শ্রেয়া আর সুনিধিঃ মিল-অমিল
তাদের শিরায় একই রক্ত বইছে না। লতা মঙ্গেশকর আর আশা ভোঁসলের মতো মুম্বাইয়ের পেডার রোডের প্রভুকুঞ্জে তারা একসঙ্গে থাকেনও না। কিন্তু এক সময়ে এই দুই বোন যেমন দাপটে ভারতীয় মহিলা প্লেব্যাক গানে রাজত্ব করেছেন, গত ১৩ বছরে সেই দুনিয়ায় এদের দাপটও তেমনই প্রতিরোধহীন। শ্রেয়া ঘোষাল আর সুনিধি চৌহান। এক হিসেবে তারাও যেন দুই বোন।
রাজীব বিজয়কর তাদের ডিএনএ বিশ্লেষণ করলেন গত হপ্তায় তিন জন প্রথম শ্রেণীর সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে আড্ডা হচ্ছিল। বান্দ্রার এক ক্যাফেতে। দেখলাম তারা একটা বিষয়ে একমত। দু’জন গায়িকার রেকর্ডিং থাকলে, মোটামুটি একবেলা কাজ করলেই হয়ে যায়। তারা এতই তুখড়, যে নোটেশান মিলিয়ে গান তুলে, রিহার্সাল করে, ফাইনাল টেক নিয়ে সকালের মধ্যেই কাজ শেষ। তার পর বাড়ি গিয়ে নিশ্চিন্তে দুপুরের ঘুমটা দেওয়া যায়। ঠিক যেমনটা হত পঞ্চাশের দশকে। দুই মারাঠি বোন যখন গাইতেন।
আর এখন? কারা এই দুই গায়িকা?
কারা আবার? শ্রেয়া ঘোষাল আর সুনিধি চৌহান। আপনাদের হয়ত মনে থাকবে দুই মারাঠি বোনকে চালেঞ্জ জানাতে বিভিন্ন সময়ে অনেকেই উঠে এসেছিলেন। গীতা দত্ত, সামশাদ বেগম, সুমন কল্যাণপুর, বাণী জয়রাম, রুনা লায়লার। কিন্তু কেন জানি না, এত জন থাকা সত্ত্বেও লতা মঙ্গেশকর এবং পরবর্তী কালে বোন আশা ভোঁশলে কী করে যেন সবাইকে ছাপিয়ে বলিউডে বহু দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। ওরাই পেরেছিলেন পঞ্চাশের দশক থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত গানের বাজারকে একচেটিয়াভাবে দখল করে রাখতে।
আজকেও গানের দুনিয়াতে রাজত্ব করছেন এমনই ‘দুই বোন’। তাদের রক্তের সম্পর্ক নেই। কিন্তু লতা-আশা যেমন মহিলা প্লে-ব্যাক জগৎটা মোনোপোলাইজ করে ফেলেছিলেন, এই দুই ‘এস’-ও তাই করছেন।
একদিকে শিশুশিল্পী হিসেবে আদেশ শ্রীবাস্তবের হাত ধরে ধূমকেতুর মতো ওঠা সুনিধি চৌহান আর অন্য দিকে ইসমাইল দরবারের আবিষ্কার শ্রেয়া ঘোষাল। যেখানে সুনিধি বলিউডকে উপহার দিলেন ‘রুকি রুকি’র (মস্ত) মতো গান যার ছন্দে দুলেছিল আপামর জনসাধারণ সেখানে শ্রেয়ার ‘বৈরি পিয়া’ (দেবদাস) ছুঁয়ে গিয়েছিল আসমুদ্রহিমাচল শ্রোতাদের হৃদয়। মঙ্গেশকর বোনেদের মতোই এই দুই গায়িকাও তাদের সঙ্গীত জীবন শুরু করেছিলেন ছোটখাটো সুরকারদের সঙ্গে। তাদের হাত ধরেই শ্রেয়া-সুনিধির প্রতিভার সঠিক বিচ্ছুরণ ঘটেছিল।
মঙ্গেশকর বোনেদের সঙ্গে শ্রেয়া সুনিধির জীবনের তুলনা চলে না। তবু কিছু তুলনা কোনও না কোনও ভাবে এসেই পড়ে। ঠিক যে ভাবে মঙ্গেশকর বোনেরা তাদের সমসাময়িক শিল্পীদের পেছনে ফেলে প্রতিভার দৌড়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন, শ্রেয়া আর সুনিধির ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে।
