জাতির বিভক্তি ও বিভাজকদের শক্তি by মিনার রশীদ
জাতিকে বিভক্তকারী বা বিভাজকদের প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়েছেন সর্বজনমান্য কয়েকজন সিনিয়র নাগরিক। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, শহীদ মিনার কারো বাবার সম্পদ নয়। দেশের মানুষের প্রকৃত ক্ষোভটিই প্রতিধ্বনিত হয়েছে সর্বজন শ্রদ্ধেয় দেশের বর্ষীয়ান এই নাগরিকের মুখ থেকে। আসলেই এ দেশটি কারোরই বাপের তালুক নয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, ‘শহীদ মিনারকে যারা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন, শহীদ মিনারকে নিয়ে যারা রাজনীতি করছেন ও করাচ্ছেন, এর ভবিষ্যৎ কতটা ভয়াবহ তা এখন অনুমানও করা যাচ্ছে না। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা পেতে সংশ্লিষ্টদের ভবিষ্যতের জন্য অপো করতে হবে।’
এখানে মুশকিল হলো, এই সর্বনাশা বিভাজনটি জাতির জটিল রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এই রোগ সারাতে খালেস নিয়তে যে চিকিৎসকই এগিয়ে আসেন এই বিভাজকদের খপ্পরে পড়ে তিনিও একজন রোগী হিসেবেই প্রতিপন্ন হন। ড. পিয়াস করিম এই মেকানিজমের সর্বশেষ শিকার। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ড. আকবর আলি খানগণ এখানে চিকিৎসক হিসেবে এগিয়ে এলে তাদেরকেও এই বিভাজনের একটি প হিসেবে তুলে ধরে তাদের প্রচেষ্টাকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হবে।
কারণ এই বিভাজকেরা সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আর্থিকভাবে খুবই শক্তিশালী। দেশের ভেতরের একটা শ্রেণীর অন্ধ আবেগ বা ক্রোধকে সুকৌশলে ব্যবহার করা হলেও এর পেছনে রয়েছে একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। কখনো শাহবাগি কখনো ঘাদানিক পরিচয় ধারণ করলেও মূল নিয়ন্ত্রণ একটি কমান্ড সেন্টার থেকেই পরিচালনা করা হয়।
একটি জাতির বিভাজন শুরু হয় যখন একটি গ্রুপ কোনো কারণে নিজেদেরকে অন্যদের তুলনায় ব্রাহ্মণ বা আশরাফ (শ্রেষ্ঠতর বা সুপিরিয়র) ভাবতে শুরু করে। বলতে দ্বিধা নেই যে, এই বিভাজন সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় দার্শনিক বা আদর্শিক রসটি আহরণ করা হয়েছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
ফুল থেকে মৌমাছি আহরণ করে মধু আর মাকড়সা আহরণ করে বিষ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থেকেও শাহবাগি এবং তাদের পূর্বতন দোসররা আহরণ করেছে ঘৃণার বিষ। মুক্তিযুদ্ধকে জাতির ঐক্য ও সমৃদ্ধির পথে কাজে না লাগিয়ে এসব মাকড়সা জাতিকে বিভক্ত করে আজ সত্যি সত্যি ধ্বংসের প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। এরা আজ আমাদের আদালত, শিালয়, প্রশাসন ও সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ফেলেছে।
আবহমান কাল ধরে এই বঙ্গীয় পলিমাটির রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় উপকরণ দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সিঙ্গেল ইউনিট বা একক জাতিসত্তার এই চমৎকার রাষ্ট্র। পরপর দু’বারের স্বাধীনতায় কিছু ঐতিহাসিক ভুল সংশোধিত হয়ে এই জাতি রাষ্ট্রটি আরো বিশুদ্ধ হয়েছে। এটা এমন এক চমৎকার জাতিরাষ্ট্র যেখানে দিনাজপুরের এক ছেলে কক্সবাজারের এক মেয়েকে অনায়াসেই বিয়ে করতে পারে এবং দু’টি অপরিচিত পরিবার সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে সম্পূর্ণরূপে মিশে যেতে পারে। একটা রাষ্ট্রের জন্য বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান উপাদান।
এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে একক জাতিসত্তা নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রটি উন্নত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। সেটা হয়ে গেলে জাতপাতের কঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ ও বিভিন্ন জাতিসত্তার জটিল কনফিক্টে ত-বিত কোনো কোনো প্রতিবেশীর জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। কাজেই এই সর্বনাশা বিভাজনে শুধু আমাদের অভ্যন্তরীণ রাগ, ােভ, হতাশা ও বোকামি কাজ করছে তা নয়Ñ বাইরের কিছু প্রভাবক বা উৎসাহও স্পষ্টতই কাজ করে যাচ্ছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি রাজনৈতিক ইস্যু কিংবা সামরিক কনফিক্ট খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে একটি ভূখণ্ডের সব মানুষ তাতে একমত হতে পেরেছে কিংবা কোনো সামরিক কনফিক্টের সময় সম্পূর্ণরূপে এক পে অবস্থান নিতে সম হয়েছে। বিশেষ করে যেখানে ১৯৪৭ সালে একবার স্বাধীনতা পাওয়ার পরও ১৯৭১-এ আবার স্বাধীনতার প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়। ১৯৪৭ সালে যে যুবক পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছেন সেই একই প্রৌঢ়ের কাছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের দ্বিখণ্ডন মেনে নেয়া কঠিন ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে কিংবা ছয় দফার কোথাও এই স্বাধীনতার কথা উল্লেখ ছিল না। ছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও অঙ্গীকার, ৭ই মার্চের ভাষণটিও শেষ হয়েছিল জয় পাকিস্তান শব্দ দিয়ে।
এই বিভাজকরা একশ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লাঠিয়াল তৈরি করে সব ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণার পথ রুদ্ধ করে রেখেছে। কাজেই শারমিন আহমদ কিংবা এ কে খন্দকার যে-ই সত্য কথা বলবে সে-ই তাদের তোপের মুখে পড়বে। এ ধরনের সত্য কথা উচ্চারণ করলে রৌর নামক নরকের মতো কোনো নরকে পাঠিয়ে দেয়ার আবহ সৃষ্টি করে ফেলে।
সাম্প্রতিক সময়ে স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে স্কটল্যান্ডের গণভোট আমাদের চোখটি কিছুটা খুলতে পেরেছে কি না জানি না। স্কটল্যান্ডের গত রেফারেন্ডামে ৪৫ ভাগ মানুষ স্বাধীনতার পে ভোট দিয়েছে। অন্য দিকে বাকি ৫৫ ভাগ মানুষ এর বিরোধিতা করেছে। এতে করে এই পঞ্চান্ন ভাগ লোকের সবাই দেশদ্রোহী বা রাজাকার হয়ে পড়েনি।
এখানে এক পরে রাজনৈতিক বিজয় অন্য পকে জনমের তরে দেশদ্রোহী বা রাজাকার বানিয়ে ফেলেনি। যারা স্বাধীনতা চেয়েছে এবং যারা চায়নি তাদের উভয় গ্রুপই দেশপ্রেমিক হিসেবেই থেকে গেছে। এই যুক্তিটি ইউরোপ আমেরিকার জন্য খাটলেও আমাদের দেশের জন্যে খাটবে না। আমাদের দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লাঠিয়ালরা কখনোই তা মেনে নেবেন না।
আমরা দেখলাম স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার আকাক্সাটি কিভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। মূল কারণ এটি নয় যে তারা আমাদের মতো বজ্রকণ্ঠের একজন শেখ মুজিব পাননি। মূল কারণ হলো তারা প্রতিপ শিবিরে ভুট্টোর মতো মাথামোটা কিংবা ইয়াহিয়ার মতো হাঁটুতে বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো নেতা পাননি।
ইয়াহিয়া-ভুট্টো ছাড়াও হতভাগা স্কটল্যান্ডবাসী ইন্দিরা গান্ধীর মতো একজন দরদি প্রতিবেশী পায়নি যে স্কটল্যান্ডবাসীর স্বাধীনতার আকাক্সাকে তার নিজের দেশের জন্য শতাব্দীর সেরা (Opportunity of the Century) সুযোগ হিসেবে গণ্য করতে পারে। আমাদের মতো কোনো শাহরিয়ার কবীর, মুনতাসীর মামুন ও জাফর ইকবাল এই হতভাগা স্কটল্যান্ডবাসীর কপালে জোটেনি যারা সারাণ এই স্বাধীনতাবিরোধীদের কথা জাতিকে স্মরণ করিয়ে প্রগতির মশালটি জ্বালিয়ে রাখবেন।
স্কটল্যান্ডের বেশির ভাগ মানুষ স্বাধীনতার আবেগের চেয়ে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। একই ধরনের চিন্তাভাবনা ৭ মার্চে পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত শেখ মুজিবুর রহমান করে থাকলে তা তার জন্য অন্যায় বা অপরাধ কিছু ছিল না; কিন্তু সমস্যা হলো ইতিহাসের এই অমোঘ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়লে সিঙ্গেল ইউনিটের চমৎকার এই জাতিরাষ্ট্রটিকে দুই ভাগ করার দায়িত্ব যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লাঠিয়ালদের ওপর চেপেছে তারা বেকায়দায় পড়ে যাবেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর প্রফেসর গোলাম আযম এই দু’জন রাজনীতিবিদের মধ্যে এ েেত্র পার্থক্য হলো প্রথমজন ২৫ মার্চ পর্যন্ত আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন ‘জয় পাকিস্তান’-এর অখণ্ডতা বজায় রাখতে। আর দ্বিতীয়জন এই প্রচেষ্টা আরেকটু দীর্ঘ সময় অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছিলেন। পরবর্তী ইতিহাস যা-ই হোক, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় দু’জনের চিন্তায় এখানে কোনো ফারাক ছিল না।
