চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বাড়িয়ে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ জারি-ব্যাংকের সমাপ্তি পর্ব শুরু করল সরকার : ড. ইউনূস
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বাড়িয়ে 'গ্রামীণ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০১২'-এর গেজেট গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা হয়েছে। গত ২ আগস্ট মন্ত্রিসভা গ্রামীণ ব্যাংক আইন সংশোধনের এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেয়।
রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর গত বুধবার আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ থেকে অধ্যাদেশটি জারি করা হয়।
আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, 'জাতীয় সংসদের অধিবেশন না থাকায় রাষ্ট্রপতি এটি অধ্যাদেশ আকারে জারি করেছেন। সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে এটি আইন আকারে পাস করা হবে।'
গ্রামীণ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০১২-এর ১৪ (২) উপধারায় বলা হয়েছে, 'ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে একজন প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য চেয়ারম্যান পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে আলোচনা করে কমপক্ষে তিন সদস্য এবং সর্বোচ্চ পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি করবেন।'
অধ্যাদেশ জারির পর দেওয়া এক বিবৃতিতে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক এমডি ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এর মধ্য
দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের সমাপ্তি পর্ব শুরু করল সরকার। তিনি দেশের তরুণদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, তাঁরা যেন এর মালিকানা গরিব নারীদের কাছে ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন সদস্য কালের কণ্ঠকে জানান, আগে এমডি নিয়োগের জন্য এ কমিটি গঠন এবং এমডি নিয়োগের এখতিয়ার ছিল পরিচালনা পর্ষদের। সংশোধনের কারণে চেয়ারম্যান পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এমডি বাছাই কমিটি গঠন করবেন। তবে এ ক্ষেত্রে পর্ষদের সদস্যদের সঙ্গে চেয়ারম্যানের একমত হতে হবে-এমন নয়। পর্ষদের সদস্যদের দ্বিমত সত্ত্বেও চেয়ারম্যান কেবল তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এই যুক্তিতেই কমিটি গঠন করতে পারবেন।
সংশোধিত অধ্যাদেশে ১৪ (৩) উপধারায় বলা হয়েছে, 'ক্ষুদ্র ঋণ (মাইক্রো-ফাইন্যান্স), পল্লী অর্থনীতি ও অর্থায়ন (রুরাল ইকোনমি অ্যান্ড ফাইন্যান্স) বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনজন প্রার্থীর একটি প্যানেলকে বাছাই কমিটি এমডি হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবে।'
আগের আইনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগের যোগ্যতা হিসেবে 'রুরাল ইকোনমি' এবং 'গ্রামীণ ব্যাংকিং বিজনেস' বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকার শর্ত ছিল।
আইনমন্ত্রী বলেন, 'কারো ক্ষমতা খর্ব করা বা বৃদ্ধি করার জন্য এটি করা হয়নি। গ্রামীণ ব্যাংকে এমডি নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেই আইন সংশোধন করা হয়েছে।'
২০১১ সালের ১২ মে ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে অব্যাহতি পান। গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুযায়ী নতুন এমডি বাছাই করার জন্য ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের একটি সার্চ কমিটি গঠনের এখতিয়ার ছিল। কিন্তু গত দেড় বছরে পর্ষদের সদস্যরা একমত হয়ে সার্চ কমিটির প্রধান নির্বাচন করতে পারেননি। পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা বারবার এ কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূসের নামই প্রস্তাব করেছেন। তবে পর্ষদের চেয়ারম্যান তাতে সম্মতি না দিয়ে