ধাতব পয়সার দিন শেষ by সুমন কায়সার

কানাডা সেন্ট মুদ্রা উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি স্রেফ টাকার অপচয়। কারণ একটি ধাতব সেন্ট মুদ্রা তৈরিতে খরচ হয় ১ দশমিক ৬ সেন্ট। পাশের দেশের এ ঘটনা নতুন করে উসকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো সেন্ট বিতর্ককে।


পেনির যৌক্তিকতা নিয়ে মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন ওঠে যুক্তরাজ্যেও। কয়েক বছর আগেই এক ও দুই পেনিকে বিদায় দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এসব কারণে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি পেনিকে বিদায় দেওয়ার সময় ঘনিয়ে এল?
মজার ব্যাপার, ব্রিটিশদের বহু কিছু ঝেঁটিয়ে বিদায় করলেও মুদ্রার ক্ষেত্রে পেনি নামটা ফেলতে পারেনি মার্কিনরা। সরকারি নাম এবং গায়ে লেখা পরিচয় ‘সেন্ট’ হলেও এক ডলারের শতাংশকে যুক্তরাষ্ট্রের লোকে পেনি বলেই ডাকে। কাজেই খুচরা পয়সার এই পক্ষ-বিপক্ষের বিতর্ককে ‘পেনি বিতর্ক’ বলা হয়তো অসংগত হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রে এক সেন্টের মুদ্রার ওপর বিরক্ত লোকের সংখ্যা কম নয়। ফ্লোরিডার মায়ামির অ্যান্ডি হাসি তাদেরই একজন। অনেকের মতো অ্যান্ডি মনে করেন, শয়ে শয়ে সেন্ট গোনা সময়ের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। ‘প্রতিটা সেকেন্ডেরই দাম আছে। আমরা স্রেফ টাকার অপচয় করেছি এত দিন। নষ্ট করেছি সময়ও।’ পেনি গুনতে গিয়ে প্রতিদিন তাঁর কর্মচারীদের কী পরিমাণ সময় যায়, সে প্রসঙ্গেই কথাটা বললেন অ্যান্ডি।
কলোরাডোর কেওএ ক্যাম্পসাইট প্রতিষ্ঠানটি ২০০৭ সাল থেকেই ‘পেনিলেস নীতি’ অনুসরণ করছে। এর মালিক জিম টার্নার বলেছেন, তাঁর ক্যাম্পে বেড়াতে আসা লোকজন বিষয়টাকে স্বাগতই জানিয়েছে। এ পর্যন্ত কেউ এ নিয়ে আপত্তি করেনি।
তবে অধ্যাপক জেফ গোর বিষয়টাকে খ্যাপামোর পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। দশ বছর ধরে এ বিষয়ে লবিং করে যাচ্ছেন এই ভদ্রলোক। ‘সিটিজেনস ফর রিটায়ারিং দ্য পেনি’ নামে একটি সংগঠনের নেতা তিনি। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) মতো খ্যাতনামা বিদ্যায়তনে অধ্যাপনা করেন। তাঁর মতে, এখনো সেন্ট রাখা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু না। কানাডায় সেন্টের বিদায়ঘণ্টা বাজায় জেফ গোর মহা খুশি। তাই বললেন, ‘অন্তত একটা দেশে কেউ কিছু করছে। এতে একটু আশা পাচ্ছি।’
গত মে মাসে রয়্যাল কানাডিয়ান মিন্ট তার শেষ এক পেনিটি (বা সেন্ট!) তৈরি করে। মুদ্রাটা একটা জাদুঘরে পাঠানো হয়েছে। এ উদ্যোগের পেছনে যুক্তি তুলে ধরে কানাডার অর্থমন্ত্রী জিম ফ্ল্যাহার্টি বলেছেন, এক সেন্ট একটা ‘মূল্যহীন মুদ্রায়’ পরিণত হয়েছে। এর দাম এখন নগণ্য, ব্যবহারও কমে গেছে একেবারে। দেশের বেশির ভাগ মানুষ এ ব্যাপারে মন্ত্রীর সঙ্গে একমত। অঙ্কের হিসাবেও ব্যাপারটা পোষায় না। টাকশালে প্রতি সেন্ট তৈরি ও বিতরণে ১ দশমিক ৬ সেন্ট খরচ পড়ে বলে বছরে কানাডা সরকারের ক্ষতি ১ কোটি ১০ লাখ ডলার।
খরচের হিসাব করলে মার্কিন সেন্ট উৎপাদন বন্ধের পক্ষে যুক্তি হবে আরও বেশি জোরালো। কারণ প্রতি সেন্টের উৎপাদন ও বিতরণ ব্যয় ২ দশমিক ৪ সেন্ট। গত বছর মার্কিন টাকশালে নির্মিত হয়েছে ৪৩০ কোটি সেন্ট মুদ্রা!
