শিক্ষায় ঔপনিবেশিকতার দীঘল ছায়া by বাহালুল মজনুন চুন্নূ
একটা
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সে দেশের মানুষের দীর্ঘকালের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও
নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। আমাদের এ দেশের ক্ষেত্রেও এমনটি
ঘটেছে। প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগে শিক্ষাকাঠামোয় ক্রমবিকাশমান
নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। প্রাচীনযুগে বাংলায়
তপোবনে, গুরুগৃহে, মন্দিরে, আশ্রমে কিংবা বৌদ্ধ বিহারে শিক্ষাকার্যক্রম
চলত। নালন্দা মহাবিহারের সঙ্গে বাংলার বৌদ্ধ সংঘারামগুলোর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ
ছিল। বিহারগুলোতে শুধু বৌদ্ধ ধর্মের চর্চাই হতো না, ব্যাকরণ, শব্দবিদ্যা,
হেতুবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, চতুর্বেদ, সাংখ্য, সংগীত ও চিত্রকলা, মহাযান
শাস্ত্র, যোগশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি জ্ঞানের বিভিন্ন দিকও অধিতব্য
বিষয়ের অন্তর্গত ছিল। দেবমন্দিরে দেবপূজকরা শুধু ব্রাহ্মণ্য
ধর্মশাস্ত্রেরই চর্চা করতেন না, তারা দৈনন্দিন সমস্যাগত জ্ঞান-বিজ্ঞানের
চর্চাও করতেন। তবে শিক্ষার বিষয়টি সমাজের উচ্চশ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
মধ্যযুগে দেশীয় সনাতন শিক্ষার বিস্তৃত ধারা হিসেবে মূলত একদিকে ছিল টোল ও
পাঠশালা এবং অন্যদিকে মক্তব-মাদ্রাসার শিক্ষা। টোল সাধারণত কোনো বিদ্বান
ব্যক্তির নিজস্ব উদ্যোগে পরিচালিত হতো যেখানে ওই ব্যক্তিই শিক্ষা
দিতেন।ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত ব্যাকরণ, কাব্য, অঙ্ক, আয়ুর্বেদ,
জ্যোতিষশাস্ত্র, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষালাভ করত। মুসলিম শাসকদের
আমলে মুসলমানদের জন্য চালু হয়েছিল মক্তব ও মাদ্রাসা। মুঘল আমলে মাদ্রাসায়
সিলেবাসভিত্তিক শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট মানবসম্পদ তৈরির চেষ্টা
করা হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের শিক্ষার প্রভাব আমাদের বর্তমা ন
শিক্ষাব্যবস্থায় তেমন একটা নেই, কেননা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলেই আমাদের
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার মূল কাঠামো গড়ে ওঠে। ব্রিটিশদের এবং
পাকিস্তানি আমলের অনুসৃত নীতি এখনও অনেক ক্ষেত্রেই মেনে চলা হচ্ছে, যার
ফলশ্রুতিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ঔপনিবেশিকতার দীঘল ছায়া বিরাজ করছে।
দেশে কাক্সিক্ষত মাত্রায় দক্ষ জনসম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে না। সৃষ্টি হচ্ছে কেবল
পুঁথিগত বিদ্যা অজর্নকারী শিক্ষিত বেকারগোষ্ঠী। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা,
কাশীতে সংস্কৃত কলেজ ও কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে এদেশে আধুনিক শিক্ষা
বিস্তারের গোড়াপত্তন বলে বিবেচনা করা হয়। ব্রিটিশরা এ অঞ্চলের শিক্ষার
মানোন্নয়নের পরিবর্তে শিক্ষাকাঠামোয় যে পুঁথিগত বিদ্যার ব্যাপকতা বৃদ্ধি
করেছিল, তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল কম মাইনেতে ইংরেজি শিক্ষিত কেরানির দল
তৈরি করা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ
অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের দায়িত্ব পায় ১৮১৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের
মাধ্যমে। এতে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতি বছর অন্তত এক লাখ টাকা বরাদ্দ করার কথা
বলা হয়। ফলে একটা পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। তারপর এ শিক্ষাসংক্রান্ত অনুদান
বিতরণের জন্য ১৮২৩ সালে ‘জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন’ গঠিত
হয়েছিল; কিন্তু শিক্ষার তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ
পার্লামেন্টে দেয়া বক্তৃতায় কোম্পানির শিক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান টমাস
