ইতালিতে ডানপন্থীদের জয়ে হুমকিতে ইইউ ও অভিবাসীরা by সরাফ আহমেদ

ইতালির নির্বাচনেও দক্ষিণপন্থীদের পতাকা উড়ল। ইউরোপের রাজনীতিতে সর্বত্র এখন দক্ষিণপন্থীদের জয়জয়কার। ৪ মার্চ ইতালির নির্বাচনেও তার বদল ঘটল না। ইতালিতে রক্ষণশীল ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন-বিরোধী জোটের বিজয় নিঃসন্দেহে ইইউ জোটকেও সংশয়ে ফেলবে। এই প্রথম ইইউ জোটভুক্ত কোনো দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ ভোটার জোটবিরোধীদের নির্বাচিত করলেন। নির্বাচনে কেউ না কেউ জয়লাভ করেই। রক্ষণশীল জোটের দ্বিতীয় শক্তি লেগা নর্ডের নেতা মাত্তো সালভানি বাণিজ্যিক শহর মাইল্যান্ডে হুংকার ছাড়লেন। বললেন, তিনি লোকরঞ্ছনবাদী রাজনীতিক এবং তা–ই থাকতে চান। লাখ মানুষ তাঁদের ভোট দিয়েছেন ইতালিকে নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিরতা থেকে মুক্ত করতে। ইতালি নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত বা অর্থনৈতিক বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্রাসেলস, বার্লিন বা প্যারিস নয়, তারা নিজেরাই তার সমাধান করতে চান। অর্ধেক ভোটারই ইতালির ঐতিহ্যবাহী দলগুলোকে ছেড়ে রক্ষণশীল দলগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। ফাইভ স্টার প্রোটেস্ট মুভমেন্ট নামক দলটি নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৩২ শতাংশ, ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টি ১৮ শতাংশ, রক্ষণশীল লেগা নর্ড ১৭ শতাংশ এবং ফোর্বস ইতালিয়া পেয়েছে ১৪ শতাংশ ভোট। কিন্তু কেন ইতালির ভোটাররা তাঁদের পুরোনো প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে রক্ষণশীলদের দিকে ঝুঁকে পড়লেন! একটি পরিসংখানে দেখা যাচ্ছে, অব্যাহত বেকারত্বের শিকার হয়ে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ২০১৫ সালে ১ লাখ ২ হাজার, ২০১৬ সালে ১ লাখ ১৪ হাজার এবং ২০১৭ সালে ১৫ লাখ কাজের খোঁজে ইতালি ছেড়েছেন। বলা বাহুল্য, এঁদের অধিকাংশ যুব সম্প্রদায়ভুক্ত তরুণ-তরুণী। ইতালির শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়দের অধিকাংশই উত্তর ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে পাড়ি জমিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী এ ধরনের দেশত্যাগের বিষয়টি ইউরোপে প্রথম ও আলোচিত বিষয়। এ থেকেই বোঝা যায় দেশটির প্রকৃত সামাজিক ও অর্থনীতির অবস্থা। একসময় অর্থনৈতিকভাবে সবল ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের শুরু থেকে থাকা এবং ইইউ জোটের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তির এই দেশটির লাগামহীন রাজনৈতিক অরাজকতা, রাজনীতিকদের সীমাহীন অনৈতিকতা ও দুর্নীতি দেশটির ভোটারদের রক্ষণশীল দলগুলোকে ভোট দিতে প্ররোচিত করেছে। ক্ষমতাসীন মধ্যবাম রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতি অনাস্থা ছাড়াও অন্য এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, দেশটির সরকারি কর্মচারীদের প্রতি ইতালির জনগণের মাত্র ৪০ শতাংশের আস্থা বোধ রয়েছে। সদ্য সমাপ্ত ইতালির নির্বাচন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর জোটের বড় দুই সদস্য জার্মানি আর ফ্রান্সের জন্য একটি বড় রকমের সতর্ক বার্তা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইতালিতে আর্থিক খাত ও শরণার্থীদের নিয়ে সমস্যা ক্রমেই বাড়ছিল। এ ক্ষেত্রে তারা ইইউ জোট বা কোনো সংস্থা থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছিল না। শরণার্থী ও অভিবাসীসংক্রান্ত বিষয়ও নির্বাচনে অন্যতম প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া