দুই মন্ত্রীর দুই কথা ও রাজনীতির আগাছা by হাসান হামিদ
আমাদের
দেশের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের কথা শুনে বেশ মজা পাই আমরা; এ আর নতুন কি!
তবে তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকায় জনগণ অপছন্দ করলেও তাদের ভোট ও ক্ষমতা;
তারপর বছরজুড়ে সেসব শুনে আড়ালে মুখ টিপে হাসেন। গত জানুয়ারি মাসে ২০১৭-১৮
অর্থবছরের চাল আমদানি নিয়ে জাতীয় সংসদে দুই মন্ত্রী দুই ধরনের তথ্য
দিয়েছেন। সে দিন প্রশ্নোত্তরে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের তথ্য
অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে চাল আমদানি করা হয়েছে ২২ লাখ টনেরও
বেশি। কিন্তু স্বয়ং খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, এই অর্থবছরে চাল
আমদানি হয়েছে আট লাখ টন। ক্ষমতাসীন দলের হাবিবুর রহমানের প্রশ্নের জবাবে
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২২ লাখ ৩৮
হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে’। তবে সরকারি দলের আরেক সংসদ সদস্য শেখ মো:
নুরল হকের প্রশ্নের জবাবে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম জানান, ‘এই অর্থবছরে
১৫ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে আট লাখ টন দেশের
বন্দরে এসে পৌঁছেছে’। দেশে বর্তমানে খাদ্য ঘাটতি নেই বলেও মন্ত্রী এ সময়
দাবি করেন। মন্ত্রীর দাবিতে যে কথাই থাকুক, সবাই জানি উন্নয়নের মহাসড়কে আগে
যে পথ যেতে তিন ঘণ্টা লাগত, তা যেতে অনেক জায়গায় সাত ঘণ্টা লেগে যায়। সে
দিন সংসদে চালের দাম বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘পাহাড়ি
ঢল, আকস্মিক বন্যা ও ধানে ব্লাস্ট রোগ ইত্যাদি কারণে বোরো ফসলের ক্ষয়ক্ষতি
হওয়ায় খোলাবাজারে চালের মূল্যে ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়। এ পরিস্থিতিতে সরকারি ও
বেসরকারি উদ্যোগে বিপুল পরিমাণ চাল দেশে আসায় দাম কমে স্বাভাবিক পর্যায়ে
আসতে শুরু করেছে। সরকারের উদ্যোগে মজুদ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি মূল্য কমে
দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোগ্য চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে
আছে’। প্রশ্ন হলো- সহনীয় পর্যায়ে আছে মানে তিনি আসলে কী বোঝাতে চান? একজন
শ্রমিক সারা দিন কাজ করে যা পান তা দিয়ে তিন কেজি চাল কিনতে পারবেন শুধু,
তেল-ডাল-লবণ কিনতে পারবেন না।
আমার মনে হয়, আমাদের মন্ত্রীদের ক্ষেতের আইল
ধরে হাঁটার অভ্যাস নেই। এ দেশের গণমানুষ ভালো মতো খেতে পরতে পারছে কি না
ঠিক মতো খবর নিয়ে দেখুন। দয়া করে রাজনীতিকে নেহায়েত মন্ত্রীগিরিতে পরিণত
করবেন না। রাজনীতি মানে এমপি-মন্ত্রী হওয়া নয়। মানুষের সমস্যা জানুন,
উপলব্ধি করুন এবং স্বীকার করুন, মানুষ সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসবে আপনাদের।
আমাদের দেশের নেতাদের জনগণ পছন্দ করেন না, অধিকাংশকেই তাদের নৈতিকতা নিয়ে
প্রশ্ন আছে; এ অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। ছোট ছোট আগাছা-পরগাছাতুল্য নেতাদের
তো সত্য বুলি বলতে বোধ হয় কিছু নেই। অনেকের নেই চরিত্র, নেই নীতির
ছিটেফোঁটাও। এবার সাবেক রিপাবলিকান মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্টের
একটি ঘটনা বলি। তিনি একবার এক সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। এমন সময় তাকে
ক্ষেপাতে এক ব্যক্তি উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘স্যার, আমি একজন
ডেমোক্র্যাট’। রুজভেল্ট জানতে চাইলেন, ‘আপনি ডেমোক্র্যাট কেন, জানতে পারি?’
