বৃটেনজুড়ে শোকের ছায়া: সর্বোচ্চ সতর্কতা, হামলায় আহতদের সহায়তায় মুসলিমরা

শোকে স্তব্ধ বৃটেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ ম্যানচেস্টার হামলায় প্রায় বাকরুদ্ধ। বৃটেনজুড়ে জারি করা হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতা। যেকোনো সময় আরো হামলার আশঙ্কা রয়েছে। তা সত্ত্বেও নিহতদের স্মরণে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ মঙ্গলবার সমবেত হয়েছিলেন। সেখানে নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সাফি রুসেস (৮), জর্জিনা (১৮)সহ সবার প্রতি প্রাণখুলে প্রার্থনা করা হয়। কান্নায় ভেঙে পড়েন জর্জিনার মা লেসলি ক্যালান্ডার। এ সময় সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। আলবার্ট স্কয়ারে সেই শোক মিছিলে সামিল হয়েছিলেন বিভিন্ন রাজনীতিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। এমন শোকযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে লন্ডন, বার্মিংহাম, ব্রিস্টল, নিউক্যাসল, গ্লাসগো এবং বেলফাস্টে। আলবার্ট স্কয়ারে মেয়ের প্রতি মা লেসলি একটি হলুদ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় একজন যুবক তাকে চাদরে আবৃত করে সান্ত্বনা দেন। সতর্কতা উপেক্ষা করে কয়েক হাজার মানুষ ম্যানচেস্টারের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে সমবেত হন। এ সময় তাদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনি ওঠে তাদের কেউ পরাস্ত করতে পারবে না। ভয়ে ভীত করতে পারবে না। আলবার্ট স্কয়ার থেকে আশপাশের সড়কে তখন জনতার ভিড় ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় অনেকের হাতে ছিল পোস্টার, পতাকা, প্লাকার্ড। তাতে লেখা ‘আই লাভ ম্যানচেস্টার’। হামলায় নিহত সবচেয়ে ছোট্ট সাফি রুসেস ও জর্জিনা ক্যালান্ডারের প্রতি শোক, শ্রদ্ধা জানাতে তাদের পরিবারের সঙ্গে সহমর্মিতা জানাতে যোগ দেন বিভিন্ন বয়স ও পেশার মানুষ। নিহত এ দুটি বালিকার বাস ছিল দুই মাইলেরও কম দূরত্বে। কনসার্টে উপস্থিত ছিলেন সাফির মা লিসা ও তার বড় মেয়ে। তারা মারাত্মক জখম হয়েছেন। অবস্থা সংকটজনক বলে জানানো হচ্ছে। মঙ্গলবারের ওই শ্রদ্ধা-সমাবেশে সাফির স্কুলের অনেক শিক্ষার্থীও যোগ দেয়। তারা মার্ক স্কয়ারে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। নিহতদের স্মরণে ওড়ানো হয় গোলাপি বেলুন। দুই মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এ সময় অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকে। স্থানীয় অধিবাসী গিলিয়ান ব্লাকলি বলেছেন, আমাদের মনের অবস্থা কি তা আজ বলতে পারবো না। আমাদের মুখে কোনো ভাষা নেই। আমাদের হৃদয়ে স্পন্দন স্তিমিত। আমরা সমবেদনা জানাই অন্য সব নিহত ও আহতদের প্রতি। একটি সমাবেশে বক্তব্য দেন বিশপ জন গোডার্ড। তিনি বলেন, আমরা এখানে সমবেত হয়েছি জর্জিনা ও সাফির প্রতি সম্মান জানাতে। সম্মান, শ্রদ্ধা জানাই অন্যদের প্রতিও। এ সময় সেখানে উপস্থিত অভিভাবকরা একে অন্যের হাত শক্ত করে ধরে রাখেন। শিশুরা অঝোরে কাঁদতে থাকে। সমাবেশে যোগ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাম্বার রাড, লেবার নেতা জেরেমি করবিন, স্পিকার জন বারকাউ, ম্যানচেস্টারের মেয়র অ্যান্ডি বার্নহ্যাম। সমাবেশে তারা বক্তব্য দেন সমবেদনা প্রকাশ করে। এসব সমাবেশে যোগ দেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিমও।
ম্যানচেস্টার হামলায় ভিন্নভাবে শোক ও শ্রদ্ধা