বেকার সমস্যা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্রমাবনতিতে হতাশ হয়ে ভোটাররা পুরোনো প্রতিষ্ঠিত সামাজিক গণতন্ত্রী ও বাম দলগুলোকে ছেড়ে দক্ষিণপন্থীদের দিকে মোড় নিয়েছেন। ক্ষমতাসীন মধ্যবাম জোটের দল সামাজিক গণতন্ত্রী ও বাম দলগুলোও ইতালির নির্বাচনে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে পারেনি। ভূবৈচিত্র্যগত অবস্থানের কারণে ভূমধ্যসাগর দিয়ে অভিবাসীদের প্রবেশ নতুন নয়। তবে ইদানীং এই পথ ধরে অভিবাসীদের আগমন আরও বেড়েছে। বিষয়টি শুধু ইতালির জন্য সমস্যা নয়, সমস্যাটি ইউরোপের মহাদেশীয় সমস্যা। তাই শরণার্থী ও অভিবাসীদের অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোয় পাঠাতে পারলে হয়তো ইতালির জন্য চাপ কমত।
এ ছাড়া ইতালির বাম দলগুলোর নিজেদের মধ্য তিক্ততা ও বিভক্তি তাদের জনসমর্থন হারাতে ভূমিকা রেখেছে। ইতালিতে যে রক্ষণশীল দলগুলো অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা বলছে, তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতা ছাড়া নিজেরা কতটা সংস্কার করতে পারবে, তা বিস্ময়ের কথা। এই অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা বলেই ইতালির রাজনীতির খলনায়ক এবং নির্বাচনে নিষিদ্ধ ফোর্বস ইতালিয়া দলের নেতা সিলভিও বের্লোসকনি দেশটিতে চারবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তবে ২০১১ সালে সর্বশেষ ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার আগে দেশটির অর্থনীতিকে তিনি রসাতলে নিয়ে ছেড়েছেন। ইতালির নির্বাচনে বড় বিজয়ী দল পাঁচ তারা প্রতিবাদ আন্দোলন ৩২ শতাংশ ভোট পেয়েছে। দলটির নেতা বেপ গ্রিলো, একজন ক্যাবার শিল্পী, সারা দেশে দেশটির রাজনৈতিক অবস্থা ও রাজনীতিকদের নিয়ে সমালোচনামূলক কৌতুক করে যথেষ্ট জনপ্রিয়, তা ছাড়া নামকরা ব্লগার। তিনি যখন তার পাঁচ তারা আন্দোলন নাম দিয়ে রাজনীতি শুরু করেন, তখন অনেকের কাছে বোধগম্য হয়নি তিনি কী করতে চাইছেন। তবে তিনি তাঁর শিল্পীসত্তা দিয়ে জনপ্রিয় হতে ও সমর্থন পেতে সক্ষম হয়েছেন, যা অন্য দলগুলো পারেনি। পাঁচ তারা আন্দোলনের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ৩১ বছরের তরুণ আইনজীবী লুইজি দে মায়োকে এখন প্রায় সমমনা দক্ষিণপন্থী লেগা নর্ড বা ফোর্বস ইতালিয়া অথবা নির্বাচনে দ্বিতীয় শক্তি ক্ষমতাসীন সামাজিক গণতন্ত্রী দলের সদ্য পদত্যাগকারী নেতা মাত্তো রেনিজির সমর্থনে নতুন সরকার গঠনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে হবে। সদ্যসমাপ্ত ইতালির নির্বাচনে কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার কারণে জোট-সঙ্গী খুঁজতে হবে। সরকার গঠন করতে দেশটির সংসদের উচ্চকক্ষে ৬৩০ আসনের মধ্য ৩১৬ জন এবং নিম্নকক্ষে ৩১৫ আসনের মধ্য ১৫৮ জন সংসদ সদস্যের সমর্থন পেতে হয়। ২৩ মার্চ নতুন পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হওয়ার পরই সরকার গঠনকল্পে জোটবিষয়ক আলোচনা শুরু করা যাবে। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় আসন নিয়ে জোট গঠিত না হলে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতালির রাজধানী রোমে ১৯৫৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) গোড়াপত্তন হয়েছিল, যা রোম চুক্তি নামে পরিচিত। এ বিষয়টি নিয়ে সেই দেশটির জনগণও গৌরব বোধ করেন। তারা শিগগির কতটা ইইউবিরোধী হয়ে উঠবে বা রক্ষণশীলদের হাতকে আরও কতটা শক্তিশালী করবে, তা জানতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর হ্যানোভার, জার্মানি প্রতিনিধি।
Sharaf.ahmed@gmx.net

No comments

Powered by Blogger.