র্যাবিংটন মেকলে নীতিনির্ধারণী এক মিটিংয়ে বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের
সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে এমন একটি শ্রেণী তৈরি করতে, যারা আমাদের এবং
আমরা যাদের শাসন করছি তাদের মাঝে ব্যাখ্যাকার (দালাল) হিসেবে কাজ করবে। এটি
এমন মানুষের শ্রেণী যারা রক্ত এবং বর্ণে ভারতীয়; কিন্তু রুচিতে, মতামতে,
মূল্যবোধে এবং বুদ্ধিবৃত্তিতে হবে ইংলিশ’। তার এ বক্তৃতার মধ্য দিয়েই
ব্রিটিশদের আসল উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছিল
১৮৫৪ সালে উডের ডেসপাচ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এতে মেকলের নীতি পরিত্যাগ করে
সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের কথা বলা হয়। এজন্য দেশীয়
ভার্নাকুলার স্কুলগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার সুপারিশ করা হয়। প্রাথমিক
শিক্ষা থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার
আদলে ভারতে শিক্ষাকাঠামো তৈরির কথা বলা হয়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও
উচ্চশিক্ষা স্তরে কীভাবে কী পড়ানো হবে, তার বিভাগ করে দেয়া হয়। এ ডেসপাচের
কারণে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি অনুদান পেতে শুরু করে। এ
ডেসপাচের সাফল্য এখানেই।
তবে গুণগত মানের উন্নয়নে দৃষ্টি দেয়া হয়নি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্রুত বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাক্ষেত্রে যে
বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৮৮২ সালে গঠিত হান্টার
কমিশন প্রায় সাতশ’ পৃষ্ঠার দীর্ঘ রিপোর্টে এ দেশের সামগ্রিক
শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরে। এতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যায়ের ডিগ্রি সরকারি
চাকরিতে সম্মানজনক অবস্থান কিংবা শিক্ষিত পেশার একটি পাসপোর্ট হিসেবে
বিবেচিত; যা আজও আমাদের সমাজে বিদ্যমান। তবে ঔপনিবেশিক আমলে লর্ড কার্জন
শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার আমলে ১৯০৪ সালে
পাস হয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন। একটি রেজুলেশনে শিক্ষা নিয়ে সমালোচনা স্বীকার
করা হয়। প্রধান অভিযোগগুলো ছিল- উচ্চশিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য সরকারি চাকরি;
পরীক্ষা ব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত প্রাধান্য আরোপ; শিক্ষাক্রম অতিমাত্রায়
সাহিত্যধর্মী; শিক্ষার্থীদের মেধাবিকাশের চেয়ে মুখস্থবিদ্যার ওপর বেশি জোর
দেয়া; যথার্থ শিক্ষার পরিবর্তে যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তির প্রাধান্য। এ
সমালোচনা স্বীকার করা হলেও সমাধানে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আজকের
শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনা করে বলা যায়, এ সমস্যাগুলো এখনও আমাদের
শিক্ষাব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে। ১৯১৭ সালে মাইকেল সেডলারের কমিশন,
১৯২৯ সালের হার্টগ কমিশন শিক্ষার বিস্তার ও গুণগত মান উন্নয়নে সুপারিশ
করলেও সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৩৭ সালে মহাত্মা গান্ধী হরিজন পত্রিকায়
শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বিশেষ পরিকল্পনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা বুনিয়াদি
শিক্ষা পরিকল্পনা বা ওয়ার্ধা স্কিম নামে পরিচিত। এ পরিকল্পনার মূল কথা ছিল
কাজের মাধ্যমে শিক্ষা। এতে ছাত্রদের কিছু মৌলিক পেশায় প্রশিক্ষণ গ্রহণের
জন্য বিষয় বেছে নেয়ার অধিকার প্রদান করার কথা বলা হয়েছিল। এটি ছিল জীবনের
সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে শিক্ষার যোগসূত্র স্থাপনের একটি সচেতন
পদক্ষেপ। কিন্তু এ শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও কর্তৃপক্ষের ছিল অনীহা।
১৯৪৪ সালে জন সার্জেন্টের নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশন ইংল্যান্ডে তৎকালে
শিক্ষার মান যে পর্যায়ে আছে, আগামী ৪০ বছরের মধ্যে ভারতবর্ষের শিক্ষার মান
সেখানে পৌঁছে দেয়ার কথা বলেছিল; কিন্তু এটাও বাস্তবায়িত হয়নি। সত্য কথা