নিজেই সার্চ কমিটির প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে পরিচালকরা তাতে রাজি হননি। এ পরিপ্রেক্ষিতে সার্চ কমিটি গঠন করা সম্ভব হচ্ছিল না। গত ২ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে এমডি বাছাইয়ের জন্য সার্চ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ক্ষমতা কমিয়ে চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বাড়াতে অধ্যাদেশ সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। প্রসঙ্গত, গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান সরকার কর্তৃক নিযুক্ত।
গ্রামীণ কমিশনের মেয়াদ বাড়ছে তিন মাস অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গ্রামীণ ব্যাংক ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গঠিত কমিশনের মেয়াদ তিন মাস বাড়ানো হচ্ছে। কমিশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই মেয়াদ বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামী রবিবার বা সোমবার এ ব্যাপারে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সাবেক সচিব মো. মামুনুর রশিদকে প্রধান করে এ কমিশন গঠন করা হয় গত ১৭ মে। তিন মাসের মধ্যে কমিশনের একটি প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল। মেয়াদ বাড়ানো হলে কমিশন আগামী ১৭ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় পাবে।
এই কমিশন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, দুর্বলতা ও প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করবে। এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকে সুশাসন নিশ্চিত করার উপায়, বিশেষ করে এর ব্যবস্থাপনার জবাবদিহিতা ও পরিচালনার স্বচ্ছতার বিষয়ে সুপারিশ করবে। গ্রামীণ ব্যাংক এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য, আইনি অবস্থা এবং এর পরিচালনা বিষয়ে পর্যালোচনা করবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরকারের কী সম্পর্ক, গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সম্পর্ক কী, গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে অবদান রাখছে, এদের সাংগঠনিক, ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক কাঠামো কী_এসব বিষয় চিহ্নিত করবে।
গ্রামীণ ব্যাংকের সমাপ্তি পর্ব শুরু করল সরকার : ইউনূস
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির প্রতিক্রিয়ায় নোবেলজয়ী ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক এমডি ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বহুজনের ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাত্র ৩ শতাংশের মালিক হয়েও প্রধান নির্বাহী নিয়োগের ক্ষমতা নিয়ে নেওয়ার মাধ্যম গ্রামীণ ব্যাংকের সমাপ্তি পর্বের শুরু করল সরকার। এই অবস্থায় তিনি দেশের তরুণদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন, তারা যেন এর মালিকানা গরিব নারীদের কাছে ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়। তিনি এ আশাও প্রকাশ করেন, 'ভবিষ্যতে একদিন আমাদের দেশে এমন সরকার আসবে যাদের প্রথম কাজ হবে, একটি জাতীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গরিব মহিলাদের এই ব্যাংকটিকে গরিব মহিলাদের হাতে তুলে দিয়ে এই ব্যাংকের গৌরবময় অগ্রযাত্রাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে দেবে।'
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো 'আজ একটা কালো দিন' শীর্ষক প্রতিক্রিয়া নিবন্ধে শান্তিতে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'জাতির জীবনে এটা একটা কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ দুঃখ ধারণ করার ক্ষমতা আমার নেই।'
