মামলায় নেতারা আত্মগোপনে, নেতৃত্ব সংকটে জামায়াত by মোশতাক আহমদ

নেতৃত্ব সংকটে পড়েছে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। ভারপ্রাপ্ত হিসেবে আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল থাকলেও নেতৃত্ব সংকট কাটছে না। জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান দায়িত্ব পাওয়ার ২১ দিন পরও জনসমক্ষে আসতে পারেননি। টেলিফোন করেও তাঁকে পাওয়া যায় না। কোথায় আছেন কেউ জানে না। কর্মীরা তো দূরের কথা, তাঁর অবস্থান দলীয় নেতাদেরও অজানা। ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমেদেরও একই অবস্থা। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের প্রায় প্রত্যেক নেতার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকায় গ্রেপ্তারের ভয়ে তাঁরা জনসমক্ষে আসার সাহস পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় তৃণমূলে দেখা দিয়েছে এক ধরনের সাংগঠনিক স্থবিরতা।


রাজধানীর কাকরাইলে ১৯ সেপ্টেম্বর পুলিশের সঙ্গে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনার পর থেকেই ভারপ্রাপ্ত আমির আত্মগোপনে রয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে রমনা ও পল্টন থানায় চারটি মামলা রয়েছে। দুটিতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। একই ঘটনার পর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে। ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নবনিযুক্ত ডা. শফিকুর রহমানও আত্মগোপনে। তাঁর বিরুদ্ধেও চারটি মামলা রয়েছে। সংগঠনের ঢাকা মহানগর আমির ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য রফিকুল ইসলাম খান, ঢাকা মহানগর সেক্রেটারি হামিদুর রহমান আযাদ এমপি, কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মজিবুর রহমান, সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল হালিম ও নুরুল ইসলাম বুলবুলের ক্ষেত্রেও অভিন্ন চিত্র।
ভারপ্রাপ্ত আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল কোথায় আছেন_এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁদের সঙ্গে কোনো সাক্ষাৎ নেই। কোথায় আছেন তাও তিনি জানেন না। ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারির সিলেটের বাড়ির মালামাল ক্রোকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যাঁদের বাসার মালামাল ক্রোক হয় তাঁদের কী আর প্রকাশ্যে পাওয়া যাবে?
জানা গেছে, গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা। ফলে মাঠের রাজনীতিতে জামায়াত ভুগছে নেতৃত্ব সংকটে। পুলিশি ভয়, মামলা মোকাবিলা ও নেতা-কর্মীদের সামলাতে গিয়ে চারদলীয় জোটের সঙ্গে মাঠের রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়ছে জামায়াত। কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও ঢাকা মহানগর কার্যালয়ে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার কাউকেই পাওয়া যায়নি। নেতাদের প্রায় সবার মোবাইল ফোন বন্ধ। দু-একজনের মোবাইল ফোন খোলা থাকলেও তা কেউ রিসিভ করছেন না।
১৯ সেপ্টেম্বরের সংঘর্ষের ঘটনার পর থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও মহানগর অফিসের সামনে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। দু-একজন কর্মচারী ছাড়া কেউ অফিসে ঢুকতে পারছেন না। গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে কেন্দ্রীয় নেতা তো দূরে থাক, সাধারণ কর্মীরাও অফিসের ধারে কাছে আসছে না। কাউকে সন্দেহ হলেই পুলিশ তাকে চ্যালেঞ্জ করছে_এমন অভিযোগও উঠেছে।
দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় নেতাদের আত্মগোপনের কারণে সংগঠনের সব কর্মসূচি আপাতত স্থগিত রয়েছে।
রাজধানীর বড় মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিস ও পুরানা পল্টনের মহানগর অফিসে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে কবরের নীরবতা। কেন্দ্রীয় অফিসের অফিস সহকারী হাসানুল বান্না ও নিরাপত্তা কর্মীরা বলেন, ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে পুলিশ এসে অফিসের ২২-২৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। সঙ্গে অফিসের ফোন, ফ্যাঙ্, কম্পিউটার, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত এমনকি আলমারি ভেঙে মূল্যবান জিনিসপত্রও নিয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় অফিসে নেতাদের কোনো ফোন নম্বর পর্যন্ত নেই। কারো সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করা যাচ্ছে না।
মহানগর প্রচার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে পুলিশ মহানগর অফিসের কম্পিউটার, প্রিন্টার ও ফাইলপত্রসহ মূল্যবান কাগজপত্র নিয়ে গেছে। সঙ্গে অফিসের ২০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ধরে নিয়ে গেছে।
এদিকে মহানগর জামায়াতের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নেতারা অব্যাহতভাবে আত্মগোপনে থাকলে তৃণমূল পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের মাঝে হতাশা নেমে আসবে। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতেই কেন্দ্রীয় নেতাদের মাঠে থাকা উচিত।
শতাধিক আইনজীবী নিয়োগ : কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা মোকাবিলায় জামায়াত শুধু ঢাকাতেই শতাধিক আইনজীবী নিয়োগ করেছে। তাঁদের নেতৃত্বে রয়েছেন অ্যাডভোকেট আবদুর রাজ্জাক, কামাল উদ্দিন, লুৎফুর রহমান আজাদ ও আবু সাইদ মোল্লা। বিএনপিপন্থী কয়েকজন আইনজীবীকেও মামলার তারিখের দিন সহায়তায় কাজে লাগানো হচ্ছে।
অ্যাডভোকেট আবদুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরের প্রায় সব নেতার বিরুদ্ধেই মামলা রয়েছে। অনেকের নামে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও রয়েছে। তিনি জানান, ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমদের নামে চারটি, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি ডা. শফিকুর রহমানের নামে চারটি, সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি এ টি এম আজহারুলের নামে চট্টগ্রাম, লালমনিরহাট ও ঢাকায় আটটি, ঢাকা মহানগর সভাপতি রফিকুল ইসলামের নামে ২১টি, মহানগর সেক্রেটারি হামিদুর রহমান আজাদের নামে সাতটি, অধ্যাপক মজিবুর রহমানের নামে আটটি, ডা. আবদুল্লাহ মো. তাহেরের নামে দুটি ও নূরুল ইসলাম বুলবুলের নামে তিনটি মামলা রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.