মেনেই নিচ্ছি নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু? by আসিফ নজরুল
গত
কয়েক দিনে বড় ধরনের কিছু ঘটনা ঘটেছে আমাদের জন্য। এর মধ্যে নেপালে
মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা সবাইকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করেছে। খালেদা জিয়ার
জামিন নিয়ে বিলম্ব কিংবা জাফর ইকবালের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা অনেকের নজর
কেড়েছে। ৭ মার্চের জনসভাগামী কিছু মিছিল থেকে প্রকাশ্য রাজপথে নারী
নির্যাতনের মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনাও ঘটেছে। এত কিছুর ভিড়ে অনেকের মনে থাকার
কথা নয় গত কয়েক দিনে পুলিশি নির্যাতনের ঘটনাকে। এ সময়ে অন্তত তিনটি বড়
ধরনের ঘটনা ঘটেছে। প্রথম ঘটনায় প্রেসক্লাবে পিস্তল হাতে ত্রাস ছড়িয়ে
সাদাপোশাকে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দ্বিতীয় ঘটনায় সমাবেশ থেকে ছিনিয়ে
চ্যাংদোলা করে একজন তরুণকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সর্বশেষ ঘটনাটি সবচেয়ে
মর্মান্তিক। এতে রিমান্ডে নেওয়ার পর কারা হেফাজতে একজন যুবকের মৃত্যুর ঘটনা
ঘটেছে। সারা ফেসবুক তাঁর শরীরে নির্যাতনের চিহ্নের ছবিতে ছেয়ে গেলেও
ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার নাকি এমন কোনো লক্ষণ খুঁজে পাননি! এই তিনটি ঘটনার
শিকার ব্যক্তিরা হলেন বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী। তিনটি ঘটনারই সূচনা
বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনকালে। তিনটি ঘটনাই বাংলাদেশের সংবিধান,
সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং দেশের প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন। নানা
ঘটনা-দুর্ঘটনার ভিড়ে এই ধারাবাহিক পুলিশি বর্বরতা অনেকের চোখ এড়িয়ে যেতে
পারে। কিন্তু গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ বিষয়গুলো নজরে রাখা বা এর
প্রতিকার করা কারও কারও আইনগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও নৈতিক দায়িত্ব। তাঁরা যখন
তা করেন না, তখন তা আতঙ্কজনক হয়ে দাঁড়ায়। আলী রীয়াজের ১৪ মার্চের লেখায় তা
সঠিকভাবে ফুটে উঠেছে। আমি মনে করি এ নিয়ে সমাজে আরও আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রয়োজন রয়েছে মানবাধিকার ধারণার প্রাথমিক পাঠ আবারও স্মরণ করার।
২. মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে (ধর্ম, বংশ, জন্মস্থান, রাজনৈতিক পরিচয়-নির্বিশেষে) এই অধিকার প্রত্যেক মানুষের। যেমন বৈষম্যহীনতা একটি মানবাধিকার। গোপালগঞ্জে বা ফেনীর মানুষ বলে তাই কারও আমলভেদে বৈষম্যের শিকার হওয়ার বা বাড়তি সুযোগ পাওয়ার অধিকার নেই। আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জামায়াতের রাজনীতি করলে আমলভেদে কারও অধিকার কেড়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কোনো বিশেষ ছাত্রসংগঠনের কর্মী এই অভিযোগে পিটিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করার যেসব সংবাদ আমরা পত্রিকায় দেখি, তাও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমাদের সংবিধানে মানবাধিকার সীমিত করা হয়েছে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য। যেমন পুলিশ বা সেনাবাহিনীর বাক্স্বাধীনতা বা মিছিল করার অধিকার নেই। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু মানবাধিকার প্রযোজ্য নয় বলা হয়েছে সংবিধানে। তবে কিছু অধিকার, যেমন নির্যাতন, অবমাননাকর ও লাঞ্ছনাকর দণ্ড বা ব্যবহার থেকে মুক্ত থাকার অধিকার, প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃত। জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারের মতো নির্যাতন থেকে রেহাই পাওয়ার অধিকার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিগুলোতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। শুধু এ বিষয়টি নিয়ে নির্যাতনবিরোধী যে কনভেনশনটি রয়েছে, তার পক্ষরাষ্ট্র বাংলাদেশও। নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক ও সাংবিধানিক বিধানের পাশাপাশি ২০১৩ সালে প্রণীত একটি আইন বাংলাদেশে রয়েছে। এই আইনে হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের অভিযোগ পুলিশ না নিলে সরাসরি আদালতে মামলা করার, হেফাজতের দায়িত্বে থাকা দোষী ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানের, অভিযোগকারী ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধানের ও তাঁর ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইনে কোনো সমস্যা নেই আমাদের। কিন্তু তারপরও দেশে অব্যাহতভাবে নির্যাতন বা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ঘটছে মূলত এসবের বাস্তবায়ন নেই বলে।