ওই ব্যক্তি বললেন, ‘আমার দাদা ছিলেন ডেমোক্র্যাট, বাবা ছিলেন ডেমোক্র্যাট,
কাজেই আমিও ডেমোক্র্যাট’। রুজভেল্ট বললেন, ‘এটা কোনো কথা হলো? আপনার দাদা
আর বাবা গাধা হলে আপনিও কি গাধা হবেন?’ তখন লোকটি জবাব দিলো, ‘তা হবো কেন,
তখন হবো রিপাবলিকান’। আমাদের দেশে কিন্তু রাজনীতির মতো অতীবটি গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়ে স্বাধীনতার পর থেকে এমনটাই হচ্ছে। নিজ যোগ্যতার চেয়ে পারিবারিক
পরিচয় আর ‘তেলবাজিতে’ দক্ষতার ভিত্তিতে নেতা নির্বাচিত হওয়ায় কিছু লোক
এখানে ‘বড়’ হয়েছেন, যারা আসলে নেতা না হয়ে অন্য কিছু হলেই দেশের জন্য ভালো
হতো। সব ক্ষেত্রে অবশ্য এ কথা খাটে না। কেউ কেউ রাজনীতির পাঠ নিয়ে জনগণের
পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হতাশ হতে হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী
আমাদের বাংলাদেশে বড় রাজনৈতিক দলগুলোতে মধ্যবিত্তের সংখ্যা কম নয়।
‘মধ্যবিত্ত’ বলতে সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক মানদণ্ডের কোনো বিশেষ শ্রেণীকে
বোঝাচ্ছি না। যারা রাজনীতিকে করণীয় না জেনে, কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে নিজেকে
জাহির করার অপচেষ্টা করে থাকেন; সেই মধ্যবর্তীদের কথা বলছি। দেশ গড়তে এরা
বাধা, বড় ধরনের ভাবতে অবাক লাগে, আমরা ধরেই নিয়েছি; ক্লাসের পড়া না পারা
বখে যাওয়া ছেলেই রাজনৈতিক দলে নাম লেখাবে। অথচ দেশ গড়তে হলে সবচেয়ে
মেধাবীদের এখানে আসতে হবে; নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাদের পাঠানোর সংস্কৃতি
আমরা তৈরি করছি এটা আমাদের ভাবনার বিষয়। দেশের ভালো কিছু আশা করছি, কিন্তু
কাজ করছি তার উল্টো, এটা হতে পারে না। রাজনীতি হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার
মাধ্যমে কিছু ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত কোনো গোষ্ঠী অভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করে। গাছের যত্ন নেয়া না হলে একসময় আগাছাই সেখানে বড় হয়ে দেখা দেয়। এমনকি
প্রয়োজনীয় গাছটিকে প্রায় নিঃশেষও করে দিতে পারে আগাছা। আমাদের রাজনীতির
অঙ্গনেও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আগাছা জন্মেছে দীর্ঘ সময় ধরে। আর যারা নিবেদিতপ্রাণ
তাদের বাদ দিয়ে যদি নীতিহীন ও সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের বেশি সুযোগ দেয়া
হয়, তবে একদিন তারা ভয়ানক ক্ষতিকর হয়ে উঠবে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে
এসে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাখো মানুষের সমাবেশে
বলেছিলেন, ‘স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে’। তারপর
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে শুরু হলো ব্যাপক আয়োজন। কিন্তু রাজনীতিতে বহু
আগাছা রয়ে গিয়েছিল এবং নতুন করে জন্ম নিচ্ছিল। সে দিকে খেয়াল করার সময়
পাননি বঙ্গবন্ধু। রাজনীতির পরগাছা ও আগাছাগুলোই ডালপালা মেলে এ দেশের
গণমানুষের কল্যাণধর্মী রাজনীতি ও রাষ্ট্রের চালিকাশক্তিকে আদর্শহীন ও
লুটপাটতন্ত্রে পরিণত করে। রাজনীতিতে আগাছা তৈরির যে বীজ বপন করা হয়েছিল,
তার পরিণতি আজো বহন করতে হচ্ছে দেশ ও জাতিকে।
যে রাজনীতি একদিন ছিল জনসেবা,
আজ তাই হয়ে উঠেছে ব্যক্তি ও কায়েমিস্বার্থ উদ্ধার এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ
লুণ্ঠনের জঘন্য হাতিয়ার। এরই ধারাবাহিকতায় রাজনীতির নামে আজ দেশসেবা নয়,
সন্ত্রাস ও নিজের আখের গুছানোর কর্মকাণ্ড হচ্ছে। আজকে যারা আওয়ামী লীগে যোগ
দিচ্ছেন, তারা কাল যে চলে যাবেন, সেটাই কিন্তু স্বাভাবিক। এটি এশিয়া
মহাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল। বর্তমানে আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন আর এ
কারণেই সবখানে এত আওয়ামী লীগার দেখা যাচ্ছে। কে না জানে এদের বেশির ভাগই
গড়ে কিছু পাওয়ার আশায় বঙ্গবন্ধুভক্ত সেজেছে। আজ যদি দল গদিতে না থাকে এদের
টিকিটিরও দেখা মিলবে না। আওয়ামী লীগের সভানেত্রীকে অনুরোধ, একটু ভাববেন; এত
শাখা লীগের দরকার কী? এমন কোনো ‘লীগ’ নেই যা গঠিত হয়নি। হকার লীগ, ভিখারি
লীগ, আমির লীগ, ফকির লীগ; এত উপশাখা হওয়ার পরও বড় মুশকিল হলো, কেউ এদের
ঠেকায় না। সে দিন দেখি শিশু লীগও হয়ে গেছে। এটা করছে কারা? একশ্রেণীর
ধান্ধাবাজ বিরিয়ানি প্যাকেট আর পানির বোতল দিয়ে কিছু মানুষকে অল্প সময়ের
জন্য খুশি রাখতে পারলেও এটাকে ‘রাজনীতি’ বলে না। এদের দমনে পদক্ষেপ নেয়া
জরুরি। ইংরেজি শব্দ ‘পলিটিক্স’-এর বাংলা প্রয়োজন। ইংরেজ আমলের বাঙালি
পণ্ডিতদের করা অনুবাদ ‘রাজনীতি’র পরিবর্তে এখন ‘জননীতি’ শব্দটি চালু করা
হলে প্রান্তিক মানুষের কাছাকাছি আসা যাবে এবং এর কার্যকারিতা জাতিকে আরো
বলিষ্ঠ করবে। সমাজ ও দেশ গঠনে মনোনিবেশ না করে যারা শুধু আখের গোছানোর জন্য
রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করে, তারাই আসলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আগাছা হয়ে বর্তমান।
এসব আগাছা-পরগাছাদের যত বেশি উপড়ে ফেলা যাবে দেশ তত দ্রুত প্রকৃত উন্নয়নের
দিকে এগিয়ে যেতে পারবে বলে জনগণ বিশ্বাস করে।
No comments