এক ইনিংসে যা খেলেছেন যথেষ্ট

ফারুক চৌধুরীকে নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, লেখায় বিশেষণের ব্যবহার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলব। প্রিয়জন কাউকে নিয়ে লিখতে বিশেষণের বাহুল্য থাকা ঠিক নয়। বাহুল্যের এই কাজটি নতুন লেখকরাই বেশি করেন। আমি তো কচি ডাব নই, স্বাদ যেমনই হোক ঝুনা নারকেল, মানে লেখালেখির বয়স অনেক দিনের। এতদিনে জেনে গেছি, বিশেষণ তারাই ব্যবহার করেন, যারা পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে পারেন না, একটা বিশেষণ দিয়ে ঢাকেন সেই অক্ষমতা। যেমন ধরুন, ‘সুন্দর’ শব্দটি বিশেষণ। নতুন লেখকরা লিখবেন- পরীকে আজ কী সুন্দর লাগছে! এই সুন্দর বিশেষণটি দিয়ে পরী নামের মেয়েটির কিছুই চেনা-বোঝা যায় না, তার সৌন্দর্যের একটা অস্পষ্ট অথবা স্বকল্পিত অবয়বই চোখে ভাসে কেবল। পরী কেন সুন্দর, তার সৌন্দর্যের মাত্রাগুলো কী- এসবের বর্ণনা দেয়াটাই কাজের কাজ। ঠিক তেমন, যদি বলি ফারুক চৌধুরী একজন মহৎ লোক ছিলেন- তার সম্পর্কে পূর্ব-ধারণা না থাকলে পাঠক কিছুই বুঝবে না, যতক্ষণ না মহত্তটা কী- তা বলতে পারছি। আমি ফারুক চৌধুরীর কসমোপলিটান ব্যক্তিত্ব নিয়েও কিছু বলব না। অথবা global standard-এ তার অবস্থান কোথায়, সেটাও এই লেখার উপজীব্য নয়। কিছু কিছু পরিচয় অথবা পদবী আছে, যা বললেই ব্যক্তিটি সম্পর্কে সাধারণ কথাগুলো বলা হয়ে যায়, বিশেষ কিছু বলতে চাইলে সেটা ভিন্ন কথা। যেমন, কাউকে যদি পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় তিনি একজন ইউপি চেয়ারম্যান, তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয় না- তিনি তার ইউনিয়নে বয়স্ক লোক যারা আছেন, তাদের সবাইকে চেনেন,
ইউনিয়নটির সম্পন্ন পরিবারগুলোর প্রতিটিরই বাড়িতে কখনও না কখনও অন্তত এক কাপ চা চেয়ে খেয়েছেন, এলাকায় সালিশি বৈঠক করেছেন অনেক এবং সেটা করতে গিয়ে কারও শ্রদ্ধা আবার কারও নিন্দা কুড়িয়েছেন, ওই বয়সে যতক্ষণ ঘুমানো প্রয়োজন তার চেয়ে কম ঘুমান ইত্যাদি। ফারুক ভাই ফরেন সেক্রেটারি ছিলেন এবং অবসর গ্রহণের পর মেধার সঙ্গে (পাকিস্তান আমলে ফরেন সার্ভিস পেয়েছিলেন মানে সিএসপি পরীক্ষায় ভালো করেছিলেন) অভিজ্ঞতা যুক্ত করে লেখকও হয়েছিলেন। এই দুই পরিচয়ের কল্যাণে এবং তিনি যেহেতু ছিলেন স্বাধীনতার পর এই রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রাচার পুনর্গঠনের এক বড় কারিগর, তাই ধরেই নেয়া যায় তিনি যা-তা কোনো পুরুষ নন, পুরুষোত্তমদের দলে তিনি। তবে দেশ-দেশান্তরের ফারুক চৌধুরীকে আমি অনুভব করতে পারি, বাস্তবে তাকে যতটুকু দেখেছি, সেই সূত্র ধরে কল্পনায় তার জীবনের পুরো ছবিটাও দেখতে পাই। তবে কি তাকে নিয়ে লিখব একটি ফিকশন (কল্পকাহিনী)? সেটা তো এক কলামে সম্ভব নয়, লিখতে হবে সাত খণ্ড রামায়ণ। বাল্মিকী যখন রামের জীবনচরিতমূলক রামায়ণ লিখছিলেন, তিনি শুধু এটুকুই জানতেন, রাম ছিলেন অযোধ্যার অধিপতি দশরথের ছেলে। দেবদূত নারদ তাকে শিখিয়েছিলেন- রামায়ণ লিখতে হলে রামের পুরোটাই জানতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বাল্মিকী রাম সম্পর্কে যতটুকু জানতেন তা ছিল সত্য, নারদের মতে যা তিনি লিখবেন তা সত্যের অধিক কিছু- higher than truth- রবীন্দ্রনাথ যেটাকে কাব্যিকতায় বলেছেন- ‘ঘটে যা তা সব সত্য নহে, সেই সত্য যা রচিবে তুমি।’ আমিও হয়তো কল্পনা মিশিয়ে একটা ঢাউস ফারুকচরিত লিখতে পারি- এমন কিছু, যা তার জীবনে ঘটেনি; কিন্তু ঘটতে পারত। যা ঘটতে পারত, তা যা সত্যিই ঘটেছিল তার চেয়ে কম কীসে!
