ব্যক্তিত্ব-যেন ভুলে না যাই by অনিরুদ্ধ আহমেদ
পরিহাসের ব্যাপার এই যে, বঙ্গবন্ধুর আত্তীকরণে আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর নেতৃত্ব যেমন অতি উৎসাহী, তেমনি বঙ্গবন্ধুর অমর্যাদায় বিএনপি-জামায়াত জোটও তৎপর। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন, সেটা সত্য কথা; কিন্তু তার চেয়েও মস্ত বড় সত্য তিনি সমগ্র দেশের নেতা।
গান্ধী কিংবা জিন্নাহ যেমন ছবি নামানো, ছবি তোলার রাজনীতি থেকে মুক্ত, বঙ্গবন্ধুকেও ওই সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করতে হবে। গোটা জাতি যেন অভিন্ন কণ্ঠে পনেরোই আগস্টে বলে ওঠে : যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই; শয়নে স্বপনে
আপাতদৃষ্টিতে পঞ্জিকার পাতায় পনেরোই আগস্ট একটি তারিখ। কিন্তু বাঙালির ইতিহাসে এটা কেবল একটি সংখ্যা নয়, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের সব অর্জনকে বিসর্জনের একটি দিন। এ তারিখ থেকেই বোধকরি আমাদের জাতীয় দুর্যোগের সূচনা, বাংলাদেশের মানুষকে আলম্বিকভাবে বিভাজনের দুষ্ট প্রয়াস তখন থেকেই। আজকাল অনেকেই নানা কূটতর্কের মধ্য দিয়ে এই বড় মাপের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খাটো করার চেষ্টা করেন, কেউ কেউ এ কথাও বলার চেষ্টা করেন, শেখ মুজিব তো আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি, অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীই হতে চেয়েছিলেন, নিতান্তই পাকিস্তানিদের নিপীড়ন-নির্যাতনই স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছে। আকারে-ইঙ্গিতে পারলে তারা যেন ইয়াহিয়া খান কিংবা ভুট্টোকেই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা দিতে চান। সত্য বটে, শেখ মুজিব কোনো রকম হঠকারিতা নয়, নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। সে কথা বঙ্গবন্ধু তার সাতই মার্চের ভাষণেও বলেছেন যে, বিভিন্ন সময়ে বাঙালিদের বিজয়কে নস্যাৎ করা হয়েছে, তবে হুশিয়ারও করে দিয়েছেন তার নিজস্ব স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণে_ '... আর দাবায়ে রাখতে পারবা না।' কাজেই পাকিস্তানের বজ্রমুষ্টির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় ছিল সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাঙালির বিজয় অর্জন। তিনি ভালোভাবেই জানতেন যে, বাঙালিদের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তর এক অলীক স্বপ্ন। আসল যে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা প্রয়োজন সেটি হলো বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অর্জন।
পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের যে ছয় দফা দাবি উত্থাপিত হলো ১৯৬৬ সালে, তাতে স্বায়ত্তশাসন আর কোনো বিমূর্ত শব্দ হয়ে রইল না। ছয় দফার একশ' শতাংশ বাস্তবায়নে অবিভক্ত পাকিস্তানের অস্তিত্ব যে শেষ হয়ে যাবে সে কথা পাকিস্তানি নেতারা যেমন জানতেন, তেমনি জানতেন মুজিব নিজেও। ১৯৬৬ সালে প্রথম যখন বঙ্গবন্ধু এই ছয় দফা প্রস্তাব দেন তখন থেকেই পাকিস্তানিরা এর বিরোধিতা করেছে এবং তারা বুঝতে পেরেছিল যে এই ছয় দফা বাস্তবায়িত হলে অখণ্ড পাকিস্তান আর্থ-রাজনৈতিকভাবে খণ্ডিত হবেই। ছয় দফা প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান ড. নুরুল ইসলাম তার লেখা Making of A Nation : Bangladesh eBwU‡Z wj‡L‡Qb, ... it was on the basis of the thorough understanding of Six Points Programme that Ayub declared that he would meet the Six Points Programme with the language of the force. ভড়ৎপব. এই শক্তি প্রয়োগ করার সময় পাননি আইয়ুব