সন্ধ্যার পর ঢাকার ভবন অগ্নিচুল্লি

সন্ধ্যার পর রাজধানী ঢাকার প্রতিটি ভবন অগ্নিচুল্লিতে পরিণত হচ্ছে। সারা দিন সূর্যের তাপ ধারণ করে নগরীর কংক্রিটের ভবন ও পিচঢালা রাজপথ। সন্ধ্যা নামলে তা থেকে বিকিরণ শুরু হয়। ফলে বিকিরণ প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তীব্র গরম অনুভূত হয়। অথচ দাবদাহের এ সময়ে পল্লীর মানুষ অপেক্ষায় থাকেন সূর্যাস্তের। সূর্য পাটে নামলেই আরামবোধ করেন তারা। বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, পাঁচ কারণে প্রকৃতিঘেরা পল্লীর চেয়ে শহরে বিশেষ করে রাজধানীতে তাপমাত্রা বেশি। এগুলো হচ্ছে- শহরে অতিমাত্রায় গড়ে উঠা কংক্রিটের ভবন ও পিচঢালা রাজপথ। যেগুলো দিনে তাপ শোষণ করে আর সন্ধ্যার তা নিঃসরণ শুরু করে। তার মতে, দিনে গ্রীষ্মের স্বাভাবিক তাপমাত্রা আর রাতে কৃত্রিম উত্তাপ মিলে গরমের অনুভূতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে গ্রীষ্মের স্বাভাবিক তাপমাত্রাই দাবদাহের মতো করে অনুভূত হচ্ছে। ১৯ মে দেশে তাপপ্রবাহ শুরু হয়। ওইদিন ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে এটি ৩৮ ডিগ্রিতে পৌঁছায়। এর চেয়েও বড় খবর হচ্ছে, এদিন খুলনার বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি পেরিয়ে যায়। আবহাওয়া বিভাগের (বিএমডি) ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী সাড়ে ৪টার দিকে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি পার হলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলে থাকেন আবহাওয়াবিদরা। এছাড়া ৩৬-৩৮ ডিগ্রি হলে তাকে মৃদু এবং ৩৮ থেকে ৪০ হলে তাকে মাঝারি আকারের তাপপ্রবাহ বলা হয়। সেই হিসাবে বুধবার এবারের মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার অভিজ্ঞতা লাভ করে বাংলাদেশ। যদিও সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় বিএমডির পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এদিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৩৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এ হিসাবের সঙ্গে একমত নন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বিএমডি যখন গড় তাপমাত্রার তথ্য প্রকাশ করে, তখন সাধারণ তাপমাত্রার মিল থাকে না। ঢাকায়ও এদিন এবারের মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল, ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বিএমডির ওয়েবসাইটের ওই তথ্য পাওয়া যায়। জানা গেছে, এ তাপমাত্রা বিএমডি মেপেছে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও আগারগাঁও এলাকায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দুই এলাকার চেয়ে ঢাকার অন্য এলাকার তাপমাত্রা ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। সেই হিসাবে স্থান ভেদে এক সপ্তাহ ধরেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশিই ছিল। গত এক সপ্তাহের তাপমাত্রার রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ সময়ে ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে দিনে তাপমাত্রা যা-ই থাকুক,
সন্ধ্যা নামলে ফ্ল্যাট-বাড়িতে থাকা একেবারেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের বাসিন্দা নাসরিন নাহার রেণু বলেন, বিকাল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শুরু হয় আসল গরম। এ সময়ে ঘরের ভেতর থাকা দায় হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, কংক্রিটের ভবন ও পিচঢালাইয়ের রাজপথ দিনে তাপমাত্রা ধারণ করে। সূর্যের তেজ যখন কমতে থাকে, তখন এ দুই উৎস থেকে তাপমাত্রা নিঃসরণ হতে থাকে। বিপরীত দিকে যেখানে ন্যাচারাল সারফেস (মাটি) আছে, সেখানে এর ব্যতিক্রম চিত্র। অর্থাৎ, সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রাও কমে যায়। তিনি বলেন, রাজধানীতে আরও চারটি কারণে গরম বেশি অনুভূত হয়। ভবনের আধিক্য- এ কারণে বাতাস প্রবাহের বাধার কারণে মানুষ স্বস্তি খুঁজে পায় না। পরিবহনের অধিক মাত্রায় কার্বন নিঃসরণ ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্রের অধিক ব্যবহারও বাতাস গরম করে তোলে। জলাশয়ের সংকট বা অনুপস্থিতি এবং গাছপালার অভাবে গরম শোষণের কিছু নেই। সবকিছু মিলে নগর জীবন আরও বেশি দুঃসহ। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মদ হানজালা বলেন, বাস্তবে তাপমাত্রা যা থাকে, নগরজীবনে তারও বেশি গরম অনুভব হয়ে থাকে। কারণ আমরা প্রকৃতি ধ্বংস করে নগরায়ণ করেছি। প্রকৃতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ভবন তৈরির প্রবণতাও বেশি। পর্যাপ্ত আলো-বায়ু চলাচলের মতো ভবন এখন কমই নির্মিত হচ্ছে। বেশির ভাগ ভবনে দেয়ালের পরিবর্তে গ্লাস ব্যবহৃত হচ্ছে। এ গ্লাস তাপ শোষণ না করে বরং বিচ্ছুরণের মাধ্যমে আরও গরম তৈরি করে। এসবই বাড়তি তাপের কারণ। তার এ বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১ সালের এক গবেষণায়। ‘ঢাকায় বায়ুর আরাম ও ধরন’ শীর্ষক ওই গবেষণা অনুযায়ী, নব্বইয়ের দশকে রাজধানীর বেশির ভাগ ভবনের প্রতিটি তলার মাঝখানে দুই ছাদের উচ্চতা ছিল ১১ থেকে ১৩ ফুট।
২০০০ সালের পর তা কমে সাড়ে ৯ ফুট করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। আগের ভবনগুলোর ছাদে ও জানালায় কার্নিশ দেয়ার প্রচলন ছিল। এখন তা অনেকটাই উঠে গেছে। ফলে এসব ভবনে আলো-বাতাস কম প্রবেশ করছে। এতে বাইরের তাপ প্রতিটি ভবনকে একেকটি অগ্নিচুল্লিতে পরিণত করছে। তবে ফ্ল্যাটের ভেতরে গরম বেশি অনুভবে আরও একটি কারণ আছে বলে মনে করেন প্রকৌশলীরা। ঢাকায় বর্তমানে বেশিরভাগ ফ্ল্যাট-বাড়ির রান্নাঘর ও টয়লেট এমনভাবে নির্মিত হচ্ছে, সেখানকার তাপ বাইরে বের না হয়ে ঘরের মধ্যেই আটকে থাকছে। এছাড়া অনেক বাসায় দিনের বেশিরভাগ সময়ে চুলা জ্বালিয়ে রাখা হয়। রাজশাহী ব্যুরো জানায়, তীব্র সূর্যদহন আর ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে রাজশাহী অঞ্চল। টানা দাবদাহে পুড়ছে এ অঞ্চলের মাঠ-ঘাট। একদিকে দাবদাহ, অন্যদিকে অব্যাহত লোডশেডিংয়ে জনজীবনে চরম দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিপাত না হলে এ দুর্ভোগ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। ২-১ দিনের মধ্যেই বৃষ্টি হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে স্থানীয় আবহাওয়া অফিস। এদিকে ক’দিন ধরে রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করছে। সর্বশেষ বুধবার রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সকাল থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত সূর্যতাপে যেন পুড়ে ছারখার হচ্ছে ফসলের মাঠ। সূর্যের অগ্নিঝরা তাপ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠছে আরও প্রখর। এতে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পথঘাট। দুপুরের দিকে নগরীর পথঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ বেশি কষ্টে পড়েছেন। গাছে গাছে আম ও লিচুর বোঁটাও শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। লোডশেডিংয়ে রাতে দেখা দেয় সীমাহীন দুর্ভোগ। এতে মানুষ একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারছেন না। নর্থ ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের একটি সূত্র জানায়, রাজশাহী শহরে এখন গড়ে বিদ্যুতের চাহিদা ৭০ থেকে ৯০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ মেগাওয়াট।