কিন্তু শুধু এই কলামের স্পেস সংকটের কারণে নয়, আরও একটি কারণে ফিকশন লিখছি না। সারারাত সাত খণ্ড রামায়ণ পড়ার পর এক পাঠক তালগোল পাকিয়ে সকালে এক লোককে কাছে পেয়ে নাকি বলেছিল- আচ্ছা দাদা, সীতা যেন কার বাপ? ফারুক ভাইয়ের জীবনচরিতমূলক ফিকশন লিখলে সেটা পড়ার পর তেমন কেউ হয়তো বলে উঠবেন- এই চৌধুরীটা আবার ক্যাডা? হ্যাঁ, ফিকশন লিখছি না, যদিও তিনি এক ক্ল্যাসিক ফিকশনের চরিত্র হওয়ার যোগ্য। আমি লিখতে চাই নিরেট সত্য, একেবারেই জীবনঘনিষ্ঠ উপলব্ধির কথা। এটাকে মন্ময় সাংবাদিকতাও (subjective journalism) বলা যেতে পারে। হিউম্যান রিসোর্স অ্যাসেসমেন্ট বিষয়ে একবার কথা বলার সময় কাকে যেন বলেছিলাম- আপনি আস্তিক, নাস্তিক, না সন্দেহবাদী এই প্রশ্নের অনেস্ট উত্তর পাওয়া গেলে উত্তরদাতাকে অর্ধেক চেনা যায়। ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাটরা কথা কম বলেন, নিজেকে ওপেন রাখার জন্য যথাসম্ভব ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’র মধ্যে সীমিত রাখেন নিজেদের। ফারুক ভাই ট্র্যাডিশনাল ডিপ্লোম্যাট ছিলেন না। কথা বলতেন এবং সম্ভবত এ কারণে যে, তিনি এত কনফিডেন্ট ছিলেন যে জানতেন যা-ই বলবেন তা ডিফেন্ড করার যোগ্যতা আছে তার। তো তার সঙ্গে এত কথা হল, তাকে চিনব না? মানুষের পুনর্জন্ম যদি থাকে, সেটা পরকালে। ইহজগতে এর কোনো ব্যবস্থা নেই। হ্যাঁ, এক ইনিংসে ফারুক ভাই যা খেলেছেন যথেষ্ট। বাজে আউট হননি তিনি। তার মুখনিঃসৃত কথা মানেই হয় সেটায় থাকবে হিউম্যান টাচ অথবা উচ্চমার্গের রসিকতা। জোকস বলতে পারা সহজ কাজ, সেটা সংগ্রহেই থাকে; কিন্তু সিচুয়েশনাল কমেডি যেটাকে বলে,
সেই যোগ্যতা সম্ভবত জন্মসূত্রেই পেতে হয়। এই যে, একটা এখনই মনে এলো! বলে নিই। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণে কাজ করি তখন, সম্পাদক ছিলেন আরেক ফরেন সেক্রেটারি প্রয়াত শাহ এএমএস কিবরিয়া। পত্রিকাটির কোনো এক প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমরা ডিনার করতে পল্টনের মিডনাইট সান চাইনিজে ঢুকেছি। ফারুক ভাই, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর আতিউর ভাই, সহকর্মী সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার ও হাসান মামুন এবং আরও অনেকে। চাইনিজ রেস্তোরাঁয় পরিবেশের যে আলো-আঁধারি থাকে, সেই রাতে আলো আরও কম ছিল। ঢুকতেই কিবরিয়া ভাই বললেন, এত অন্ধকার কেন? ফারুক ভাই সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন- possibly they are not willing to shwo what they are going to feed