ড. ইউনূস বলেন, 'আইনে সংশোধনী এনে সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী নিয়োগে ভূমিকা রেখে প্রকারান্তরে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার দায়-দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিল। দুনিয়ার কোথাও নজির নাই যে বহুজনের ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী নিয়োগের ক্ষমতা ৩ শতাংশ মালিকানার অংশীদারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।' তিনি আরো বলেন, 'এই সংশোধনীর ফলে গ্রামীণ ব্যাংকের গৌরবময় ইতিহাসের সমাপ্তি পর্বের সূচনা হলো। এখন থেকে গরিব মহিলাদের মালিকানার ব্যাংকটি সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে পরিচালিত হবে।'
গ্রামীণ ব্যাংকের আগের বিধি অনুসারে ব্যাংকের নির্বাহী প্রধান হিসেবে এমডি পদে নিয়োগের এখতিয়ার পরিচালনা পরিষদের কাছে ছিল। ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতা নারীদের প্রাধান্য দিয়েই পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু গত বুধবার জারি করা অধ্যাদেশের ফলে পরিচালনা পরিষদের এ ক্ষমতা রইল না। এখন থেকে সরকার নিযুক্ত চেয়ারম্যান স্রেফ পরিচালনা পরিষদের সঙ্গে 'পরামর্শ' করেই এমডি নিয়োগ দিতে পারবেন।
এর প্রতিক্রিয়ায় ইউনূস বলেন, 'সরকার বলছে যে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এই অচলাবস্থা কে সৃষ্টি করেছিল? ব্যাংকের মালিকরা আইনগত প্রক্রিয়ায় একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য সিলেকশন কমিটি গঠন করেছিলেন। যেহেতু এই সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁরা আমার নাম এবং অন্যান্য সদস্য হিসেবে ড. আকবর আলি খান এবং জনাব খালেদ শামসের নাম প্রস্তাব করেছিলেন, সরকারের প্রতিনিধি, বোর্ডের চেয়ারম্যান এই প্রস্তাব বোর্ডের সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে নারাজ থাকেন। অদ্ভুত পরিস্থিতি। গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আইন কাউকে দেয় নাই। চেয়ারম্যান সাহেব গায়ের জোরে ভেটো দিয়ে যেতে থাকলেন পর পর তিনটি বোর্ড মিটিংয়ে। একেই বলা হচ্ছে অচলাবস্থা। তার জন্য এখন আইন সংশোধন করে পুরো ব্যাংকের ভবিষ্যৎটাই মূলত চেয়ারম্যান সাহেবের হাতে তুলে দেওয়া হলো।'
তিনি বলেন, "সরকার থেকে বারবার বলা হচ্ছে 'আমরা গ্রামীণ ব্যাংক দখল করিও নাই, করতে যাচ্ছিও না। ইউনূস সাহেব মিথ্যাচার করছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকদের কর্তৃত্ব আগের মতোই আছে। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই চেয়ারম্যান সিলেকশন কমিটি গঠন করবেন।' পরামর্শ কখন করে, আর ভোট কখন নেয়? যখন ক্ষমতা একজনের হাতে থাকে তখন পরামর্শ করে। ভোট নেয় যখন ক্ষমতা ভোটদাতাদের কাছে থাকে। গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাদেশ সংশোধন করে এখন মালিকদের ভোটদানের ক্ষমতা রহিত করে তাদের 'পরামর্শ' দেওয়ার ভূমিকায় রাখা হলো। তারপর একক চেয়ারম্যান কর্তৃক তৈরি সিলেকশন কমিটি তিনটি নাম বোর্ডের কাছে দেবে। বোর্ডের সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ থাকবে, যে এই প্রার্থীরা চেয়ারম্যানের চোখের দিকে তাকিয়ে কাজ করবেন। মালিকদের চোখের দিকে তাকিয়ে কাজ করবেন না। যাঁকেই তাঁরা নিয়োগ দিন না কেন, এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না।"
ইউনূস প্রশ্ন করেন, 'যে বোর্ডের কাছে সমস্ত ক্ষমতা আগের মতোই রয়ে গেছে বলা হচ্ছে সে বোর্ড কিছু জানার আগেই সরকার থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে বোর্ড সদস্যরা যা চাচ্ছেন তা হতে দেওয়া হবে না। কেন হতে দেওয়া হবে না? কারণ ক্ষমতা সরকারের হাতে। সরকার বলছে সিলেকশন কমিটি এক সপ্তাহের মধ্যে হয়ে যাবে। এটা কি বোর্ডের কথা, নাকি সরকারের কথা? এবং তাতে ইউনূস থাকবে না। কারণ কী? কারণ সরকার এটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। এটা কি বোর্ডের সিদ্ধান্ত? ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন আকর্ষণীয় অঙ্কের হবে, তা না হলে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পাওয়া যাবে না। এটা কি বোর্ডের সিদ্ধান্ত?'