৩. মানবাধিকার রক্ষিত হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য দেশে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন সংসদ, উচ্চ আদালত ও মানবাধিকার কমিশন। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান রয়েছে, মানবাধিকার বিষয়ে নজরদারির জন্য এরা বিদেশ থেকে উচ্চ অঙ্কের আর্থিক সহযোগিতাও পেয়ে থাকে। মানবাধিকার নজরদারির জন্য গণমাধ্যমও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এর মধ্যে বর্তমান সংসদ ও সংসদীয় কমিটিগুলো অকার্যকর থাকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ২০১৪ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর সদস্যদের মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলবে না, এটি অভাবনীয় নয়। কিন্তু এ বিষয়ে বাদবাকি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার থাকার জন্য বাংলাদেশে জনগণের অর্থে পরিচালিত একটি মানবাধিকার কমিশন রয়েছে। এই কমিশনের মৌলিকতম দায়িত্ব হচ্ছে যে কারও মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হলে সে বিষয়ে তদন্ত করা, অন্তত তার উদ্বেগ ও আপত্তি প্রকাশ করা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা করা হয় না। সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দল (যেমন বিএনপি, সিপিবি) ও সংগঠনগুলোর (যেমন তেল-গ্যাসসংক্রান্ত জাতীয় কমিটিসহ) সভা-সমাবেশের ওপর পুলিশি আক্রমণের বহু ঘটনা ঘটলেও আমরা মানবাধিকার কমিশনকে এ বিষয়ে কিছু বলতে দেখি না। হেফাজতে ছাত্রদল নেতা জাকিরের মৃত্যুর সাম্প্রতিক ঘটনাসহ এ ধরনের বহু ঘটনায় কমিশনকে সোচ্চার হতে দেখি না। অতীতে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কিছু ঘটনায় কমিশনকে সরকারের ভূমিকার প্রতি সমর্থন প্রদান পর্যন্ত করতে দেখা গেছে। মানবাধিকার রক্ষার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালনের অবকাশ রয়েছে উচ্চ আদালতের। নিকট অতীতে উচ্চ আদালত গ্রেপ্তার ও রিমান্ডসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তমূলক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এরপর এসব নির্দেশ লঙ্ঘিত হওয়ার সংবাদ ফলাও করে পত্রিকায় বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিতভাবে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে সরকারের যেকোনো বাহিনীর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ে আমরা উচ্চ আদালতকে তা করতে দেখি না। নিম্ন আদালতের হাত-পা আরও বাঁধা। চার বছর আগে নিম্ন আদালতের একজন বিচারক ২০১৩ সালের আইন অনুসারে র্যাবের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা (নির্যাতন ও হত্যাসংক্রান্ত) গ্রহণ করেছিলেন। এরপর প্রথমে তাঁর মামলা আমলে নেওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়, পরে তাঁকে অন্য জায়গায় বদলি করে দেওয়া হয়। নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা ও মর্যাদার ওপর এই জাজ্বল্যমান হস্তক্ষেপের ঘটনায় প্রতিবাদ পর্যন্ত করেনি গণমাধ্যম ছাড়া অন্য কেউ। বাকি থাকে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলো। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাগুলো এরা লিপিবদ্ধ করে জানিয়ে দেওয়ার কাজটি করে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে নিরন্তর সোচ্চার থাকার দায়িত্ব অনেক ক্ষেত্রে পালন করে না। রাজনৈতিকভাবে যারা সরকারের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ বা ছাত্রলীগের নির্যাতন হলে বহু মানবাধিকার সংগঠন তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমল, রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্মীয় পরিচয়, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ভেদে তাদের উৎসাহের মাত্রা দৃষ্টিকটু রকমের হেরফের হয়। জাকিরের মৃত্যুর ঘটনাও তাদের অনেকে হয়তো এ কারণে এড়িয়ে গেছে। অথচ মানবাধিকারের মূল দর্শনের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ থাকলে এটি করার কথা নয়।
