আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৯০)-এই তো আমার বাংলাদেশ by আলী যাকের
স্বাধীন বাংলাদেশে আসার পর থেকে আমাদের মানসিক অবস্থা এমন যে যা দেখছি, যা শুনছি, যা খাচ্ছি_সবই অমৃত মনে হচ্ছে। সকাল ৮টার দিকে একটা নৌকার সঙ্গে রফা হলো। তারা আমাদের সবাইকে এক নৌকায় পেঁৗছে দেবে আরিচা ঘাটে।
আমাদের মধ্যে দুজন মুক্তিযোদ্ধা তাদের হাতিয়ার, সেই স্টার্লিং স্টেন, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল; কিন্তু তাতে কোনো গুলি ছিল না। ওই স্টেনগানগুলো গ্রামের সাধারণ মানুষ একটু ছুঁয়ে দেখতে চায়। যেহেতু হাতিয়ারগুলোতে ম্যাগাজিন লাগানো ছিল না, সেহেতু আমরা ওদের হাতে দিই। ওরা অস্ত্রগুলোর ওপর হাত বোলায় সস্নেহে। যেন ওদের হাতের ভাষায় বুঝিয়ে দিতে চায় যে এই অস্ত্রগুলোর জন্যই ওরা আজ স্বাধীন।
গোয়ালন্দ থেকে আরিচা পাড়ি দিতে দুই ঘণ্টা লেগেছিল আমাদের। ভারি সুন্দর লেগেছিল ওই পথটুকু পেরোতে। রোদের আলোয় চকচক করছে নদীর পানি। মাঝেমধ্যে জেগে উঠেছে একটি-দুটি সোনালি চর। হঠাৎ হাওয়ায় বালুর ঘূর্ণি উঠছে ওই চরগুলোর মধ্যখানে। আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে চলি অভীষ্ট গন্তব্যের দিকে। আরিচা ঘাটটিকেও বোমার আঘাতে উড়িয়ে দিয়েছে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। অতএব, ঘাট থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে নদীর ধারে আমাদের নামিয়ে দেওয়া হয়। আমরা হেঁটে চলি সামনে। একদিকে নদী, অন্যদিকে নানা ধরনের শস্যের ক্ষেত। সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য! সেদিন ফিরতে ফিরতে যা কিছু দেখছিলাম, তা-ই ভালো লাগছিল। এ যেন এক নতুন দেশ আবিষ্কার করেছি আজ। দেশের প্রতিটি মানুষ আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। মনে পড়ে, আরিচার অদূরে একটি গ্রামের কোল ঘেঁষে আসার সময় দুজন গ্রামবাসী অ্যালুমিনিয়ামের কলসি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পথচারীদের পানি খাওয়ানোর জন্য। ঠিক একই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলাম, যখন দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিই। পথে আমাদের থাকা-খাওয়ার কোনো ঠিক ছিল না। দেশের মানুষ আমাদের খেতে দিয়েছে, থাকতে দিয়েছে। সব মানুষ এমন সংবেদনশীল ছিল তখন।
আরিচা থেকে একটি জুতসই বাস খুঁজে পেতে আমাদের বেশ সমস্যাই হলো। বিকেল ৩টার দিকে একটা মুড়ির টিনের মতো বাসে আমরা ৩০ জন এবং সেই সঙ্গে আরো কিছু যাত্রী কোনোমতে গাদাগাদি হয়ে বসে ঢাকার পথে রওনা হলাম। আরিচা যে থানার অন্তর্গত, সেই শিবালয় থানার সঙ্গে আমার অল্পবিস্তর পরিচয় ছিল। এখানে পথের ধারে একটি সরকারি বাংলো আছে, ছোট নদীর ধারে, সেখানে আমাদের এক বন্ধু সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাস করার পর সেটলমেন্টের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য এসেছিল কয়েক দিন। অতি সুন্দর, প্রায় ছবির মতো দেখতে বাংলোটি। একটি ছোট নদীর পাশে। আমরা প্রায়ই সপ্তাহান্তে দিন এবং রাত কাটাতে আমাদের এ বন্ধুর কাছে চলে আসতাম। মাঝেমধ্যে নদীতে নৌকা ভাসিয়ে সারা দিন এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতাম। সেই বাংলোটি বাসের জানালা দিয়ে চোখে পড়ল। এখনো অটুট আছে। বুঝলাম এখানেও নিশ্চয়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল এবং তারা একটু বিলম্বেই এ বাংলো ছেড়ে গেছে। সে কারণেই বাংলোটি বিধ্বস্ত হয়নি। আমি পরে লক্ষ করেছি, যেসব সরকারি ভবনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আসন গেড়ে বসেছিল এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবস্থান নিয়েছিল, সেসব ভবন ক্ষতবিক্ষত হয়নি। এ ভবনগুলো আরো বেশি বোঝা যেত এ কারণে যে ওইগুলোর সামনে-পেছনে বালুর বস্তা দিয়ে এক ধরনের শেল্টার তৈরি করা হতো, যেখানে অস্ত্রধারী সৈনিকরা দিনরাত দাঁড়িয়ে ভবনটিকে পাহারা দিত। আরিচা থেকে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকার দিকে ছুটে