‘উৎসে কর’-নির্ভর হচ্ছে রাজস্ব



আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সব ক্ষেত্রেই উৎসে কর বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিদ্যমান সর্বনিন্ম ১ দশমিক ৫ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত থাকা সব খাতের উৎসে করকে ৫ শতাংশে বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আয়কর ও ভ্যাট উভয় ক্ষেত্রেই আগাম করের এই ৫ শতাংশ একক হার কার্যকরের প্রস্তাব করা হবে নতুন বাজেটে। এ জন্য মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২-এর ৪৯(১) ধারা ও আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এবং আয়কর বিধিমালার সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করা হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। অথচ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে প্রাক-বাজেট বৈঠককালে প্রধান ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো উৎসে কর কর্তনের বিধান বাতিলের দাবি জানান। তাদের যুক্তি ছিল, নতুন আইনে ভ্যাট ব্যবস্থা ডিজিটালাইজড হচ্ছে, তাই অগ্রিম পরিশোধের প্রয়োজন নেই। ওই প্রস্তাব আমলেই নেয়নি এনবিআর। তবে উৎসে কর বাড়ানোর কারণে সব শ্রেণীর আমদানিকারক, উৎপাদক ও ভোক্তা পর্যায়ে করের বোঝা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও চলতি অর্থবছরে ৫২ খাত থেকে এ কর আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু আগামী অর্থবছর তা আরও সম্প্রসারিত করে ৬১টি খাত থেকে এ কর আদায় করা হবে। সব ধরনের উৎপাদক, আমদানিকারক ও সেবা প্রদানকারীর ওপরই উৎসে কর কার্যকর করা হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাবে এসব পণ্য বা সেবার মূল্য বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নতুন ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২-এর ৪৯(১) ধারায় সরবরাহ মূল্যের কর-ভগ্নাংশের ‘অনধিক এক-তৃতীয়াংশ’ উৎসে ভ্যাট কর্তনের বিধান রাখা হয়েছে।
সব ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হারে কর্তনের সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে আইনের সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়, ‘ভিন্ন ভিন্ন হারে উৎসে ভ্যাট কর্তনের ফলে প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি করবে। এ কারণে কর কর্তনের বিষয়টি অধিকতর সহজ ও সব ক্ষেত্রে সমতা বিধানের জন্য এবং সব ক্ষেত্রে কর্তনের হার ৫ ভাগ নির্ধারণের জন্য ধারা ৪৯-এর উপ-ধারা (১) সংশোধন করা যেতে পারে।’ একইভাবে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ ও আয়কর বিধিমালার সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। বর্তমানে ৩৮টি সেবা খাতে উৎসে ভ্যাট আদায় করা হয়। এর মধ্যে জমি উন্নয়নে ৩ শতাংশ উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করতে হয়। এটিকে ৫ শতাংশ করা হলে চূড়ান্তভাবে এর প্রভাব পড়বে ফ্ল্যাটের দামে। ফলে ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে। এ ছাড়া ১ থেকে ১১০০ বর্গফুট ফ্ল্যাট বিক্রির ওপর দেড় শতাংশ, ১১০১ থেকে ১৬০০ বর্গফুট পর্যন্ত ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ ও ১৬০০ বর্গফুটের বেশি আয়তনের ফ্ল্যাট বিক্রির ওপর সাড়ে ৪ শতাংশ উৎসে ভ্যাট আছে। এ ক্ষেত্রে উৎসে ভ্যাট ৫ শতাংশ করা হলে ছোট ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে। আসবাবপত্র কেনার সময় ৪ শতাংশ উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করতে হয়। এটি ৫ শতাংশ করা হলে আসবাবপত্রের দাম বাড়বে। জোগানদার সেবায় ৫ শতাংশ, পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য পরিবহনে সাড়ে ৪ শতাংশ, নিলামকৃত পণ্যের ক্রেতায় ৪ শতাংশ এবং তথ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর সেবার ওপর সাড়ে ৪ শতাংশ উৎসে ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সব ধরনের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম, সিটি কর্পোরেশনের পণ্য এবং সেবা ক্রয়, পরামর্শক ফি, বেতন-ভাতা পরিশোধ, লাইসেন্স নবায়ন, মন্ত্রণালয় প্রকল্পের বিভাগের বেতন-ভাতা, পণ্য সেবা ক্রয়ে বিল পরিশোধে ৫ শতাংশ কর আগাম পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া জনশক্তি রফতানি, আবাসন, ইটভাটা, ফ্রেইট ফরওয়ার্ড এজেন্সি, শিপিং এজেন্সি, বিদেশি প্রতিষ্ঠান, ট্রাভেল এজেন্ট, কনসালটেন্সি সার্ভিস, ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে, হাউস প্রপার্টি ইত্যাদি খাতেও আগামী অর্থবছরে ৫ শতাংশ আগাম কর দিতে হবে। এনবিআরের একটি সূত্র স্বীকার করেছে, নতুন বছরে ভ্যাট ও কর আদায়ে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা থাকছে। এর বিরাট অংশ আসবে উৎসে কর থেকে। আয়কর আদায়েও সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে উৎসে কর। মোট আয়করের ৫৭ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। নতুন ব্যবস্থায় ভ্যাট ও আয়কর খাতে রাজস্ব আদায় অনেক বেড়ে যাবে। কর ফাঁকি কমে যাবে।
সব ক্ষেত্রেই প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক থাকায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের সদস্য পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জানান, আগামী অর্থবছরে এনবিআরের কাঁধে ২ লাখ ৪৮ কোটি টাকার রাজস্বের বোঝা চাপানো হচ্ছে। এই বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আদায় করতে হলে জনগণের ওপর করভার বাড়াতে হবে। নতুন নতুন খাতে করের আওতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে উৎসে কর থেকেই সিংহভাগ রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে। নতুন ভ্যাট আইনে উৎসে কর খাতে আরও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় পুরো বিষয়টিই অটোমেশনের আওতায় আনা হয়েছে। এ জন্য স্বতন্ত্র একটি কর অঞ্চল করা হবে। গঠিত হবে ৫টি উৎসে কর কর্তন পরিবীক্ষণ অঞ্চল। সূত্রমতে, বর্তমান ভ্যাট ব্যবস্থায় ৩৮টি সেবার তালিকা নির্ধারণ করা আছে যেসব ক্ষেত্রে অবশ্যই উৎসে কর দিতে হয়। নতুন ভ্যাট ব্যবস্থায় কিছু উৎসে ভ্যাট কর্তনকারী সত্তা নির্ধারণ করা হয়েছে। উৎসে ভ্যাট কর্তনকারী সত্তা হল- কোনো সরকারি সত্তা, এনজিও, ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মাধ্যমিকোত্তর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ও বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (ভ্যাট) আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া বর্তমান ভ্যাট ব্যবস্থায় মূলত ভ্যাট ফাঁকি হওয়ার আশঙ্কা বেশি এমন খাতগুলোতে আগাম ভ্যাট উৎসে কেটে নেয়ার বিধান করা হয়েছে। নতুন ভ্যাট ব্যবস্থায় অল্পকিছু ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে ডকুমেন্টেশন সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। এর ফলে পরবর্তী সময়ে অডিট করে ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে।

No comments

Powered by Blogger.