us- তারা আমাদের এখন যা খাওয়াতে যাচ্ছে, সম্ভবত সেগুলো আমাদের দেখাতে চাচ্ছে না। কারও অহংকার ভেঙে ফেলার একটা সহজ উপায় ছিল (এখন তো ‘হল’ না বলে ‘ছিল’ই বলতে হবে) ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে তাকে কথা বলার সুযোগ করে দেয়া। এই তো সেদিন তার প্রসঙ্গ এলে আমার ছেলেকে বলছিলাম- তুমি তো মনে করো অনেক কিছুই জেনে-বুঝে গেছ। ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে কিছুদিন কথা বলো, দেখবে এ যাবত যা কিছু জেনেছে, শিখেছ তার একটা বড় অংশ মস্ত ভুল। ফারুক ভাই যদি আমার সাধারণ পাঠক হতেন, তাহলেও আমার ফোরটিন জেনারেশন ধন্য হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ও মা, তিনি আমার ভক্ত পাঠক! তার নিয়মিত কলাম ‘দেশ-দেশান্তর’-এ যেদিন পড়লাম এ কথা, মনে হচ্ছিল যায়যায়দিনের সেই পত্রিকাটি বুকে সেঁটে ঘুরে বেড়াই। এত ইফেক্টিভ বিজ্ঞাপনী চিত্র আর হয়? আমি বিড়াল,
এই বিজ্ঞাপনে আমাকে যে উটের দামে কিনবে মানুষ! আমার ব্যবসায়িক বুদ্ধি খুলে গেছে। ফারুক ভাইয়ের আরও কিছু সার্টিফিকেট দেখাতে হবে। ‘ডেনমার্কের যুবরাজ ছাড়া হ্যামলেট মঞ্চস্থ করা যায় না’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি কলাম লিখেছিলাম। সেই প্রথম দেখা, ফারুক ভাই আমাকে বললেন, শফিককে (সম্পাদক শফিক রেহমান) বলেছি, আমি লিখলে ওভাবেই লিখতাম। আরও বলেছিলেন, life is a merry-go-round, a rotating circular platform, you are on the best place now- জীবন নাগরদোলার মতো ঘূর্ণায়মান প্ল্যাটফর্ম। তুমি এখন সবচেয়ে ভালো জায়গায় অবস্থান করছ। বুঝলাম, লেখাটি তিনি মনোযোগ দিয়েই পড়েছেন। কারণ ওখানে ছিল, জাসদীয় রাজনীতি করার সময় বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নেতিবাচক। আমি কিন্তু বলিনি, বিশেষণ একদমই ব্যবহার করব না, বলেছি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলব। হ্যাঁ, ফারুক ভাই ছিলেন একজন পারফেকশনিস্ট। লেখালেখি মানে তার কাছে ছিল সর্বাঙ্গে সুন্দর নারী, একটি দাঁতও ঁহবাবহ থাকা চলবে না। তার লেখার প্রুফ কাটতেন বর্তমানে দৈনিক সমকালে কর্মরত বাঁধন; কিন্তু প্রতি সপ্তাহে যায়যায়দিন কার্যালয়ে এসে ফাইনাল কপিটা না দেখলে স্বস্তি পেতেন না। কোনো তথ্যের ব্যাপারে কনফিউজড হলে অথবা কবিতার কোনো লাইন হুবহু উদ্ধৃত করতে চাইলে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতেন আমাকে। তো একবার নজরুলের ‘সিন্ধু’ কবিতার দুটি লাইন হুবহু জানতে চাইলেন ফোনে। আমি জানি, কিন্তু লাইন দুটির যতিচিহ্ন জানি না। কী করি!
