অপদখলীয় ভূমি বাংলাদেশকে ফেরতের বিপক্ষে উলফা

স্থল সীমান্তবিষয়ক প্রটোকলের আওতায় ভারতের দখলে থাকা বাংলাদেশের ভূমি ফেরত দেওয়ার বিপক্ষে দেশটির বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা)। সংগঠনটির পরেশ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন অংশের প্রচার শাখার প্রধান অরুণোদয় দিহোটিয়ার ই-মেইল বার্তায় তাঁদের এই অবস্থানের কথা জানানো হয়েছে। তবে অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ের ফলে যে ভারতই তুলনামূলক বেশি লাভবান হবে সে বিষয়টি তাঁরা কৌশলে পাশ কাটিয়ে গেছে।সম্প্রতি আইবিএন লাইভের অনলাইন সংস্করণে 'পিএম (প্রাইম মিনিস্টার), সিএম (চিফ মিনিস্টার) সিক্রেটলি গেইভ অ্যায়োয়ে আসাম ল্যান্ড টু বাংলাদেশ : উলফা' শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।


ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের গত ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সফরের এক সপ্তাহ আগে এক বিবৃতিতে ভূমি বিনিময়ে সমঝোতার বিরোধিতা করেন উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া। স্থল সীমান্ত প্রটোকল স্বাক্ষরের এক মাসেরও বেশি সময় পর উলফার পক্ষ থেকে আবার বিরোধিতার বিষয়টি জানান দেওয়া হলো।
ই-মেইল বার্তায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে বলা হয়, 'প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আসামের প্রকৃত বাসিন্দা নন। তিনি ও মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ রাজ্যের আদিবাসী জনগণকে না জানিয়ে আসামের ভূমি হাসিমুখে বাংলাদেশকে দিয়ে এসেছেন। এর মাধ্যমে মনমোহন সিং ও তরুণ গগৈ আমাদের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছেন।' বার্তায় বলা হয়, 'আদিবাসীরা জানে না বাংলাদেশের কাছ থেকে আসাম কতটুকু ভূমি পেয়েছে। অসমিয়া হিসেবে আমরা রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানা অক্ষুণ্ন রাখাকে মর্যাদার বিষয় বলে মনে করি।'
অরুণোদয় বলেন, ভূমি হস্তান্তরের প্রতিবাদ করলেই মাওবাদী বা আইএসআই এজেন্ট বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। সরকারকে এর প্রমাণ দিতে হবে। একই সঙ্গে তরুণ গগৈ ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে রাজ্যের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
বার্তায় অভিযোগ করা হয়, 'ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নদীর ওপর বড় বড় বাঁধ নির্মাণে উৎসাহীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। আর এ জন্যই মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রীরা বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতাকারীদের মাওবাদী বা উলফা বলে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছেন।'
জানা গেছে, মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ সফরের পর দিলি্লতে এক সংবাদ সম্মেলনে তরুণ গগৈ বলেন, স্বাক্ষরিত স্থল সীমান্ত প্রটোকল অনুযায়ী আসাম-বাংলাদেশ সীমান্তে বিরোধপূর্ণ ৩৫৭ দশমিক ৫ একর ভূমি বাংলাদেশ পেয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের কাছ থেকে আসাম পেয়েছে ১২৩৯ দশমিক ৫ একর জমি। তিনি আরো বলেন, করিমগঞ্জের পাল্লাথল চা বাগানের ৪৫৫ একর জমি বাংলাদেশ নিজেদের দাবি করেছিল। এর মধ্যে আসাম তথা ভারত সরকার মাত্র ৭৪ দশমিক ৫ একর জমি ছাড়তে রাজি হয়েছে। বাকি ৩৮০ দশমিক ৫ একর জমি আসাম নিজের দখলেই রাখবে। অন্যদিকে করিমগঞ্জের নয়াগাঁও অঞ্চলের ১৪৫ একর জমি বাংলাদেশ নিজেদের বলে দাবি করলেও ভারত সম্মত হয়নি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সফরের পর মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাঙমা ডাউকীতে ভারতীয় সাংবাদিকদের বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী মেঘালয় ৪১ একর ভূমি বাংলাদেশকে ছাড় দিয়েছে। এর বিপরীতে পেয়েছে ২৪০ একর।
প্রটোকল স্বাক্ষরের পর ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কথাতেই একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তরে সার্বিক বিচারে ভারতেরই লাভ হবে বেশি। অথচ নিজেদের লাভের দিকটি আড়ালে রেখে উলফার পক্ষ থেকে 'বাংলাদেশ লাভবান হচ্ছে' বলে প্রচার চালানো হচ্ছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গত আগস্ট মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ ছিল পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা সেক্টরে মোট ২৫টি অপদখলীয় ভূমিকে ঘিরে। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের দখলে সাতটি এবং ভারতের দখলে রয়েছে ১৮টি।
পশ্চিমবঙ্গের ৯টি অপদখলীয় ভূমির মধ্যে বাংলাদেশের দখলে রয়েছে দুটি, যার পরিমাণ এক হাজার ৬৯৭ দশমিক ০৪ একর। পক্ষান্তরে ভারতের দখলে রয়েছে চারটি, যার পরিমাণ এক হাজার ২৩ দশমিক ০৮ একর। অপর তিনটি জায়গায় অপদখল নেই বলে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে।
ত্রিপুরা সেক্টরের তিনটি বিরোধপূর্ণ জায়গার মধ্যে দুটিতে কোনো অপদখলীয় জমি নেই বলে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে। অপর একটি ভারতের দখলে রয়েছে, যার পরিমাণ ১৩৮ দশমিক ৪১ একর। আসাম সেক্টরে তিনটি অপদখলীয় জমির মধ্যে একটিতে বাংলাদেশের দখলে থাকা জমির পরিমাণ ১৯৩ দশমিক ৮৫ একর।
জানা গেছে, অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশ তেমন একটা লাভবান হবে না। বরং ছিটমহল বিনিময় হলে কিছুটা লাভ হবে। বাংলাদেশের ভেতর কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও পঞ্চগড় জেলায় ভারতীয় ছিটমহলের সংখ্যা ১১১টি। এসব ছিটমহলের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর। অন্যদিকে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলায় বাংলাদেশের ছিটমহলের সংখ্যা ৫১টি। এগুলোর জমির পরিমাণ সাত হাজার ১১০ দশমিক ০২ একর। ছিটমহল বিনিময় হলে বাংলাদেশ ১০ হাজার একরেরও বেশি ভূমি পাবে।
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক জানান, ভারত আগামী বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে অপদখলীয় ভূমি বিনিময় করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত ছিটমহল ও অপদখলীয় ভূমি একই সময়ে বিনিময়ের কথা প্রটোকলে উল্লেখ করা হয়। এটি বাস্তবায়ন হলে দুই দেশের সীমান্ত রেখা ও মানচিত্রে কিছুটা পরিবর্তন আসবে।
স্বাক্ষরিত প্রটোকলে দুই দেশের মধ্যে অপদখলীয় ভূমি ও ছিটমহল বিনিময়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কবে নাগাদ এ বিনিময় সম্ভব হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গত ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, ভারতের পার্লামেন্টে আগামী শীতকালীন অধিবেশনে বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে পাস হলেই এটি বাস্তবায়ন হবে।

No comments

Powered by Blogger.