গ্যাস রাইজারে বজ্রপাত: সিলেটে ৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু by ওয়েছ খছরু
মর্মান্তিক
ঘটনায় শোকাহত সিলেটের গোলাপগঞ্জ। হঠাৎ আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেলেন ৫ জন। এর
মধ্যে ২ জন অন্তঃসত্ত্বা নারী ও তিনজন শিশু-কিশোর। নিজের জীবনকে আগুনে
সঁপে দিয়ে স্বামীকে আগুন থেকে রক্ষা করেছেন মারা যাওয়া নারী শেবু বেগম।
গতকাল ভোররাতে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষণাবন্দ গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
প্রতিদিনের মতো রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল দুটি পরিবার। মধ্যরাত থেকে আকাশে মেঘ
ডাকছিল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল মাঝে-মধ্যে। রাত তখন আড়াইটা। হঠাৎ বাসার বাইরে
গ্যাস রাইজারে পড়লো বজ্রপাত। মুহূর্তে আগুন ধরে যায় বাসায়। এক ছাদের নিচে
দুই ঘরে ঘুমিয়েছিলেন ৭ জন। ঘুমন্ত অবস্থায় আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান ৫ জন।
তবে বেঁচে গেছেন দুই পরিবারের দুই কর্তা। তাদের অবস্থাও গুরুতর। সিলেট
ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। স্থানীয় লক্ষণাবন্দ
গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন- রাত দুইটা থেকে আকাশে মেঘ ডাকছিল।
পাশাপাশি বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। এমন সময় তাদের গ্রামে বিকট শব্দে বজ্রপাত হয়।
এই বজ্রপাতের পরপরই তারা চিৎকার শুনতে পান। বাসার মালিক লয়লুস আহমদ
প্রবাসী। আধাপাকা ওই টিনশেডের দুটি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন দিন মজুর ফজলু রহমান
মসকন্দর আলী। তাদের বাসা থেকেই চিৎকার আসছিল। এমন সময় স্থানীয় কয়েকজন দেখেন
আগুনের লেলিহান শিখা। তারা প্রাথমিকভাবে আগুন নেভাতে ব্যর্থ হন। এমন সময়
ঘরের জানালা ভেঙে বেরিয়ে আসেন ফজলুর রহমান। একটু পরে স্ত্রীর সহায়তায় বাসা
থেকে বের হয়ে আসেন মসকন্দর আলী। আর কেউ বাসা থেকে বের হতে পারেননি। আগুন
বেড়ে যাওয়ায় গ্রামবাসীও দূরে অবস্থান নেন। খবর দেয়া হয় সিলেটের ফায়ায়
সার্ভিসকে। রাত পৌনে ৪টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
তার আগেই ঘরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান ৫ জন। এ সময় গ্রামের লোকজন কান্নায়
ভেঙে পড়েন। চোখের সামনে এমন ঘটনা মেনে নিতে পারছিলেন না কেউ। ঘটনার পরপর
সিলেট শহরতলীর মোগলবাজার থানার খালেরমুখ এলাকার ফজলু মিয়ার ৫ মাসের
অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী তাসনিমা বেগম (৩০) ও তার ২ বছরের শিশু সন্তান তাহমিদ,
গোলাপগঞ্জের ফনাইরচক এলাকার মস্কন্দর আলীর ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী
শেবু বেগম, গোলাপগঞ্জের নোয়াইর চক এলাকার সেবুল মিয়া (১৭), জিয়া উদ্দিনের
(১৭) লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- মসকন্দর আলীকে তার স্ত্রী
শেবু বেগম ঘরের টিনের চালা ভেঙে বাইরে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু নিজে বের হওয়ার
আগে আগুনে ঝলসে মারা যান শেবু বেগম। তার এই ত্যাগ নাড়া দিয়েছে
গোলাপগঞ্জবাসীকে। শেবু বেগমের ঘটনায় কাতর হয়ে পড়েছে পুরো এলাকা। স্থানীয়
লক্ষণাবন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নসিরুল হক শাহীন জানিয়েছেন- রাত আড়াইটার
দিকে বজ্রপাত এসে পড়ে গ্যাস রাইজারে। এ সময় আগুন গোটা বাসায় ছড়িয়ে পড়ে।
এলাকার মানুষ এগিয়ে এসে ফজলুর রহমান নামের যুবককে জানালা দিয়ে বের করেন।
রাত সাড়ে ৩টার দিকে যখন আগুন নিয়ন্ত্রনে আসে তখন বাসার ভেতরে দুই নারী ও ৩
শিশু-কিশোর পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। গোলাপগঞ্জ থানার ওসি ফজলুল হক শিবলী
জানিয়েছেন- দুঘর্টনায় আহত ফজলুর রহমানকে সকালে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে যায়। এদিকে-
হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে- ফজলুকে ভর্তি করার পর সকাল সাড়ে ৯টায় তাকে
অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়েছে। তার শরীরে পুড়ে যাওয়া অংশে অস্ত্রোপচার করা
হচ্ছে। রোববার সকালে ঘটনাস্থল পরির্দশনে যান সিলেট জেলার পুলিশ সুপার মো.
মনিরুজ্জামান। এ সময় তিনি মোবাইলে শিক্ষা মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের
সঙ্গে কথা বলেন। অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া পরিবার দুটির সদস্যরা শ্রমজীবী
ছিলেন। তারা কয়েক মাস আগে ওই বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছিলেন বলে জানিয়েছেন
ইউপি চেয়ারম্যান শাহীন। দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক তন্ময়
বিশ্বাস সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- দুটি ঘরে ৭ জন ছিলেন। ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
গ্যাসের রাইজার থেকে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিক ভাবে তারা ধারণা
করছেন। লাশগুলো আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। এদিকে সিলেটের
জেলা প্রশাসক নুমেরী জামান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আগুনে যারা মারা গেছেন
তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে।
এছাড়া ২ বান্ডিল টিন জরুরি ভিত্তিতে বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। হাসপাতালে যারা
আছেন তাদের সুচিকিৎসা চলছে বলে জানান তিনি। উল্লেখ্য, গেল বছর সিলেটে বেশ
কয়েকটি বাসার বাইরে থাকা গ্যাস রাইজারে আঘাত হানে বজ্রপাত। এতে করে নগরীতে
অন্তত ১০টি বাসায় আগুন ধরে। এ নিয়ে সিলেটে আতঙ্ক দেখা দিলে সিলেটের
জালালাবাদ গ্যাস অফিস থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল খোলা স্থানে গ্যাস
রাইজার না রাখতে। এরপরও সাধারণ মানুষের মধ্যে সতর্কতা বাড়েনি।
No comments