কোট-আনকোটের মধ্যে থাকলে তো যতিচিহ্নও লাগবে। ফারুক ভাইয়ের কাছে তো আনস্মার্ট থাকা চলে না। আমি বললাম, ফারুক ভাই আপনি ফোনটা রাখেন, আমি ব্যাক করছি। বেইলি রোডে যায়যায়দিনের অফিস আর সাগর পাবলিশার্স জাস্ট রাস্তার এপার-ওপার। দৌড়ে গিয়ে একটা সঞ্চিতা টেনে নিয়ে টুকে নিলাম লাইন দুটি। দশ মিনিটের আগেই ব্যাক করলাম ফোন। একটা হরিষে-বিষাদ ঘটনা বলি। আমি একবার ‘আমলাতন্ত্রের প্রবচন’-এ লিখলাম- হিন্দু এবং বড় লেখক উভয়ই হওয়া যায় না, হইয়া জন্মাইতে হয়। বঙ্কিম দুইটি সত্তা লইয়াই জন্মাইয়াছিলেন, তবে তিনি আমলাও হইয়াছিলেন। এখনকার অনেক আমলা বড় লেখক হইবার বৃথা চেষ্টা করিতেছেন।’ এরপর দেখা হলে ফারুক ভাই স্মিত হেসে বলেছিলেন- yes I agree, I am not a good writer. কথাটায় কি কোনো দুঃখবোধ ছিল? হ্যাঁ, আমি টের পেয়ে পাল্টা বলেছি- but I disagree, look at my next column. পরের সংখ্যার লেখায় শিরোনাম দিলাম- ‘ঘাস হল নিয়ম, ঘাসফুল ব্যতিক্রম’। ফারুক ভাই কী যে খুশি! বলেছিলেন- I understand, your first one was positive for me in disguise- তোমার প্রথম কথাগুলো আমার জন্য ছদ্মবেশে ইতিবাচক ছিল! একটা হাসির ঘটনা বলি। অবসর গ্রহণের পর (মানুষ কি বেড-রিডেন হওয়া ছাড়া অবসর নেয়?) ফারুক ভাই ব্র্যাকে যোগ দিয়েছিলেন। তো একদিন অনুজপ্রতিম লেখক ও নাট্যকার আবু সুফিয়ান একটা কাজে ঠেলে পাঠালেন আমাকে তার কাছে। তিনি জানতেন, আমি বলা মানে ফারুক ভাইয়ের কাছে সেটা ‘ইয়েস’। তো ব্র্যাকে তার রুমে বসে গল্প করছি। চীনের দীর্ঘ কূটনীতিক জীবনে তার খাবার দাবারের আলাপ। খাদ্যরসিক ফারুক ভাইয়ের কাছে রন্ধন ব্যবস্থাপনা ছিল এক বড় শিল্প। হঠাৎ একটা ফোন এলো।
রিসিভ করার পর ফারুক ভাইয়ের চেহারায় একটা ভাবান্তর লক্ষ করলাম। তিনি শুধু বললেন- না, না আমার ছেলেমেয়েরা দেশে থাকে না। এরপর রেখে দিলেন ফোন। ফারুক ভাইকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলাম, কার ফোন? কী কথা? তিনি বললেন, লোকটি নাকি কালা জাহাঙ্গীর। পরিচয় দিয়ে সে ভিলেইনের সুরে জিজ্ঞেস করেছে, আপনার ছেলেমেয়েরা ভালো আছে? কথাটার আন্ডারলায়িং অর্থ হচ্ছে, টাকা না দিলে তাদের বিপদ হবে। ফোনটা আবার বেজে ওঠে। ফারুক ভাইয়ের অনুমতি না নিয়েই রিসিভ করি আমি। লোকটি খুব অ্যাংরি টোনে বলে, ফোনটা রেখে দিলেন যে? আমি বললাম, আপনি কে? সে বলল-বললাম তো, আমি কালা জাহাঙ্গীর। এবার আমি বলি, আমি ঘাউরা বাবু। এই মহল্লায় যে আইছস, আমারে জিগাইছস? ‘কালা জাহাঙ্গীর’ ফোন কেটে দেয়। আমি ফারুক ভাইকে আশ্বস্ত করি- টেক ইট ফর সিওর, হি উইল নট ফোন ইউ এগেইন। তিনি আমাকে শুধু বলেন, আজ তোমাকে একটা স্পেশাল কফি খাওয়াব। একবার স্যালারি লোন নিতে গেছি ব্র্যাক ব্যাংক মগবাজার শাখায়। আমাকে বলা হল- সাংবাদিক ও উকিলদের লোন দেয়া হয় না। টাকা ফেরত দেয়ার কথা বললে সাংবাদিকরা নাকি বলে- লেইখ্যা দিমু আর উকিলরা বিনা খরচায় মামলা চালায়। আমি ম্যানেজারকে বললাম, আপনি যে আজ নির্বিঘ্নে অফিসে আসতে পেরেছেন, দুর্বৃত্তরা আপনার পরনের কাপড় খুলে নেয়নি, এটা যে কিছু সাংবাদিকের কর্মের ফল, এটা কি আপনি বোঝেন? যদি বোঝেন তো লোন দ্যান্ না ক্যান্?