তিনি বলেন, 'আমি আশাবাদী মানুষ। আমি হতাশ হতে চাই না। নিজের মনে আশার ক্ষীণ আলো জাগিয়ে রাখতে চাই। আমি আগের মতো আবারও দেশবাসীর কাছে আহবান জানাচ্ছি যে, তারা যেন এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করে। আমি দেশের তরুণদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি, তারা যেন একদিন গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকদের এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তাদের ফিরিয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে। গরিব মালিকদের পরিবারের তরুণরাও যেন এই প্রতিজ্ঞা করে যে, তাদের মায়েদের সম্পদ তারা তাদের মায়েদের ফেরত এনে দেবে। তাদের ব্যাংক তাদের কাছে যেন আবার পূর্ণ ক্ষমতায় ফিরে আসে।'
আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, 'জাতীয় সংসদের অধিবেশন না থাকায় রাষ্ট্রপতি এটি অধ্যাদেশ আকারে জারি করেছেন। সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে এটি আইন আকারে পাস করা হবে।'
গ্রামীণ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০১২-এর ১৪ (২) উপধারায় বলা হয়েছে, 'ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে একজন প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য চেয়ারম্যান পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে আলোচনা করে কমপক্ষে তিন সদস্য এবং সর্বোচ্চ পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি করবেন।'
অধ্যাদেশ জারির পর দেওয়া এক বিবৃতিতে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক এমডি ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এর মধ্য
দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের সমাপ্তি পর্ব শুরু করল সরকার। তিনি দেশের তরুণদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, তাঁরা যেন এর মালিকানা গরিব নারীদের কাছে ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন সদস্য কালের কণ্ঠকে জানান, আগে এমডি নিয়োগের জন্য এ কমিটি গঠন এবং এমডি নিয়োগের এখতিয়ার ছিল পরিচালনা পর্ষদের। সংশোধনের কারণে চেয়ারম্যান পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এমডি বাছাই কমিটি গঠন করবেন। তবে এ ক্ষেত্রে পর্ষদের সদস্যদের সঙ্গে চেয়ারম্যানের একমত হতে হবে-এমন নয়। পর্ষদের সদস্যদের দ্বিমত সত্ত্বেও চেয়ারম্যান কেবল তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এই যুক্তিতেই কমিটি গঠন করতে পারবেন।
সংশোধিত অধ্যাদেশে ১৪ (৩) উপধারায় বলা হয়েছে, 'ক্ষুদ্র ঋণ (মাইক্রো-ফাইন্যান্স), পল্লী অর্থনীতি ও অর্থায়ন (রুরাল ইকোনমি অ্যান্ড ফাইন্যান্স) বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনজন প্রার্থীর একটি প্যানেলকে বাছাই কমিটি এমডি হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবে।'
আগের আইনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগের যোগ্যতা হিসেবে 'রুরাল ইকোনমি' এবং 'গ্রামীণ ব্যাংকিং বিজনেস' বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকার শর্ত ছিল।
আইনমন্ত্রী বলেন, 'কারো ক্ষমতা খর্ব করা বা বৃদ্ধি করার জন্য এটি করা হয়নি। গ্রামীণ ব্যাংকে এমডি নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেই আইন সংশোধন করা হয়েছে।'
২০১১ সালের ১২ মে ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে অব্যাহতি পান। গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুযায়ী নতুন এমডি বাছাই করার জন্য ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের একটি সার্চ কমিটি গঠনের এখতিয়ার ছিল। কিন্তু গত দেড় বছরে পর্ষদের সদস্যরা একমত হয়ে সার্চ কমিটির প্রধান নির্বাচন করতে পারেননি। পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা বারবার এ কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূসের নামই প্রস্তাব করেছেন। তবে পর্ষদের চেয়ারম্যান তাতে সম্মতি না দিয়ে নিজেই সার্চ কমিটির প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে পরিচালকরা তাতে রাজি হননি। এ পরিপ্রেক্ষিতে সার্চ কমিটি গঠন করা সম্ভব হচ্ছিল না। গত ২ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে এমডি বাছাইয়ের জন্য সার্চ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ক্ষমতা কমিয়ে চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বাড়াতে অধ্যাদেশ সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। প্রসঙ্গত, গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান সরকার কর্তৃক নিযুক্ত।
