গ্রামীণ ব্যাংকের সার্চ কমিটি-যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ প্রশমন করুন
দীর্ঘদিন ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের থাকা না থাকা নিয়ে বিতর্ক, তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া, পরবর্তী সময়ে সার্চ কমিটি গঠনের ঘোষণা এবং সর্বশেষ সার্চ কমিটিতে তাঁর অন্তর্ভুক্তির প্রশ্ন নিয়ে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর গত দেড় বছরেও এ প্রতিষ্ঠানে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়ে ওঠেনি। একজন নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দিতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। সম্প্রতি এই পদে নিয়োগের জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছে সরকারের দায়িত্বশীল মহল। খোদ অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, যে সার্চ কমিটি গঠিত হবে, সেখানে ড. মুহাম্মদ ইউনূস থাকবেন না। সরকারের যুক্তি হলো, যিনি এতকাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন, তিনি কোনোক্রমেই সার্চ বা নিয়োগ অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান হতে পারেন না। সরকারের এ সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্র প্রকারান্তরে নাখোশ হওয়ার কথাই জানিয়েছে। মঙ্গলবার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে গভীর উদ্বেগের কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে এই ব্যাংকের গুরুত্ব এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাৎপর্য তুলে ধরে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ব্যাংকের অখণ্ডতা ও কার্যকারিতা অক্ষুণ্ন রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্বেগ আমাদের আমলে নিতে হবে। নিঃসন্দেহে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভুলে গেলে চলবে না যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব। যিনি বাংলাদেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে এনেছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও অকল্পনীয়। সুতরাং ব্যক্তিগতভাবে তাঁর মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখাও আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু সবার কাছেই এটা পরিষ্কার যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সরকারের একটি শীতল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বা অনেক দিন ধরেই চলছে, যা কোনো পক্ষের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে কি না সে ব্যাপারে সংশয় রয়েছে। অন্য বাস্তবতাও সরকারকে বিবেচনায় রাখতে হবে। তা হলো যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন অংশীদার; বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রাহক। সুতরাং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশ্নে অনড় থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিরাগ করা সরকারের জন্য দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কাজ হবে না এবং তা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেও উজ্জ্বল করবে না। এটা মনে রাখা অবশ্যই কর্তব্য, বিশ্বের পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষুব্ধ করে তুললে আমাদের অর্থনীতিতে তা মারাত্মকভাবে প্রতিফলিত হতে পারে। নিশ্চয়ই দেশের প্রচলিত আইন, সাংবিধানিক রীতিনীতি অক্ষুণ্ন ও অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু সেটা রাখতে গিয়ে তো কারো সঙ্গে সংঘাত বা বৈরিতা সৃষ্টি করার কথা নয়। আমরা জানি, শুধু যুক্তরাষ্ট্র তথা আন্তর্জাতিক মহলেই নয়, দেশের অভ্যন্তরেও এই ধারণা বিদ্যমান আছে যে গ্রামীণফোন ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়টি যতটা না আইনগত জটিলতায় আটকে আছে, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপড়েন। আমরা মনে করি, যে করেই হোক এই ধারণা থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে। সার্চ কমিটি যদি গ্রহণযোগ্য হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ড যদি অব্যাহত থাকে এবং অব্যাহতভাবে প্রশংসিত হয়, তাহলে নিশ্চয়ই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে। অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে, এর ব্যত্যয় ঘটলে দেশ ও জাতিকে অনেক বড় খেসারত দিতে হতে পারে।
No comments