এ কথায়ও কাজ হল না যখন, আমি বাধ্য হয়ে ফারুক ভাইকে ফোন করে বললাম, ফারুক ভাই আগে বলেননি কেন, তাহলে সাংবাদিকতা ছেড়ে অন্য পেশা নিতাম, আপনার ম্যানেজার তো আমাকে লোন দিচ্ছেন না। ফারুক ভাই বললেন, ফোনটা ওনাকে দাও। এরপর তিনি কী বললেন জানার উপায় নেই। শুধু দেখলাম, ম্যানেজার রীতিমতো কাঁপছেন। আমাকে ঘণ্টা দুয়েক বসিয়ে রেখে নিজেই আমার অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে সব প্রক্রিয়া শেষ করে টাকা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো যখন, ভেবেছিলাম ফারুক ভাইকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হবে। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে দিল্লিতে নেমেছিলেন বঙ্গবন্ধু। পালাম বিমানবন্দরে তার অবতরণের যে দৃশ্য, তার এক কাব্যিক বর্ণনা দিয়েছেন ফারুক ভাই এক লেখায়। ঢাকার পথে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রীও হয়েছিলেন তিনি। ফারুক ভাইকে কেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হল না, এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই আমার কাছে। তবে কি তিনি যায়যায়দিনে লিখতেন বলে শফিক রেহমানের সঙ্গে আইডেন্টিক্যাল হয়ে পড়েছিলেন? আর তাই শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন বার্ডস অব দ্য সেম ফেদার ফ্লক টুগেদার? সেটাই বা কেন হবে? কারণ তিনি তো আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা, না কী যেন একটা হয়েছিলেন। ২০০০ সালে এক অনুষ্ঠানে দেখা পেয়ে ফারুক ভাইকে বলেছিলাম, we had enjoyed a nice foreign secretary and should not have missed a nice foreign minister. তিনি কি সামান্য বিব্রত হয়েছিলেন? হবে হয়তো। বলেছিলেন, you see, life is an imperfect entity. You can never be all-out perfect. দুর্বল কেউ মারা গেলে আমি কষ্ট পাই, শক্তিমানের ক্ষেত্রে পাই না। বস্তুর অবিনাশিতাবাদ সূত্রের মতো শক্তিও অবিনাশী। এর রূপান্তর হয় মাত্র। জীবিতাবস্থায় যা গতিশক্তি (kinetic energy), মৃত্যুর পর সেটাই রূপান্তরিত হয় স্থিতিশক্তিতে (potential energy)। রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইনরা যেমন স্থিতিশক্তি হয়ে ঠেলে চলেছেন আমাদের সামনের দিকে। ১৭ তারিখ ভোরে দীদারের ফোনকলে ফারুক ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনতে শুনতে জেগে উঠি, এরপর এক এক করে আরও অনেক ফোন। মনে হচ্ছিল, আমি কোনো পত্রিকা অথবা টেলিভিশনের বার্তাকক্ষ। ওরা বুঝেছিল মৃত্যুর খবরটা প্রথমেই দিতে হবে আমাকে। কিন্তু ওদের কেউই জানে না, আমি কারও কলেই কোনো কষ্ট পাইনি।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
mahbubkamal08@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.