কাজেই ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেছিলেন এ কথা লিখে এ কে খন্দকার বুঝতে পারেননি যে কোন ভীমরুলের চাকে তিনি ঢিলটি ছুড়ে ফেলেছেন। কারণ নতুন প্রজন্ম এ ইতিহাসটি জেনে গেলে তিলে তিলে গড়া বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লাঠিয়ালদের তৈরি সব ঘৃণার মেশিন ‘আউট অব সার্ভিস’ হয়ে পড়বে।
কাজেই জাতিকে বিভাজনের এই কৌশল বা রোডম্যাপটি অনেক সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও সাধনার ফসল। আমরা শুধু সেই রোডম্যাপ ধরে হেঁটে চলছি। কেউ হাঁটছি বুঝে, কেউ হাঁটছি না বুঝে।
গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবাইকে উদারতা দিতে পারেনি। কারো কারো মনে ইনফেরিয়র কমপ্লেক্স (সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের বাস্তবরূপ) গেঁথে দিয়েছে। এ হীনম্মন্যতার একটা ঐতিহাসিক কারণ বা প্রোপট নুরুল কবির একটি টিভি আলোচনায় উল্লেখ করেছেন। তার মতে, মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করলেও যারা যুদ্ধ করতে পারেননি সেই মুজিব বাহিনীর সন্তানরাই মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড নামে সে দিন শহীদ মিনারে জমায়েত হয়েছিল। মুজিব বাহিনী পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার সুযোগ না পেলেও বেশ কয়েক জায়গায় মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল। নুরুল কবির তার কোনো ােভ থেকে এই গরল উদ্গিরণ করেননি। তিনি কোনো নতুন ইতিহাস রচনা করেননি। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করা পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তির বই থেকেই তিনি এসব তথ্য উদ্ধৃত করেছেন। যেসব কথা এত দিন ছাপার অরে বন্দী হয়েছিল আজ কিছুসংখ্যক মানুষের সাহসী উচ্চারণে দেশের মানুষ তা নতুন করে জানতে পারছে।
অনেক বামপন্থী গ্রুপ যাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারে তজ্জন্য চেতনার এই লাঠিয়াল বাহিনী কাজ করেছে বলেও জনাব কবির উল্লেখ করেছেন। কাজেই কিছু বাম ও পুরো ডানপন্থী গ্রুপগুলো যে এভাবে জনমের তরে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হবেন, তা অনেক আগেই সেট করা হয়েছিল; অর্থাৎ রাজাকার তাদের হতেই হতো।
মওলানা ভাসানীকেও যুদ্ধের পুরো সময় অনেকটা বন্দী করে রাখা হয়েছিল। জাতির যে বিভাজন নিয়ে আমরা বিলাপ করছি সেই বিভাজকদের চিনতে এসব ইতিহাস আমাদের স্মরণে রাখতে হবে।
শহীদ মিনারে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে সরকার সমর্থক কয়েকটি সংগঠন। এসব বিশিষ্ট ব্যক্তি সরকারকে ছেঁচেছেন বা তুলোধোনো করেছেন তাদের ুরধার যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে। প্রকারান্তরে সরকার এদেরকে ছেঁচতে চাচ্ছেন রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে। কৌশলগত কারণে তা সম্ভব না হলে বিভিন্ন রঙের শাহবাগিদের লেলিয়ে দিয়েছে।
শাহবাগিদের কিছু চিহ্নিত স্বপ্নপুরুষ পেছনে থাকলেও ব্যানার নিয়ে সামনে এগিয়ে এসেছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড, গণজাগরণ মঞ্চের একাংশ, মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক প্লাাটুন, সিপি গ্যাং প্রভৃতি। তারা কেবল মরহুম অধ্যাপক পিয়াস করিম ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা কুৎসা রটিয়েই ান্ত হয়নি, নয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তির ছবিতে কাঁটা চিহ্নযুক্ত ব্যানার টানিয়ে তাদের শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। এই বিভাজকদের ঠিকভাবে চিনতে হলে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।
জাতি বিভাজকেরা আমাদের সংস্কৃতি ও বিনোদন জগৎটিকে কব্জা করে নিয়েছে। মূলত স্বাধীনতার পর থেকেই এই গোষ্ঠীটি সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে কিছু ঘৃণা উৎপাদনের মেশিন সৃষ্টি করেছে। এসব উৎপাদিত ঘৃণার ওপরে সুন্দরভাবে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রলেপ মাখানো হয়েছে। এভাবে একক জাতিসত্তার এ চমৎকার জাতিরাষ্ট্রটিকে অনেকটা সার্থকভাবেই বিভাজিত করতে পেরেছে।
এগুলো নিয়ে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে কোনো গবেষণা করাও নিরাপদ নয়। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা, ঐতিহাসিক প্রোপট সব কিছুকে একপাশে রেখে অন্ধ আবেগ ও আক্রোশকে নান্দনিকতার ক্যাপসুলে ভরে পরিবেশন করা হয়েছে।