শ্রেয়া আর সুনিধি যখন গানের জগতে এলেন, তখন রাজত্ব করছেন অলকা যাজ্ঞিক, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল লতাজি আশাজির বেলায়। লতার কাছে গানের রোল মডেল ছিলেন নূরজাহান। আশার গানে প্রভাব পড়েছিল গীতা দত্তের। কিন্তু কোনও শিল্পী যখন আরেক সমসাময়িক শিল্পীকে ছাপিয়ে এগিয়ে যান তার কারণ হয়ে ওঠে তার বা তাদের গায়কীর মৌলিক শৈলী।
মিল-অমিল
তবে যেকোনো মুহূর্তেই ভেঙে যেতে পারে শ্রেয়া বা সুনিধির এই একাধিপত্য। হয়তো আজই ঘটল সেটা। কিন্তু বাস্তব তথ্য বলছে গত ১৩ বছরে অজস্র গায়িকা এলেও সুনিধি-শ্রেয়াকে ছাপিয়ে যাওয়া তো দূরস্থান, সমকক্ষও হয়ে উঠতে পারেননি।
সঙ্গীত পরিচালক শান্তনু মৈত্র অনেক কাজ করেছেন শ্রেয়ার সঙ্গে। কিন্তু তার কাছেও শ্রেয়া-সুনিধি একই গোত্রের শিল্পী। “শ্রেয়া আর সুনিধির মধ্যে কোনো তুলনায় আমি যাব না। দু’জনেই উঁচুদরের শিল্পী। সব চাইতে বড় কথা হল এই দুই মেয়ে গত ১৩ বছর ধরে একচেটিয়া ভাবে চালিয়ে তো দিল। আশাজি-লতাজির পর অসামান্য গায়িকাদের দরকার ছিল। সেই ফাঁকা জায়গাটা ওরা দুজনে পূরণ করেছে দাপটের সঙ্গে। তুলনায় কিন্তু রফি-কিশোর-মান্নাদের পর তেমন এককচেটিয়াভাবে গান গেয়ে চলা গায়ক বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে আসেনি। প্রচুর ছেলে গান গাইছে। কিন্তু শ্রেয়া বা সুনিধির মতো অনিবার্য হতে পারছে না।
“আজকাল যদি দশটা গান হিট করে, তার মধ্যে ন’টাই শ্রেয়া বা সুনিধির গাওয়া,” বলছেন শান্তনু।
হিন্দি প্লেব্যাক দুনিয়ায় অবশ্য সাফল্যের দুটো শর্ত আছে। প্রথমত কণ্ঠস্বর আর সুর লাগানোর নতুনত্ব। দ্বিতীয়ত বৈচিত্রময়তা। প্রথমটা একেবারেই ভাগ্যের ব্যাপার। যার আছে তার আছে, যার নেই তার নেই। দ্বিতীয় ব্যাপারটা অনেকটাই নির্ভর করে একাগ্র পরিশ্রম আর সুযোগের ওপর।
শ্রেয়া আর সুনিধি দুজনেই বেড়ে উঠেছেন কল্যাণজি-আনন্দজির সান্নিধ্যে। সেই কল্যাণজি আনন্দজি, যারা ষাটের দশক থেকে বলিউডি শিল্পীদের প্রায় এক তৃতীয়াংশের উত্থান ঘটিয়েছেন।
দিল্লির এক আসরে টেলিভিশন সঞ্চালক তাবাসসুমের নজরে পড়েন সুনিধি। বয়স বছর দশেক তখন। সুনিধির বাবা-মাকে রাজি করিয়ে মুম্বাইয়ে আনার ব্যবস্থা করেন তিনি। বলিউডের বড় বড় গুণিজনদের সঙ্গে আলাপও করিয়ে দেন। শুরু হয় সিনেমার গানে সুনিধির প্রশিক্ষণ। মাস কয়েকের রেওয়াজের পরেই কল্যাণজি আনন্দজির ট্রুপ ‘লিটল ওয়ান্ডারস’-এর উজ্জ্বল তারা হয়ে ওঠেন সুনিধি।
সে সময়ে সুনিধির কাছে সবাই শুনতে চাইতেন ‘লমহে’র সুপারহিট গান ‘মোরনি বাগা মা বোলে’। এবং সুনিধির স্পেশালিটি ছিল, গানটা ইলা অরুণ আর লতা মঙ্গেশকর, দু’জনের গলাতেই গাওয়া। এর পরেই দূরদর্শনে ‘মেরি আওয়াজ সুনো’ জেতেন তিনি। কল্যাণজি আনন্দজির শেষ সাউন্ডট্র্যাকেও গেয়েছিলেন সুনিধি। ছবির নাম ছিল ‘মাসুম গাওয়া’। গায়িকা হিসেবে সুপরিচিত হওয়ার পর সুনিধি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেয়া শুরু করেন।
সুনিধি দিল্লির এক অখ্যাত থিয়েটার কর্মীর সন্তান। অন্য দিকে শ্রেয়া এসেছিলেন একেবারেই ভিন্ন পরিবেশ থেকে।