বুর্জ খলিফায় জড়ানো বৃটিশ পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক। নিমেষেই নিভে গেল প্যারিসে আইফেল টাওয়ারের আলো। ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম, জাগরেব- সর্বত্রই শোকের আবহ। এ শোক ম্যানচেস্টারে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ও আহতদের উদ্দেশ্যে। সারা বিশ্ব এ হামলার পর হতাহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে শোক প্রকাশ করেছে। নিন্দা জানিয়েছে হামলার। এ খবর দিয়েছে লন্ডনের অনলাইন দ্য ডেইলি মেইল। এতে বলা হয়েছে, দুবাইয়ে বুর্জ খলিফা ভবনে ফুটিয়ে তোলা হয় বৃটিশ পতাকা। ক্রোয়েশিয়ার জাগরেবে বৃটিশ পতাকার রঙে রাঙিয়ে তোলা হয় একটি ঝরণা। রোমের কলোসিয়াম শ্রদ্ধা জানাতে অন্ধকার করে দেয়া হয়। ইয়াঙ্কি স্টেডিয়ামে ‘গড সেভ দ্য কুইন’ লেখা ব্যানার প্রদর্শন করা হয়। প্রদর্শন করা হয় ভিডিও। তাতে বলা হয়, ম্যানচেস্টার হামলায় হতাহতদের প্রতি আমাদের হৃদয়ের গভীর থেকে শ্রদ্ধা ও প্রার্থনা। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামের মাথার লাল ও সাদা রঙে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এর নিচেই লেখা ‘ফর ম্যানচেস্টার’। ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগরেবে যুক্তরাজ্যের পতাকার রঙে রাঙিয়ে দেয়া হয় একটি ঝরণা। চার দিক থেকে তা দেখে চোখের অশ্রু মোছেন সহানুভূতিশীল মানুষরা। প্যারিসে মঙ্গলবার মধ্যরাতে আইফেল টাওয়ারের বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়। ম্যানচেস্টার হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে তিন ধাপে এ টাওয়ারের আলো নিভে যেতে থাকে। ওদিকে নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিস আউটফিল্ডার অ্যারন, জ্যাকোবি, এলসবারি, অ্যারন জাজসহ অন্যরা বৃটিশ জাতীয় সংগীত বাজতেই দাঁড়িয়ে যান। তাদের মাথা নত হয়ে যায় ম্যানচেস্টার হামলায় নিহতদের স্মরণে। ইয়াঙ্কি স্টেডিয়ামে মঙ্গলবার ছিল বেসবল খেলা। এতে মুখোমুখি হয় নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিস ও কানসান সিটি রয়েলস। বৃটিশ পতাকার রঙ ফুটিয়ে তোলা হয় সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় লি জেট ডি’ইউ ঝরনায়। তার পাশে বসে মানুষ মাথা নত করে থাকে। 
ম্যানচেস্টার হামলায় এগিয়ে এসেছেন মুসলিমরা
ম্যানচেস্টার হামলার পর হতাহতদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন বৃটিশ মুসলিমরা। এরই মধ্যে তারা সংগ্রহ করেছেন কয়েক হাজার পাউন্ড। এ উদ্যোগে শামিল হয়েছে মুসলিমদের বিভিন্ন সংগঠন। তার মধ্যে বেসরকারি সংগঠন মুসলিম এনগেজমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অন্যতম। তারা সংগ্রহ করেছে ২ হাজার ৩ শতাধিক পাউন্ড। এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. শাজাদ আমিন বলেছেন, যারা বিপদে পড়েন, তারা যে ধর্মেরই হোন না কেন, তাদেরকে সহায়তা করা আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের মৌলিক উপাদান। এই নৃশংসতার শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অবস্থান করছেন মুসলিমরা। তার ভাষায়, আমরা বিপদে পড়া মানুষগুলোকে সহায়তার জন্য যে অর্থ সংগ্রহ করছি তা বিতরণ ও হাতবদলের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে একটি আইনি অথবা পরামর্শ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করবো। অর্থ সংগ্রহ করছে মুসলিমদের আরেকটি সংগঠন। তারা হলো বৃটিশ মুসলিম হেরিটেজ সেন্টার। এ ছাড়া রয়েছে ইসলামিক সোসাইটি অব বৃটেন। এসব সংগঠন মঙ্গলবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করেছে ৭০০ পাউন্ড। এসব সংগঠন তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, যদিও এটা উদ্যোগ মুসলিমদের তবু আমাদের যেকোনো বন্ধু, যেকোনো ধর্মে বিশ্বাসী এতে শামিল হতে পারেন। অর্থ সহায়তা দিতে পারেন। বিশেষ করে আমরা আহ্বান জানাই বৃটিশ মুসলিম, মসজিদ, ইমাম, ধর্মীয় নেতাদের কাছে। তারা সবাই যাতে এ উদ্যোগে শামিল হন। সংগৃহীত অর্থ যাতে যথাযথভাবে বিতরণ হয় তা নিশ্চিত করতে তারা সমন্বয় করছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। এ ছাড়া হামলার নিন্দা জানিয়েছে মুসলিমদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। এর মধ্যে রয়েছে রমাদান ফাউন্ডেশন এবং মুসলিম কাউন্সিল অব বৃটেনের নেতারা। হামলার পর এগিয়ে এসেছেন মুসলিম সম্প্রদায়ের ট্যাক্সি চালকরা। তারা বিনা ভাড়ায় ঘটনার দিন