ব্যক্তির চেয়ে নাগরিক সম্প্রদায় বড় by ইকতেদার আহমেদ
চলতি বছর জুনের শেষ সপ্তাহের কোনো একদিন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর একমাত্র পুত্রের বিবাহোত্তর সংবর্ধনায় যোগ দেয়ার জন্য কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের উদ্দেশে আমার সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে রাত ৮টায় রওনা হই। অভিজ্ঞতার আলোকে আমার ধারণা ছিল ৩০-৪৫ মিনিটের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। কিন্তু মন্ত্রীপাড়া হয়ে শেরাটন হোটেলের উত্তর-পূর্ব কোণার গোল চত্বরে পৌঁছার আগেই দেখা গেল গাড়ির লম্বা সারি। ১০-১৫ মিনিট পার হওয়ার পরও যখন দেখা গেল সামনের সারি সারি গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, তখন অগত্যা গাড়ি থেকে বের হয়ে একটু সামনে এগিয়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকে যানজটের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, শেরাটনের সামনের রাস্তা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবন থেকে শেরেবাংলা নগরে তার বাসস্থানে যাবেন। তাই সড়কের একপাশে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে এবং তার গাড়িবহর অতিক্রম না করা পর্যন্ত প্রতিটি প্রবেশমুখ বন্ধ থাকবে। এভাবে যানজটে আধঘণ্টারও বেশি সময় আটকে থাকার পর ধীরে ধীরে গাড়ি সামনে এগোতে থাকে। কিন্তু প্রতিটি প্রবেশমুখে দীর্ঘক্ষণ অনেক গাড়ি আটকে থাকায় এবং রাস্তার একপাশে দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় প্রধানমন্ত্রীর প্রস্থানের পর রাস্তাটি সাধারণের চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হলেও তাতে চতুর্মুখের গাড়ির চাপে সামনে এগোনোর গতি শ্লথ হয়ে পড়ে। যা হোক, অবশেষে সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে যখন বিয়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পৌঁছালাম, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ১০টায় ছুঁই ছুঁই। আমার বন্ধু বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিল আমি যেন সাড়ে আটটার মধ্যে সংবর্ধনাস্থলে পৌঁছে তাকে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানোসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজে সহায়তা করি। আমার ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিলম্বে পৌঁছার কারণ বন্ধুকে অবহিত করলে বন্ধুটি বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু এতে আমার মতো তারও আক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।
বিয়ের সংবর্ধনাস্থলে সরকারের সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ আরও বেশকিছু পদস্থ কর্মকর্তার দেখা পেলাম। ইতিপূর্বে মন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন এমন কয়েকজনকেও পাওয়া গেল। অভ্যাগতদের মধ্যে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের নেতৃস্থানীয় অনেকেই ছিলেন। তাদের অনেকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের জন্য পথ রুদ্ধ করা থেকে সৃষ্ট যানজটে পড়ে তারা সবাই ক্ষেত্রভেদে নির্ধারিত সময়ের আধঘণ্টা থেকে একঘণ্টা দেরিতে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয়েছেন।
সেদিন আমার সঙ্গে যারা যানজটে আটকে ছিলেন তাদের মধ্যে একজনকে পাওয়া গেল বিদেশ যাত্রী। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তার অ্যামিরেট এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ছাড়ার কথা ১২টায়। তিনি যানজটের নাজুক অবস্থা দেখে রাস্তায় দণ্ডায়মান কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্টকে বারবার অনুনয়-বিনয় করে বলছিলেন, যে কোনোভাবে বিকল্প পথ দিয়ে হলেও তার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হোক। তিনি আরও বলছিলেন, যানজটের কারণে নির্ধারিত সময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছে ফ্লাইট ধরতে না পারলে বিমানভাড়া বাবদ দেয়া তার সম্পূর্ণ টাকা মার যাবে। তাছাড়া নির্ধারিত দিন কর্মস্থলে যোগ না দিলে তার চাকরির ক্ষতি হবে, এমনকি চাকরি হারাতেও হতে পারে। তার কথা শুনে পুলিশ সার্জেন্টের তার প্রতি সহানুভূতি জাগলেও যানজট এত অসহনীয় ছিল যে কিছুতেই তার গাড়িটিকে অন্যান্য গাড়ি সরিয়ে বাইরে আনা সম্ভব ছিল না। ওই বিদেশ যাত্রী সেদিন বিমানবন্দরে বিলম্বে পৌঁছে তার নির্ধারিত ফ্লাইট ধরতে পেরেছিলেন কি-না তা জানা না গেলেও আমার মনে বারবার প্রশ্নের উদয় হতে থাকল, যারা বিদেশে প্রতিকূল পরিবেশে চাকরি করে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছেন, তাদের প্রাপ্য কি এভাবে যানজটে ফেলে নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছা থেকে বঞ্চিত করা?
