এত বিদ্যুৎ গেল কোথায়
একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শাখা উদ্বোধন উপলক্ষে ঢাকা থেকে গাজীপুরে গিয়েছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, এমডিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট শাখায় ৪ ঘণ্টা অবস্থান করেন তারা। এর মধ্যে ৪০ মিনিট বিদ্যুৎ ছিল। বাকি ৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট কাটাতে হয় বিদ্যুৎবিহীন। তেলচালিত জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুতের জোগান দেয়া হচ্ছিল। এক সময় জেনারেটরও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে টিকতে না পেরে নতুন এ শাখা থেকে দ্রুত বের হয়ে রাস্তায় পার্কিংয়ে থাকা এসি চালিত গাড়িতে অবস্থান নিতে হয় তাদের। এ ঘটনা গত মঙ্গলবারের। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বিদ্যুতের এ দুর্বিষহ অবস্থা বলতে গিয়ে আক্ষেপ করে বলেন, টেলিভিশনের পর্দায় বিদ্যুতে সয়লাব হয়ে গেছে দেশ এমন দাবির কথা শোনা যায় ক্ষমতাসীনদের মুখে। কিন্তু বাস্তবে চিত্র উল্টো। তিনি বলেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা দেয়ার কথা বলে গত কয়েক বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছে দফায় দফায়। অথচ এর সুফল পাচ্ছে না জনগণ। ওই কর্মকর্তার প্রশ্ন, তাহলে সরকারের দাবি অনুযায়ী এত বিদ্যুৎ গেল কোথায়? রাজধানীর অভিজাত এলাকা খ্যাত উত্তরার এক বাসিন্দা গতকাল বুধবার নয়া দিগন্তকে জানান, রাত ১২টা থেকে সকাল পর্যন্ত তিন দফা লোডশেডিং হয়েছে। একে তো ভ্যাপসা গরম তার ওপর ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে রাতে ঘুম হয়নি। বনশ্রীর এক বাসিন্দাও বিদ্যুতের একই চিত্র তুলে ধরে জানান, বাসায় জেনারেটর নেই। আইপিএস আছে। কিন্তু ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে গভীর রাতে আইপিএসেও চার্জ না থাকায় বৈদ্যুতিক পাখা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রচণ্ড গরমে কোমলমতি শিশুরা ঘুমাতে পারেনি। রাত জেগে হাতপাখা দিয়ে তিনি সন্তানদের ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। গত কয়েক দিন দেশে চলছে তীব্র তাপদাহ। আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিং। রাজধানীর পাশাপাশি সারা দেশই ভুগছে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায়। ঢাকার বাইরে এ চিত্র আরো ভয়াবহ। ঢাকায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মঈন উদ্দিন খান। বাবা মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে তিনি পিরোজপুর গিয়েছিলেন কয়েক দিন আগে। ঢাকায় ফিরে তিনি গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহের চিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, সরকার বিদ্যুৎ দেয়ার নামে গ্রামের মানুষের সাথে প্রতারণা করছে। গ্রামের পর গ্রাম বিদ্যুতের খাম্বা গেড়ে বিদ্যুতের লাইন দেয়া হয়েছে। কিন্তু দিনে রাতে এখন বড় জোর দুই থেকে তিন ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকছে না।
জেনারেটর, আইপিএস বা বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এক ভয়াবহ যন্ত্রণার মধ্যে বাস করছে গ্রামের মানুষ। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত ২২ মে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন চার দিনের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ইতোমধ্যে সময়সীমার দুই দিন পার হয়ে গেছে। কিন্তু লোডশেডিং পরিস্থিতি গতকালও অপরিবর্তিত ছিল। ভয়াবহ লোডশেডিং খোদ রাজধানীতেই। পিডিবির ওয়েব সাইটে গতকাল দেখানো হয়েছে, দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ১২ হাজার ৫৭৮ মেগাওয়াট। কিন্তু গতকাল অফপিক আওয়ারে বিদ্যুৎ উৎপাদন দেখানো হয়েছে আট হাজার ৩৮৮ মেগাওয়াট। আর পিক আওয়ারে অর্থাৎ সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত উৎপাদন দেখানো হয়েছে আট হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। চাহিদা দেখানো হয়েছে, ৯ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ গতকাল চাহিদার তুলনায় উৎপাদনের ঘাটতি এক হাজার ৫২ মেগাওয়াট। চাহিদার চেয়ে উৎপাদনের এ ঘাটতি দেখানোর বিষয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক (জনসংযোগ) সাইফুল হাসান নয়া দিগন্তকে জানান, আসন্ন রমজানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ১০টি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র সংস্কারের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল। ইতোমধ্যে কিছু উৎপাদনে এসেছে। আগামী ২৬ মে আরো দু’টি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। সবমিলে রমজানের আগেই বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে তিনি আশা করেন। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, চাহিদার চেয়ে বিদ্যুতের ঘাটতি সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। কারণ সরকার গড়ে আট হাজার থেকে সাড়ে আট হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। কিন্তু যে ভাবে বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হয়েছে তাতে প্রকৃত চাহিদা ১২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। সে হিসাবে ঘাটতি সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। সুতরাং বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোর দাবি কতটুকু যৌক্তিক তা বাস্তবেই প্রমাণ হচ্ছে।
No comments