সন্ধ্যা নদীর তীরে মানুষের মেলা by রফিকুল ইসলাম,

ট্রলারে মানুষ, নৌকায় মানুষ, গাছে মানুষ, সন্ধ্যা নদীর তীরেই মানুষের মেলা। শেষ বাইচের অপেক্ষায় তখন সবাই। তেঁতুলের মতো বাঁকা বিশাল নৌকাগুলোর নাম সারেঙ্গি। সেগুলোর সুচালো মাথা পানি ছুঁইছুঁই। অর্ধশতাধিক মাঝি-মাল্লা নিয়ে নৌকাগুলো ভাসছে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার হারতা বাজারসংলগ্ন সন্ধ্যা নদীতে। লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী এ নৌকাবাইচ দেখতেই গতকাল মঙ্গলবার হাজারো মানুষের ঢল নামে নদীর তীরে।
এবারের প্রতিযোগিতাটি ১৫১তম। তাতে অংশ নিতে আসা নৌকাগুলো গতকাল বাইচ শুরুর সংকেত পেয়েই ছুটতে শুরু করে তীর বেগে। আয়োজক কমিটি, প্রশাসন আর সংবাদকর্মীদের ট্রলারগুলো ছুটতে থাকে তাদের পিছু পিছু।


কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ইঞ্জিনচালিত ট্রলারগুলোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় বাইচের নৌকাগুলো। ইঞ্জিনের সর্বোচ্চ গতি দিয়েও মেলেনি বাইচের নৌকাগুলোর নাগাল।
অর্ধশতাধিক মাঝি কোষা আর সারেঙ্গি নৌকার বাইচে এতগুলো বৈঠা একসঙ্গে পানিতে পড়ায় অপূর্ব শব্দের মূর্ছনা তৈরি হচ্ছিল সন্ধ্যার বুকে। পুরো নৌকা পানির ওপর কয়েক ইঞ্চি ভেসে এগিয়ে যাচ্ছিল। দূর থেকে চোখে পড়ে শুধু মাঝি আর বৈঠাগুলো; যেন পানির ওপর দিয়েই বৈঠা হাতে ভেসে চলেছেন মাঝি-মাল্লারা।
ছলাৎছলাৎ বৈঠার টানে এগিয়ে চলছে নৌকা। মাঝি বৈঠা ফেলছে একই তালে। একজন শক্ত হাতে নৌকার হাল ধরে আছেন। দ্রুতগতিতে বৈঠা চালানো মাঝিদের আরো উদ্দীপ্ত করতে নৌকার মধ্যে বাজছিল ঢোল-কাঁসরসহ নানা বাদ্যযন্ত্র। সন্ধ্যা নদীর দুই তীরে দর্শকরা করতালির সঙ্গে চিৎকার দিয়ে বলছিল, 'এগিয়ে যাও।'
'এবারের মতো এত জমজমাট নৌকাবাইচ অনেক বছর পর দেখলাম। আমাদের শৈশবে দেখেছি বাইচের সময় মানুষ ঈদের মতো আনন্দ করত। আত্মীয়রা কয়েক দিন আগে এসে হাজির হতো।' বলছিলেন হারতার বাসিন্দা বর্ষীয়ান সুরেশ মাল। নৌকাবাইচ দেখতে তিনি এসেছেন সন্ধ্যা নদীর তীরে। তাঁর মতো উৎসাহী ব্যক্তিরা আবার কাছ থেকে বাইচ দেখার জন্য নৌকা আর ট্রলার ভাড়া করে নদীর বুকেই ছিলেন। ফলে একসময় এসব ট্রলারের ভিড়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া বাইচের নৌকাগুলোই হারিয়ে যায়। হাজারো দর্শকের ভিড়ে সন্ধ্যা নদীর দুই তীরেই আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। দুপুর ২টা থেকে নানা আকৃতির নৌকা এক এক করে হাজির হচ্ছিল প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য। মূল প্রতিযোগিতা শুরুর আগে নৌকাগুলো বিভিন্ন রকম কসরত দেখিয়ে মুগ্ধ করে রাখে দর্শকদের।
হারতা নৌকাবাইচ আয়োজক কমিটির সভাপতি ও হারতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চিকিৎসক হরেন রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘ দেড়শ বছর ধরে লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে সন্ধ্যা নদীতে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা চলে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় এবারের ১৫১তম প্রতিযোগিতায় পাঁচটি নৌকা অংশ নিয়েছে। বাইচ শেষে প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় স্থান অধিকারীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন বরিশাল-২ (বানারীপাড়া-উজিরপুর) আসনের সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম। এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়সিন্ধু তালুকদার ও থানার ওসি সুকুমার রায় উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.