১৯৪৭ সালের আগে এই ভূখণ্ডের মানুষ একটি একক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা ধারণ করলেও আজ তা অনেক খণ্ডে ভাগ হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য উপকরণ হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আমাদের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টিতে ধর্মের একটা বিশেষ প্রেরণা বা ভূমিকা রয়েছে। কাজেই এর বাইরে গিয়ে কখনোই জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হবে না। তজ্জন্য মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিপ বানানো হবে একটা ঐতিহাসিক ভুল।
আজকের ধর্মনিরপে আওয়ামী লীগের শুরু হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে। এই দলের প্রাণপুরুষ তরুণ শেখ মুজিব চল্লিশের দশকে অনেক দাঙ্গায় সশরীরে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৭৪ সালে ইন্ডিয়ার চোখরাঙানিকে অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু ওআইসির সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ভুট্টোকে এ দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু যাকে বিশেষ দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি স্বয়ং শাহ আজিজুর রহমান। ভুট্টোকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে বঙ্গবন্ধুর পাশে শাহ আজিজের ছবি রয়েছে, অর্থাৎ তার দেখানো পথেই প্রেসিডেন্ট জিয়া দেশের এই অনন্য মেধাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। নতুন প্রজন্ম এই ইতিহাস না জেনে মুনতাসীর মামুনদের ফ্যান্টাসি ও জাতিকে বিভক্তকারী ইতিহাস শিখে বড় হচ্ছে।
জাতিকে দ্বিখণ্ডিত করার পরিণাম বঙ্গবন্ধুই উপলব্ধি করেছিলেন। তিনিই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সাধারণ মা ঘোষণা করে গেছেন। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভিসনারি রাষ্ট্রনায়ক প্রেসিডেন্ট জিয়া জাতিকে এক করার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে এগিয়ে গেছেন। ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীকে ‘মুরগি সরবরাহকারী’ শাহরিয়ার কবিরদের কাছে জিয়া এখন বড় অপরাধী।
১৯৯৬ সালে এই আওয়ামী লীগ জামায়াতের সাথেই একসাথে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, এক মঞ্চে বসেছে। তার পর যখনই ২০০১ সালে বিএনপির সাথে জোট হলো এবং তাদের জন্য এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো তখনই নতুন করে চেতনার হাড় কড়মড়ে রোগটি মাথাচাড়া দিয়েছে। চেতনার নাম দিয়ে জাতির সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে।
আমরা রুয়ান্ডা নামক দেশটির কথা হয়তো ভুলিনি। ১৯৯৪ সালে জাতিগত দ্বন্দ্বে মাত্র কয়েক দিনের গৃহযুদ্ধে বারো লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। হুতো এক্সট্রিমিস্টরা নিজেদের সম্প্রদায়ের প্রেসিডেন্টকে নিজেরাই হত্যা করে; কিন্তু সেই দোষ চাপায় তুতসিদের ঘাড়ে। এভাবে গণহত্যার পটভূমির জন্য প্রয়োজনীয় ঘৃণা ও আক্রোশটি তৈরি করে। পরের ইতিহাস সবার জানা। এই গণহত্যার পর রুয়ান্ডা নদীর পানি আরিক অর্থেই লাল হয়ে পড়ে।
এখন এই দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন তুতসি সম্প্রদায়ের পল কাগামে। পরপর তিন টার্মে তিনি এই পদে আছেন। তিনি নিজেও তুতসি সম্প্রদায়ের একজন সাবেক রেবেল লিডার। নিজের সম্প্রদায়কে কচু কাটা করার প্রতিশোধ তিনি সহজেই নিতে পারেন। প্রত্যেক ভুক্তভোগী পরিবার তাদের প্রিয়জনদের হত্যাকারীদের আশপাশেই দেখতে পান। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার নামেও তিনি সেই গণহত্যার বিচার শুরু করতে পারেন; কিন্তু তা না করে প্রেসিডেন্ট পল কাগামে করছেন পুরো নব্য রাজাকারের কাজ।
জাতিগত বিদ্বেষ ও অনৈক্য বন্ধের জন্য কিছু কঠিন পদপে গ্রহণ করেছেন। হুতো তুতসিদের মধ্যকার সেই কনফিক্ট নিয়ে কথা বললেই এখন ছয় মাসের জেল ঘোষণা করছেন। ফলে ল্যান্ড লক্ড রুয়ান্ডা বেশ দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও আশপাশের যে কোনো দেশের চেয়েও উন্নত। বলা হয় আফ্রিকায় দুর্নীতিমুক্ত দেশের তালিকায় রুয়ান্ডা এখন শীর্ষে অবস্থান করছে। জানি না এদের মতো করে আমাদের হুঁশটি কখন ফিরে আসবে? কখন আমরা এই বিভাজকদের হাত থেকে আসলেই মুক্তি পাবো?
