কেবল ঈদেই নয়... by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

আপনজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে শত কষ্ট সহ্য করে গ্রামে গেছে প্রায় কোটি মানুষ। ভাঙাচোরা রাস্তার কষ্ট, যানজট ও নানা দুর্ভোগ ভুলে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করার জন্য এই ত্যাগ। ঈদ বলে কথা। সারা বছর যেমনই হোক, ঈদটা বাড়িতে করতেই হবে। একেই বলে নাড়ির টান; রক্তের টান ও আত্মীয়তার বন্ধন।


বলা যায়, সারা বছর মানুষ যেন অপেক্ষা করে এই দিনের জন্য। এ ছাড়া যে আর সাক্ষাৎ হয় না আত্মীয়দের মাঝে পরস্পর!
গত সোমবার বাংলাদেশে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়েছে। ঈদ শেষে গ্রামমুখী মানুষ আবার কর্মস্থলে ফিরেও যাচ্ছে। মাঝে কয়েক দিন কাটিয়েছে বাবা-মা, ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। এর মধ্যে অনেকেই আছে, যারা বছরের ঈদের দিনগুলো বাদে অন্য সময়ে বাবা-মাসহ আত্মীয়দের কোনো খোঁজ নিতে পারে না ব্যস্ততার দরুন। ব্যস্ততা হোক আর সমস্যা থাকুক, এভাবে আপনজনদের সারা বছর ভুলে থেকে বছরে শুধু দু'বার ঈদে তাদের খোঁজ নেওয়া ঈদের শিক্ষার পরিপন্থী কাজ; ইসলাম ও নৈতিকতাবিরোধী কাজ। শুধু ঈদের দিন নয়, বছরজুড়ে বাবা-মা ও আত্মীয়দের খোঁজ নেওয়া, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ইসলামের অনুপম শিক্ষা। আত্মীয়তার বন্ধন নিছক কোনো সামাজিক প্রথা নয়। বরং ইসলামে তা মৌলিক বিষয়গুলোর অন্যতম। ইসলাম এ বিষয়কে অন্যান্য ফরজ ইবাদতের মতো গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলাম মনে করে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে চায়, তাকে অবশ্যই আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। কারণ যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে, আল্লাহ তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করেন। যে আত্মীয়তা ছিন্ন করে, আল্লাহ তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। যে ব্যক্তি জান্নাতে যেতে চায়; নামাজ-রোজা আদায়ের পাশাপাশি তাকে অবশ্যই সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে।
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা জরুরি। তা ছিন্ন করা হারাম। এ কথা স্পষ্টভাবে কোরআনে কারিম ও হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। পক্ষান্তরে, যারা এ সম্পর্ক অটুট রাখে না, তীব্র ভাষায় তাদের ভর্ৎসনা করে আল্লাহ বলেন, 'আর যারা আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, তা ছিন্ন করে এবং দুনিয়ায় ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের জন্যই অভিশাপ আর তাদের জন্যই রয়েছে আখিরাতের মন্দ আবাস।'_সূরা আর রাদ :২৫
উলি্লখিত আয়াত ছাড়া কোরআনের আরও কয়েক স্থানে আত্মীয়তা বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে। হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'আল্লাহতায়ালা সকল বস্তু সৃষ্টি করেন। যখন তিনি সৃষ্টির কাজ সমাপ্ত করেন, তখন আত্মীয়তার সম্পর্ক বলে উঠল, 'এটি আপনার কাছে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী হতে আশ্রয়ের স্থান।' আল্লাহ বললেন, 'হ্যাঁ, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, যে ব্যক্তি তোমার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে, আমিও তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করব, আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে, আমিও তাকে ছিন্ন করব?' আত্মীয়তার সম্পর্ক বলল, 'জি অবশ্যই, হে আমার রব। তিনি বললেন, 'এটা শুধু তোমার জন্য।'_বুখারি
হজরত আবু সুফিয়ান (রা.) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে বাণিজ্য সফরে শাম দেশে গেলে সম্রাট হিরাক্লিয়াস তার কাছে হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) বিবরণ জানতে চান। জবাবে তিনি হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) বিবরণ তুলে ধরেন এভাবে, 'তিনি বলেন, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তোমাদের পিতৃবর্গ যা বলেন, তা বর্জন কর। আর তিনি আমাদেরকে নামাজ, সত্যবাদিতা, চারিত্রিক শুভ্রতা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার আদেশ করেন।'_বুখারি
উপরোক্ত হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নবুওয়তের সূচনাকালে যেসব বিষয়ে দাওয়াত দিয়েছেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা তন্মধ্যে অন্যতম। আত্মীয়দের সঙ্গে সদ্ব্যবহার, সদাচার, কষ্ট না দেওয়া এবং তাদের কোনো ধরনের ক্ষতি না করা ইসলামের নির্দেশবিশেষ। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার ফজিলত অনেক। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার দ্বারা মানুষের হায়াত বৃদ্ধিসহ ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, 'যে ব্যক্তি কামনা করে তার রিজিক প্রশস্ত হোক এবং তার আয়ু দীর্ঘ হোক, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে।'_বুখারি ও মুসলিম
আত্মীয়তার সম্পর্কের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। স্বভাব, ধরন, কাল, অঞ্চল ও পাত্রভেদে তা নির্ধারিত হয়। আত্মীয়তার পার্থক্য ও মর্যাদা অনুযায়ী সম্পর্কের ধরন ও মাত্রায় পার্থক্য হয়। উদাহরণত, পিতার সম্পর্ক আর দূরসম্পর্কের চাচাত ভাইয়ের সম্পর্ক এক হতে পারে না। অবস্থা অনুযায়ী এ সম্পর্কের পার্থক্য ঘটে থাকে। রোগী এবং অসহায়ের সম্পর্ক ধনী এবং সুস্থের সমান হয় না। তদ্রূপ বড়-ছোটর সম্পর্কও এক হয় না। অনুরূপভাবে স্থান অনুযায়ী সম্পর্কের মধ্যে পার্থক্য ঘটে থাকে। সম্পর্কের নিদর্শন হলো পরস্পর খোঁজ-খবর নেওয়া, সম্ভাব্য যাবতীয় উপায়ে যোগাযোগ রাখা। সাধ্য অনুসারে সহযোগিতা করা ইত্যাদি। আর এসব তো শুধু দিনবিশেষের নয়; সারা বছরের। তাই বলি, শুধু ঈদেই নয়; সারা বছর
আত্মীয়দের পাশে থাকুন, বাবা-মার সেবা করুন ও তাদের খোঁজ-খবর নিন।
muftianaet@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.