মার্চের মধ্যেই ট্রানজিট সুবিধা পাবে ভারত by আবুল কাশেম

গামী বছরের মার্চের মধ্যেই বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা পেতে যাচ্ছে ভারত। সব কিছু ঠিক থাকলে ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান নৌ প্রটোকল চুক্তি নবায়নের সময়ই চালু হবে পুরোপুরি ট্রানজিট ব্যবস্থা। ওই সময়ই ট্রানজিট ফি বা চার্জ নির্ধারণ করা হবে পারস্পারিক আলোচনার ভিত্তিতে। তবে এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ খরচের সঙ্গে যুক্তিসংগত মুনাফা নেওয়া হবে। কোন সড়ক দিয়ে কোথা থেকে কোথায় পণ্য যাবে_তার ভিত্তিতে ফি নির্ধারণ করা হবে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে তিক্ততা দেখা দিয়েছিল।


তবে তা ট্রানজিট চালুর ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন সরকারের ঊর্ধ্বতনরা। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান একান্ত আলাপচারিতায় কালের কণ্ঠকে এমনই আভাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ১৯৪৭ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট প্রটোকল আছে। রেল ও নৌপথে চলা ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট প্রটোকল নির্দিষ্ট সময় পর পর নবায়ন করা হয়। ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান নৌ প্রটোকল চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০১২ সালের মার্চ মাসে। তার আগেই এ চুক্তি নবায়ন হওয়ার কথা। ওই চুক্তিতেই বলা আছে, প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে বিভিন্ন সময় আলোচনা করে চুক্তির বিষয়বস্তু সংশোধন করা যাবে। তিনি আরো বলেন, ওই প্রটোকল নবায়নের সময়ই মাল্টিমোডাল বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হবে। যেহেতু ট্রানজিট ভারতেরই প্রয়োজন, তাই চুক্তি নবায়ন কখন হবে, তা দেশটির আগ্রহের ওপরই নির্ভর করবে। আর তারই অংশ হিসেবে বর্তমানে আশুগঞ্জে পরীক্ষামূলকভাবে ট্রানজিট চালু হয়েছে, তা করা হয়েছে বিদ্যমান প্রটোকলের আওতায়ই।
মসিউর রহমান বলেন, ট্রানজিট চালুর আগে এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবি্লউটিএ), সড়ক বিভাগ ও শুল্ক বিভাগের অভিজ্ঞতার প্রয়োজন রয়েছে। আশুগঞ্জ থেকে তারা সে অভিজ্ঞতাই অর্জন করছে। তাদের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই পুরোপুরি ট্রানজিট চালু হবে। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর না হলেও ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হবে কি-না_এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির সঙ্গে ট্রানজিটের কোনো সম্পর্ক নেই।'
'চার্জ হিসেবে ট্রনপ্রতি ফি নির্ধারণ করা সম্ভব না। কারণ, তাতে জাহাজে আসা পণ্যের ওজন মাপার বিষয়টি আসবে। তার বদলে কস্ট প্লাস রিজনেবল রিটার্ন নেওয়া যেতে পারে; কিন্তু একচেটিয়া ফি আদায় করা যৌক্তিক হবে না। রাস্তার ভিত্তিতে চার্জ আরোপ করা যেতে পারে'_বলেন ড. মসিউর।
তিনি বলেন, যাঁরা মনে করেন, আশুগঞ্জে ভারতকে শুধু শুধুই ট্রানজিট দেওয়া হয়েছে, তাঁরা মূলত অপপ্রচার চালাচ্ছেন। আসলে নৌ প্রটোকলের আওতায় আশুগঞ্জ-আগরতলায় ট্রানজিট চালু হয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই। আশুগঞ্জ বন্দর থেকে ভারতে ঢুকার পথে কিছুদূর পরই নদী। ওইটুকু জায়গায় আমাদের রাস্তা ছিল। তবে তা ভারী কার্গো (ওডিসি) বহনের উপযোগী ছিল না। ওই রাস্তাকে ভারী কার্গো বহনের উপযোগী হিসেবে নির্মাণ করতে ভারত এক বিলিয়ন ডলার ঋণের বাইরে সম্পূর্ণ অনুদান হিসেবে অর্থ দিয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ওই অর্থ দিয়েছে দেশটি। এমনকি ভারতীয় কার্গো বহনের কারণে রাস্তার ক্ষতি হলে তা মেরামতের জন্যও অর্থ দেবে দেশটি।
তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ওপরে নির্মিত রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহনের বিনিময়ে কোনো ফি নেওয়া উচিত কি-না_এ ধরনের এক প্রশ্নের উত্তরে মসিউর রহমান বলেন, 'রাস্তাটা যদি আপনার পয়সায় করেন, তাহলে তা ব্যবহারের বিনিময়ে কেন ভাড়া দেবেন? নিজের তৈরি বাড়িতে কেউ তো ভাড়া দিয়ে থাকে না।' কিন্তু অন্যের জমিতে বাড়ি করতে গেলে তো জমির ভাড়া দিতে হবে_এমন প্রশ্ন করা হলে মসিউর রহমান বলেন, ওই রাস্তা দিয়ে বাংলাদেশের যানবহনও চলাচল করবে। তার পরও ট্রানজিট ফি হিসাবে ভারত সরকার নির্দিষ্ট হারে, অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ অবশ্যই দেবে। আর বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের যেসব ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠান পণ্য পরিবহন করবে, তারা দেশের ভেতর কোনো সেবা ভোগ করলে তার মূল্য ওই প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ীরা পরিশোধ করবেন। নৌ প্রটোকলে এ ধরনের কথাই বলা আছে। সড়কপথে ট্রানজিটের ক্ষেত্রেও একই পন্থা অবলম্বন করা হবে।
এর আগে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক সেমিনারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মসিউর রহমান বলেন, 'তিস্তা চুক্তির সঙ্গে ট্রানজিটের কোনো সম্পর্ক নেই। পানি নিচের দিকে নেমে আসবেই। ভারত বাধা না দিলে বাংলাদেশে এখন যে পানি আসছে, তা কমবে না। আর সম্প্রতি ভারতের সিকিমে ভূমিকম্পের পর ভারত নির্বোধ দ্বারা শাসিত না হলে আগামী ৫০ বছরে কোনো নদীর ওপরে বাঁধ দিয়ে তারা পানির প্রবাহ বন্ধ করবে না।'
'আমি অর্ধেক জানালা খুলব, প্রতিবেশী অর্ধেক জানালা খুলবে_এমন নয়। বরং প্রতিবেশীদের মধ্যে সুবাতাস বইবে_এমন পরিবেশ চাই আমরা। এটি হলে কোথাও আমরা লাভবান হব, কোথাও ভারত লাভবান হবে। তৈরি পোশাকে যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিল, তাতে বাংলাদেশ লাভবান হবে। আবার ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট চালু হলে ভারত লাভবান হবে'_বলেন জনাব মসিউর।
তিনি জানান, আশুগঞ্জ থেকে আগরতলায় ভারী কার্গো বহনের উপযোগী রাস্তা নির্মাণের সম্পূর্ণ টাকাই ভারতের কাছ থেকে অনুদান হিসাবে পাওয়া গেছে। ওই রাস্তা কার্গো বহনের উপযোগী করতে কত টাকার প্রয়োজন, তার হিসাব করেছিল বাংলাদেশের সড়ক ও জনপথ বিভাগ। তিনি বলেন, বিদ্যমান প্রটোকল অনুযায়ী, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের মালামাল আনা-নেওয়ার কারণে বাংলাদেশ কিছু টাকা পায়। তবে তা কম বা বেশি কি-না, সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পরিবহনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কম্পানিগুলোয় বীমা করা হবে কি-না, সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের উত্তরে মসিউর রহমান বলেন, এটি হলে ভারতীয় কোনো পণ্য নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার ক্ষতিপূরণ বাংলাদেশের বীমা কম্পানিগুলোকে দিতে হবে। কিন্তু অন্যের মালামাল নষ্টের দায় বাংলাদেশের বীমা কম্পানিগুলো কেন নেবে? তা ছাড়া ট্রানজিটের নামে কেউ যদি ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশে এনে বিক্রি করে দেয়, তা তো ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে বিবেচিত হবে না। এমন হলে তা কালোবাজারি হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে বাংলাদেশে বীমা হলে কম্পানিগুলোর কিছু মুনাফা হবে। সেটা বাংলাদেশের বীমা কম্পানি ও ভারতের পণ্য যাঁরা পরিবহন করবেন, তাঁরাই সিদ্ধান্ত নেবেন কোথায় বীমা করবেন।

No comments

Powered by Blogger.