minarrashid@yahoo.com
এখানে মুশকিল হলো, এই সর্বনাশা বিভাজনটি জাতির জটিল রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এই রোগ সারাতে খালেস নিয়তে যে চিকিৎসকই এগিয়ে আসেন এই বিভাজকদের খপ্পরে পড়ে তিনিও একজন রোগী হিসেবেই প্রতিপন্ন হন। ড. পিয়াস করিম এই মেকানিজমের সর্বশেষ শিকার। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ড. আকবর আলি খানগণ এখানে চিকিৎসক হিসেবে এগিয়ে এলে তাদেরকেও এই বিভাজনের একটি প হিসেবে তুলে ধরে তাদের প্রচেষ্টাকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হবে।
কারণ এই বিভাজকেরা সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আর্থিকভাবে খুবই শক্তিশালী। দেশের ভেতরের একটা শ্রেণীর অন্ধ আবেগ বা ক্রোধকে সুকৌশলে ব্যবহার করা হলেও এর পেছনে রয়েছে একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। কখনো শাহবাগি কখনো ঘাদানিক পরিচয় ধারণ করলেও মূল নিয়ন্ত্রণ একটি কমান্ড সেন্টার থেকেই পরিচালনা করা হয়।
একটি জাতির বিভাজন শুরু হয় যখন একটি গ্রুপ কোনো কারণে নিজেদেরকে অন্যদের তুলনায় ব্রাহ্মণ বা আশরাফ (শ্রেষ্ঠতর বা সুপিরিয়র) ভাবতে শুরু করে। বলতে দ্বিধা নেই যে, এই বিভাজন সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় দার্শনিক বা আদর্শিক রসটি আহরণ করা হয়েছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
ফুল থেকে মৌমাছি আহরণ করে মধু আর মাকড়সা আহরণ করে বিষ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থেকেও শাহবাগি এবং তাদের পূর্বতন দোসররা আহরণ করেছে ঘৃণার বিষ। মুক্তিযুদ্ধকে জাতির ঐক্য ও সমৃদ্ধির পথে কাজে না লাগিয়ে এসব মাকড়সা জাতিকে বিভক্ত করে আজ সত্যি সত্যি ধ্বংসের প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। এরা আজ আমাদের আদালত, শিালয়, প্রশাসন ও সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ফেলেছে।
আবহমান কাল ধরে এই বঙ্গীয় পলিমাটির রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় উপকরণ দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সিঙ্গেল ইউনিট বা একক জাতিসত্তার এই চমৎকার রাষ্ট্র। পরপর দু’বারের স্বাধীনতায় কিছু ঐতিহাসিক ভুল সংশোধিত হয়ে এই জাতি রাষ্ট্রটি আরো বিশুদ্ধ হয়েছে। এটা এমন এক চমৎকার জাতিরাষ্ট্র যেখানে দিনাজপুরের এক ছেলে কক্সবাজারের এক মেয়েকে অনায়াসেই বিয়ে করতে পারে এবং দু’টি অপরিচিত পরিবার সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে সম্পূর্ণরূপে মিশে যেতে পারে। একটা রাষ্ট্রের জন্য বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান উপাদান।
এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে একক জাতিসত্তা নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রটি উন্নত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। সেটা হয়ে গেলে জাতপাতের কঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ ও বিভিন্ন জাতিসত্তার জটিল কনফিক্টে ত-বিত কোনো কোনো প্রতিবেশীর জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। কাজেই এই সর্বনাশা বিভাজনে শুধু আমাদের অভ্যন্তরীণ রাগ, ােভ, হতাশা ও বোকামি কাজ করছে তা নয়Ñ বাইরের কিছু প্রভাবক বা উৎসাহও স্পষ্টতই কাজ করে যাচ্ছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি রাজনৈতিক ইস্যু কিংবা সামরিক কনফিক্ট খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে একটি ভূখণ্ডের সব মানুষ তাতে একমত হতে পেরেছে কিংবা কোনো সামরিক কনফিক্টের সময় সম্পূর্ণরূপে এক পে অবস্থান নিতে সম হয়েছে। বিশেষ করে যেখানে ১৯৪৭ সালে একবার স্বাধীনতা পাওয়ার পরও ১৯৭১-এ আবার স্বাধীনতার প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়। ১৯৪৭ সালে যে যুবক পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছেন সেই একই প্রৌঢ়ের কাছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের দ্বিখণ্ডন মেনে নেয়া কঠিন ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে কিংবা ছয় দফার কোথাও এই স্বাধীনতার কথা উল্লেখ ছিল না। ছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও অঙ্গীকার, ৭ই মার্চের ভাষণটিও শেষ হয়েছিল জয় পাকিস্তান শব্দ দিয়ে।
