‘বাঙালিপ্রেমী’ জাফর মাসুদ by সোহরাব হাসান
একাত্তরের
মার্চে ইয়াহিয়া খানের সামরিক অভিযানের বিরোধিতা করে পূর্ব পাকিস্তানের
তৎকালীন গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল আহসান ও পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক প্রশাসক
লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের পদত্যাগের কথা আমরা জানি। এই
দুই শীর্ষস্থানীয় পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক
সমাধানের তাগিদ দিয়েছিলেন। তাঁরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বোঝাতে চেষ্টা
করেছিলেন যে সামরিক অভিযানের পরিণতি পাকিস্তানের ভাঙন এবং অগণিত নিরীহ
মানুষের মৃত্যু। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অনেক গবেষক এবং সেই সময়ের ঘটনাবলির
প্রত্যক্ষদর্শীদের লেখায় এই দুই বাঙালিপ্রেমী পাকিস্তানি কর্মকর্তার কথা
উঠে এসেছে। কিন্তু পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার মার্শাল জামাল
খান ও গবেষক নাসিম ইউসুফের লেখায় বাঙালিপ্রেমী তৃতীয় যে শীর্ষস্থানীয়
সামরিক কর্মকর্তার নাম পাওয়া যায়, তিনি হলেন এয়ার কমোডর জাফর মাসুদ, যিনি
মিট্টি মাসুদ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন পাকিস্তান
বিমানবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান। ১৯৭০ সালের এপ্রিলে যখন জাফর মাসুদ এই
দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় আসেন, তখন রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল উত্তপ্ত। পাকিস্তানজুড়ে
জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছিল। ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ ৩১৩ আসনের জাতীয় পরিষদে ১৬৭টি
আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী
ভুট্টোর পিপিপি পায় ৮১টি আসন। কিন্তু নির্বাচনের এই ফল সামরিক চক্র ও
পিপিপি নেতা ভুট্টো মানতে পারছিলেন না। ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ আহুত অধিবেশন
স্থগিত ঘোষণা করলে পূর্ববঙ্গের মানুষ ক্ষুব্ধ প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া জানায়।
বঙ্গবন্ধু ধর্মঘটের ডাক দেন। গভর্নর আহসানের শেষ অনুরোধ ছিল যদি একান্তই
অধিবেশন স্থগিত করতে হয়, তাহলে যেন নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু
ইয়াহিয়া সেটি করলেন না। আহসান ওই দিনই পদত্যাগ করেন। ইয়াহিয়া খান
পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক প্রশাসক ইয়াকুব খানকে গভর্নরের দায়িত্ব দেন। কিন্তু ৪
মার্চ ইয়াকুবও পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসকের পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
এ অবস্থায়
সামরিক হাইকমান্ড বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা জাফর মাসুদকে পূর্বাঞ্চলীয়
কমান্ডের দায়িত্ব দেয় এবং বেলুচিস্তানের কসাই নামে পরিচিত জেনারেল টিক্কা
খানকে নতুন গভর্নর করে পাঠায়। নাসিম ইউসুফ লিখেছেন, ইয়াহিয়া খান যে পথে
রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলা করছিলেন, তাতে মাসুদ অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁর
উপলব্ধি ছিল, পূর্ব বাংলার যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, তা দমন-পীড়ন বা
সহিংসতা দিয়ে থামানো যাবে না। এ অবস্থায় তিনি ও তাঁর সহযোগীরা ১৫ মার্চ
ইয়াহিয়া খানকে ঢাকায় আসতে রাজি করান। শেষমেশ ইয়াহিয়া ঢাকায় আসেন এবং
প্রেসিডেন্ট হাউসে মাসুদ ও জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই
বৈঠকে জাফর মাসুদ প্রেসিডেন্টের কাছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত
করেন। তিনি বলেন, পরিস্থিতি খুবই জটিল এবং শান্তিপূর্ণভাবেই রাজনৈতিক
সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। অন্যথায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুর
প্রাণহানি ঘটবে। ইয়াহিয়া জবাব দেন, ‘মিট্টি আমি তা জানি, আমি তা জানি।’
এয়ার কমোডর মাসুদ এক ঘণ্টা ধরে সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক এবং পূর্ব বাংলার
সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের
আন্দোলন সামরিক শক্তি দিয়ে সমাধান করা যাবে না। ২০০৩ সালের ৭ অক্টোবর জাফর
মাসুদ মারা যাওয়ার পর পাকিস্তানের সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান মার্শাল জামাল
খান লিখেছেন, মিট্টি মাসুদ ছিলেন বিমানবাহিনীর এক সাহসী কর্মকর্তা। কিন্তু
তিনি তাঁর কমান্ডকে নিরীহ মানুষ হত্যার কাজে ব্যবহার করতে দেননি। (ডন, ১৩
অক্টোবর ২০০৬) ঢাকায় অবস্থানকালে ইয়াহিয়া নির্বাচনে বিজয়ী নেতা শেখ মুজিবের
সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করেন। একপর্যায়ে তিনি ভুট্টোকেও ঢাকায় আসতে বলেন।
কিন্তু তাঁদের আলোচনা সফল হয়নি। ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক সমাধানের পথে না গিয়ে
২৫ মার্চ ঢাকা ত্যাগের আগে বাঙালিদের ওপর সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ
দিয়ে যান। জাফর মাসুদ শেষে চেষ্টা হিসেবে বিমানবন্দরে বিদায় জানানোর সময়ও
তাঁকে এর পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে
পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে। এই ক্রান্তিলগ্নে
টিক্কা খান মাসুদকে সামরিক অভিযানে বিমানবাহিনীর সহায়তার জন্য অনুরোধ
জানান। কিন্তু মাসুদ দেখতে পাচ্ছিলেন, নিরীহ বাঙালিদের ওপর নির্দয় ও
বর্বরোচিত বিমান হামলা বা ধ্বংসযজ্ঞ পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করে দেবে। তিনি
পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষা এবং বাঙালিদের ওপর গণহত্যা এড়ানোর জন্য টিক্কার
আহ্বানে সাড়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২৬ মার্চ মাসুদ এয়ার কমোডর ইনামুল
হককে (পরবর্তীকালে এয়ার মার্শাল) বিমানবাহিনীর কমান্ডের দায়িত্ব দিয়ে
পশ্চিম পাকিস্তান চলে যান। সেখানে তাঁকে নতুন পদে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব
দেওয়া হলেও মাসুদ তা গ্রহণ করেননি এবং বিমানবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন।
পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যম জাফর মাসুদের প্রতিক্রিয়া নেওয়ার চেষ্টা
করলেও তাঁকে সেটি করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টেও
মাসুদের কোনো বিবৃতি নেই। টিক্কা খান ২৫ মার্চ সর্বাত্মক অভিযান চালিয়েও
যখন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছিলেন না, তখন ইয়াহিয়া খান তাঁর চেয়েও
গণহত্যায় ‘সিদ্ধহস্ত’ জেনারেল এ এ কে নিয়াজিকে ঢাকায় পাঠান। এবং তার
সমাপ্তি ঘটে ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজির নেতৃত্বে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনার
নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। নাসিম ইউসুফের শেষ মন্তব্য ‘মাসুদের
বীরত্বপূর্ণ ও নীতিগত অবস্থান চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি তাঁর
সম্ভাবনাময় পেশা ত্যাগ করেছেন জনগণের অধিকার এবং দেশের স্বার্থরক্ষার
জন্য।’
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com
No comments