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব শিকাগোর অর্থনীতিবিদ ফ্রাঁসোয়া ভেলদে মনে করেন, পেনি একটা অর্থহীন স্মারকে পরিণত হয়েছে। এটা দিয়ে কোনো কাজ হয় না আজকাল।
অতীতে কয়েকটি মুদ্রা বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে ১৮৫৭ সালে বন্ধ করা হয় আধা সেন্টের উৎপাদন। যুক্তরাজ্যে বাজার থেকে আধা সেন্ট তুলে নেওয়া হয় ১৯৮৪ সালে।
নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া এক সেন্ট ও দুই সেন্টের মুদ্রা বাতিল করেছে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। নিউজিল্যান্ড এক কাঠি এগিয়ে বিদায় দিয়েছে পাঁচ সেন্টকেও।
যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল অ্যাকাউন্টিং অফিসের হিসাবে সে দেশের যাবতীয় পেনির দুই-তৃতীয়াংশই বাজারে নেই। এর অনেকগুলোই লোকের হাতে পড়া মাত্রই বাজার থেকে উধাও হয়। হয়তো তা অযত্নে পড়ে থাকে টেবিলের ড্রয়ারে বা অদরকারি জিনিসের মধ্যে। বহু লোক ‘পেনি জার’ বা ‘পিগি ব্যাংকে’ তা জমায়। এভাবে জমা হয় কোটি কোটি পেনি। খুচরা সেন্ট অনেক সময় অবহেলাভরে ফেলেও দেওয়া হয়।
এই বৃত্তান্ত থেকে মনে হতে পারে যে পেনির পক্ষে কেউ নেই। কিন্তু কথাটা মোটেই ঠিক নয়। পেনিকে বাতিলের খাতায় তুলতে যেমন বহু লোক তৎপর, তেমনি এর ঘোর সমর্থকও আছে অনেক। গঠিত হয়েছে তাদের সংগঠনও। ‘আমেরিকানস ফর কমন সেন্টস’ এমনই এক সংগঠন। এই সংগঠনের নেতা মার্ক ওয়েলার বলেন, পেনি উঠে গেলে জিনিসের ‘রাউন্ড’ দাম ধরতে গেলে বাড়িয়েই ধরা হবে। কোনো ব্যবসায়ী দাম কমিয়ে ধরবেন না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গরিবেরা। তিনি বলেন, কেউ পেনির দাম নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। কিন্তু জমানো গেলে তা খুবই মূল্যবান। অনেক দাতব্য সংগঠন যে দান হিসেবে পাওয়া পেনি জমিয়েই লাখ লাখ ডলারের তহবিল করছে, সে রকম কয়েকটি উদাহরণ মনে করিয়ে দিলেন ওয়েলার।
বিভিন্ন সময়ে জনমত জরিপেও দেখা গেছে, বেশির ভাগ মার্কিন মুদ্রাটি বহাল রাখার পক্ষে। ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব আমেরিকান হিস্ট্রির মুদ্রা সংগ্রহ বিভাগের জ্যেষ্ঠ কিউরেটর রিচার্ড ডটির কথায় এর সমর্থন মেলে। তিনি বলেন, ‘লোকে পেনি নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করে বটে, কিন্তু তারা এটি রাখতেও চায়।’ চার বছর ধরে এই জাদুঘর এক পেনি মুদ্রা চাওয়া না-চাওয়ার ব্যাপারে দর্শনার্থীদের ভোট নিয়েছে। দেখা গেছে, এ ব্যাপারে মার্কিন জনমত দ্বিধাবিভক্ত। পক্ষে-বিপক্ষে ভোট পড়ে ৬০/৪০। কিউরেটর ডটির কথা হচ্ছে: কোনো মুদ্রা বা নোটের দাম শুধু এর বিনিময়মূল্য দিয়ে নির্ধারিত হয় না। এর আবেদনটা আর্থিক মূল্য ছাড়িয়ে অনেক বেশি হয়ে থাকে। লোকে ঐতিহ্যের ব্যাপারটা উপেক্ষা করতে চায় না।
এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে—সেই ১৯০৯ সাল থেকে—মার্কিন পেনিতে সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হচ্ছে। গৃহযুদ্ধের টালমাটাল সময়ে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লিংকন। পাঁচ ডলারের নোটেও তাঁর ছবি আছে। কিন্তু তার পরও অনেকেই লিংকনের স্মৃতির কারণে এক পেনির মুদ্রাটি হারাতে নারাজ।
কংগ্রেসের মাধ্যমে দুই দুবার পেনি বিলুপ্ত করার চেষ্টা হয়েছে। ২০০২ ও ২০০৬ সালে। দুবারই তা ব্যর্থ হয়। মার্কিন জনপ্রিয় টিভি সিরিজ দি ওয়েস্ট উইংয়ের একটি পর্বে পর্যন্ত এই বিতর্ক ঠাঁই পায়।

