কমিয়ে খবর শুনতে শুনতে প্লেটে সে ভাত নেয়। দীপু বড় ভাইয়ের মুখে রগুড়ে চাহনি দিয়ে এবার বাবাকে দেখে, মুখে মিঠেল হাসি সে জ্বেলে রেখেছে। নিপু বিরক্ত—খাওয়া নিয়ে খিটিমিটি তার আছেই।—‘কই মাছ মানুষ কেমনে খায়? হাইব্রিড মাছ, টেস্ট নেই—কাঁটা শক্ত।’ পারলে কই মাছ, এই মাছের গুষ্টিগোত্র, এমনকি কই মাছের ক্রেতার ওপর দিয়ে সে মনের ঝাল মিটিয়ে নেয়।
ডাইনিং টেবিলে কোনো ছুতানাতায় নিপু তার স্বভাবসুলভ অসন্তোষ ছড়িয়ে খাওয়ার পরিবেশ বিস্বাদ করে দিতে পারে ভেবে সুনীল সতর্ক থাকে।
টিভিতে সরকারের খবরের পর এবার বিরোধী দলের সংবাদ—দুর্নীতির কারণে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, এই সরকারের জনপ্রিয়তা এখন শূন্যের কোঠায়। সুনীলের প্লেটে হাত, ঘাড়ে চাপ, চোখ টিভি স্ক্রিনের ওপর ধরা দেখে দীপু বিরাগ স্বর উড়িয়ে বাবার মনোযোগ টলিয়ে দিতে চায়—‘যত বাজে প্যাঁচাল। ডার্টি পলিটিকসের কী শোনো তুমি? বোর ফিল করো না?’ দীপু বড় ভাইয়ের সমর্থন আদায়ে আঙুল বাড়িয়ে টিপ দেয়। অনেক অতলে বুঝি নিপু ডুবে ছিল, এতক্ষণে তার হুঁশ ফিরেছে—‘ও টিভি নিউজ, রাবিশ।’ বাবার উদ্দেশে এবার তার মোটা স্বর—‘এত খবর দেখলে, নিজে কখনো হলে না।’ প্লেটে রাখা সুনীলের হাত এবার জমেই যায়। তাকে কি নিপু ব্যঙ্গ করছে, না এটা বাবার নিরুপদ্রব গোবেচারা জীবন নিয়ে সমব্যথী ছেলের নিরীহ উক্তি, কোনটা? যাই হোক, একটা বিষয় এখন পরিষ্কার—ছেলে বাবার পুরোনো ডালে কিছুই বসার পক্ষপাতী না। ডানা সে ঝাপটাবে—উড়াল দেবে। ভালো ভালো।
—‘টিভি বন্ধ করে দিই বাবা। কেউ তো দেখছে না।’ দীপু রিমোট টিপতে যাবে তখুনি যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে খবর শুরু হলে সুনীল হাত তুলে ছোট ছেলেকে নিবৃত্ত করে।
—‘এই আর এক সাবজেক্ট!’ দীপুর বাঁকা কণ্ঠে সুনীলের অবাক হওয়ার পালা। ছেলেটা কি অসময়ে সাবালক হয়ে গেছে, নচেৎ কি কথা, কি ঘটনার সঙ্গে অত জড়িয়ে পড়া কেন; আর বয়স্কদের মতো এত মুখভঙ্গি, কথা কখনো বাঁকা কখনো জটিল করে তোলা, এত তাড়াতাড়ি সে ঘোরপ্যাঁচ শিখল কীভাবে? একেই তবে ইচড়ে পাকা বলে! উত্তম, এক ছেলে ওপরে ওঠার সিঁড়ি খুঁজছে, আরেক ছেলে এই বয়সে স্নব—দেশের কোনো কিছু ভালো না। মাথার মধ্যে তার পরবাসী হওয়ার স্বপ্ন।
‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতে হবেই। চক্রান্ত করে এই বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত করা যাবে না’—সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সচিত্র সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে।
দীপু এঁটো ডান হাত সামান্য তুলে হিসাব করে—‘দুই হাজার বারো সাল এখন, যুদ্ধ হয়েছে উনিশ একাত্তরে, চল্লিশ-একচল্লিশ বছর হলো, এত দিন আগের, এর ওপর তো ধুলো পড়ে গেছে। বাবা—।’ দীপুর গাঢ় স্বর টেবিলে প্লেটে, পরে ফ্লোরে পড়ে ছড়িয়ে যায়।—‘তোমরা যারা ফ্রিডম ফাইটার, এখন কি মনে হয় যুদ্ধ করে ভুল করেছ?’ নিপুর গলা মুহূর্তে তেড়ে ওঠে—‘ধুর, তোর এত চ্যাটাং কথা কেন?’ কশেরুকায় কাঁ কাঁ বেগে ছড়িয়ে পড়ছে। যুদ্ধ করে ভুল, কিসের ভুল, বলে কী ছেলে! মুক্তিযুদ্ধ না হলে সংখ্যালঘু হওয়ার অপরাধে তাদের উদ্বাস্তু হতে হতো কিংবা পাকিস্তান নামের ব্যর্থ একটা রাষ্ট্রের থার্ড ক্লাস নাগরিকের হীন পরিচয়ে থাকতে হতো। যুদ্ধ করে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা না হলে কোথায় জন্মাত এই ছেলেপেলেরা। সবই যুদ্ধ করে পাওয়া। যুদ্ধ, অমন শ্রেষ্ঠ কীর্তির ওপর কেমনে ধুলো পড়ে।
—‘ইমপসিবল’ সুনীলের কণ্ঠছেঁড়া জোর আওয়াজের প্রতাপে নিপু-দীপু দুজনই খানিক ভয়ে খানিক বিস্ময় মিশেলে বাবাকে অপলক দেখে। অমন বাঁচা-মরার যুদ্ধের ওপর ধুলো, উহু, হতেই পারে না, সুনীল তার নাগালের টেবিলের অংশে দুহাত এগিয়ে ধুলো সরাতে তৎপর হয়।

No comments

Powered by Blogger.