গ্রামীণ কমিশনের মেয়াদ বাড়ছে তিন মাস অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গ্রামীণ ব্যাংক ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গঠিত কমিশনের মেয়াদ তিন মাস বাড়ানো হচ্ছে। কমিশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই মেয়াদ বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামী রবিবার বা সোমবার এ ব্যাপারে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সাবেক সচিব মো. মামুনুর রশিদকে প্রধান করে এ কমিশন গঠন করা হয় গত ১৭ মে। তিন মাসের মধ্যে কমিশনের একটি প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল। মেয়াদ বাড়ানো হলে কমিশন আগামী ১৭ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় পাবে।
এই কমিশন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, দুর্বলতা ও প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করবে। এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকে সুশাসন নিশ্চিত করার উপায়, বিশেষ করে এর ব্যবস্থাপনার জবাবদিহিতা ও পরিচালনার স্বচ্ছতার বিষয়ে সুপারিশ করবে। গ্রামীণ ব্যাংক এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য, আইনি অবস্থা এবং এর পরিচালনা বিষয়ে পর্যালোচনা করবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরকারের কী সম্পর্ক, গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সম্পর্ক কী, গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে অবদান রাখছে, এদের সাংগঠনিক, ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক কাঠামো কী_এসব বিষয় চিহ্নিত করবে।
গ্রামীণ ব্যাংকের সমাপ্তি পর্ব শুরু করল সরকার : ইউনূস
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির প্রতিক্রিয়ায় নোবেলজয়ী ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক এমডি ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বহুজনের ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাত্র ৩ শতাংশের মালিক হয়েও প্রধান নির্বাহী নিয়োগের ক্ষমতা নিয়ে নেওয়ার মাধ্যম গ্রামীণ ব্যাংকের সমাপ্তি পর্বের শুরু করল সরকার। এই অবস্থায় তিনি দেশের তরুণদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন, তারা যেন এর মালিকানা গরিব নারীদের কাছে ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়। তিনি এ আশাও প্রকাশ করেন, 'ভবিষ্যতে একদিন আমাদের দেশে এমন সরকার আসবে যাদের প্রথম কাজ হবে, একটি জাতীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গরিব মহিলাদের এই ব্যাংকটিকে গরিব মহিলাদের হাতে তুলে দিয়ে এই ব্যাংকের গৌরবময় অগ্রযাত্রাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে দেবে।'
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো 'আজ একটা কালো দিন' শীর্ষক প্রতিক্রিয়া নিবন্ধে শান্তিতে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'জাতির জীবনে এটা একটা কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ দুঃখ ধারণ করার ক্ষমতা আমার নেই।'
ড. ইউনূস বলেন, 'আইনে সংশোধনী এনে সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী নিয়োগে ভূমিকা রেখে প্রকারান্তরে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার দায়-দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিল। দুনিয়ার কোথাও নজির নাই যে বহুজনের ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী নিয়োগের ক্ষমতা ৩ শতাংশ মালিকানার অংশীদারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।' তিনি আরো বলেন, 'এই সংশোধনীর ফলে গ্রামীণ ব্যাংকের গৌরবময় ইতিহাসের সমাপ্তি পর্বের সূচনা হলো। এখন থেকে গরিব মহিলাদের মালিকানার ব্যাংকটি সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে পরিচালিত হবে।'
