জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ‘পরিত্যক্ত’ গণজাগরণ মঞ্চ by সোহরাব হাসান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরকালে গালফ নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী গত ৬০ বছরে উপমহাদেশে উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক অবস্থান করতে পারেনি। আমি মনে করি না দলটি এখানে এমন কোনো শক্ত ভিত গাড়তে পারবে, যা নিরাপত্তা-ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে।’ তাঁর মতে, ‘যদি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, পয়োনিষ্কাশন, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও জনগণের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেন, তাহলে বাইরের ও ভেতরের কোনো শক্তিই আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।’ একই সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উল্লেখ করে বলেন, দেশে এখন উদারপন্থীদেরই আধিপত্য রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করে নিলেন, জনগণের কল্যাণে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর নেতাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা প্রয়োজন। কেননা, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কিংবা মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইটা সম্মিলিতভাবেই করতে হবে। অতিসম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণে জেএমবি সদস্যদের হতাহত হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে যত বিভেদই থাকুক না কেন, জঙ্গিরা ঐক্যবদ্ধ। এক দেশের জঙ্গিরা অপর দেশে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ে, মানুষ হত্যা করে, স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে ধর্মীয় চরমপন্থী ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত লড়াইয়ে তাঁর সরকারের যে সাফল্য দাবি করেছেন, চারদলীয় জোট আমলের সঙ্গে তুলনা করলে তার সঙ্গে কেউ দ্বিমত করবেন না। কিন্তু এই সাফল্য কতটা স্থায়ী? জঙ্গি সমস্যাটি কেবল আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয় যে শুধু সেনা, পুলিশ, র্যাব কিংবা বিজিবি দিয়ে এদের নির্মূল করা যাবে। সমস্যাটি রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। জঙ্গিরা যে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ ধরনের প্রাণঘাতী ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তাকে পরাস্ত করতে হবে আধুনিক ও মানবতাবাদী চিন্তা দিয়ে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সংহত করে।
গত দুই দশকে বাংলাদেশে ডজন ডজন জঙ্গি সংগঠনের উদ্ভব ঘটেছে। এই জঙ্গিদের কেউ কেউ আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণ নিয়েছে, কেউ বা পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশে ওহাবিবাদী দীক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে তা চালু করতে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে। তাদের সাংগঠনিক শক্তি যত দুর্বলই হোক না কেন, অর্থশক্তিতে তারা মোটেই দুর্বল নয়। জঙ্গিবাদীদের শক্তির উৎস ধর্মান্ধতা বা অন্ধকার চিন্তাধারা; সেই চিন্তার জোর এতই বেশি যে কেবল বাংলাদেশ বা উপমহাদেশ নয়, ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোতেও নতুন নতুন জঙ্গিবাদী সংগঠন গড়ে উঠেছে, সেসব দেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গিরা অন্যত্র গিয়ে জিহাদে যোগ দিচ্ছে। তাই অর্থনৈতিক কারণেই সুবিধাবঞ্চিত তরুণেরা জঙ্গি হয়ে যাচ্ছেন, এই যুক্তি ধোপে টেকে না। দারিদ্র্য বা অর্থনৈতিক বৈষম্য মৌলবাদী জঙ্গিবাদ উত্থানের একটি কারণ। আরও যেসব কারণে জঙ্গিবাদ একটি সমাজে ভিত গাড়ে, তা হলো গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক সংঘাত। সমাজে যখন নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়, যখন বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শ্রেণির মধ্যে হানাহানি বেড়ে যায়, তখন জঙ্গিবাদীরা সহজেই সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝাতে সক্ষম হয়।