এই বিভাজকরা একশ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লাঠিয়াল তৈরি করে সব ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণার পথ রুদ্ধ করে রেখেছে। কাজেই শারমিন আহমদ কিংবা এ কে খন্দকার যে-ই সত্য কথা বলবে সে-ই তাদের তোপের মুখে পড়বে। এ ধরনের সত্য কথা উচ্চারণ করলে রৌর নামক নরকের মতো কোনো নরকে পাঠিয়ে দেয়ার আবহ সৃষ্টি করে ফেলে।
সাম্প্রতিক সময়ে স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে স্কটল্যান্ডের গণভোট আমাদের চোখটি কিছুটা খুলতে পেরেছে কি না জানি না। স্কটল্যান্ডের গত রেফারেন্ডামে ৪৫ ভাগ মানুষ স্বাধীনতার পে ভোট দিয়েছে। অন্য দিকে বাকি ৫৫ ভাগ মানুষ এর বিরোধিতা করেছে। এতে করে এই পঞ্চান্ন ভাগ লোকের সবাই দেশদ্রোহী বা রাজাকার হয়ে পড়েনি।
এখানে এক পরে রাজনৈতিক বিজয় অন্য পকে জনমের তরে দেশদ্রোহী বা রাজাকার বানিয়ে ফেলেনি। যারা স্বাধীনতা চেয়েছে এবং যারা চায়নি তাদের উভয় গ্রুপই দেশপ্রেমিক হিসেবেই থেকে গেছে। এই যুক্তিটি ইউরোপ আমেরিকার জন্য খাটলেও আমাদের দেশের জন্যে খাটবে না। আমাদের দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লাঠিয়ালরা কখনোই তা মেনে নেবেন না।
আমরা দেখলাম স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার আকাক্সাটি কিভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। মূল কারণ এটি নয় যে তারা আমাদের মতো বজ্রকণ্ঠের একজন শেখ মুজিব পাননি। মূল কারণ হলো তারা প্রতিপ শিবিরে ভুট্টোর মতো মাথামোটা কিংবা ইয়াহিয়ার মতো হাঁটুতে বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো নেতা পাননি।
ইয়াহিয়া-ভুট্টো ছাড়াও হতভাগা স্কটল্যান্ডবাসী ইন্দিরা গান্ধীর মতো একজন দরদি প্রতিবেশী পায়নি যে স্কটল্যান্ডবাসীর স্বাধীনতার আকাক্সাকে তার নিজের দেশের জন্য শতাব্দীর সেরা (Opportunity of the Century) সুযোগ হিসেবে গণ্য করতে পারে। আমাদের মতো কোনো শাহরিয়ার কবীর, মুনতাসীর মামুন ও জাফর ইকবাল এই হতভাগা স্কটল্যান্ডবাসীর কপালে জোটেনি যারা সারাণ এই স্বাধীনতাবিরোধীদের কথা জাতিকে স্মরণ করিয়ে প্রগতির মশালটি জ্বালিয়ে রাখবেন।
স্কটল্যান্ডের বেশির ভাগ মানুষ স্বাধীনতার আবেগের চেয়ে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। একই ধরনের চিন্তাভাবনা ৭ মার্চে পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত শেখ মুজিবুর রহমান করে থাকলে তা তার জন্য অন্যায় বা অপরাধ কিছু ছিল না; কিন্তু সমস্যা হলো ইতিহাসের এই অমোঘ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়লে সিঙ্গেল ইউনিটের চমৎকার এই জাতিরাষ্ট্রটিকে দুই ভাগ করার দায়িত্ব যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লাঠিয়ালদের ওপর চেপেছে তারা বেকায়দায় পড়ে যাবেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর প্রফেসর গোলাম আযম এই দু’জন রাজনীতিবিদের মধ্যে এ েেত্র পার্থক্য হলো প্রথমজন ২৫ মার্চ পর্যন্ত আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন ‘জয় পাকিস্তান’-এর অখণ্ডতা বজায় রাখতে। আর দ্বিতীয়জন এই প্রচেষ্টা আরেকটু দীর্ঘ সময় অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছিলেন। পরবর্তী ইতিহাস যা-ই হোক, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় দু’জনের চিন্তায় এখানে কোনো ফারাক ছিল না।
কাজেই ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেছিলেন এ কথা লিখে এ কে খন্দকার বুঝতে পারেননি যে কোন ভীমরুলের চাকে তিনি ঢিলটি ছুড়ে ফেলেছেন। কারণ নতুন প্রজন্ম এ ইতিহাসটি জেনে গেলে তিলে তিলে গড়া বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লাঠিয়ালদের তৈরি সব ঘৃণার মেশিন ‘আউট অব সার্ভিস’ হয়ে পড়বে।
কাজেই জাতিকে বিভাজনের এই কৌশল বা রোডম্যাপটি অনেক সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও সাধনার ফসল। আমরা শুধু সেই রোডম্যাপ ধরে হেঁটে চলছি। কেউ হাঁটছি বুঝে, কেউ হাঁটছি না বুঝে।
গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবাইকে উদারতা দিতে পারেনি। কারো কারো মনে ইনফেরিয়র কমপ্লেক্স (সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের বাস্তবরূপ) গেঁথে দিয়েছে। এ হীনম্মন্যতার একটা ঐতিহাসিক কারণ বা প্রোপট নুরুল কবির একটি টিভি আলোচনায় উল্লেখ করেছেন। তার মতে, মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করলেও যারা যুদ্ধ করতে পারেননি সেই মুজিব বাহিনীর সন্তানরাই মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড নামে সে দিন শহীদ মিনারে জমায়েত হয়েছিল। মুজিব বাহিনী পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার সুযোগ না পেলেও বেশ কয়েক জায়গায় মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল। নুরুল কবির তার কোনো ােভ থেকে এই গরল উদ্গিরণ করেননি। তিনি কোনো নতুন ইতিহাস রচনা করেননি। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করা পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তির বই থেকেই তিনি এসব তথ্য উদ্ধৃত করেছেন। যেসব কথা এত দিন ছাপার অরে বন্দী হয়েছিল আজ কিছুসংখ্যক মানুষের সাহসী উচ্চারণে দেশের মানুষ তা নতুন করে জানতে পারছে।
অনেক বামপন্থী গ্রুপ যাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারে তজ্জন্য চেতনার এই লাঠিয়াল বাহিনী কাজ করেছে বলেও জনাব কবির উল্লেখ করেছেন। কাজেই কিছু বাম ও পুরো ডানপন্থী গ্রুপগুলো যে এভাবে জনমের তরে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হবেন, তা অনেক আগেই সেট করা হয়েছিল; অর্থাৎ রাজাকার তাদের হতেই হতো।
মওলানা ভাসানীকেও যুদ্ধের পুরো সময় অনেকটা বন্দী করে রাখা হয়েছিল। জাতির যে বিভাজন নিয়ে আমরা বিলাপ করছি সেই বিভাজকদের চিনতে এসব ইতিহাস আমাদের স্মরণে রাখতে হবে।
শহীদ মিনারে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে সরকার সমর্থক কয়েকটি সংগঠন। এসব বিশিষ্ট ব্যক্তি সরকারকে ছেঁচেছেন বা তুলোধোনো করেছেন তাদের ুরধার যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে। প্রকারান্তরে সরকার এদেরকে ছেঁচতে চাচ্ছেন রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে। কৌশলগত কারণে তা সম্ভব না হলে বিভিন্ন রঙের শাহবাগিদের লেলিয়ে দিয়েছে।
শাহবাগিদের কিছু চিহ্নিত স্বপ্নপুরুষ পেছনে থাকলেও ব্যানার নিয়ে সামনে এগিয়ে এসেছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড, গণজাগরণ মঞ্চের একাংশ, মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক প্লাাটুন, সিপি গ্যাং প্রভৃতি। তারা কেবল মরহুম অধ্যাপক পিয়াস করিম ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা কুৎসা রটিয়েই ান্ত হয়নি, নয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তির ছবিতে কাঁটা চিহ্নযুক্ত ব্যানার টানিয়ে তাদের শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। এই বিভাজকদের ঠিকভাবে চিনতে হলে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।
জাতি বিভাজকেরা আমাদের সংস্কৃতি ও বিনোদন জগৎটিকে কব্জা করে নিয়েছে। মূলত স্বাধীনতার পর থেকেই এই গোষ্ঠীটি সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে কিছু ঘৃণা উৎপাদনের মেশিন সৃষ্টি করেছে। এসব উৎপাদিত ঘৃণার ওপরে সুন্দরভাবে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রলেপ মাখানো হয়েছে। এভাবে একক জাতিসত্তার এ চমৎকার জাতিরাষ্ট্রটিকে অনেকটা সার্থকভাবেই বিভাজিত করতে পেরেছে।
এগুলো নিয়ে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে কোনো গবেষণা করাও নিরাপদ নয়। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা, ঐতিহাসিক প্রোপট সব কিছুকে একপাশে রেখে অন্ধ আবেগ ও আক্রোশকে নান্দনিকতার ক্যাপসুলে ভরে পরিবেশন করা হয়েছে।
