১০ খাতের দুর্নীতি বন্ধে ৬৫ দফা সুপারিশ
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ব্যাংক-বীমাসহ সরকারের ১০ খাতের দুর্নীতি রোধে ৬৫ দফা সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রাষ্ট্রপতিকে দেয়া ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ওই সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এগুলো বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট দফতরের সহযোগিতা চেয়েছে দুদক। বুধবার বিকালে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদসহ তিন কমিশনার। এ সময় রাষ্ট্রপতির কাছে তারা দুদকের ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। প্রতিবেদনে শিক্ষা খাতের দুর্নীতি রোধে ১০ দফা সুপারিশ করা হয়। স্বাস্থ্য খাতে ৭, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনায় ৫, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ৯, এনবিআরে ৪, হিসাব ও নিরীক্ষা বিভাগে ৩, রাজউক গণপূর্ত ও সরকারি নির্মাণ কাজে ৬ দফা সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া আর্থিক খাতে ৬ দফা জনপ্রশাসন খাতে ১০ এবং বিবিধ খাতের দুর্নীতি রোধে ৫ দফাসহ মোট ৬৫ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। সচিবালয়ে বিজনেস নিষ্পত্তির পদ্ধতি হিসেবে সনাতনী ফাইল উপস্থাপন প্রক্রিয়ার বিলোপ দরকার।
সপ্তাহ শেষে কোনো ফাইল নিষ্পত্তি না হলে এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে কৈফিয়ত দিতে হবে। সরকারি সেবা খাতের দুর্নীতি বন্ধে প্রতিটি সংস্থায় ‘হেল্প ডেস্ক’ ও ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস’ কার্যক্রম চালু করতে বলা হয়। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড গঠনের মাধ্যমে কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেলের পরিবর্তে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিবকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তের সুপারিশ করা হয়। বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে এসে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রপতি হাওরের দুর্নীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। দুদকের ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে আসা সুপারিশ সরকার বাস্তবায়ন করেছে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব দুদকের সুপারিশের আলোকে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরে দুর্নীতিমুক্ত সেবা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে চিঠি দিয়েছেন। কিছু সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়েছে বলে তিনি জানান। দুদক চেয়ারম্যান যুগান্তরকে বলেন, গত এক বছরে আমরা বেশকিছু এলাকা চিহ্নিত করেছি। তার নিরিখেই সুপারিশ তৈরি করা হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে দুর্নীতি সহনীয় অবস্থায় আসবে। শিক্ষা খাতে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে তা রোধের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে মেধার ভিত্তিতে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি আলাদা পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠনের কথা বলা হয়। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থের হিসাব কোনো পেশাদার নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে অডিট করানো যেতে পারে। মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও জেলা প্রশাসকের সমন্বয়ে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার মান তদারকি কমিটি’ ও ‘নাগরিক কমিটি’ গঠন করা যেতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি, পরীক্ষা ও সনদ প্রদানসহ ভুক্তভোগীদের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একটি আলাদা রেগুলেটরি অথরিটি গঠন করা যেতে পারে। শিক্ষক বদলিতে ঘুষ ঠেকাতে একটি স্বচ্ছ নীতিমালা করা দরকার।
পাবলিক পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বদলের বিদ্যমান বিধান পরিবর্তন করে শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান বদলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি রোধে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস ও রোগীদের কাছ থেকে নেয়া ফি নির্ধারণে নীতিমালা তৈরির সুপারিশ করা হয়। ওষুধ ও মেডিকেল যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়া অনুসরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। দেশের নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্য বীমার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এর প্রিমিয়ামের টাকাতেই চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেয়া যেতে পারে। বেসরকারি মেডিকেলে যারা পড়ছে, তাদের শিক্ষার মান যাচাইয়ে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি বন্ধে ৫ দফা সুপারিশ করা হয়েছে দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, থানায় সাধারণ ডায়েরি বা মামলা হওয়ার পর এর তদন্ত ও রিপোর্ট দাখিলের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সময়সীমা আইনে বেঁধে দেয়া যেতে পারে। পাসপোর্ট পেতে ভোগান্তি কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। বিসিএস বা প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা নিয়োগের ভেরিফিকেশনের সুবিধার্থে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অনলাইনে ডাটাবেজ শেয়ারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিআরটিএ কর্তৃক প্রণীত