এর প্রতিকার হতে পারত একটি টেকসই গণতান্ত্রিক কাঠামো, যেখানে শ্রেণি-পেশা, ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে সবাই নিজের মত প্রকাশ এবং সমাজে ও রাষ্ট্রে নিজের ভূমিকা রাখার সুযোগ পেতেন। গত ৪৩ বছরে বাংলাদেশের শাসকেরা সেই জায়গাটি করে দেননি। সবকিছু নিজেদের দখলে নিতে সচেষ্ট থেকেছেন, এখনো আছেন।
গণতন্ত্র বলতে যদি আমরা গণের বা জনগণের শাসন বুঝি, সেটা এই বাংলাদেশে কখনোই ছিল না, এখনো নেই। যে রাষ্ট্রে বা দেশের প্রধান দুটি দল একে অন্যের ধ্বংসের মধ্যে নিজেদের সাফল্য দেখে, সেই দেশে গণতন্ত্র ও মানুষের মৌলিক মানবাধিকার মোটেই নিরাপদ থাকতে পারে না। নাগরিক সমাজকেও তারা এ-দলে ও-দলে ভাগ করে নিজেদের শক্তি বাড়াতে সচেষ্ট। গণতন্ত্রের জন্য জরুরি যে ভিন্নমত, সেটা তারা একেবারেই শুনতে চায় না। তারা গণতন্ত্রের কথা মুখে বলে, কিন্তু নিজেদের ব্যক্তি আচরণে গণতন্ত্রকে স্বীকার করে না।
বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক সরকারের আমলে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে আমরা গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়ে রাস্তায় নামিয়েছি, কেউ নূর হোসেনের মতো গুলিতে নিহত হয়েছেন। তাজুলের মতো জীবন দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখে গিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন আজও বাস্তবায়িত হয়নি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শহীদ নূর হোসেন-তাজুলদের কথা আমরা ভুলে গেছি, যে রাজনৈতিক দলটির কর্মী ছিলেন নূর হোসেন, তারাও ভুলে গেছে, তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করছে নারায়ণগঞ্জের নূর হোসেনেরা।
গণতন্ত্র ও জঙ্গিবাদ যেমন একসঙ্গে চলতে পারে না, তেমনি সাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রও একসঙ্গে চলতে পারে না। আমরা যদি বাংলাদেশকে ন্যূনতম একটি গণতান্ত্রিক ও আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই; সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব গোত্রের মানুষের মৌলিক অধিকার স্বীকার করতে হবে। কিন্তু আমাদের শাসকগোষ্ঠী তাদের অধিকার স্বীকার না করে বরাবর অধিকার হরণ করতেই অভ্যস্ত। এ কারণেই আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা দৌড়ের ওপর থাকেন এবং বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা৷ আর আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলেমিশে তাদের সমর্থক-অনুরাগী বাদে অন্যদের দৌড়ের ওপর রাখতে ভালোবাসে। এ কারণে বাংলাদেশে চার দশক ধরে যে গণতন্ত্র চলছে, তাকে দৌড় গণতন্ত্র নামে অভিহিত করা যায়।
গণতন্ত্র হলো একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি দেশ বা সমাজে বসবাসকারী যথাসম্ভব সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রয়াস চালানো হয়৷ গণতন্ত্র হলো একটি কাঠামো, যাতে সব দল-মতের মানুষ, সব জাতি-ধর্মের মানুষের অধিকার স্বীকৃত হয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে যা চলছে, শতকরা ১ ভাগের গণতন্ত্র, লুটপাটতন্ত্র, বাকি ৯৯ শতাংশের চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য নেই। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, গণতন্ত্র হলো জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণের শাসন। সেটি এখন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ স্টিগলিৎজের ভাষায় পরিণত হয়েছে ‘ফর দি ওয়ান পারসেন্ট, বাই দি ওয়ান পারসেন্ট অ্যান্ড অব দি ওয়ান পারসেন্ট’। বাংলাদেশের সমাজে ৯৯ ভাগ লোকই ১ শতাংশের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ। এই ৯৯ ভাগের মধ্যে আবার যারা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, তারা আরও বেশি নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার। অর্থনীতির ভাষায় এদের রেন্ট সিকার বা রক্তচোষা শ্রেণি বললেও অত্যুক্তি হয় না। অর্থনীতিতে এই বৈষম্যকে বাড়তে দিয়ে বা জিইয়ে রেখে গণতন্ত্র কায়েম করা যায় না।
