গ্রামীণ ব্যাংক এবং বাস্তবতা by মেজর (অব.) সুধীর সাহা

বহুল আলোচিত 'গ্রামীণ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০১২'-এর গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। সংশোধিত অধ্যাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের ক্ষমতা খর্ব এবং সরকার নিযুক্ত চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়েছে।


এর আগে মন্ত্রিসভা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ব্যাংকটির এমডি পদে নির্ধারিত বয়সের অতিরিক্ত সময় দায়িত্বে থেকে কী পরিমাণ অর্থ নিয়েছেন এবং এটা বৈধ ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখারও নির্দেশ দিয়েছে। এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালে ড. ইউনূস ওয়েজ আর্নার হিসেবে কত টাকা বিদেশ থেকে এনেছেন এবং তা আনতে পারেন কি না, এনে থাকলে কী পরিমাণ কর অব্যাহতি নিয়েছেন, সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশও দিয়েছে মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিসভার এমন খসড়া অধ্যাদেশের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ২৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ১৭ জন নারী সিনেটরের পক্ষে সিনেটর বারবারা বক্সার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা পরিচালনা পর্ষদকে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। গত ৩ আগস্ট গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর আরো বেশি করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সরকারি চেষ্টার বিষয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন মার্কিন সিনেটর বারবারা বক্সার। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সরকারকে এ ধরনের হস্তক্ষেপ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গ্রামীণ ব্যাংক প্রায় ৮৩ লাখ লোককে ঋণ ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে আসছে, যেখানে ঋণগ্রহীতার বেশির ভাগই নারী।
উল্লিখিত তথ্যগুলো হয়তো ইতিমধ্যে সবারই জানা। অন্যদিকে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথাও বাংলাদেশ ছাড়িয়ে পৃথিবীর অনেকেরই জানা। ড. মুহাম্মদ ইউনূসই প্রথম বাংলাদেশি, যিনি নোবেল বিজয়ের মতো একটি বিরল সম্মান অর্জনের অধিকারী। সবাইকে একটু পেছনে নিয়ে যাওয়ার জন্য দু-একটা পুরনো সত্যের পুনঃপ্রকাশ করছি এখানে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হঠাৎ করেই ড. ইউনূস সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে আসবেন। প্রাথমিক কাজও শুরু করেছিলেন। তারপর আবার হঠাৎ করেই তিনি রাজনীতিতে আসবেন না বলে ঘোষণা দিলেন। সেই সময়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রীই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জেলে ছিলেন। তারপর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এলো বিপুল বিজয় নিয়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুই রাজনৈতিক নেত্রীর বিষয়ে ড. ইউনূসের মনোভাব বা কার্যাবলি কী ছিল প্রকাশ্যে তার কিছু না এলেও পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের অনেকেই ইঙ্গিতে অনেক সময় বুঝিয়েছেন যে দুই নেত্রীর মাইনাস পদ্ধতিতে ড. ইউনূসের পরোক্ষ হাত ছিল; কিন্তু এ বিষয়টি সরাসরিভাবে বা তথ্যগতভাবে কখনো বাংলাদেশের জনগণের সামনে আসেনি। কিন্তু শুরু থেকেই আমরা সরকারের একটি বৈরী অবস্থান দেখেছি ড. ইউনূসের ব্যাপারে। বাংলা একাডেমীর সভায় ভারত থেকে আরেক নোবেল বিজয়ী বাঙালিকে (ড. অমর্ত্য সেন) বিশেষ সমাদরে প্রধান অতিথি হিসেবে সরকার আনয়ন করলেও তাঁর নিজ দেশের আরেক নোবেল বিজয়ীকে কখনো কোনো সরকার আয়োজিত সভায় আনতে দেখা যায়নি। বরং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এবং অন্য মন্ত্রীদের ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে এবং তাঁর পাওয়া নোবেল বিজয় নিয়ে নানা ধরনের নেগেটিভ বক্তব্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মিডিয়াতেও ঝড় তুলেছে। আর এরই বহিঃপ্রকাশ পেয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে গ্রামীণ ব্যাংক আর ড. ইউনূসের প্রতি সমর্থনের মধ্য দিয়ে। গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যেসব দেশ, এর মধ্যে সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। এই প্রতিষ্ঠানটির জন্য তারা এখনো সমান তালে রীতিমতো সংগ্রাম করে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যসহ আরো অনেক দেশ এবং বিশ্ব সংগঠনও ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের সমালোচনা করেছে।
ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের মতো একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সত্যকে কেন বর্তমান সরকার প্রশ্নবিদ্ধ করল তা কেবল সরকারই বলতে পারবে। তবে এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে সমস্যাটি গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্ভাবন নয় বরং সরকারের ড. ইউনূস নিয়ে একটি নেগেটিভ নীতির কারণেই ঘনীভূত হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের ঘটনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের বক্তব্যের জের ধরে যেকোনো লোকই খুব সহজেই বুঝতে পারে যে সরকার অযথা একটি বিষয়কে দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষভাবে মুখ্য করে তুলেছে এবং ড. ইউনূসকে বিতর্কিত করে দেখানোর একটি অলিখিত সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। রাষ্ট্রের একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রের একটি সম্মানজনক প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ের কার্যকলাপের ব্যাখ্যা কী হতে পারে তা এ দেশের অনেকের মতো আমার মাথায়ও আসে না। একের পর এক সরকার বিষয়টি নিয়ে লেজে-গোবরে জড়িয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের ভেতরে গ্রামীণ ব্যাংককে যারা ভালোবাসে এবং ড. ইউনূসকে যারা পছন্দ করে ও ভালোবাসে তাদের সবার কাছে অযথাই বিতর্কিত হচ্ছে সরকার এবং অন্যদিকে দেশে-বিদেশে সরকার এবং রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান কোনটা কিভাবে চলছে তা এ দেশের মানুষের চেয়ে আর বেশি কে জানে! তার পরও গ্রামীণ ব্যাংকের মতো বিশ্বমানের একটি সংগঠনকে সরকারের আরো নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পেছনে সরকারের কী মহৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে তা বোঝার মতো জ্ঞান বাংলাদেশের মানুষের নেই। তার পরও সরকার বা মন্ত্রিসভা শান্তি পাচ্ছে না। নতুন করে আবার ড. ইউনূসের ব্যাপারে নতুন তদন্ত রিপোর্ট। যে দুটি বিষয়ের ওপর মন্ত্রিসভা রিপোর্ট চাচ্ছে, তারা কি মনে করে না যে এই কাজগুলো যখন সংঘটিত হয়েছিল তখনো সরকার এ দেশে ছিল। যদি অনিয়মই হয়ে থাকে তাহলে তখন সরকার কেন ব্যবস্থা নেয়নি? হায়রে দুর্ভাগা দেশ, কে দেবে এর জবাব?
বাংলাদেশ, গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. ইউনূস কোনোটাই যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ নয় এবং নিয়ন্ত্রণে নয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সিনেট অযথাই বাড়াবাড়ি করছে সেই প্রথম থেকেই। বিশ্ব স্বীকৃত গ্রামীণ ব্যাংক এবং নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সহানুভূতি থাকতেই পারে এবং এর প্রকাশও ঘটতে পারে পররাষ্ট্র নীতির সীমারেখা থেকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কাজকর্মে বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিয়ে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের খবরদারি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভালো লাগছে না, তা যত তাড়াতাড়ি যুক্তরাষ্ট্র অনুভব করে ততই তাদের মঙ্গল। তাদের দেশের কোন সংগঠন কিভাবে চলবে তা যেমন আমরা তাদের বলতে যাই না তেমন বাংলাদেশের মতো একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরাও আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তাদের নগ্ন হস্তক্ষেপকে ভালো চোখে দেখি না তা যেন তারা বুঝতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংক বা ড. ইউনূস যদি সরকার বা অন্য কারো অন্যায় কাজ থেকে রক্ষা পেতে চায় তবে তাদের এ দেশের জনগণের সাহায্যই নিতে হবে সর্বাগ্রে। এ দেশের কোনো সংগঠনের জন্য এ দেশের জনগণের শক্তিই হবে একমাত্র শক্তি। বাইরের দুনিয়াকে তথ্য জানিয়ে প্রতিবিধান চাওয়ার মধ্যে এই সমস্যার প্রকৃত সমাধানের রাস্তা নয়।
লেখক : কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.