সংসদীয় গণতন্ত্র অনুসৃত হয় এমন সব দেশে প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান এবং সরকারের শীর্ষ নির্বাহী। ৯০-এর পর আমাদের দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সে সময় থেকে অদ্যাবধি সাময়িক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকাল ছাড়া সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। আমাদের দেশে বর্তমানে রাষ্ট্রপতির পদটি অনেকটাই আলংকারিক। তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হলেও প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ ছাড়া অন্যসব বিষয়ে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করতে হয়।
আমাদের সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় মানক্রম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের এক নম্বর ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রীয় যে কোনো অনুষ্ঠানে তিনি সবার ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করেন। রাষ্ট্রীয় মানক্রমে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান দ্বিতীয়। আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এ দুজন প্রশাসনিক আদেশ বলে অতীব অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (ভিভিআইপি)। এ দুজন যখন সড়কপথে চলাচল করেন, তখন তাদের চলাচলের পথ অপর সব যানবাহন চলাচলের জন্য বন্ধ থাকে। এমনকি তাদের চলাচলের সড়কপথের প্রতিটি প্রবেশমুখও অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরে অন্তর্ভুক্ত তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের অভিমত, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই তাদের উভয়ের চলাচলের সময় তাদের চলাচলের পথে অন্যান্য যানবাহনের চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পদে থাকাকালীন দেশে সড়কপথে চলাচলের সময় এ বিশেষ সুবিধাটি নিয়ে থাকেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ের পদের একটি নির্ধারিত সময়সীমা দেয়া আছে। তারা উভয়ে যতক্ষণ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের সমর্থন ভোগ করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্দিষ্ট মেয়াদ অবধি তারা ক্ষমতায় থাকতে পারেন। জনমত সবসময় ওঠানামা করে। আমাদের দেশের মতো অন্য কোনো দেশে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী অনির্ধারিত সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকতে পারেন না।
আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তাদের চলাচলের সময় বর্তমানে অপরের চলাচল রুদ্ধ করে যে সুবিধা নিচ্ছেন, ক্ষমতায় থাকাকালীন অনুরূপ সুবিধা নিয়েছিলেন এমন তিনজন সাবেক রাষ্ট্রপতি, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং একজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বর্তমানে ক্ষমতার বাইরে থেকে নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করছেন। তারা যখন চলাচল করেন তখন তাদের নিরাপত্তার জন্য সরকার প্রদত্ত নিরাপত্তা প্রহরী সজ্জিত গাড়ি তাদের গাড়ির সামনে বা পেছনে থাকার আবশ্যকতা দেখা দেয় না। তাদের মতো বর্তমান রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীও একদিন ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবেন। তখন তাদেরও যে সড়কপথে চলাচলের সময় নিরাপত্তা প্রহরী সজ্জিত গাড়ির আবশ্যকতা থাকবে না বা দেয়া হবে না, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেয়, ক্ষমতার বাইরে থাকাবস্থায় যে নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই, ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় সে নিরাপত্তা দিয়ে প্রকারান্তরে তাদের জনসাধারণ থেকে কি দূরে রাখা হচ্ছে না? আর যখন এভাবে দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জনসাধারণ থেকে দূরে থাকবেন, তখন তাদের প্রতি জনগণের বিদ্যমান আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
