বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৯০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ কাজী মোরশেদুল আলম বীর প্রতীক বিক্রমী এক মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের বেশির ভাগ এলাকা থেকে পশ্চাদপসরণ করেছে।
কোথাও কোথাও সীমান্তের অল্প কিছু এলাকা তাদের দখলে। এমন একটি এলাকা চণ্ডীদার। সেখানে তখনো রয়ে গেছে একদল পাকিস্তানি সেনা। মরিয়া তাদের মনোভাব। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানার (বর্তমানে উপজেলা) অন্তর্গত চণ্ডীদার।
ফলে সেখানে যুদ্ধ নিশ্চিত ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল। কাজী মোরশেদুল আলমসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা রওনা দিলেন চণ্ডীদারে। তাঁরা মুখোমুখি হলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। সামনাসামনি হওয়া মাত্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁদের ওপর আক্রমণ শুরু করে দেয়। তাঁরা অত্যন্ত বীরত্ব ও সাফল্যের সঙ্গে আক্রমণ প্রতিহত করেন। দিনের আলোয় দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণের ধারা অব্যাহত রাখে। কয়েক ঘণ্টা মরণপণ লড়াই করেও কাজী মোরশেদুল আলম ও তাঁর সহযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ-কৌশল পাল্টান। পরে তাঁরা পুনসংগঠিত ও কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে নতুন করে আক্রমণ চালান।
মুক্তিযোদ্ধাদের উপদলের একটি দল সামনে থেকে আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিভ্রান্ত করে। আরেক দল অপর পাশ থেকে স্মোক গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধূম্রকুণ্ডলীর সৃষ্টি করে পেছনে সরে যায়। এই সুযোগে আত্মঘাতী উপদল সৃষ্ট ধূম্রকুণ্ডলীর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর ঝটিকা আক্রমণ চালায়। কাজী মোরশেদুল আলমসহ কয়েকজন ছিলেন এই দলে। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁদের অস্ত্রের গুলির আঘাতে অসহায়ভাবে লুটিয়ে পড়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতায় অবশিষ্ট শত্রুসেনাদের মনোবলে চিড় ধরে। তখন তারা কিছুটা পশ্চাদপসরণ করে নতুন স্থানে অবস্থান নেয়। কাজী মোরশেদুল আলম ও তাঁর সহযোদ্ধারা ধাওয়া করে নতুন স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করেন।
বিপর্যস্ত পাকিস্তানি সেনারাও মরিয়া হয়ে পাল্টা আক্রমণ করে। অমিত সাহসী কাজী মোরশেদুল আলম পাকিস্তানি সেনাদের গুলিবৃষ্টি উপেক্ষা করে কিছুটা এগিয়ে যান। খুব কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। একপর্যায়ে হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহযোদ্ধারা তাঁকে উদ্ধার করার আগেই নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ। শহীদ হন তিনি।
সেদিন যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকজন নিহত হয়। পরে জীবিত পাকিস্তানিরা নিহতদের লাশ ফেলে আহতদের নিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কাজী মোরশেদুল আলম শহীদ ও তিন-চারজন আহত হন। যুদ্ধ শেষে সহযোদ্ধারা শহীদ মোরশেদুল আলমকে সমাহিত করেন কুল্লাপাথরে। সেখানে তাঁর সমাধি সংরক্ষিত।
কাজী মোরশেদুল আলম ১৯৭১ সালে উচ্চমাধ্যমিক ক্লাসের শেষবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসের শেষদিকে ভারতে যান। প্রশিক্ষণ নিয়ে যোগ দেন ২ নম্বর সেক্টরে। পরে তাঁকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি বেশ কয়েকটি যুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ কাজী মোরশেদুল আলমকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর-১৪৯।
শহীদ কাজী মোরশেদুল আলমের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার নিলাখাদ গ্রামের পূর্বপাড়ায়। অবিবাহিত ছিলেন। বাবার নাম আবদুল জব্বার। মা মরিয়ম বেগম। কাজী মোরশেদ আলমের ছোটবেলায় তাঁর বাবা-মা দুজনই তাঁকে ও আরেক ভাইকে রেখে মারা যান। নিঃসন্তান চাচা চান মিয়া তাঁকে ও তাঁর ভাইকে লালন-পালন করেন। এ জন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষাগত সনদে বাবা হিসেবে তাঁর চাচার নাম উল্লেখ আছে। শহীদ কাজী মোরশেদুল আলমের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: প্রথম আলোর আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি দুলাল ঘোষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