কাকতালীয়ভাবে শ্রেয়া আর সুনিধি দু’জনেই গানের তালিম শুরু করেন চার বছর বয়সে। ধ্রুপদী সঙ্গীতে পারদর্শী মায়ের কাছেই শ্রেয়ার গান শেখা শুরু। শ্রেয়ার বাবা নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার। রাজস্থানের কোটায় চাকরি করতেন।
বাবার উৎসাহেই শ্রেয়া সপ্তাহে তিন দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাতায়াত করতেন গুরুজি মহেশচন্দ্র শর্মার কাছে গান শিখতে।
মুম্বইতে ‘সারেগামাপা’ অনুষ্ঠানে জিতে এবং কল্যাণজির সান্নিধ্যে বদলে যায় শ্রেয়ার জীবন। কল্যাণজিই উৎসাহেই শ্রেয়ার বাবা বদলি নিয়ে চলে আসেন মুম্বাই। কিন্তু কল্যাণজি দেখে যেতে পারেননি শ্রেয়ার সেই সাফল্য। ‘দেবদাস’ করার আগে দুটি মরাঠি গানের অ্যালবাম প্রকাশ হয় শ্রেয়ার।
ঘটনাক্রমে সুনিধির জীবনে ‘লাকি ব্রেক’ ছিলেন সোনু নিগম। রাম গোপাল বর্মার ‘মস্ত’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক সন্দীপ চৌতার সঙ্গে সুনিধির আলাপ করিয়ে দেন তিনিই।
সে ছবির বিখ্যাত ‘রুকি রুকি থি জিন্দেগি’ গানটি দিয়েই বলিউডের নক্ষত্রলোকে সুনিধি ঢুকে পড়েন। অন্য দিকে দ্বিতীয় দফায় ‘সা রে গা মা পা’তে শ্রেয়ার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে সঞ্জয় লীলা বনশালী তার খোঁজখবর শুরু করেন। পুরনো হিন্দি গানের কয়েকটা মহড়া দিয়ে শ্রেয়া ‘দেবদাস’ এ সুযোগ পেলেন। শ্রেয়ার পাঁচটা জাতীয় পুরস্কারের মধ্যে প্রথমটা এসেছিল ওই ‘বৈরি পিয়া’র সুবাদেই। অন্যগুলো ‘ধীরে জ্বলনা’ (পহেলি), ‘ইয়ে ইশ্ক হায়’ (জব উই মেট), ‘জীব রঙ্গালা’ (মরাঠি ছবি জগোয়া) এবং ‘ফেরারী মন’ (অন্তহীন) গানগুলির জন্য।
অন্য দিকে সুনিধি এনরিকে এগলেশিয়াসের অ্যালবাম ‘ইউফোরিয়া’র ট্র্যাক ‘হার্ট বিট’ আর একটা পাকিস্তানি ট্র্যাকের সঙ্গে গান গেয়েছেন।
শ্রেয়া কিন্তু এখনও বিদেশের কোনো শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেননি।
দু’জনেরই একটা বড় গুণ লাইভ শো-তে দুর্দান্ত গাইতে পারা। বিশেষ করে এই সময়ে যেখানে একটা ট্র্যাক নানা রকম ইলেকট্রনিক কারিগরির মাধ্যমে বানানো হয়। আগেকার দিনের কিংবদন্তি শিল্পীদের মতোই এরা দু’জন নিখুঁত সুরে মঞ্চে গান গাইতে পারেন।
কিছুদিন হল শ্রেয়া আর সুনিধি নন-ফিল্মি গানের দিকেও ঝুঁকেছেন। সুনিধি শাড়ি পরে সাবেকিভাবে বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে মাত করেছেন বাঙালিকে। আর শ্রেয়া বাংলা সিনেমাতেও গাইছেন আবার গজলও গাইছেন। শান্তনু বলছেন, “এখন নানা ধরনের গান দুজনেই গাইছে। শ্রোতাদের হয়তো মনে হতে পারে আমি শ্রেয়াকে বেশি পছন্দ করি। আমার কমপোজিশনে শ্রেয়ার গলা বেশি ব্যবহার করেছি। কারণ আমি যে ধরনের গান কম্পোজ করি তাতে শ্রেয়ার গলা ভালো যায়। সুনিধির গলাও ব্যবহার করেছি বেশ কয়েকবার। সম্প্রতি ‘কৃষ্ণ অ্যান্ড কংস’ বলে একটা ছবিতে সুনিধিকে দিয়ে গাইয়েছি। সে গান শুনলে মনে হবে সুনিধি রকস্টার।” সূত্র: ওরেবসাইট।
আর এখন? কারা এই দুই গায়িকা?