প্রধানমন্ত্রী ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উপমহাদেশের নেতাদের একযোগে কাজ করার কথা বলেছেন। কিন্তু এই অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেশের ভেতরে রাজনৈতিক ঐক্য প্রয়োজন, সে সম্পর্কে কিছু বলেননি। কিংবা তিনি হয়তো মনে করছেন, যারা সরকারের অংশীদার তারাই মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীকে মোকাবিলা করতে সক্ষম। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে সরকারের বাইরেও মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার অনেক মানুষ ও সংগঠন আছে। তাদের বাদ দিয়ে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদবিরোধী লড়াইয়ে জয়ী হওয়া যাবে না। বিষয়টি ক্ষমতায় যাওয়ার বা থাকার নয়। এর সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। সরকার একদিকে মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ জারি রাখে, আরেক দিকে যে জঙ্গিবাদী-মৌলবাদী রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হয়েছিল, সেই মঞ্চকে কার্যত ‘পরিত্যক্ত’ ঘোষণা করে। এই স্ববিরোধী নীতি নিয়ে মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী রাজনীতিকে মোকাবিলা করা যাবে না। গোঁজামিল দিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা যায়; কিন্তু গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আর প্রধানমন্ত্রী কাদের নিয়ে মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীকে মোকাবিলা করবেন? কাদের নিয়ে সেক্যুলার বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন? হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে, যিনি বাংলাদেশের সংবিধানকে কলঙ্কিত করেছেন, যিনি কথায় কথায় জিহাদের ঘোষণা দেন এবং মানুষের ফাঁসি চান?
জঙ্গিবাদী-মৌলবাদী রাজনীতিকে পরাস্ত করতে পারে দেশের সেই তরুণেরা; যাঁরা এখনো নষ্ট ও ভ্রষ্ট রাজনীতির শিকার হননি। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে যে তরুণেরা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ করতে পারেন, সেই তরুণেরা আধুনিক ও মানবিক বাংলাদেশের অভিযাত্রাও নিশ্চিত করতে পারবেন বলে বিশ্বাস করি। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কোনো নেতা ছিলেন না, কোনো দল ছিল না। এটি ছিল সব শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত, স্বতঃপ্রণোদিত আয়োজন, যা শাহবাগ ছাড়িয়ে গোটা ঢাকা শহরে, ঢাকা ছাড়িয়ে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা মনে করি, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি, কেবল যুদ্ধাপরাধের বিচার নয়, কেবল মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িকতাবাদী রাজনীতির বিরোধিতা নয়, সত্যিকারভাবে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য এই আন্দোলন জারি রাখতে হবে। যেমন, সলিমুল্লাহ খানের ভাষায়, ‘শাহবাগের তরুণ জাতি যদি আবালবৃদ্ধ জাতির বিবেক হইয়া উঠিতে পারে, তো তাকে শতকরা শতভাগ গণতন্ত্রের আওয়াজ তুলিতে হইবে। আর গণতন্ত্রের শব্দের মধ্যেই লুকাইয়া আছে মানুষে মানুষে সমানাধিকার, মানুষের মর্যাদার আর সামাজিক সাম্য ও সংহতির দাবি।’ (ইতিহাসের দায়, গণজাগরণ মঞ্চ, ২০১৪)
গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে আমাদের ভাষা আন্দোলনের কিছুটা মিল লক্ষ করি। ভাষা আন্দোলনেও ব্যক্তি-নেতৃত্ব ছিল না, দলীয় নির্দেশনা ছিল না বরং দলীয় নিষেধাজ্ঞার বাইরে গিয়েই সাধারণ ছাত্র-তরুণেরা এই আন্দোলন সংঘটিত করেছিলেন৷ বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন পরিণতি পেয়েছিল, ভাষা আন্দোলনকেই যদি স্বাধীনতার সূতিকাগার বলা হয়, তাহলে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে বলা যাবে না। তারা এই সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে অন্তত একটি ধাক্কা তো দিতে পেরেছে। বাংলাদেশ হয়তো পরবর্তী ধাক্কার অপেক্ষায় আছে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net
এই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করে নিলেন, জনগণের কল্যাণে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর নেতাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা প্রয়োজন। কেননা, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কিংবা মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইটা সম্মিলিতভাবেই করতে হবে। অতিসম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণে জেএমবি সদস্যদের হতাহত হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে যত বিভেদই থাকুক না কেন, জঙ্গিরা ঐক্যবদ্ধ। এক দেশের জঙ্গিরা অপর দেশে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ে, মানুষ হত্যা করে, স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে ধর্মীয় চরমপন্থী ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত লড়াইয়ে তাঁর সরকারের যে সাফল্য দাবি করেছেন, চারদলীয় জোট আমলের সঙ্গে তুলনা করলে তার সঙ্গে কেউ দ্বিমত করবেন না। কিন্তু এই সাফল্য কতটা স্থায়ী? জঙ্গি সমস্যাটি কেবল আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয় যে শুধু সেনা, পুলিশ, র্যাব কিংবা বিজিবি দিয়ে এদের নির্মূল করা যাবে। সমস্যাটি রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। জঙ্গিরা যে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ ধরনের প্রাণঘাতী ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তাকে পরাস্ত করতে হবে আধুনিক ও মানবতাবাদী চিন্তা দিয়ে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সংহত করে।
গত দুই দশকে বাংলাদেশে ডজন ডজন জঙ্গি সংগঠনের উদ্ভব ঘটেছে। এই জঙ্গিদের কেউ কেউ আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণ নিয়েছে, কেউ বা পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশে ওহাবিবাদী দীক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে তা চালু করতে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে। তাদের সাংগঠনিক শক্তি যত দুর্বলই হোক না কেন, অর্থশক্তিতে তারা মোটেই দুর্বল নয়। জঙ্গিবাদীদের শক্তির উৎস ধর্মান্ধতা বা অন্ধকার চিন্তাধারা; সেই চিন্তার জোর এতই বেশি যে কেবল বাংলাদেশ বা উপমহাদেশ নয়, ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোতেও নতুন নতুন জঙ্গিবাদী সংগঠন গড়ে উঠেছে, সেসব দেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গিরা অন্যত্র গিয়ে জিহাদে যোগ দিচ্ছে। তাই অর্থনৈতিক কারণেই সুবিধাবঞ্চিত তরুণেরা জঙ্গি হয়ে যাচ্ছেন, এই যুক্তি ধোপে টেকে না। দারিদ্র্য বা অর্থনৈতিক বৈষম্য মৌলবাদী জঙ্গিবাদ উত্থানের একটি কারণ। আরও যেসব কারণে জঙ্গিবাদ একটি সমাজে ভিত গাড়ে, তা হলো গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক সংঘাত। সমাজে যখন নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়, যখন বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শ্রেণির মধ্যে হানাহানি বেড়ে যায়, তখন জঙ্গিবাদীরা সহজেই সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝাতে সক্ষম হয়।
এর প্রতিকার হতে পারত একটি টেকসই গণতান্ত্রিক কাঠামো, যেখানে শ্রেণি-পেশা, ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে সবাই নিজের মত প্রকাশ এবং সমাজে ও রাষ্ট্রে নিজের ভূমিকা রাখার সুযোগ পেতেন। গত ৪৩ বছরে বাংলাদেশের শাসকেরা সেই জায়গাটি করে দেননি। সবকিছু নিজেদের দখলে নিতে সচেষ্ট থেকেছেন, এখনো আছেন।