বিস্ফোরণে হতাহতদের হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন। তবে মঙ্গলবার আর্নডেলে শপিং সেন্টারের বাইরে ইংলিশ ডিফেন্স লীগের একদল বিক্ষোভকারী প্রতিবাদ বিক্ষোভ করতে থাকে। তারা একটি পতাকা বহন করে। তাতে লেখা ‘ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান’। ক্রমাগত তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তখন স্থানীয়রা বলতে থাকেন, এখানে এইসব বর্ণবাদের প্রচারণা তারা সহ্য করবেন না। উল্লেখ্য, সোমবার দিবাগত রাতে অ্যারিনা কনসার্ট হলে কনসার্ট চলাকালে সেখানে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায় বৃটিশ নাগরিক সালমান আবেদি। এতে কমপক্ষে ২২ জন নিহত ও ৫৯ জন আহত হন। এ ঘটনায় শোকে স্তব্ধ বৃটেনসহ বাকি বিশ্ব। নিন্দার ঝড় বইছে সারা দুনিয়ায়। এর পরই হতাহতদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন মুসলিমসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। অর্থ সংগ্রহ করছে জাস্ট গিভিং পেজ নামের একটি সংগঠন। তারা সংগ্রহ করেছে ৫ লাখ ৬২ হাজার পাউন্ড। অন্যদিকে বিস্ফোরণের পর গৃহহীন ক্রিস পার্কারের হাতের ওপর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন এক নারী। তার উদ্দেশ্যে গঠিত গ্রুপ ‘গো ফান্ড মি পেজ’ সংগ্রহ করেছে কমপক্ষে ৮০০০ পাউন্ড। 
যুুক্তরাজ্যে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি
যুক্তরাজ্যজুড়ে জারি করা হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতা। পরিস্থিতি বর্ণনা করতে ইংরেজিতে ‘ক্রিটিক্যাল’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। শিগগিরই যেকোনো সময়ে আরো হামলার ঝুঁকি রয়েছে এমনটা বোঝাতে এ শব্দটি বা সতর্কতা লেভেল ব্যবহার করা হয়। ওদিকে সোমবার দিবাগত রাতে ম্যানচেস্টারে অ্যারিনা কনসার্টে হামলাকারীকে চিহ্নিত করেছে বৃটিশ পুলিশ। তারা জানিয়েছে হামলাকারীর নাম সালমান আবেদি। তার জন্ম ম্যানচেস্টারে। সে লিবিয়ান বংশোদ্ভূত। তবে ওই হামলা সে একা চালিয়েছে নাকি তার কোনো সহযোগী ছিল সে বিষয়টি অনুসন্ধান করছে পুলিশ। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি, দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট। এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যে যে সতর্কতা জারি করা হয়েছে তার ফলে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। এরই মধ্যে নিহত চারজনের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৮ বছর বয়সী সাফি রোজ রুসসে। নিহত আরেকটি বালিকার নাম অলিভিয়া ক্যাম্পবেল (১৫)। হামলা ও পরবর্তীতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবারই তার মন্ত্রিপরিষদকে নিয়ে বৈঠক করেন। তারপর তিনি বলেছেন, সশস্ত্র পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি মোতায়েন করা হবে সেনাবাহিনীর সদস্যদের। আগামী দিনগুলোতে বড় কোনো ইভেন্ট মোতায়েন করা হতে পারে সেনা সদস্যদের। বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিনিধি ফ্রাঙ্ক গার্ডনার বলেছেন, এর আগে রিপোর্টে বলা হয়েছে মোতায়েন করা হবে ৫০০০ সেনা সদস্য। তবে এ সংখ্যা সঠিক নয়। এ সংখ্যা হবে কয়েক শত। বর্তমানে যুক্তরাজ্যজুড়ে যে সতর্কতা জারি করা হয়েছে অতীতে মাত্র দু’বার এমনটি করা হয়েছিল। এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় জয়েন্ট টেররিজম এনালাইসিস সেন্টার থেকে। এটি পুলিশ, সরকারির বিভিন্ন বিভাগ ও এজেন্সির বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি গ্রুপ। এ গ্রুপটি এর আগে ২০০৬ সালে এমন সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। সেবার বিমান পরিবহনে তরল বোমা হামলার ষড়যন্ত্র নস্যাতে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। ওদিকে ম্যানচেস্টার হামলার তদন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন মেট্রোপলিটন পুলিশের এসিসট্যান্ট কমিশনার মার্ক রাউলি।

No comments

Powered by Blogger.