কারা আবার? শ্রেয়া ঘোষাল আর সুনিধি চৌহান। আপনাদের হয়ত মনে থাকবে দুই মারাঠি বোনকে চালেঞ্জ জানাতে বিভিন্ন সময়ে অনেকেই উঠে এসেছিলেন। গীতা দত্ত, সামশাদ বেগম, সুমন কল্যাণপুর, বাণী জয়রাম, রুনা লায়লার। কিন্তু কেন জানি না, এত জন থাকা সত্ত্বেও লতা মঙ্গেশকর এবং পরবর্তী কালে বোন আশা ভোঁশলে কী করে যেন সবাইকে ছাপিয়ে বলিউডে বহু দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। ওরাই পেরেছিলেন পঞ্চাশের দশক থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত গানের বাজারকে একচেটিয়াভাবে দখল করে রাখতে।
আজকেও গানের দুনিয়াতে রাজত্ব করছেন এমনই ‘দুই বোন’। তাদের রক্তের সম্পর্ক নেই। কিন্তু লতা-আশা যেমন মহিলা প্লে-ব্যাক জগৎটা মোনোপোলাইজ করে ফেলেছিলেন, এই দুই ‘এস’-ও তাই করছেন।
একদিকে শিশুশিল্পী হিসেবে আদেশ শ্রীবাস্তবের হাত ধরে ধূমকেতুর মতো ওঠা সুনিধি চৌহান আর অন্য দিকে ইসমাইল দরবারের আবিষ্কার শ্রেয়া ঘোষাল। যেখানে সুনিধি বলিউডকে উপহার দিলেন ‘রুকি রুকি’র (মস্ত) মতো গান যার ছন্দে দুলেছিল আপামর জনসাধারণ সেখানে শ্রেয়ার ‘বৈরি পিয়া’ (দেবদাস) ছুঁয়ে গিয়েছিল আসমুদ্রহিমাচল শ্রোতাদের হৃদয়। মঙ্গেশকর বোনেদের মতোই এই দুই গায়িকাও তাদের সঙ্গীত জীবন শুরু করেছিলেন ছোটখাটো সুরকারদের সঙ্গে। তাদের হাত ধরেই শ্রেয়া-সুনিধির প্রতিভার সঠিক বিচ্ছুরণ ঘটেছিল।
মঙ্গেশকর বোনেদের সঙ্গে শ্রেয়া সুনিধির জীবনের তুলনা চলে না। তবু কিছু তুলনা কোনও না কোনও ভাবে এসেই পড়ে। ঠিক যে ভাবে মঙ্গেশকর বোনেরা তাদের সমসাময়িক শিল্পীদের পেছনে ফেলে প্রতিভার দৌড়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন, শ্রেয়া আর সুনিধির ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে।
শ্রেয়া আর সুনিধি যখন গানের জগতে এলেন, তখন রাজত্ব করছেন অলকা যাজ্ঞিক, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল লতাজি আশাজির বেলায়। লতার কাছে গানের রোল মডেল ছিলেন নূরজাহান। আশার গানে প্রভাব পড়েছিল গীতা দত্তের। কিন্তু কোনও শিল্পী যখন আরেক সমসাময়িক শিল্পীকে ছাপিয়ে এগিয়ে যান তার কারণ হয়ে ওঠে তার বা তাদের গায়কীর মৌলিক শৈলী।
মিল-অমিল
তবে যেকোনো মুহূর্তেই ভেঙে যেতে পারে শ্রেয়া বা সুনিধির এই একাধিপত্য। হয়তো আজই ঘটল সেটা। কিন্তু বাস্তব তথ্য বলছে গত ১৩ বছরে অজস্র গায়িকা এলেও সুনিধি-শ্রেয়াকে ছাপিয়ে যাওয়া তো দূরস্থান, সমকক্ষও হয়ে উঠতে পারেননি।