ফলে সেখানে যুদ্ধ নিশ্চিত ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল। কাজী মোরশেদুল আলমসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা রওনা দিলেন চণ্ডীদারে। তাঁরা মুখোমুখি হলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। সামনাসামনি হওয়া মাত্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁদের ওপর আক্রমণ শুরু করে দেয়। তাঁরা অত্যন্ত বীরত্ব ও সাফল্যের সঙ্গে আক্রমণ প্রতিহত করেন। দিনের আলোয় দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণের ধারা অব্যাহত রাখে। কয়েক ঘণ্টা মরণপণ লড়াই করেও কাজী মোরশেদুল আলম ও তাঁর সহযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ-কৌশল পাল্টান। পরে তাঁরা পুনসংগঠিত ও কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে নতুন করে আক্রমণ চালান।
মুক্তিযোদ্ধাদের উপদলের একটি দল সামনে থেকে আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিভ্রান্ত করে। আরেক দল অপর পাশ থেকে স্মোক গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধূম্রকুণ্ডলীর সৃষ্টি করে পেছনে সরে যায়। এই সুযোগে আত্মঘাতী উপদল সৃষ্ট ধূম্রকুণ্ডলীর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর ঝটিকা আক্রমণ চালায়। কাজী মোরশেদুল আলমসহ কয়েকজন ছিলেন এই দলে। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁদের অস্ত্রের গুলির আঘাতে অসহায়ভাবে লুটিয়ে পড়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতায় অবশিষ্ট শত্রুসেনাদের মনোবলে চিড় ধরে। তখন তারা কিছুটা পশ্চাদপসরণ করে নতুন স্থানে অবস্থান নেয়। কাজী মোরশেদুল আলম ও তাঁর সহযোদ্ধারা ধাওয়া করে নতুন স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করেন।
বিপর্যস্ত পাকিস্তানি সেনারাও মরিয়া হয়ে পাল্টা আক্রমণ করে। অমিত সাহসী কাজী মোরশেদুল আলম পাকিস্তানি সেনাদের গুলিবৃষ্টি উপেক্ষা করে কিছুটা এগিয়ে যান। খুব কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। একপর্যায়ে হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহযোদ্ধারা তাঁকে উদ্ধার করার আগেই নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ। শহীদ হন তিনি।
সেদিন যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকজন নিহত হয়। পরে জীবিত পাকিস্তানিরা নিহতদের লাশ ফেলে আহতদের নিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কাজী মোরশেদুল আলম শহীদ ও তিন-চারজন আহত হন। যুদ্ধ শেষে সহযোদ্ধারা শহীদ মোরশেদুল আলমকে সমাহিত করেন কুল্লাপাথরে। সেখানে তাঁর সমাধি সংরক্ষিত।
কাজী মোরশেদুল আলম ১৯৭১ সালে উচ্চমাধ্যমিক ক্লাসের শেষবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসের শেষদিকে ভারতে যান। প্রশিক্ষণ নিয়ে যোগ দেন ২ নম্বর সেক্টরে। পরে তাঁকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি বেশ কয়েকটি যুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ কাজী মোরশেদুল আলমকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর-১৪৯।
শহীদ কাজী মোরশেদুল আলমের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার নিলাখাদ গ্রামের পূর্বপাড়ায়। অবিবাহিত ছিলেন। বাবার নাম আবদুল জব্বার। মা মরিয়ম বেগম। কাজী মোরশেদ আলমের ছোটবেলায় তাঁর বাবা-মা দুজনই তাঁকে ও আরেক ভাইকে রেখে মারা যান। নিঃসন্তান চাচা চান মিয়া তাঁকে ও তাঁর ভাইকে লালন-পালন করেন। এ জন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষাগত সনদে বাবা হিসেবে তাঁর চাচার নাম উল্লেখ আছে। শহীদ কাজী মোরশেদুল আলমের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: প্রথম আলোর আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি দুলাল ঘোষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments