দুবাই বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী by ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

এ বছর ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন করে সরকার গঠন করার পর শেখ হাসিনা একের পর এক বিশ্বে বিজয় অর্জনের ধারাবাহিক রেকর্ড স্থাপন করে চলেছেন। ২০০৮ সালের ‘আঁতাতের’ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকেই চমকের পর চমক দেখিয়ে আসছিলেন তিনি। প্রাচীনকালের রাজা বাদশাদের মতো জনপদের পর জনপদ দখল করে সেখানকার মানুষদের পদানত করার গৌরব তারা অর্জন করেননি; বরং নিজ দেশের মানুষদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে বিজয়ের গৌরব অর্জন করতে চেয়েছেন। কবিতাও আবৃত্তি করেছেন, ‘মহারাজ জয় আমি চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।’ কী পরিপ্রেক্ষিতে এই কাব্যাংশ উচ্চারিত হয়েছিল সে সম্পর্কে তাদের সুস্পষ্ট ধারণা আছে কি না, আমাদের জানা নেই। আমি তো রীতিমতো প্রধানমন্ত্রীর গুণমুগ্ধ। কেননা, তার বক্তব্য থেকে অনেক পুরনো দিনের গ্রামীণ শ্লোকাদি জানা যায়। কখনো কখনো তা খুবই মজাদার। যেমনÑ তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমার বেগুন আমি রাঁধব, যত খুশি লবণ দেব।’ ছেলেবেলায় দাদীর বিছানায় শুয়ে পরী, দৈত্যদানব, নবী-রাসূলদের জীবনের গল্প শুনেছি। পাশাপাশি শ্লোকও।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনলে কখনো কখনো সেরকম শৈশবে ফিরে যাই। বড় আনন্দঘন সে দিনগুলো। তার আর আমার বয়সের পার্থক্য ছয়-সাত বছর মাত্র। গ্রাম্য জীবনে, শুধু গ্রাম্য জীবনই বা বলি কেন, বাংলাদেশের জনজীবনে তখন পরিবর্তনের ধারা খুব ধীরগতিসম্পন্ন ছিল। আমাদের গ্রাম থেকে আট মাইল দূরে পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা দিতে টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে। অষ্টম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষার সময়ও তাই। এমনকি ১৯৬৮ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিতেও টমটমে চড়ে টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম। অর্থাৎ ছয় বছরেও জীবনধারার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি; হতো না। ফলে একই ধারার গল্প, শ্লোক সেই সময়ের শিশু-কিশোর-তরুণদের উপজীব্য বিষয় ছিল। এখন এগুলোর আবেদন কমেছে। সব কিছুর দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। গতকাল যা নতুন বা আধুনিক ছিল, আজ তা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন পুরনো প্রযুক্তিকে ঠেলে ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি আসছে। এরকম একটা ত্বরিত পরিবর্তনের যুগে শেখ হাসিনা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। জনগণের ভোটের তোয়াক্কা করেননি।
প্রযুক্তি বিকাশের এই যুগে তার সরকারের সাফল্যগাথার শেষ নেই। জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন, সেটা জনগণ পারলে করে নিক। সরকার কি প্রত্যেকের বাড়িতে পাকা ঘর, বিদ্যুৎ, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, আইফোন, ওয়াইফাইÑ এগুলো করে দেবে নাকি? জনগণকেই এগুলো করে নিতে হবে। গাড়ি যদি কিনতে হয়, নিজেদেরই কিনতে হবে। সরকার কি গাড়ি কিনে প্রত্যেক ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে আসবে। তা তো হয় না। এখন আধুনিক প্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তির সুবিধা অর্জন করে নিজেরাই ভোগ করতে হবে।
কিন্তু এজন্য কী করেনি বর্তমান সরকার? বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার জন্য তারা দিনরাত অকান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মাসে দুই-তিনবার বিদেশ ভ্রমণ এটা কি চাট্টিখানি কথা? এই বয়সে শরীরে কুলায়! কিন্তু দেশ ও জাতিকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার জন্য, ‘মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য’ ফজরের নামাজের পর থেকেই মধ্যরাত পর্যন্ত অকান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিছু কিছু দুর্মুখ এর কোনো মূল্যই দিচ্ছে না। এরা আসলে চোর। মধ্যরাতে জেগে টেলিভিশন টকশোতে সরকারকে টক টক আলোচনা শোনায়। বড় অসহ্য! আগে বলা হতো, কিছুটা চিনি দিলে ভালো হয়। তারপর শুনলাম, মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থাকে চোরেরা। অর্থাৎ মধ্যরাতে যারা টকশোতে কথা বলতে এসে হাজির হন, তারা চোরের সমতুল্য। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা হচ্ছে, এসব টকশোতে আসেন সুশীলসমাজের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নিজ নিজ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ব্যক্তিরা, আসেন চিকিৎসা, অপরাধ, কূটনীতি-রাজনীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা, আসেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও। তাদের আলোচনা ক্ষমতাসীনদের কাছে খুব টক মনে হয়।
এতে দোষ দেখি না। একচু লোকজন সরকারের ভালো কিছু দেখতেই পায় না। যেমন ধরা যাক, সরকার সমুদ্র বিজয় করল। গিনেজ বুকে নাম উঠুক বা না উঠুক, বৃহত্তম মানবপতাকা রচনা করে সরকার বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিলো। তেমনি লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইয়ে বিশ্বব্যাপী শোরগোল তুলে দিলো। আন্তর্জাতিক একাধিক সংস্থায় জয় নিয়ে এলো। শান্তির জন্য নোবেল পাওয়া ড. ইউনূসের মতো ব্যক্তিকে ‘ঘুষখোর আর সুদখোর’ সমান বলে একটি রায় দিয়ে দিলো। সমুদ্র বিজয়ের নামে তালপট্টি দ্বীপ ভারতকে দিয়ে দিলো, যেখানে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রয়েছে, সেই কৃতিত্বের কেউ প্রশংসা করল না। এই জাতিকে ধিক্কার দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় আছে? তখন সরকারপ্রধান বললেন, তালপট্টি দ্বীপের অস্তিত্বই নেই, যদি থাকে কেউ দেখাক। আশ্চর্য ঘটনা হলো, দেশের বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র গুগল আর্থের সাম্প্রতিক ছবিতে তালপট্টি দ্বীপের অস্তিত্ব দেখিয়ে জানান দিয়েছে, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই যে দেখুন, তালপট্টি দ্বীপ, এটি আমাদের। দয়া করে নিয়ে আসুন।’
এসব দুর্মুখ সহ্য করা যায় না। তাই সরকার সহ্য করতে নারাজ। তাহলে কী করা যায়? এর আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, যারা ‘বিদ্যুৎ নেই, বিদ্যুৎ নেই’ বলে সমালোচনা করেন, তাদের বাসার বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেবো। কিন্তু বিদ্যুৎ যদি না থাকে, ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হয়, তাহলে আমাদের কী করণীয়? সুযোগ পেলেই আমাদের জানান দেয়া হয় যে, হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তারা উৎপাদন করেছেন। কূপের পর কূপ থেকে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সংযোজন করছেন। তাহলে বিদ্যুতের এত ঘাটতি কেন? এ ধরনের ঘটনা নিয়ে জাতীয় সংসদে এক হাস্যকৌতুক করেছিলেন সাবেক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব:) আকবর হোসেন। তখন আওয়ামী লীগ সরকার দাবি করছিল, ভারতের সাথে ২৫ বছরের পানিচুক্তির পর পদ্মায় উত্তাল ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আকবর হোসেন সংসদে বলেছিলেন, সরকারি দল তো বলছে যে, পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে বাংলাদেশ। হাজার হাজার কিউসেক পানি ঢুকছে। কিন্তু লুঙ্গি পরে পদ্মা পার হয়ে এলাম, কিউসেক তো ভিজল না। এখন হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, ট্রিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সংযোজিত হচ্ছে। বিদ্যুৎও পাচ্ছি না, শিল্পকারখানাগুলো গ্যাসও পাচ্ছে না। বিজয় কাহিনী কাগজে-কলমেই লিপিবদ্ধ থাকছে।