গণতন্ত্র বলতে যদি আমরা গণের বা জনগণের শাসন বুঝি, সেটা এই বাংলাদেশে কখনোই ছিল না, এখনো নেই। যে রাষ্ট্রে বা দেশের প্রধান দুটি দল একে অন্যের ধ্বংসের মধ্যে নিজেদের সাফল্য দেখে, সেই দেশে গণতন্ত্র ও মানুষের মৌলিক মানবাধিকার মোটেই নিরাপদ থাকতে পারে না। নাগরিক সমাজকেও তারা এ-দলে ও-দলে ভাগ করে নিজেদের শক্তি বাড়াতে সচেষ্ট। গণতন্ত্রের জন্য জরুরি যে ভিন্নমত, সেটা তারা একেবারেই শুনতে চায় না। তারা গণতন্ত্রের কথা মুখে বলে, কিন্তু নিজেদের ব্যক্তি আচরণে গণতন্ত্রকে স্বীকার করে না।
বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক সরকারের আমলে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে আমরা গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়ে রাস্তায় নামিয়েছি, কেউ নূর হোসেনের মতো গুলিতে নিহত হয়েছেন। তাজুলের মতো জীবন দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখে গিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন আজও বাস্তবায়িত হয়নি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শহীদ নূর হোসেন-তাজুলদের কথা আমরা ভুলে গেছি, যে রাজনৈতিক দলটির কর্মী ছিলেন নূর হোসেন, তারাও ভুলে গেছে, তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করছে নারায়ণগঞ্জের নূর হোসেনেরা।
গণতন্ত্র ও জঙ্গিবাদ যেমন একসঙ্গে চলতে পারে না, তেমনি সাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রও একসঙ্গে চলতে পারে না। আমরা যদি বাংলাদেশকে ন্যূনতম একটি গণতান্ত্রিক ও আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই; সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব গোত্রের মানুষের মৌলিক অধিকার স্বীকার করতে হবে। কিন্তু আমাদের শাসকগোষ্ঠী তাদের অধিকার স্বীকার না করে বরাবর অধিকার হরণ করতেই অভ্যস্ত। এ কারণেই আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা দৌড়ের ওপর থাকেন এবং বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা৷ আর আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলেমিশে তাদের সমর্থক-অনুরাগী বাদে অন্যদের দৌড়ের ওপর রাখতে ভালোবাসে। এ কারণে বাংলাদেশে চার দশক ধরে যে গণতন্ত্র চলছে, তাকে দৌড় গণতন্ত্র নামে অভিহিত করা যায়।
গণতন্ত্র হলো একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি দেশ বা সমাজে বসবাসকারী যথাসম্ভব সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রয়াস চালানো হয়৷ গণতন্ত্র হলো একটি কাঠামো, যাতে সব দল-মতের মানুষ, সব জাতি-ধর্মের মানুষের অধিকার স্বীকৃত হয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে যা চলছে, শতকরা ১ ভাগের গণতন্ত্র, লুটপাটতন্ত্র, বাকি ৯৯ শতাংশের চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য নেই। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, গণতন্ত্র হলো জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণের শাসন। সেটি এখন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ স্টিগলিৎজের ভাষায় পরিণত হয়েছে ‘ফর দি ওয়ান পারসেন্ট, বাই দি ওয়ান পারসেন্ট অ্যান্ড অব দি ওয়ান পারসেন্ট’। বাংলাদেশের সমাজে ৯৯ ভাগ লোকই ১ শতাংশের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ। এই ৯৯ ভাগের মধ্যে আবার যারা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, তারা আরও বেশি নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার। অর্থনীতির ভাষায় এদের রেন্ট সিকার বা রক্তচোষা শ্রেণি বললেও অত্যুক্তি হয় না। অর্থনীতিতে এই বৈষম্যকে বাড়তে দিয়ে বা জিইয়ে রেখে গণতন্ত্র কায়েম করা যায় না।