যুক্তরাজ্যের চিত্র
যুক্তরাজ্যে পেনি ইস্যুটা ততটা রাজনৈতিক নয়। তবে সে দেশেও মাঝেমধ্যে প্রচারমাধ্যমে মুদ্রাটি বাতিলের পক্ষে আওয়াজ ওঠে। যুক্তরাজ্যে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পুরুষদের মধ্যে ১০ শতাংশ পেনি দেখলে এত রেগে যান যে, তা ছুড়ে মারেন ডাস্টবিনে। খুচরা দেখে মেজাজ খারাপ হওয়ার এই ব্যাপারটাকে যুক্তরাজ্যে অনেকে বলেন ‘পেনি ক্রোধ’।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পেনি তৈরি হয় ১৭৯৩ সালে। কিন্তু যুক্তরাজ্যে পেনির ইতিহাস আরও অনেক পুরোনো। ৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ওফা যুক্তরাজ্যে প্রথম পেনি চালু করেন। প্রায় ৫০০ বছর এটাই ছিল ইংল্যান্ডের একমাত্র মুদ্রা।

টাকা আনা পাই
বাংলাদেশ সম্পদ বা আর্থিক সামর্থ্যের বিচারে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার ধারেকাছে না থাকলেও মুদ্রাস্ফীতির দৌলতে এক পয়সা ওরফে ‘পাই’-এর দিন বহু আগেই গেছে। ৫, ১০, ২৫ এমনকি ৫০ পয়সার মুদ্রাও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেওয়ার পর্যায়ে। বাজারে মেলে মূলত এক, দুই ও পাঁচ টাকার মুদ্রা। এক টাকার নোটও জাদুঘরের সামগ্রীতে পরিণত প্রায়। অনেক জায়গায় দোকানিরা এক টাকার ভাঙতি ফেরত দেন চকোলেট দিয়ে। অভিজাত দোকানে এক-দুই টাকা ফেরত দেওয়ার প্রবণতা খুব কম। ছোট হয়ে যাবেন ভেবে ক্রেতারাও ছোট মুদ্রা নিয়ে গা করেন না। ফেরতটা নায্য প্রাপ্য মনে করে চাইলে দোকানকর্মী এমনভাবে তাকাতে পারেন যে আপনি ভিক্ষা চাইছেন। মনে হচ্ছে, অন্তত এই একটা ব্যাপারে আমরা আমেরিকা-ইউরোপকে ছাড়িয়ে গেছি। ব্যাটারা এখনো এক পয়সা নিয়ে পড়ে আছে। ছো!
বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে এক থেকে ৫০ পয়সা তৈরি বন্ধ করেনি। তাদের মজুদ তথা বাজারে বেশ কিছু খুচরো পয়সা এখনো আছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক বা কেউ চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা সরবরাহ করে। তবে মজুদ আছে বলে এই মুহূর্তে নতুন করে তৈরি হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক অসীম কুমার গুপ্ত জানালেন, রুপালি রঙের এক টাকা তৈরিতে ব্যয় হয় ৮৭ পয়সা আর দুই টাকার ক্ষেত্রে ব্যয় এক টাকা ১০ পয়সা। এক পয়সা বাংলাদেশেও তৈরি হতো দস্তা (জিংক) দিয়ে।
সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি

No comments

Powered by Blogger.