সঙ্গীত পরিচালক শান্তনু মৈত্র অনেক কাজ করেছেন শ্রেয়ার সঙ্গে। কিন্তু তার কাছেও শ্রেয়া-সুনিধি একই গোত্রের শিল্পী। “শ্রেয়া আর সুনিধির মধ্যে কোনো তুলনায় আমি যাব না। দু’জনেই উঁচুদরের শিল্পী। সব চাইতে বড় কথা হল এই দুই মেয়ে গত ১৩ বছর ধরে একচেটিয়া ভাবে চালিয়ে তো দিল। আশাজি-লতাজির পর অসামান্য গায়িকাদের দরকার ছিল। সেই ফাঁকা জায়গাটা ওরা দুজনে পূরণ করেছে দাপটের সঙ্গে। তুলনায় কিন্তু রফি-কিশোর-মান্নাদের পর তেমন এককচেটিয়াভাবে গান গেয়ে চলা গায়ক বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে আসেনি। প্রচুর ছেলে গান গাইছে। কিন্তু শ্রেয়া বা সুনিধির মতো অনিবার্য হতে পারছে না।
“আজকাল যদি দশটা গান হিট করে, তার মধ্যে ন’টাই শ্রেয়া বা সুনিধির গাওয়া,” বলছেন শান্তনু।
হিন্দি প্লেব্যাক দুনিয়ায় অবশ্য সাফল্যের দুটো শর্ত আছে। প্রথমত কণ্ঠস্বর আর সুর লাগানোর নতুনত্ব। দ্বিতীয়ত বৈচিত্রময়তা। প্রথমটা একেবারেই ভাগ্যের ব্যাপার। যার আছে তার আছে, যার নেই তার নেই। দ্বিতীয় ব্যাপারটা অনেকটাই নির্ভর করে একাগ্র পরিশ্রম আর সুযোগের ওপর।
শ্রেয়া আর সুনিধি দুজনেই বেড়ে উঠেছেন কল্যাণজি-আনন্দজির সান্নিধ্যে। সেই কল্যাণজি আনন্দজি, যারা ষাটের দশক থেকে বলিউডি শিল্পীদের প্রায় এক তৃতীয়াংশের উত্থান ঘটিয়েছেন।
দিল্লির এক আসরে টেলিভিশন সঞ্চালক তাবাসসুমের নজরে পড়েন সুনিধি। বয়স বছর দশেক তখন। সুনিধির বাবা-মাকে রাজি করিয়ে মুম্বাইয়ে আনার ব্যবস্থা করেন তিনি। বলিউডের বড় বড় গুণিজনদের সঙ্গে আলাপও করিয়ে দেন। শুরু হয় সিনেমার গানে সুনিধির প্রশিক্ষণ। মাস কয়েকের রেওয়াজের পরেই কল্যাণজি আনন্দজির ট্রুপ ‘লিটল ওয়ান্ডারস’-এর উজ্জ্বল তারা হয়ে ওঠেন সুনিধি।
সে সময়ে সুনিধির কাছে সবাই শুনতে চাইতেন ‘লমহে’র সুপারহিট গান ‘মোরনি বাগা মা বোলে’। এবং সুনিধির স্পেশালিটি ছিল, গানটা ইলা অরুণ আর লতা মঙ্গেশকর, দু’জনের গলাতেই গাওয়া। এর পরেই দূরদর্শনে ‘মেরি আওয়াজ সুনো’ জেতেন তিনি। কল্যাণজি আনন্দজির শেষ সাউন্ডট্র্যাকেও গেয়েছিলেন সুনিধি। ছবির নাম ছিল ‘মাসুম গাওয়া’। গায়িকা হিসেবে সুপরিচিত হওয়ার পর সুনিধি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেয়া শুরু করেন।
সুনিধি দিল্লির এক অখ্যাত থিয়েটার কর্মীর সন্তান। অন্য দিকে শ্রেয়া এসেছিলেন একেবারেই ভিন্ন পরিবেশ থেকে।
কাকতালীয়ভাবে শ্রেয়া আর সুনিধি দু’জনেই গানের তালিম শুরু করেন চার বছর বয়সে। ধ্রুপদী সঙ্গীতে পারদর্শী মায়ের কাছেই শ্রেয়ার গান শেখা শুরু। শ্রেয়ার বাবা নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার। রাজস্থানের কোটায় চাকরি করতেন।