যুক্তরাষ্ট্র, য্ক্তুরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, কানাডাসহ উন্নত রাষ্ট্রগুলোর সরকারপ্রধানরা যখন সড়কপথে চলাচল করেন তখন তা অপরের চলাচলের জন্য রুদ্ধ করা হয় না। এমনকি চলার পথে সড়কের নির্ধারিত সিগনালে থামার আবশ্যকতা থাকলে তাদের জন্য কোনো ধরনের ব্যতিক্রমও পরিলক্ষিত হয় না। এসব সরকারপ্রধান অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের আন্তর্জাতিক গুরুত্বের কারণে তারা যে কোনো সময় বিদেশী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দ্বারা আক্রান্ত হবেন, এমন আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু তারপরও যেহেতু তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং জনমতের প্রতিফলনে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত, তাই তারা কখনও অপরের চলাচলের পথ রুদ্ধ করে নিজের চলাচলের পথ সুগম করেন না। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের ক্ষেত্রেও অনুরূপ রীতি অনুসরণ করা হয় না।
যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে একজন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অপরের চলাচলের অধিকার ক্ষুণ্ন করে নিজের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করা গণতন্ত্রের রীতিনীতি ও জনআকাক্সক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমাদের দেশে রাজধানী ঢাকার সড়কগুলো অপ্রশস্ত ও আয়তন কম হওয়ায় এমনিতেই প্রতিদিন অধিকাংশ সড়কে যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। এর ওপর রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের কারণে যখন তাদের নির্ধারিত পথে অন্যান্য যান চলাচল বন্ধ করা হয়, তখন সে যানজটের মাত্রা কী হতে পারে তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারও পক্ষে উপলব্ধি করা কঠিন। যানজটে পড়ে ভুক্তভোগীরা যেসব কটুবাক্য ব্যবহার করেন, তা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কান পর্যন্ত পৌঁছালে তারা এভাবে অপরের চলাচলের পথ রুদ্ধ করে চলবেন কি-না সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, যানজটের কারণে বাংলাদেশে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা। এটি জ্বালানি ও সময় উভয়ের অপচয় বিবেচনায় নিয়ে করা হয়েছে। এ অপচয়ের বড় একটি অংশ যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের সময় অপরের চলাচলের পথ রুদ্ধ করার কারণে হচ্ছে, সে বিষয়ে দেশের সচেতন মানুষের কোনো সন্দেহ নেই।
আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী যখন সড়কপথে চলাচল করেন, তখন তাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে উদ্বিগ্ন থাকার কথা নয়। যারা তাদের উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে এভাবে চলাচলের ব্যবস্থা করছেন, তারা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে জনবিচ্ছিন্ন করে তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাসে ভূমিকা রাখছেন। আর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী একান্তই যদি মনে করেন, এভাবে না চললে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, সেক্ষেত্রে তারা হেলিকপ্টারে করে শহরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল করতে পারেন। এতে একদিকে যেমন অপরের চলাচলের পথ রুদ্ধ হয়ে জনঅসন্তোষের কারণ ঘটবে না, অপরদিকে জ্বালানি ও সময়ের অপচয়ও কমবে।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com
বিয়ের সংবর্ধনাস্থলে সরকারের সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ আরও বেশকিছু পদস্থ কর্মকর্তার দেখা পেলাম। ইতিপূর্বে মন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন এমন কয়েকজনকেও পাওয়া গেল। অভ্যাগতদের মধ্যে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের নেতৃস্থানীয় অনেকেই ছিলেন। তাদের অনেকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের জন্য পথ রুদ্ধ করা থেকে সৃষ্ট যানজটে পড়ে তারা সবাই ক্ষেত্রভেদে নির্ধারিত সময়ের আধঘণ্টা থেকে একঘণ্টা দেরিতে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয়েছেন।