খান, ঊনসত্তরের যে গণআন্দোলনে শেখ মুজিব হলেন বঙ্গবন্ধু, সেই একই আন্দোলনে আইয়ুবকে নিতে হলো বিদায়। তবে শক্তির ভাষা প্রয়োগ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি তার উত্তরসূরি ইয়াহিয়া খান। ছয় দফার প্রকৃত তাৎপর্য যারা বোঝেননি তেমন বাঙালিদেরও ১৯৭০-৭১-এ বলতে শুনেছি, মুজিব দু-একটা দফা বাদ দিয়ে আপস করে নিলেই তো পারেন। আসলে তারা বুঝতে পারেননি যে, ছয় দফার ব্যাপারে আপস করলে বস্তুত স্বাধীনতার সম্ভাবনাই নাকচ হয়ে যায়। ড. নুরুল ইসলাম তার বইয়ে ছয় দফাকে যে বিস্তারিতভাবে বিশেল্গষণ করেছেন তাতে তিনি এ বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, ছয় দফা এমন এক প্রস্তাব ছিল যা অপিরবর্তনীয়। শেখ মুজিব যে ছয় দফার ব্যাপারে কোনো সমঝোতা করেননি পাকিস্তানিদের সঙ্গে, সেটি তার রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদর্শিতার পরিচয়। কারণ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন, To stay a longer period with Pakistan making compromises would have brought no gain; momentum in East would have been lost. The countrywide total mobilization of the people that was achieved would have been lost; one compromise by East would lead to another… The future of the movement in East would have been thrown into uncertainty| দেশব্যাপী যে একটা গণজাগরণ এসেছিল বাঙালি জাতীয়তাবোধের পক্ষে, সেই নির্ভেজাল অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে বাঙালির ভাগ্য বদলে ব্রতী হলেন শেখ মুজিব। সে সময় আপস করে সহজেই ক্ষমতায় যেতে পারতেন এই অবিসংবাদিত নেতা এবং সেটা হতো সম্পূর্ণ বৈধ ব্যাপারও। তবে তিনি সেই বৈধতাকে ব্যবহার করেছিলেন দেশের মুক্তির জন্য। এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা শেখ মুজিবের ছিল বলেই তিনি সাতই মার্চ এমন একটি দ্ব্যর্থবোধক ভাষণ দিয়েছিলেন, যেখানে একদিকে তিনি যেমন জনগণকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন, তেমনি অন্যদিকে তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই দ্বিবিধ ভূমিকার কেউ কেউ সমালোচনা করতেই পারেন কিন্তু এর প্রয়োজন ছিল বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে বৈধতা প্রদানের জন্য। ছাবি্বশে মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল এতদিনকার রাজনৈতিক প্রস্তুতির, বলা চলে চূড়ান্ত পরিণতি। পরের দিন ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তদানীন্তন মেজর জিয়া যে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন, সেটি নিঃসন্দেহে জনসাধারণকে উজ্জীবিত করেছিল। কারণ মানুষ বুঝতে পারল যে, রাজনীতির সংগ্রাম এখন সামরিক যুদ্ধে রূপান্তরিত হচ্ছে। তবে এ কথা বলে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক আন্দোলন এবং প্রজ্ঞাকে খর্ব করা যথার্থ নয়। আমাদের নিতান্তই দুর্ভাগ্য যে জেনারেল জিয়াউর রহমান, যিনি একসময় অকপটে স্বীকার করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর অবদান বাংলাদেশের স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রামে এবং ৯ মাসের প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধেও যে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন সব প্রেরণার উৎস; তিনিই ক্ষমতা গ্রহণের পর সযত্নে ও সুকৌশলে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা_ এ ধরনের অভিধা এড়িয়ে গেলেন, রাজনৈতিক সুবিধার কারণেই মুজিব-হত্যাকারীদের বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া সংক্রান্ত আইনটি অনুমোদন করান এবং ঘাতকদের পুরস্কৃত করেন। গোটা জাতিকে আদর্শিকভাবে বিভাজনে জিয়ার এই ভূমিকা তাকে সাময়িকভাবে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছিল বৈকি কিন্তু এর জন্য গোটা দেশকে আজও চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। খালেদা জিয়া, যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন পূর্ণ মেয়াদে দু'বার, তিনিই বা কার পরামর্শে পনেরোই আগস্টের বেদনাবিধুর দিনে জন্মদিন পালন করেন সাড়ম্বরে? ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন কি-না, সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, রাষ্ট্রীয় শোকের মুহূর্তে, ব্যক্তিগত আনন্দ-উল্লাসকে তিনি লুকিয়ে রাখতে পারতেন না! আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই প্রজ্ঞার অভাব রয়েছে শীর্ষ নেতাদের মধ্যেও। আওয়ামী লীগের নেতার পদ থেকে মুজিবের যে উত্তরণ ঘটল জাতির জনকে, তাতে তো এ কথা পরিষ্কার হলো যে, মুজিব কোনো দলের নন, মুজিব গোটা দেশের।
তবে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখার এই প্রয়াস কেবল যে বিএনপির সে কথা বললে সবটুকু বলা হয় না। বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগ নিজ সম্পদ হিসেবে কুক্ষিগত করেছে, নির্বাচনে মূলধন হিসেবে ব্যবহার করছে, যার জন্য গোটা দেশকে এর চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। পরিহাসের ব্যাপার এই যে, বঙ্গবন্ধুর আত্তীকরণে আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর নেতৃত্ব যেমন অতি উৎসাহী, তেমনি বঙ্গবন্ধুর অমর্যাদায় বিএনপি-জামায়াত জোটও তৎপর। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন, সেটা সত্য কথা; কিন্তু তার চেয়েও মস্ত বড় সত্য তিনি সমগ্র দেশের নেতা। গান্ধী কিংবা জিন্নাহ যেমন ছবি নামানো, ছবি তোলার রাজনীতি থেকে মুক্ত, বঙ্গবন্ধুকেও ওই সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করতে হবে। গোটা জাতি যেন অভিন্ন কণ্ঠে পনেরোই আগস্টে বলে ওঠে : যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই; শয়নে স্বপনে।
অনিরুদ্ধ আহমেদ : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক ও নিবন্ধকার
আপাতদৃষ্টিতে পঞ্জিকার পাতায় পনেরোই আগস্ট একটি তারিখ। কিন্তু বাঙালির ইতিহাসে এটা কেবল একটি সংখ্যা নয়, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের সব অর্জনকে বিসর্জনের একটি দিন। এ তারিখ থেকেই বোধকরি আমাদের জাতীয় দুর্যোগের সূচনা, বাংলাদেশের মানুষকে আলম্বিকভাবে বিভাজনের দুষ্ট প্রয়াস তখন থেকেই। আজকাল অনেকেই নানা কূটতর্কের মধ্য দিয়ে এই বড় মাপের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খাটো করার চেষ্টা করেন, কেউ কেউ এ কথাও বলার চেষ্টা করেন, শেখ মুজিব তো আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি, অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীই হতে চেয়েছিলেন, নিতান্তই পাকিস্তানিদের নিপীড়ন-নির্যাতনই স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছে। আকারে-ইঙ্গিতে পারলে তারা যেন ইয়াহিয়া খান কিংবা ভুট্টোকেই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা দিতে চান। সত্য বটে, শেখ মুজিব কোনো রকম হঠকারিতা নয়, নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। সে কথা বঙ্গবন্ধু তার সাতই মার্চের ভাষণেও বলেছেন যে, বিভিন্ন সময়ে বাঙালিদের বিজয়কে নস্যাৎ করা হয়েছে, তবে হুশিয়ারও করে দিয়েছেন তার নিজস্ব স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণে_ '... আর দাবায়ে রাখতে পারবা না।' কাজেই পাকিস্তানের বজ্রমুষ্টির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় ছিল সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাঙালির বিজয় অর্জন। তিনি ভালোভাবেই জানতেন যে, বাঙালিদের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তর এক অলীক স্বপ্ন। আসল যে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা প্রয়োজন সেটি হলো বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অর্জন।
পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের যে ছয় দফা দাবি উত্থাপিত হলো ১৯৬৬ সালে, তাতে স্বায়ত্তশাসন আর কোনো বিমূর্ত শব্দ হয়ে রইল না। ছয় দফার একশ' শতাংশ বাস্তবায়নে অবিভক্ত পাকিস্তানের অস্তিত্ব যে শেষ হয়ে যাবে সে কথা পাকিস্তানি নেতারা যেমন জানতেন, তেমনি জানতেন মুজিব নিজেও। ১৯৬৬ সালে প্রথম যখন বঙ্গবন্ধু এই ছয় দফা প্রস্তাব দেন তখন থেকেই পাকিস্তানিরা এর বিরোধিতা করেছে এবং তারা বুঝতে পেরেছিল যে এই ছয় দফা বাস্তবায়িত হলে অখণ্ড পাকিস্তান আর্থ-রাজনৈতিকভাবে খণ্ডিত হবেই। ছয় দফা প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান ড. নুরুল ইসলাম তার লেখা Making of A Nation : Bangladesh eBwU‡Z wj‡L‡Qb, ... it was on the basis of the thorough understanding of Six Points Programme that Ayub declared that he would meet the Six Points Programme with the language of the force. ভড়ৎপব. এই শক্তি প্রয়োগ করার সময় পাননি আইয়ুব খান, ঊনসত্তরের যে গণআন্দোলনে শেখ মুজিব হলেন বঙ্গবন্ধু, সেই একই আন্দোলনে আইয়ুবকে নিতে হলো বিদায়। তবে শক্তির ভাষা প্রয়োগ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি তার উত্তরসূরি ইয়াহিয়া খান। ছয় দফার প্রকৃত তাৎপর্য যারা বোঝেননি তেমন বাঙালিদেরও ১৯৭০-৭১-এ বলতে শুনেছি, মুজিব দু-একটা দফা বাদ দিয়ে আপস করে নিলেই তো পারেন। আসলে তারা বুঝতে পারেননি যে, ছয় দফার ব্যাপারে আপস করলে বস্তুত স্বাধীনতার সম্ভাবনাই নাকচ হয়ে যায়। ড. নুরুল ইসলাম তার বইয়ে ছয় দফাকে যে বিস্তারিতভাবে বিশেল্গষণ করেছেন তাতে তিনি এ বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, ছয় দফা এমন এক প্রস্তাব ছিল যা অপিরবর্তনীয়। শেখ মুজিব যে ছয় দফার ব্যাপারে কোনো সমঝোতা করেননি পাকিস্তানিদের সঙ্গে, সেটি তার রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদর্শিতার পরিচয়। কারণ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন, To stay a longer period with Pakistan making compromises would have brought no gain; momentum in East would have been lost. The countrywide total mobilization of the people that was achieved would have been lost; one compromise by East would lead to another… The future of the movement in East would have been thrown into uncertainty| দেশব্যাপী যে একটা গণজাগরণ এসেছিল বাঙালি জাতীয়তাবোধের পক্ষে, সেই নির্ভেজাল অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে বাঙালির ভাগ্য বদলে ব্রতী হলেন শেখ মুজিব। সে সময় আপস করে সহজেই ক্ষমতায় যেতে পারতেন এই অবিসংবাদিত নেতা এবং সেটা হতো সম্পূর্ণ বৈধ ব্যাপারও। তবে তিনি সেই বৈধতাকে ব্যবহার করেছিলেন দেশের মুক্তির জন্য। এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা শেখ মুজিবের ছিল বলেই তিনি সাতই মার্চ এমন একটি দ্ব্যর্থবোধক ভাষণ দিয়েছিলেন, যেখানে একদিকে তিনি যেমন জনগণকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন, তেমনি অন্যদিকে তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই দ্বিবিধ ভূমিকার কেউ কেউ সমালোচনা করতেই পারেন কিন্তু