চললাম। মানিকগঞ্জের অদূরে তরা ঘাটে আমাদের আরো একটি ফেরি পার হতে হলো। কেননা তখনো ওখানকার মহাসড়কের সেতুটি নির্মাণ করা হয়নি। আবারও বাসের ভেতরে বসে আমরা ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে গাইতে লাগলাম দেশি গান। ঢাকা যতই এগিয়ে এলো কাছাকাছি, ততই আমাদের চোখ বাষ্পাকুল হয়ে উঠল। কী রোমাঞ্চ যে লাগছিল তখন, ভাষায় প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। ঢাকায় পেঁৗছলাম আমরা সন্ধ্যা ৬টায়। বাস এসে থেমেছিল একেবারে নিউ মার্কেটের পাশে। ঢাকা শহরে প্রবেশের পর আমরা কেউই অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। আমাদের মধ্যে মেয়েরা অনেকেই একেবারে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছে। নিউ মার্কেটে নেমে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মধ্য দিয়ে ব্যাগ হাতে আমি হেঁটে চলেছি। আমার গন্তব্য ঢাকার নারিন্দা, যেখানে আমার ভাই ও ভাবি থাকে। অবাক হয়ে গেলাম দেখে যে সন্ধ্যার আধো আলো আধো অন্ধকারের মধ্যেও ঢাকা শহরের রাস্তা লোকারণ্য। হঠাৎ মনে পড়ল আজ ১০ জানুয়ারি। আজই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি জেল থেকে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ফিরে এসেছেন তাঁর প্রিয় বাংলাদেশে। পথে অজস্র নারী-পুরুষের সমাগম। সবাই তাদের নেতাকে একনজর দেখতে নেমে এসেছে শহরের রাস্তায় রাস্তায়। এ দৃশ্য দেখে আমার মনে হলো, ঢাকা শহরে এত নারী ছিল, তা তো কখনো কল্পনাও করিনি! আরো একটি বিষয় মনে হলো, যখন পরাধীনতার শৃঙ্খল যায় ছিঁড়ে, ঔপনিবেশিকের অত্যাচারের শঙ্কা আর থাকে না, তখন এক নতুন প্রাণে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে গণমানুষ। আজ কারো মধ্যেই কোনো দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই। তারা সবাই হাসছে, হাতে হাত ধরে, এদিক থেকে সেদিক ঘুরছে-ফিরছে। পথে অনেকের হাতে ছোটখাটো আগ্নেয়াস্ত্রও দেখলাম। উষ্কখুষ্ক চুল, দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে গেছে। পরনে আধময়লা কাপড়। বুঝলাম এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। আরো একটা বিষয় লক্ষ করলাম, অনেক তরুণ একে অন্যকে সম্ভাষণ জানাচ্ছে 'জয় বাংলা' বলে। এই তো আমার বাংলাদেশ। যে দেশের জন্য দীর্ঘ ৯টি মাস নিপীড়িত হয়েছে সাধারণ মানুষ, যুদ্ধ করেছে অস্ত্র হাতে, জীবন বিসর্জন দিয়েছে অবলীলায়।
(চলবে)
গোয়ালন্দ থেকে আরিচা পাড়ি দিতে দুই ঘণ্টা লেগেছিল আমাদের। ভারি সুন্দর লেগেছিল ওই পথটুকু পেরোতে। রোদের আলোয় চকচক করছে নদীর পানি। মাঝেমধ্যে জেগে উঠেছে একটি-দুটি সোনালি চর। হঠাৎ হাওয়ায় বালুর ঘূর্ণি উঠছে ওই চরগুলোর মধ্যখানে। আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে চলি অভীষ্ট গন্তব্যের দিকে। আরিচা ঘাটটিকেও বোমার আঘাতে উড়িয়ে দিয়েছে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। অতএব, ঘাট থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে নদীর ধারে আমাদের নামিয়ে দেওয়া হয়। আমরা হেঁটে চলি সামনে। একদিকে নদী, অন্যদিকে নানা ধরনের শস্যের ক্ষেত। সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য! সেদিন ফিরতে ফিরতে যা কিছু দেখছিলাম, তা-ই ভালো লাগছিল। এ যেন এক নতুন দেশ আবিষ্কার করেছি আজ। দেশের প্রতিটি মানুষ আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। মনে পড়ে, আরিচার অদূরে একটি গ্রামের কোল ঘেঁষে আসার সময় দুজন গ্রামবাসী অ্যালুমিনিয়ামের কলসি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পথচারীদের পানি খাওয়ানোর জন্য। ঠিক একই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলাম, যখন দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিই। পথে আমাদের থাকা-খাওয়ার কোনো ঠিক ছিল না। দেশের মানুষ আমাদের খেতে দিয়েছে, থাকতে দিয়েছে। সব মানুষ এমন সংবেদনশীল ছিল তখন।