সব ধরনের গাড়ির ডাটাবেজ তৈরি করে তা ট্রাফিক পুলিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শেয়ারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ছাড়া প্রত্যেক থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে একজন বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার সুপারিশ করা হয়। দুদক ভূমি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি দমনে ৯ দফা সুপারিশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, একই ছাতার নিচে ভূমির সহকারী কমিশনারের তত্ত্বাবধানে সাবরেজিস্ট্রি অফিস, সেটেলমেন্ট অফিসের কার্যক্রমের সমন্বয় করা দরকার। এ ক্ষেত্রে ‘মুয়ীদ কমিটির রিপোর্ট’ পুনরায় পর্যালোচনা করা যেতে পারে। রেজিস্ট্রেশন অধিদফতরকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় আনা প্রয়োজন। সরকারের খাসজমি বরাদ্দে বড় ধরনের অনিয়ম হচ্ছে। এটা বন্ধ করতে খাসজমির ডাটাবেজ তৈরি করা দরকার। ভূমি রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতির অটোমেশন করা ও দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দফতরে ভূমি উন্নয়ন কর বা সেবা গ্রহণ ফি প্রদানের সময় নগদ অর্থ গ্রহণ বন্ধ করতে ব্যাংকের জমার বিধান চালু করা যেতে পারে। রেজিস্ট্রেশন আইন ও বিধি সম্পর্কে জনগণকে তথ্য জানাতে প্রত্যেক অফিসে সিটিজেন চার্টার প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করতে হবে। জমির রেজিস্ট্রেশন ফি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন আইনের ৭৯ ধারার বিধান মোতাবেক প্রদর্শন করা যেতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দুর্নীতির উৎস উল্লেখ করে তা রোধে ৪ দফা সুপারিশ করা হয়। এতে আয়কর ফরম সহজীকরণ করার কথা বলা হয়। এ ছাড়া রাজস্ব সংক্রান্ত আইনের স্পষ্টকরণ, অটোমেশন পদ্ধতির মাধ্যমে রাজস্ব আদায় এবং সংবিধানের ৮৩ অনুচ্ছেদের আলোকে এসআরও জারি বন্ধ করা যেতে পারে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) মাধ্যমে নামজারি ও প্ল্যান পাসের নামে মানুষকে হয়রানি করা হয়। প্ল্যান-বুক না থাকায় ডেভেলপারদের বিরুদ্ধে জনগণের অভিযোগ নিষ্পত্তি হচ্ছে না। দুদকের সুপারিশে বলা হয়েছে, রাজউকের নামজারি ও প্ল্যান পাসের বিদ্যমান প্রথা রহিত করে নামজারির দায়িত্ব সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) দেয়া যেতে পারে। ডেভেলপারদের বিরুদ্ধে জনগণের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ‘ডেভেলপার ও রেন্টাল এজেন্সি রেগুলেটরি অথরিটি’ গঠন করা যেতে পারে। যোগাযোগ, সরকারি নির্মাণ ও মেরামতকারী সংস্থার দুর্নীতি বন্ধে দুদকের সুপারিশে বলা হয়, নির্মাণকারী সরকারি সংস্থার উন্নয়ন কাজের জন্য প্রণীত নিজস্ব প্রাক্কলন তৃতীয় কোনো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুনঃযাচাই করতে হবে। এটা ছাড়া টেন্ডার আহ্বান করা যাবে না । বিষয়টি প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্টে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। নির্মাণকারী সরকারি সংস্থার কাজ কোনোভাবেই বাকিতে বা অগ্রিম ভিত্তিতে কোনো ঠিকাদারকে দিয়ে করানো যাবে না। বকেয়া বিল পরিশোধের পদ্ধতি বন্ধ করতে হবে। সরকারের আর্থিক খাতের দুর্নীতি বন্ধে ৬ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আর্থিক বছর শুরুর পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা থেকে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের যৌক্তিকতা যাচাই করা অর্থ বিভাগের একার পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। এ কারণে তা নিষ্পত্তির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি ‘অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ উপদেষ্টা কাউন্সিল’ গঠন করা যেতে পারে। যা সরকারের ব্যয়ের ক্ষেত্রে ‘ভেল্যু ফর মানি’ নিশ্চিত করবে। দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি ত্বরান্বিত করতে দৈনিক ব্যাংকিংয়ের একক লেনদেনের সর্বোচ্চসীমা ২০ লাখ টাকায় উন্নীত করা যেতে পারে।
এমএলএম কোম্পানির ব্যবসা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া দরকার। এতে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এ প্রতারণার বিচার করা যেতে পারে। জমি, ফ্ল্যাট ও অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তির রেজিস্ট্রেশন ফি অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। রেজিস্ট্রেশনের উচ্চ ফি জনগণকে দুর্নীতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রতিবেদনে হিসাব ও নিরীক্ষা বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, কম্পন্ট্রোলার এবং অডিটর জেনারেল অফিসের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ও উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের বিল পাসের ক্ষেত্রে জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার। অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করা হলে, বিলের ক্ষেত্রে বিধি অনুসরণ করা না হলে বা এ ক্ষেত্রে আর্থিক অনিয়ম হলে এর দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিতে হবে। এ জন্য ফাইন্যান্সিয়াল রুলে একটি উপবিধি সংযোজন করা যেতে পারে। কোনো সরকারি কর্মকর্তা বদলি হলে তিনি বর্তমান কর্মস্থল থেকে দায়িত্বভার হস্তান্তরের আগেই তার অনুকূলে ‘কোনো প্রকার অডিট অবজেকশন পেন্ডিং নেই’ মর্মে এজি অফিস কর্তৃক প্রত্যয়নপত্র প্রদানের ব্যবস্থা করলে সরকারি ব্যয়ে স্বচ্ছতা বাড়বে। প্রতিবেদনে জনপ্রশাসনে দক্ষতার উন্নয়ন ও অনিয়ম বন্ধে ১০ দফা সুপারিশ করা হয়।
No comments