ট্রলারের শব্দ পেলেই ত্রাণের জন্য ছুটে আসেন হাওরের মানুষ
‘ভাই আমরারে কিছু দিবায়নি। চাউল দিবায় না টেহা (টাকা) দিবায়। আমরাতো বস্তা নিয়া বহু সময় খাড়া হইয়া তোমরার ট্রলার দেখতাছি। ভাতাছি তোমরা মনে হয় আমরার লাগি কিছু খাওন লইয়া আইতাছো। দিনে কোন কোন সময় এক বেলা-দুই বেলা আধা পেট করেও খাওন পাইনা। বাচ্ছারার কান্দন সইতা ফারিনা, বুকের দুধ দিয়াও চুপ করাইতে পারিনা’। এ ভাবেই জীর্নশীর্ণ হয়ে কাতর অবস্তায় চাউল, খাবাব বা কিছু টাকার আকুতি জানিয়েছিলেন সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার সর্ববৃহৎ বোরো ফসলী “পাকনা হাওরের” নিভৃত ভাটির পল্লী হঠামার গ্রামের ৩০ উর্দ্ধ তিন সন্তানের জননী নজমুন নাহার। সামিনা বেগম তার তিন সন্তানকে শান্তনা দিয়ে মিষ্টি আলু খেতে দিয়ে টিপ-টিপ করে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে পেটের ক্ষুধার না বলা কষ্টগুলো বুঝিযে দিয়েছেন। তার মতো জুরমত বিবি, মাফিয়া বেগম, সুলতানা বেগম, জয়নাল আবেদীন, আব্দুল হকসহ অর্ধশতাধিক মানুষ ট্রলার নৌকার শব্দ শুনে ত্রাণের আশায় দীর্ঘক্ষণ বসা ছিলেন নদীর ঘাটে। তারা জানান ট্রলার নৌকার শব্দ শুনতে পেলেই তারা মনে করেন ত্রাণ নিয়ে আসছেন কেউ। একারণেই সবাই জড়ো হন এক সাথে ত্রাণ পেতে। হঠামার গ্রামের ইউপি সদস্য কে.এম.আ:রহিম জানান তার ওয়ার্ডে ৮’শত পরিবার ২৭০ জনকে বিজিএফ (বিশেষ) এর আওতায় নিলেও বাকী পরিবারের সদস্যদের তুপের মুখে পড়তে হচ্ছে প্রতিনিয়তই। ফেনারবাঁক ইউপি সচিব অজিত কুমার রায় বলেন, ওই ইউনিয়নের ৭৫৫০ পরিবারের মধ্যে ১১শত পরিবার ধনী বাকী সব দরিদ্র ও হতদরিদ্র। চলতি বিজিএফ (বিশেষ) আওতায় ৩০২৬ পরিবারকে আনা হলেও মূলত এ বছর ফসল ডুবির কারণে ধনী-গরিব সকল পরিবারই বিজিএফ পাওয়ার উপযুক্ত। বছরের একটি মাত্র বোরো ফসল হারিয়ে জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, মধ্যনগর, দিরাই-শাল্লা, দক্ষিণ সনামগঞ্জসহ সুনামগঞ্জ জেলার কৃষকরা আজ নি:স্ব হয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। বানের পানি পাহাড়ি ঢল কেড়ে নিয়েছে তাদের সারা বছরের সব স্বপ্ন। এখন বাঁচার দাগিদে যে কারো কাছে হাত পাততে দ্বিধাবোধ করেননা তারা। এভাবেই চলছে হাওরের ফসল হারা নিভৃত পল্লী গ্রামের মানুষের দিনকাল।
হাওরাঞ্চলের উদয়পুর, নাজিম নগর, শ্রীমন্তপুর, জসমন্তপুর, মিলনপুর সহ বেশ ক’টি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, ফসলহারা কৃষক পরিবার গুলোতে চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানীয়, বাসস্থান ও চিকিৎসাসহ নানাবিদ সঙ্কটে ঋণগ্রস্ত ফসলহারা কৃষক, কিষাণী, জেলেসহ সকল পরিবারের মধ্যে এখন হাহাকার বিরাজ করছে। এই বিপর্যয়ের ঘূর্ণিপাকে পড়ে ফসলহার কৃষক পরিবারের আর্তনাদ ও কান্না থামছে না। সুনামগঞ্জের হাওরে বোরো ধান কাটার শুরু থেকেই প্রবল বর্ষণ ও ভারতের মেঘালয় এবং আসাম রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের দুনীতিবাজ পাউবোর নামকায়স্তে নির্মিত ফসল রক্ষা বেড়ি বাঁধগুলো একের পর এক ভেঙে উঠতি বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। ফসল ডুবার পর মাছ ও হাঁসের মড়কে তাদের চোখে নেমে আসে অন্ধকার। হাওরে অজ্ঞাত এক রহস্যজনক গ্যাসের প্রভাবে বিপুল পরিমান মাছ মরে পানিতে ভাসতে থাকে। আর সেই বিষাক্ত মাছ খেয়ে হাজার হাজার হাঁসের মৃত্যু ঘটেছে। একের পর এক বিপর্যয়ে হাওরাঞ্চলের মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েন। বোরো ফসল গোলায় ওঠার সময় যে কৃষকরা অকাতরে লোকজনের মধ্যে ধান বিলি করতেন ফসল হারিয়ে আজ তারাই এখন ত্রাণের আশায় প্রহর গুনছেন। গ্রামের লোকজন এখন একবেলা, আধাবেলা ও অনেক পরিবারের সদস্যদের না খেয়ে অভুক্ত থাকতে হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে, তা প্রয়োজনের চেয়ে একবোরেই নগণ্য। যৎ সামান্য ত্রাণ তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। এমন পরিবারও রয়েছে এখনো কোনো ত্রাণ পায়নি। বোরো ধান চাষ করে যাদের গোলায় বারো মাস ধান থাকতো, গোয়াল ভরা গরু আর হাওরের পানিতে মাছ থাকতো, আজ সেই গোলায় নেই ধান, গরু শুন্য গোয়াল মাছেরও দেখা দিয়েছে আকাল। অতীতে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কৃষকরা বহুবার ফসল হারিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হলেও এবারের মতো এমন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হাওরবাসী আর কখনো হননি। ফসলহারা ঋণগ্রস্ত কৃষকেরা কিভাবে পরিবারের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করবেন ও মহাজনদের ঋণ পরিশোধ করবেন সেই দুশ্চিন্তায় বিচলিত হয়ে পড়েছেন।
No comments