১৯৪৭ সালের আগে এই ভূখণ্ডের মানুষ একটি একক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা ধারণ করলেও আজ তা অনেক খণ্ডে ভাগ হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য উপকরণ হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আমাদের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টিতে ধর্মের একটা বিশেষ প্রেরণা বা ভূমিকা রয়েছে। কাজেই এর বাইরে গিয়ে কখনোই জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হবে না। তজ্জন্য মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিপ বানানো হবে একটা ঐতিহাসিক ভুল।
আজকের ধর্মনিরপে আওয়ামী লীগের শুরু হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে। এই দলের প্রাণপুরুষ তরুণ শেখ মুজিব চল্লিশের দশকে অনেক দাঙ্গায় সশরীরে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৭৪ সালে ইন্ডিয়ার চোখরাঙানিকে অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু ওআইসির সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ভুট্টোকে এ দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু যাকে বিশেষ দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি স্বয়ং শাহ আজিজুর রহমান। ভুট্টোকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে বঙ্গবন্ধুর পাশে শাহ আজিজের ছবি রয়েছে, অর্থাৎ তার দেখানো পথেই প্রেসিডেন্ট জিয়া দেশের এই অনন্য মেধাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। নতুন প্রজন্ম এই ইতিহাস না জেনে মুনতাসীর মামুনদের ফ্যান্টাসি ও জাতিকে বিভক্তকারী ইতিহাস শিখে বড় হচ্ছে।
জাতিকে দ্বিখণ্ডিত করার পরিণাম বঙ্গবন্ধুই উপলব্ধি করেছিলেন। তিনিই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সাধারণ মা ঘোষণা করে গেছেন। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভিসনারি রাষ্ট্রনায়ক প্রেসিডেন্ট জিয়া জাতিকে এক করার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে এগিয়ে গেছেন। ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীকে ‘মুরগি সরবরাহকারী’ শাহরিয়ার কবিরদের কাছে জিয়া এখন বড় অপরাধী।
১৯৯৬ সালে এই আওয়ামী লীগ জামায়াতের সাথেই একসাথে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, এক মঞ্চে বসেছে। তার পর যখনই ২০০১ সালে বিএনপির সাথে জোট হলো এবং তাদের জন্য এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো তখনই নতুন করে চেতনার হাড় কড়মড়ে রোগটি মাথাচাড়া দিয়েছে। চেতনার নাম দিয়ে জাতির সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে।
আমরা রুয়ান্ডা নামক দেশটির কথা হয়তো ভুলিনি। ১৯৯৪ সালে জাতিগত দ্বন্দ্বে মাত্র কয়েক দিনের গৃহযুদ্ধে বারো লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। হুতো এক্সট্রিমিস্টরা নিজেদের সম্প্রদায়ের প্রেসিডেন্টকে নিজেরাই হত্যা করে; কিন্তু সেই দোষ চাপায় তুতসিদের ঘাড়ে। এভাবে গণহত্যার পটভূমির জন্য প্রয়োজনীয় ঘৃণা ও আক্রোশটি তৈরি করে। পরের ইতিহাস সবার জানা। এই গণহত্যার পর রুয়ান্ডা নদীর পানি আরিক অর্থেই লাল হয়ে পড়ে।
এখন এই দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন তুতসি সম্প্রদায়ের পল কাগামে। পরপর তিন টার্মে তিনি এই পদে আছেন। তিনি নিজেও তুতসি সম্প্রদায়ের একজন সাবেক রেবেল লিডার। নিজের সম্প্রদায়কে কচু কাটা করার প্রতিশোধ তিনি সহজেই নিতে পারেন। প্রত্যেক ভুক্তভোগী পরিবার তাদের প্রিয়জনদের হত্যাকারীদের আশপাশেই দেখতে পান। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার নামেও তিনি সেই গণহত্যার বিচার শুরু করতে পারেন; কিন্তু তা না করে প্রেসিডেন্ট পল কাগামে করছেন পুরো নব্য রাজাকারের কাজ।
জাতিগত বিদ্বেষ ও অনৈক্য বন্ধের জন্য কিছু কঠিন পদপে গ্রহণ করেছেন। হুতো তুতসিদের মধ্যকার সেই কনফিক্ট নিয়ে কথা বললেই এখন ছয় মাসের জেল ঘোষণা করছেন। ফলে ল্যান্ড লক্ড রুয়ান্ডা বেশ দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও আশপাশের যে কোনো দেশের চেয়েও উন্নত। বলা হয় আফ্রিকায় দুর্নীতিমুক্ত দেশের তালিকায় রুয়ান্ডা এখন শীর্ষে অবস্থান করছে। জানি না এদের মতো করে আমাদের হুঁশটি কখন ফিরে আসবে? কখন আমরা এই বিভাজকদের হাত থেকে আসলেই মুক্তি পাবো?
minarrashid@yahoo.com
No comments