আর এসব কথা যাতে কেউ না বলতে পারে, সেজন্য টকশোগুলোতে অনেককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের আর আমন্ত্রণ নেই। এখন টকশোগুলোতে কেবলই ‘আমরা ও মামুরা’। আগে সরকারপ্রধান টকশো দেখার জন্য রাত জেগে থাকতে হতো। এখন ভিন্নমতের বেশির ভাগ স্তব্ধ করে দিয়েছেন। চোরদের অনুষ্ঠান না দেখলে কোনো ক্ষতি নেই। আর এসব অনুষ্ঠানে তেঁতুল টক আলোচনা করতে যাতে কোনো বাজে লোক আসতে না পারে সেটা সুনিশ্চিত করা হয়েছে এবং নিজেকে এক ঘেরাটোপের ভেতরে বন্দী করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা সম্প্রতি সংযুক্ত আরব-আমিরাত সফর করে এসেছেন। ১৯৯৬-২০০১-এ যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি ঘনঘন বিদেশ সফর করতেন। এখনো পরিস্থিতি প্রায় তাই। বাংলাদেশে থাকার চেয়ে বিদেশ সফর অনেকের জন্য আনন্দদায়ক বিষয়। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এক কবিতা লিখেছিলেন। তার চরণ ছিল, ‘সহে না, সহে না জনতার জঘন্য মিতালী।’ যা হোক, সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের আগে স্তাবকরা এমন এক প্রচারণা চালাল যে, প্রধানমন্ত্রী আমিরাত সফরে গেলেই তার পরদিন থেকে বাংলাদেশের আড়াই লাখ শ্রমিক প্রতি বছর প্লেনভর্তি করে আমিরাত যেতে শুরু করবে। এই অর্থহীন প্রচারণায় সাজ সাজ রব পড়ে গেল। ওসব দেশে যারা চাকরিপ্রার্থী, তারাও পাসপোর্ট রিনিউ করতে লেগে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী কি এমনি যান! সব নিশ্চয়ই ফাইনাল। ভাবলেন, প্রধানমন্ত্রী যাবেন আর প্লেনভর্তি লোক হয়তো দুবাই বিমানবন্দরে পৌঁছে যাবেন।
কিন্তু পুরো বিষয়টিই দাঁড়াল একটা বিভ্রান্তি হিসেবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আগে থেকে কিছুই নিশ্চিত করতে পারেনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীরও ধারণা ছিল ‘বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যাবেন, আর আমিরাত শ্রমবাজার উন্মোচন করবে না, এ কী করে সম্ভব?’ এই সরকার যা করে তাই করেছে। আমিরাতে গিয়ে আড়াই লাখ শ্রমিকের বদলে ১৪ খাতে এক হাজার নারী শ্রমিক নেয়ার চুক্তিতে সই করে এসেছে। সেটিও কবে নেয়া হবে, গ্যারান্টি নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যার পূর্ববর্তী রেকর্ড প্রশ্নবিদ্ধ, তিনিও চুপ মেরে গেছেন। শিক্ষাদীক্ষা তার কিছু ছিল বটে। রাজনীতিতে ঢুকে তা কি কমে গেছে। প্রধানমন্ত্রী আমিরাত থেকে ফিরে তার দলীয় মিডিয়াকর্মীদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন গণভবনে। সেখানে একজন লোকও কি ছিলেন না, একজন সাংবাদিকও কি ছিলেন না, যিনি প্রশ্ন করতে পারেন, যিনি বলতে পারেনÑ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সংযুক্ত আরব আমিরাতে জনশক্তি রফতানির কী হলো? কিন্তু তা কেউ বলেননি। তাহলে কোটি টাকা খরচ করে এই সফরের অর্থ কী? এই টাকা জনগণের ট্যাক্সের। অথচ জনগণের কল্যাণে লাগল না।
এই সংবাদ সম্মেলনে আমন্ত্রিত সাংবাদিকেরা বেশির ভাগই ছিলেন আওয়ামী সমর্থক। তারা যখন বুঝলেন, শেখ হাসিনার দুবাই সফর ব্যর্থ, তখন তারা কেবল ৫ জানুয়ারি ও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করছিলেন। আর প্রধানমন্ত্রী তার আজগুবি জবাব দিচ্ছিলেন। এ নিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে প্রশ্ন করার কেউ ছিলেন না। যদি সংবাদ সম্মেলনই করা হয়, যদি কোনো সফরের সাফল্য বা ব্যর্থতা বিষয়ে দেশবাসীকে জানানোর প্রয়োজন হয়, তাহলে ভাবতে হবে, যারা ভিন্ন প্রশ্ন করতে পারে, যারা সরকারের মতাদর্শের লোক নয়, তারাও যেন এই সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়ে প্রশ্ন করতে পারেন। তা না হলে, এটা মূলত সংবাদ সম্মেলন হতে পারে না। সেটা অন্ধকারের পঙ্কে পুনরায় নিজেদের আড়াল করার নামান্তরই হবে মাত্র।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.