এর প্রয়োজন ছিল বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে বৈধতা প্রদানের জন্য। ছাবি্বশে মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল এতদিনকার রাজনৈতিক প্রস্তুতির, বলা চলে চূড়ান্ত পরিণতি। পরের দিন ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তদানীন্তন মেজর জিয়া যে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন, সেটি নিঃসন্দেহে জনসাধারণকে উজ্জীবিত করেছিল। কারণ মানুষ বুঝতে পারল যে, রাজনীতির সংগ্রাম এখন সামরিক যুদ্ধে রূপান্তরিত হচ্ছে। তবে এ কথা বলে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক আন্দোলন এবং প্রজ্ঞাকে খর্ব করা যথার্থ নয়। আমাদের নিতান্তই দুর্ভাগ্য যে জেনারেল জিয়াউর রহমান, যিনি একসময় অকপটে স্বীকার করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর অবদান বাংলাদেশের স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রামে এবং ৯ মাসের প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধেও যে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন সব প্রেরণার উৎস; তিনিই ক্ষমতা গ্রহণের পর সযত্নে ও সুকৌশলে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা_ এ ধরনের অভিধা এড়িয়ে গেলেন, রাজনৈতিক সুবিধার কারণেই মুজিব-হত্যাকারীদের বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া সংক্রান্ত আইনটি অনুমোদন করান এবং ঘাতকদের পুরস্কৃত করেন। গোটা জাতিকে আদর্শিকভাবে বিভাজনে জিয়ার এই ভূমিকা তাকে সাময়িকভাবে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছিল বৈকি কিন্তু এর জন্য গোটা দেশকে আজও চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। খালেদা জিয়া, যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন পূর্ণ মেয়াদে দু'বার, তিনিই বা কার পরামর্শে পনেরোই আগস্টের বেদনাবিধুর দিনে জন্মদিন পালন করেন সাড়ম্বরে? ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন কি-না, সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, রাষ্ট্রীয় শোকের মুহূর্তে, ব্যক্তিগত আনন্দ-উল্লাসকে তিনি লুকিয়ে রাখতে পারতেন না! আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই প্রজ্ঞার অভাব রয়েছে শীর্ষ নেতাদের মধ্যেও। আওয়ামী লীগের নেতার পদ থেকে মুজিবের যে উত্তরণ ঘটল জাতির জনকে, তাতে তো এ কথা পরিষ্কার হলো যে, মুজিব কোনো দলের নন, মুজিব গোটা দেশের।
তবে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখার এই প্রয়াস কেবল যে বিএনপির সে কথা বললে সবটুকু বলা হয় না। বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগ নিজ সম্পদ হিসেবে কুক্ষিগত করেছে, নির্বাচনে মূলধন হিসেবে ব্যবহার করছে, যার জন্য গোটা দেশকে এর চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। পরিহাসের ব্যাপার এই যে, বঙ্গবন্ধুর আত্তীকরণে আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর নেতৃত্ব যেমন অতি উৎসাহী, তেমনি বঙ্গবন্ধুর অমর্যাদায় বিএনপি-জামায়াত জোটও তৎপর। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন, সেটা সত্য কথা; কিন্তু তার চেয়েও মস্ত বড় সত্য তিনি সমগ্র দেশের নেতা। গান্ধী কিংবা জিন্নাহ যেমন ছবি নামানো, ছবি তোলার রাজনীতি থেকে মুক্ত, বঙ্গবন্ধুকেও ওই সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করতে হবে। গোটা জাতি যেন অভিন্ন কণ্ঠে পনেরোই আগস্টে বলে ওঠে : যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই; শয়নে স্বপনে।
অনিরুদ্ধ আহমেদ : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক ও নিবন্ধকার
No comments