হল, ব্রিটিশ আমলের শিক্ষা কমিশনগুলোর রির্পোটে ভালো ভালো কথা লেখা থাকলেও
সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। তারা যে শিক্ষাকাঠামো তৈরি করেছিল তা আদতে ছিল
সাধারণ মানুষের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। এ শিক্ষায় শিক্ষিতরা উৎপাদন প্রক্রিয়া
থেকে স্বাভাবিকভাবেই দূরে সরে গিয়েছিল। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায়
প্রকৃতি, পরিবেশ ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাযুজ্য স্থাপন এবং মানবিক
গুণাবলি বিকাশের চেয়ে তত্ত্বগত শিক্ষা ও যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার
ওপরই বেশি জোর দেয়া হয়েছিল, যেই ধারা এদেশে আজও অব্যাহত। ঔপনিবেশিক আমলে
শিক্ষাক্ষেত্রে ছিল বৈষম্য, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ছিল। সেই ধারা এখনও অনেকটা
বিদ্যমান। পাকিস্তান আমলে মওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ শিক্ষা কমিশন, আতাউর
রহমান খান শিক্ষা কমিশন, শরীফ ও হামিদুর রহমান কমিশন গঠিত হয়েছিল; কিন্তু এ
কমিশনগুলো শিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি বরং বৈষম্য আরও প্রকট করে
তুলেছিল। তাই দেখা যায়, ১৯৪৭-৪৮ থেকে ১৯৬৫-৬৬ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমে গিয়েছে, অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে বেড়েছে
চারগুণ। মাধ্যমিক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্রই ছিল বৈষম্য। জাতির জনক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ২৪ অক্টোবর কুদরত-ই-খুদা কমিশন গঠন
করেন। একটি বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক বিশ্ব মানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলাই
ছিল এ কমিশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ১৯৭৪ সালের এ কমিশন যে রির্পোট প্রকাশ
করে, তা এ জাতির জন্য মূল্যবান শিক্ষা দলিল হিসেবে বিবেচিত। এদেশের
শিক্ষাব্যবস্থা পর্যায়ক্রমিকভাবে গড়ে উঠেছে; কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই
ঔপনিবেশিকতার করাল গ্রাসে ছিল বন্দি। তাই শতাব্দীকাল ধরে এর অবয়বে ছিল
বৈদেশিকতার ছাপ। সেখান থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা ছিল এ কমিশনের। এতে
বাংলাদেশের শিক্ষার বাস্তব সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানের সুনির্দিষ্ট
পরিকল্পনা দেয়া হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা যথাযথভাবে সুপারিশ
করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ’৭৫-র পটপরিবর্তনের পর পরবর্তী শাসকগোষ্ঠী এ
শিক্ষা দলিলটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেনি। পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন
শিক্ষা কমিশন (১৯৭৯), মফিজ উদ্দিন শিক্ষা কমিশন (১৯৮৮), জাতীয় শিক্ষানীতি
প্রণয়ন কমিটি (১৯৯৭), জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন করা হয়। সময়ের অমোঘ
ধারায় শিক্ষাক্ষেত্রে সংখ্যাগত পরিবর্তন ঘটলেও গুণগত মানের যে খুব একটা
পরিবর্তন হয়েছে, তা কিন্তু নয়। এখনও তাত্ত্বিক বিদ্যার প্রতি গুরুত্বারোপ
হয়ে আসছে। ব্যবহারিক ও প্রযুক্তিগত বিদ্যার প্রসার ঘটেছে শম্বুকগতিতে।
স্বচ্ছ মুক্তচিন্তা, অনুসন্ধিৎসা, অনুধাবন ও প্রয়োগ, সৃজনশীলতা এসব গুণ আজও
বহুদূর। এখনও সংখ্যাগত বৃদ্ধির দিকেই নজর, গুণগত মানের দিকে তেমন একটা নয়।
ঔপনিবেশিকতার দীঘল ছায়া শিক্ষাব্যবস্থার সর্বত্রই এখনও বিরাজ করছে। ছাঁচে
ঢালা দায়সারা গোছের শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন অসম্ভব। আশার
কথা, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার ঔপনিবেশিকতার সেই ছায়া থেকে, বেরিয়ে
আসতে চেষ্টা করে যাচ্ছে; যা সফল হলে মানবিক ও দক্ষ জনসম্পদ হিসেবে গড়ে
উঠবে আগামী প্রজন্ম।
বাহালুল মজনুন চুন্নূ: সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
বাহালুল মজনুন চুন্নূ: সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
No comments