৪. মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানগুলো পালন না করলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বাড়তে থাকবে। নির্বাচনের বছরে এসে তা বাড়ার কারণও আছে। এমনিতেই গণমামলা আর যথেচ্ছ সংখ্যায় অজ্ঞাতনামা আসামি করার প্রচলন দেশে রয়েছে। এই সুযোগে বিরোধী পক্ষের যে কাউকে গ্রেপ্তার করার সুযোগ সরকারের রয়েছে। গ্রেপ্তারের পর থাকে নির্যাতিত হওয়ার এমনকি মারা যাওয়ার আশঙ্কা। এর কোনো প্রতিকার না হলে দেশের বিপুলসংখ্যক নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার বলে কিছু থাকবে না। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন তখন আরও বিপর্যস্ত হবে।
আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক
২. মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে (ধর্ম, বংশ, জন্মস্থান, রাজনৈতিক পরিচয়-নির্বিশেষে) এই অধিকার প্রত্যেক মানুষের। যেমন বৈষম্যহীনতা একটি মানবাধিকার। গোপালগঞ্জে বা ফেনীর মানুষ বলে তাই কারও আমলভেদে বৈষম্যের শিকার হওয়ার বা বাড়তি সুযোগ পাওয়ার অধিকার নেই। আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জামায়াতের রাজনীতি করলে আমলভেদে কারও অধিকার কেড়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কোনো বিশেষ ছাত্রসংগঠনের কর্মী এই অভিযোগে পিটিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করার যেসব সংবাদ আমরা পত্রিকায় দেখি, তাও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমাদের সংবিধানে মানবাধিকার সীমিত করা হয়েছে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য। যেমন পুলিশ বা সেনাবাহিনীর বাক্স্বাধীনতা বা মিছিল করার অধিকার নেই। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু মানবাধিকার প্রযোজ্য নয় বলা হয়েছে সংবিধানে। তবে কিছু অধিকার, যেমন নির্যাতন, অবমাননাকর ও লাঞ্ছনাকর দণ্ড বা ব্যবহার থেকে মুক্ত থাকার অধিকার, প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃত। জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারের মতো নির্যাতন থেকে রেহাই পাওয়ার অধিকার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিগুলোতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। শুধু এ বিষয়টি নিয়ে নির্যাতনবিরোধী যে কনভেনশনটি রয়েছে, তার পক্ষরাষ্ট্র বাংলাদেশও। নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক ও সাংবিধানিক বিধানের পাশাপাশি ২০১৩ সালে প্রণীত একটি আইন বাংলাদেশে রয়েছে। এই আইনে হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের অভিযোগ পুলিশ না নিলে সরাসরি আদালতে মামলা করার, হেফাজতের দায়িত্বে থাকা দোষী ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানের, অভিযোগকারী ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধানের ও তাঁর ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইনে কোনো সমস্যা নেই আমাদের। কিন্তু তারপরও দেশে অব্যাহতভাবে নির্যাতন বা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ঘটছে মূলত এসবের বাস্তবায়ন নেই বলে।
৩. মানবাধিকার রক্ষিত হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য দেশে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন সংসদ, উচ্চ আদালত ও মানবাধিকার কমিশন। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান রয়েছে, মানবাধিকার বিষয়ে নজরদারির জন্য এরা বিদেশ থেকে উচ্চ অঙ্কের আর্থিক সহযোগিতাও পেয়ে থাকে। মানবাধিকার নজরদারির জন্য গণমাধ্যমও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এর মধ্যে বর্তমান সংসদ ও সংসদীয় কমিটিগুলো অকার্যকর থাকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ২০১৪ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর সদস্যদের মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলবে না, এটি অভাবনীয় নয়। কিন্তু এ বিষয়ে বাদবাকি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার থাকার জন্য বাংলাদেশে জনগণের অর্থে পরিচালিত একটি মানবাধিকার কমিশন রয়েছে। এই কমিশনের মৌলিকতম দায়িত্ব হচ্ছে যে কারও মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হলে সে বিষয়ে তদন্ত করা, অন্তত তার উদ্বেগ ও আপত্তি প্রকাশ করা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা করা হয় না। সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দল (যেমন বিএনপি, সিপিবি) ও সংগঠনগুলোর (যেমন তেল-গ্যাসসংক্রান্ত জাতীয় কমিটিসহ) সভা-সমাবেশের ওপর পুলিশি আক্রমণের বহু ঘটনা ঘটলেও আমরা মানবাধিকার কমিশনকে এ বিষয়ে কিছু বলতে দেখি না। হেফাজতে ছাত্রদল নেতা জাকিরের মৃত্যুর সাম্প্রতিক ঘটনাসহ এ ধরনের বহু ঘটনায় কমিশনকে সোচ্চার হতে দেখি না। অতীতে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কিছু ঘটনায় কমিশনকে সরকারের ভূমিকার প্রতি সমর্থন প্রদান পর্যন্ত করতে দেখা গেছে। মানবাধিকার রক্ষার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালনের অবকাশ রয়েছে উচ্চ আদালতের। নিকট অতীতে উচ্চ আদালত গ্রেপ্তার ও রিমান্ডসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তমূলক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এরপর এসব নির্দেশ লঙ্ঘিত হওয়ার সংবাদ ফলাও করে পত্রিকায় বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিতভাবে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে সরকারের যেকোনো বাহিনীর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ে আমরা উচ্চ আদালতকে তা করতে দেখি না। নিম্ন আদালতের হাত-পা আরও বাঁধা। চার বছর আগে নিম্ন আদালতের একজন বিচারক ২০১৩ সালের আইন অনুসারে র্যাবের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা (নির্যাতন ও হত্যাসংক্রান্ত) গ্রহণ করেছিলেন। এরপর প্রথমে তাঁর মামলা আমলে নেওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়, পরে তাঁকে অন্য জায়গায় বদলি করে দেওয়া হয়। নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা ও মর্যাদার ওপর এই জাজ্বল্যমান হস্তক্ষেপের ঘটনায় প্রতিবাদ পর্যন্ত করেনি গণমাধ্যম ছাড়া অন্য কেউ। বাকি থাকে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলো। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাগুলো এরা লিপিবদ্ধ করে জানিয়ে দেওয়ার কাজটি করে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে নিরন্তর সোচ্চার থাকার দায়িত্ব অনেক ক্ষেত্রে পালন করে না। রাজনৈতিকভাবে যারা সরকারের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ বা ছাত্রলীগের নির্যাতন হলে বহু মানবাধিকার সংগঠন তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমল, রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্মীয় পরিচয়, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ভেদে তাদের উৎসাহের মাত্রা দৃষ্টিকটু রকমের হেরফের হয়। জাকিরের মৃত্যুর ঘটনাও তাদের অনেকে হয়তো এ কারণে এড়িয়ে গেছে। অথচ মানবাধিকারের মূল দর্শনের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ থাকলে এটি করার কথা নয়।
৪. মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানগুলো পালন না করলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বাড়তে থাকবে। নির্বাচনের বছরে এসে তা বাড়ার কারণও আছে। এমনিতেই গণমামলা আর যথেচ্ছ সংখ্যায় অজ্ঞাতনামা আসামি করার প্রচলন দেশে রয়েছে। এই সুযোগে বিরোধী পক্ষের যে কাউকে গ্রেপ্তার করার সুযোগ সরকারের রয়েছে। গ্রেপ্তারের পর থাকে নির্যাতিত হওয়ার এমনকি মারা যাওয়ার আশঙ্কা। এর কোনো প্রতিকার না হলে দেশের বিপুলসংখ্যক নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার বলে কিছু থাকবে না। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন তখন আরও বিপর্যস্ত হবে।
আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক
No comments