প্রধানমন্ত্রী ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উপমহাদেশের নেতাদের একযোগে কাজ করার কথা বলেছেন। কিন্তু এই অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেশের ভেতরে রাজনৈতিক ঐক্য প্রয়োজন, সে সম্পর্কে কিছু বলেননি। কিংবা তিনি হয়তো মনে করছেন, যারা সরকারের অংশীদার তারাই মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীকে মোকাবিলা করতে সক্ষম। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে সরকারের বাইরেও মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার অনেক মানুষ ও সংগঠন আছে। তাদের বাদ দিয়ে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদবিরোধী লড়াইয়ে জয়ী হওয়া যাবে না। বিষয়টি ক্ষমতায় যাওয়ার বা থাকার নয়। এর সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। সরকার একদিকে মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ জারি রাখে, আরেক দিকে যে জঙ্গিবাদী-মৌলবাদী রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হয়েছিল, সেই মঞ্চকে কার্যত ‘পরিত্যক্ত’ ঘোষণা করে। এই স্ববিরোধী নীতি নিয়ে মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী রাজনীতিকে মোকাবিলা করা যাবে না। গোঁজামিল দিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা যায়; কিন্তু গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আর প্রধানমন্ত্রী কাদের নিয়ে মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীকে মোকাবিলা করবেন? কাদের নিয়ে সেক্যুলার বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন? হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে, যিনি বাংলাদেশের সংবিধানকে কলঙ্কিত করেছেন, যিনি কথায় কথায় জিহাদের ঘোষণা দেন এবং মানুষের ফাঁসি চান?
জঙ্গিবাদী-মৌলবাদী রাজনীতিকে পরাস্ত করতে পারে দেশের সেই তরুণেরা; যাঁরা এখনো নষ্ট ও ভ্রষ্ট রাজনীতির শিকার হননি। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে যে তরুণেরা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ করতে পারেন, সেই তরুণেরা আধুনিক ও মানবিক বাংলাদেশের অভিযাত্রাও নিশ্চিত করতে পারবেন বলে বিশ্বাস করি। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কোনো নেতা ছিলেন না, কোনো দল ছিল না। এটি ছিল সব শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত, স্বতঃপ্রণোদিত আয়োজন, যা শাহবাগ ছাড়িয়ে গোটা ঢাকা শহরে, ঢাকা ছাড়িয়ে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা মনে করি, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি, কেবল যুদ্ধাপরাধের বিচার নয়, কেবল মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িকতাবাদী রাজনীতির বিরোধিতা নয়, সত্যিকারভাবে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য এই আন্দোলন জারি রাখতে হবে। যেমন, সলিমুল্লাহ খানের ভাষায়, ‘শাহবাগের তরুণ জাতি যদি আবালবৃদ্ধ জাতির বিবেক হইয়া উঠিতে পারে, তো তাকে শতকরা শতভাগ গণতন্ত্রের আওয়াজ তুলিতে হইবে। আর গণতন্ত্রের শব্দের মধ্যেই লুকাইয়া আছে মানুষে মানুষে সমানাধিকার, মানুষের মর্যাদার আর সামাজিক সাম্য ও সংহতির দাবি।’ (ইতিহাসের দায়, গণজাগরণ মঞ্চ, ২০১৪)
গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে আমাদের ভাষা আন্দোলনের কিছুটা মিল লক্ষ করি। ভাষা আন্দোলনেও ব্যক্তি-নেতৃত্ব ছিল না, দলীয় নির্দেশনা ছিল না বরং দলীয় নিষেধাজ্ঞার বাইরে গিয়েই সাধারণ ছাত্র-তরুণেরা এই আন্দোলন সংঘটিত করেছিলেন৷ বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন পরিণতি পেয়েছিল, ভাষা আন্দোলনকেই যদি স্বাধীনতার সূতিকাগার বলা হয়, তাহলে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে বলা যাবে না। তারা এই সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে অন্তত একটি ধাক্কা তো দিতে পেরেছে। বাংলাদেশ হয়তো পরবর্তী ধাক্কার অপেক্ষায় আছে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net
No comments