গ্রামীণ ব্যাংকের আগের বিধি অনুসারে ব্যাংকের নির্বাহী প্রধান হিসেবে এমডি পদে নিয়োগের এখতিয়ার পরিচালনা পরিষদের কাছে ছিল। ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতা নারীদের প্রাধান্য দিয়েই পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু গত বুধবার জারি করা অধ্যাদেশের ফলে পরিচালনা পরিষদের এ ক্ষমতা রইল না। এখন থেকে সরকার নিযুক্ত চেয়ারম্যান স্রেফ পরিচালনা পরিষদের সঙ্গে 'পরামর্শ' করেই এমডি নিয়োগ দিতে পারবেন।
এর প্রতিক্রিয়ায় ইউনূস বলেন, 'সরকার বলছে যে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এই অচলাবস্থা কে সৃষ্টি করেছিল? ব্যাংকের মালিকরা আইনগত প্রক্রিয়ায় একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য সিলেকশন কমিটি গঠন করেছিলেন। যেহেতু এই সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁরা আমার নাম এবং অন্যান্য সদস্য হিসেবে ড. আকবর আলি খান এবং জনাব খালেদ শামসের নাম প্রস্তাব করেছিলেন, সরকারের প্রতিনিধি, বোর্ডের চেয়ারম্যান এই প্রস্তাব বোর্ডের সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে নারাজ থাকেন। অদ্ভুত পরিস্থিতি। গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আইন কাউকে দেয় নাই। চেয়ারম্যান সাহেব গায়ের জোরে ভেটো দিয়ে যেতে থাকলেন পর পর তিনটি বোর্ড মিটিংয়ে। একেই বলা হচ্ছে অচলাবস্থা। তার জন্য এখন আইন সংশোধন করে পুরো ব্যাংকের ভবিষ্যৎটাই মূলত চেয়ারম্যান সাহেবের হাতে তুলে দেওয়া হলো।'
তিনি বলেন, "সরকার থেকে বারবার বলা হচ্ছে 'আমরা গ্রামীণ ব্যাংক দখল করিও নাই, করতে যাচ্ছিও না। ইউনূস সাহেব মিথ্যাচার করছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকদের কর্তৃত্ব আগের মতোই আছে। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই চেয়ারম্যান সিলেকশন কমিটি গঠন করবেন।' পরামর্শ কখন করে, আর ভোট কখন নেয়? যখন ক্ষমতা একজনের হাতে থাকে তখন পরামর্শ করে। ভোট নেয় যখন ক্ষমতা ভোটদাতাদের কাছে থাকে। গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাদেশ সংশোধন করে এখন মালিকদের ভোটদানের ক্ষমতা রহিত করে তাদের 'পরামর্শ' দেওয়ার ভূমিকায় রাখা হলো। তারপর একক চেয়ারম্যান কর্তৃক তৈরি সিলেকশন কমিটি তিনটি নাম বোর্ডের কাছে দেবে। বোর্ডের সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ থাকবে, যে এই প্রার্থীরা চেয়ারম্যানের চোখের দিকে তাকিয়ে কাজ করবেন। মালিকদের চোখের দিকে তাকিয়ে কাজ করবেন না। যাঁকেই তাঁরা নিয়োগ দিন না কেন, এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না।"
ইউনূস প্রশ্ন করেন, 'যে বোর্ডের কাছে সমস্ত ক্ষমতা আগের মতোই রয়ে গেছে বলা হচ্ছে সে বোর্ড কিছু জানার আগেই সরকার থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে বোর্ড সদস্যরা যা চাচ্ছেন তা হতে দেওয়া হবে না। কেন হতে দেওয়া হবে না? কারণ ক্ষমতা সরকারের হাতে। সরকার বলছে সিলেকশন কমিটি এক সপ্তাহের মধ্যে হয়ে যাবে। এটা কি বোর্ডের কথা, নাকি সরকারের কথা? এবং তাতে ইউনূস থাকবে না। কারণ কী? কারণ সরকার এটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। এটা কি বোর্ডের সিদ্ধান্ত? ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন আকর্ষণীয় অঙ্কের হবে, তা না হলে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পাওয়া যাবে না। এটা কি বোর্ডের সিদ্ধান্ত?'
তিনি বলেন, 'আমি আশাবাদী মানুষ। আমি হতাশ হতে চাই না। নিজের মনে আশার ক্ষীণ আলো জাগিয়ে রাখতে চাই। আমি আগের মতো আবারও দেশবাসীর কাছে আহবান জানাচ্ছি যে, তারা যেন এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করে। আমি দেশের তরুণদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি, তারা যেন একদিন গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকদের এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তাদের ফিরিয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে। গরিব মালিকদের পরিবারের তরুণরাও যেন এই প্রতিজ্ঞা করে যে, তাদের মায়েদের সম্পদ তারা তাদের মায়েদের ফেরত এনে দেবে। তাদের ব্যাংক তাদের কাছে যেন আবার পূর্ণ ক্ষমতায় ফিরে আসে।'
No comments