সেদিন আমার সঙ্গে যারা যানজটে আটকে ছিলেন তাদের মধ্যে একজনকে পাওয়া গেল বিদেশ যাত্রী। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তার অ্যামিরেট এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ছাড়ার কথা ১২টায়। তিনি যানজটের নাজুক অবস্থা দেখে রাস্তায় দণ্ডায়মান কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্টকে বারবার অনুনয়-বিনয় করে বলছিলেন, যে কোনোভাবে বিকল্প পথ দিয়ে হলেও তার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হোক। তিনি আরও বলছিলেন, যানজটের কারণে নির্ধারিত সময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছে ফ্লাইট ধরতে না পারলে বিমানভাড়া বাবদ দেয়া তার সম্পূর্ণ টাকা মার যাবে। তাছাড়া নির্ধারিত দিন কর্মস্থলে যোগ না দিলে তার চাকরির ক্ষতি হবে, এমনকি চাকরি হারাতেও হতে পারে। তার কথা শুনে পুলিশ সার্জেন্টের তার প্রতি সহানুভূতি জাগলেও যানজট এত অসহনীয় ছিল যে কিছুতেই তার গাড়িটিকে অন্যান্য গাড়ি সরিয়ে বাইরে আনা সম্ভব ছিল না। ওই বিদেশ যাত্রী সেদিন বিমানবন্দরে বিলম্বে পৌঁছে তার নির্ধারিত ফ্লাইট ধরতে পেরেছিলেন কি-না তা জানা না গেলেও আমার মনে বারবার প্রশ্নের উদয় হতে থাকল, যারা বিদেশে প্রতিকূল পরিবেশে চাকরি করে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছেন, তাদের প্রাপ্য কি এভাবে যানজটে ফেলে নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছা থেকে বঞ্চিত করা?
সংসদীয় গণতন্ত্র অনুসৃত হয় এমন সব দেশে প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান এবং সরকারের শীর্ষ নির্বাহী। ৯০-এর পর আমাদের দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সে সময় থেকে অদ্যাবধি সাময়িক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকাল ছাড়া সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। আমাদের দেশে বর্তমানে রাষ্ট্রপতির পদটি অনেকটাই আলংকারিক। তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হলেও প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ ছাড়া অন্যসব বিষয়ে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করতে হয়।
আমাদের সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় মানক্রম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের এক নম্বর ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রীয় যে কোনো অনুষ্ঠানে তিনি সবার ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করেন। রাষ্ট্রীয় মানক্রমে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান দ্বিতীয়। আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এ দুজন প্রশাসনিক আদেশ বলে অতীব অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (ভিভিআইপি)। এ দুজন যখন সড়কপথে চলাচল করেন, তখন তাদের চলাচলের পথ অপর সব যানবাহন চলাচলের জন্য বন্ধ থাকে। এমনকি তাদের চলাচলের সড়কপথের প্রতিটি প্রবেশমুখও অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরে অন্তর্ভুক্ত তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের অভিমত, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই তাদের উভয়ের চলাচলের সময় তাদের চলাচলের পথে অন্যান্য যানবাহনের চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পদে থাকাকালীন দেশে সড়কপথে চলাচলের সময় এ বিশেষ সুবিধাটি নিয়ে থাকেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ের পদের একটি নির্ধারিত সময়সীমা দেয়া আছে। তারা উভয়ে যতক্ষণ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের সমর্থন ভোগ করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্দিষ্ট মেয়াদ অবধি তারা ক্ষমতায় থাকতে পারেন। জনমত সবসময় ওঠানামা করে। আমাদের দেশের মতো অন্য কোনো দেশে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী অনির্ধারিত সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকতে পারেন না।
আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তাদের চলাচলের সময় বর্তমানে অপরের চলাচল রুদ্ধ করে যে সুবিধা নিচ্ছেন, ক্ষমতায় থাকাকালীন অনুরূপ সুবিধা নিয়েছিলেন এমন তিনজন সাবেক রাষ্ট্রপতি, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং একজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বর্তমানে ক্ষমতার বাইরে থেকে নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করছেন। তারা যখন চলাচল করেন তখন তাদের নিরাপত্তার জন্য সরকার প্রদত্ত নিরাপত্তা প্রহরী সজ্জিত গাড়ি তাদের গাড়ির সামনে বা পেছনে থাকার আবশ্যকতা দেখা দেয় না। তাদের মতো বর্তমান রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীও একদিন ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবেন। তখন তাদেরও যে সড়কপথে চলাচলের সময় নিরাপত্তা প্রহরী সজ্জিত গাড়ির আবশ্যকতা থাকবে না বা দেয়া হবে না, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেয়, ক্ষমতার বাইরে থাকাবস্থায় যে নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই, ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় সে নিরাপত্তা দিয়ে প্রকারান্তরে তাদের জনসাধারণ থেকে কি দূরে রাখা হচ্ছে না? আর যখন এভাবে দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জনসাধারণ থেকে দূরে থাকবেন, তখন তাদের প্রতি জনগণের বিদ্যমান আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
যুক্তরাষ্ট্র, য্ক্তুরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, কানাডাসহ উন্নত রাষ্ট্রগুলোর সরকারপ্রধানরা যখন সড়কপথে চলাচল করেন তখন তা অপরের চলাচলের জন্য রুদ্ধ করা হয় না। এমনকি চলার পথে সড়কের নির্ধারিত সিগনালে থামার আবশ্যকতা থাকলে তাদের জন্য কোনো ধরনের ব্যতিক্রমও পরিলক্ষিত হয় না। এসব সরকারপ্রধান অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের আন্তর্জাতিক গুরুত্বের কারণে তারা যে কোনো সময় বিদেশী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দ্বারা আক্রান্ত হবেন, এমন আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু তারপরও যেহেতু তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং জনমতের প্রতিফলনে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত, তাই তারা কখনও অপরের চলাচলের পথ রুদ্ধ করে নিজের চলাচলের পথ সুগম করেন না। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের ক্ষেত্রেও অনুরূপ রীতি অনুসরণ করা হয় না।
যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে একজন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অপরের চলাচলের অধিকার ক্ষুণ্ন করে নিজের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করা গণতন্ত্রের রীতিনীতি ও জনআকাক্সক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমাদের দেশে রাজধানী ঢাকার সড়কগুলো অপ্রশস্ত ও আয়তন কম হওয়ায় এমনিতেই প্রতিদিন অধিকাংশ সড়কে যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। এর ওপর রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের কারণে যখন তাদের নির্ধারিত পথে অন্যান্য যান চলাচল বন্ধ করা হয়, তখন সে যানজটের মাত্রা কী হতে পারে তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারও পক্ষে উপলব্ধি করা কঠিন। যানজটে পড়ে ভুক্তভোগীরা যেসব কটুবাক্য ব্যবহার করেন, তা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কান পর্যন্ত পৌঁছালে তারা এভাবে অপরের চলাচলের পথ রুদ্ধ করে চলবেন কি-না সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, যানজটের কারণে বাংলাদেশে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা। এটি জ্বালানি ও সময় উভয়ের অপচয় বিবেচনায় নিয়ে করা হয়েছে। এ অপচয়ের বড় একটি অংশ যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের সময় অপরের চলাচলের পথ রুদ্ধ করার কারণে হচ্ছে, সে বিষয়ে দেশের সচেতন মানুষের কোনো সন্দেহ নেই।
আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী যখন সড়কপথে চলাচল করেন, তখন তাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে উদ্বিগ্ন থাকার কথা নয়। যারা তাদের উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে এভাবে চলাচলের ব্যবস্থা করছেন, তারা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে জনবিচ্ছিন্ন করে তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাসে ভূমিকা রাখছেন। আর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী একান্তই যদি মনে করেন, এভাবে না চললে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, সেক্ষেত্রে তারা হেলিকপ্টারে করে শহরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল করতে পারেন। এতে একদিকে যেমন অপরের চলাচলের পথ রুদ্ধ হয়ে জনঅসন্তোষের কারণ ঘটবে না, অপরদিকে জ্বালানি ও সময়ের অপচয়ও কমবে।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com
No comments