আরিচা থেকে একটি জুতসই বাস খুঁজে পেতে আমাদের বেশ সমস্যাই হলো। বিকেল ৩টার দিকে একটা মুড়ির টিনের মতো বাসে আমরা ৩০ জন এবং সেই সঙ্গে আরো কিছু যাত্রী কোনোমতে গাদাগাদি হয়ে বসে ঢাকার পথে রওনা হলাম। আরিচা যে থানার অন্তর্গত, সেই শিবালয় থানার সঙ্গে আমার অল্পবিস্তর পরিচয় ছিল। এখানে পথের ধারে একটি সরকারি বাংলো আছে, ছোট নদীর ধারে, সেখানে আমাদের এক বন্ধু সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাস করার পর সেটলমেন্টের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য এসেছিল কয়েক দিন। অতি সুন্দর, প্রায় ছবির মতো দেখতে বাংলোটি। একটি ছোট নদীর পাশে। আমরা প্রায়ই সপ্তাহান্তে দিন এবং রাত কাটাতে আমাদের এ বন্ধুর কাছে চলে আসতাম। মাঝেমধ্যে নদীতে নৌকা ভাসিয়ে সারা দিন এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতাম। সেই বাংলোটি বাসের জানালা দিয়ে চোখে পড়ল। এখনো অটুট আছে। বুঝলাম এখানেও নিশ্চয়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল এবং তারা একটু বিলম্বেই এ বাংলো ছেড়ে গেছে। সে কারণেই বাংলোটি বিধ্বস্ত হয়নি। আমি পরে লক্ষ করেছি, যেসব সরকারি ভবনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আসন গেড়ে বসেছিল এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবস্থান নিয়েছিল, সেসব ভবন ক্ষতবিক্ষত হয়নি। এ ভবনগুলো আরো বেশি বোঝা যেত এ কারণে যে ওইগুলোর সামনে-পেছনে বালুর বস্তা দিয়ে এক ধরনের শেল্টার তৈরি করা হতো, যেখানে অস্ত্রধারী সৈনিকরা দিনরাত দাঁড়িয়ে ভবনটিকে পাহারা দিত। আরিচা থেকে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকার দিকে ছুটে চললাম। মানিকগঞ্জের অদূরে তরা ঘাটে আমাদের আরো একটি ফেরি পার হতে হলো। কেননা তখনো ওখানকার মহাসড়কের সেতুটি নির্মাণ করা হয়নি। আবারও বাসের ভেতরে বসে আমরা ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে গাইতে লাগলাম দেশি গান। ঢাকা যতই এগিয়ে এলো কাছাকাছি, ততই আমাদের চোখ বাষ্পাকুল হয়ে উঠল। কী রোমাঞ্চ যে লাগছিল তখন, ভাষায় প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। ঢাকায় পেঁৗছলাম আমরা সন্ধ্যা ৬টায়। বাস এসে থেমেছিল একেবারে নিউ মার্কেটের পাশে। ঢাকা শহরে প্রবেশের পর আমরা কেউই অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। আমাদের মধ্যে মেয়েরা অনেকেই একেবারে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছে। নিউ মার্কেটে নেমে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মধ্য দিয়ে ব্যাগ হাতে আমি হেঁটে চলেছি। আমার গন্তব্য ঢাকার নারিন্দা, যেখানে আমার ভাই ও ভাবি থাকে। অবাক হয়ে গেলাম দেখে যে সন্ধ্যার আধো আলো আধো অন্ধকারের মধ্যেও ঢাকা শহরের রাস্তা লোকারণ্য। হঠাৎ মনে পড়ল আজ ১০ জানুয়ারি। আজই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি জেল থেকে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ফিরে এসেছেন তাঁর প্রিয় বাংলাদেশে। পথে অজস্র নারী-পুরুষের সমাগম। সবাই তাদের নেতাকে একনজর দেখতে নেমে এসেছে শহরের রাস্তায় রাস্তায়। এ দৃশ্য দেখে আমার মনে হলো, ঢাকা শহরে এত নারী ছিল, তা তো কখনো কল্পনাও করিনি! আরো একটি বিষয় মনে হলো, যখন পরাধীনতার শৃঙ্খল যায় ছিঁড়ে, ঔপনিবেশিকের অত্যাচারের শঙ্কা আর থাকে না, তখন এক নতুন প্রাণে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে গণমানুষ। আজ কারো মধ্যেই কোনো দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই। তারা সবাই হাসছে, হাতে হাত ধরে, এদিক থেকে সেদিক ঘুরছে-ফিরছে। পথে অনেকের হাতে ছোটখাটো আগ্নেয়াস্ত্রও দেখলাম। উষ্কখুষ্ক চুল, দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে গেছে। পরনে আধময়লা কাপড়। বুঝলাম এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। আরো একটা বিষয় লক্ষ করলাম, অনেক তরুণ একে অন্যকে সম্ভাষণ জানাচ্ছে 'জয় বাংলা' বলে। এই তো আমার বাংলাদেশ। যে দেশের জন্য দীর্ঘ ৯টি মাস নিপীড়িত হয়েছে সাধারণ মানুষ, যুদ্ধ করেছে অস্ত্র হাতে, জীবন বিসর্জন দিয়েছে অবলীলায়।
(চলবে)
No comments