বাবার উৎসাহেই শ্রেয়া সপ্তাহে তিন দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাতায়াত করতেন গুরুজি মহেশচন্দ্র শর্মার কাছে গান শিখতে।
মুম্বইতে ‘সারেগামাপা’ অনুষ্ঠানে জিতে এবং কল্যাণজির সান্নিধ্যে বদলে যায় শ্রেয়ার জীবন। কল্যাণজিই উৎসাহেই শ্রেয়ার বাবা বদলি নিয়ে চলে আসেন মুম্বাই। কিন্তু কল্যাণজি দেখে যেতে পারেননি শ্রেয়ার সেই সাফল্য। ‘দেবদাস’ করার আগে দুটি মরাঠি গানের অ্যালবাম প্রকাশ হয় শ্রেয়ার।
ঘটনাক্রমে সুনিধির জীবনে ‘লাকি ব্রেক’ ছিলেন সোনু নিগম। রাম গোপাল বর্মার ‘মস্ত’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক সন্দীপ চৌতার সঙ্গে সুনিধির আলাপ করিয়ে দেন তিনিই।
সে ছবির বিখ্যাত ‘রুকি রুকি থি জিন্দেগি’ গানটি দিয়েই বলিউডের নক্ষত্রলোকে সুনিধি ঢুকে পড়েন। অন্য দিকে দ্বিতীয় দফায় ‘সা রে গা মা পা’তে শ্রেয়ার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে সঞ্জয় লীলা বনশালী তার খোঁজখবর শুরু করেন। পুরনো হিন্দি গানের কয়েকটা মহড়া দিয়ে শ্রেয়া ‘দেবদাস’ এ সুযোগ পেলেন। শ্রেয়ার পাঁচটা জাতীয় পুরস্কারের মধ্যে প্রথমটা এসেছিল ওই ‘বৈরি পিয়া’র সুবাদেই। অন্যগুলো ‘ধীরে জ্বলনা’ (পহেলি), ‘ইয়ে ইশ্ক হায়’ (জব উই মেট), ‘জীব রঙ্গালা’ (মরাঠি ছবি জগোয়া) এবং ‘ফেরারী মন’ (অন্তহীন) গানগুলির জন্য।
অন্য দিকে সুনিধি এনরিকে এগলেশিয়াসের অ্যালবাম ‘ইউফোরিয়া’র ট্র্যাক ‘হার্ট বিট’ আর একটা পাকিস্তানি ট্র্যাকের সঙ্গে গান গেয়েছেন।
শ্রেয়া কিন্তু এখনও বিদেশের কোনো শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেননি।
দু’জনেরই একটা বড় গুণ লাইভ শো-তে দুর্দান্ত গাইতে পারা। বিশেষ করে এই সময়ে যেখানে একটা ট্র্যাক নানা রকম ইলেকট্রনিক কারিগরির মাধ্যমে বানানো হয়। আগেকার দিনের কিংবদন্তি শিল্পীদের মতোই এরা দু’জন নিখুঁত সুরে মঞ্চে গান গাইতে পারেন।
কিছুদিন হল শ্রেয়া আর সুনিধি নন-ফিল্মি গানের দিকেও ঝুঁকেছেন। সুনিধি শাড়ি পরে সাবেকিভাবে বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে মাত করেছেন বাঙালিকে। আর শ্রেয়া বাংলা সিনেমাতেও গাইছেন আবার গজলও গাইছেন। শান্তনু বলছেন, “এখন নানা ধরনের গান দুজনেই গাইছে। শ্রোতাদের হয়তো মনে হতে পারে আমি শ্রেয়াকে বেশি পছন্দ করি। আমার কমপোজিশনে শ্রেয়ার গলা বেশি ব্যবহার করেছি। কারণ আমি যে ধরনের গান কম্পোজ করি তাতে শ্রেয়ার গলা ভালো যায়। সুনিধির গলাও ব্যবহার করেছি বেশ কয়েকবার। সম্প্রতি ‘কৃষ্ণ অ্যান্ড কংস’ বলে একটা ছবিতে সুনিধিকে দিয়ে গাইয়েছি। সে গান শুনলে মনে হবে সুনিধি রকস্টার।” সূত্র: ওরেবসাইট।
No comments