১১টি কারখানার তিন শতাধিক শ্রমিক অসুস্থ : গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, প্রচণ্ড দাবদাহে গাজীপুরের কোনাবাড়ীর কাশিমপুর শিল্প এলাকার অন্তত ১১টি পোশাক কারখানার তিন শতাধিক শ্রমিক বুধবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ওই এলাকার অধিকাংশ কারখানায় ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। গাজীপুর শিল্প পুলিশের ইন্সপেক্টর মো. আবদুল খালেক ও অসুস্থ শ্রমিকরা জানান, কাশিমপুর, জরুন, নয়পাড়া শিল্প এলাকার কারখানাগুলোর শ্রমিকরা প্রতিদিনের মতো বুধবার সকালে কাজে যোগ দেন। এর ঘণ্টাখানেক পর থেকে প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে কটন ক্লাব বিডি লিমিটেড, মুনটেক্স, পালকি, তাসনিয়া ফ্যাব্রিক্স, মাল্টিসেফ ও আলিম নিটওয়্যার লিমিটেডসহ ওই এলাকার অন্তত ১১টি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের পর্যায়ক্রমে বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরানো ও পেট ব্যথা শুরু হয়। অসুস্থদের অনেকের খিঁচুনিও দেখা দেয়। একপর্যায়ে বিভিন্ন কারখানার তিন শতাধিক শ্রমিক পর্যায়ক্রমে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কারখানা কর্তৃপক্ষ অসুস্থদের উদ্ধার করে স্থানীয় শরীফ জেনারেল হাসাপাতাল, পপুলার হাসপাতাল, কোনাবাড়ী ক্লিনিক ও হক জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে নিয়ে যায়। অসুস্থদের মধ্যে কারখানার সুয়িং শাখার নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। এ ঘটনায় শ্রমিকদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে অন্য শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে চলে যান। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার কাজে অংশ নেয় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। প্রায় সব ক’টি পোশাক কারখানা এদিনের জন্য ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে কোনাবাড়ী শরীফ জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক বাবুল আহমেদ শরীফ জানান, এটি ‘হিসটিরিক্যাল কনভারশন রিঅ্যাকশন্স ডিজিজ’। এ রোগে একজন মাথা ঘুরে পড়ে গেলে তাকে দেখে আরেকজন অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাছাড়া প্রচণ্ড গরমে কেউ হিটস্ট্রোক করলে দেখাদেখি অপরজন মনে করবে তারও স্ট্রোক হয়েছে। আবার সেও অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়তে পারে। তবে অসুস্থদের অধিকাংশ চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। গাজীপুর শিল্প পুলিশের এসআই মফিজুল ইসলাম জানান, শ্রমিক অসুস্থ হওয়ার খবরে পুলিশ সদস্যরাও ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার কাজে অংশ নেন। শনিবার থেকে প্রতিদিনই এ এলাকার বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা অসুস্থ হচ্ছেন। তবে বুধবার স্থানীয় প্রায় সব ক’টি পোশাক কারখানার বেশ কিছু শ্রমিক অসুস্থ হন। চিকিৎসকরা বলছেন প্রচণ্ড গরমে কারখানাগুলোর কিছু শ্রমিক অসুস্থ হন। অসুস্থদের সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকে। তাদের ‘মাস হিস্টিরিয়া’ হতে পারে। আবার অনেক শ্রমিক কাজে ফাঁকি দিতে ইচ্ছাকৃতভাবে অসুস্থ হওয়ার ভানও করতে পারেন। অসুস্থ শ্রমিকদের স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। প্রায় সবাই প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। এ ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাশিমপুর, নয়াপাড়া, জরুন এলাকার অধিকাংশ পোশাক কারখানা এদিনের জন্য ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।

No comments

Powered by Blogger.