পাগলাঘণ্টি বেজেই চলেছে, শুনতে কি পাও? by ফারুক ওয়াসিফ
ছিনতাইকারীদের নির্মমতায় নিহত আয়েশা আক্তারের শিশুকন্যা রাইসার কান্নার খবর পড়ে ল্যু শ্যুনের পাগলের ডায়রি গল্পের শেষ কথাটি মনে পড়ল: ‘শিশুদের বাঁচান’...সেভ দ্য চিলড্রেন। নিহত সাংবাদিক সাগর-রুনির সন্তান মেঘের আর্তনাদ শুনেও মনে বিপদের ঘণ্টা বেজেছিল। এরপর ত্বকী হত্যাকাণ্ড, পুড়িয়ে বাসযাত্রীদের হত্যা...। মিরপুরের কালশীর বিহারিপল্লিতে আগুন দিয়ে নয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার সময়ও মনে বেজে উঠেছিল বিপর্যয়ের পাগলাঘণ্টি। ডুবন্ত জাহাজের নাবিকেরা বাঁচার জন্য বার্তা পাঠান, SOS—সেভ আওয়ার সোলস, আমাদের বাঁচান। বাংলাদেশের মানুষেরা বোবা ভাষায় বার্তা পাঠিয়ে যাচ্ছে: সেভ আওয়ার সোলস। যদিও রাজনীতির গোলমালে সেই আওয়াজ শোনার কান মনে হয় নেই।
রাজনীতি হিংস্র হয়ে উঠেছে এ আমরা জানি। রানা-তাজরীনের মতো লাগামছাড়া মুনাফা তৃষ্ণাতেও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু আমরা ভুলিনি। এসব দেখে যদি বলি সমাজটাই হিংস্র হয়ে উঠছে; সেই সত্য এড়িয়ে যাবেন কী করে? আগে ছিনতাইয়ের কবলে পড়লে বড়জোর টাকা-পয়সা যেত, এখন জীবনও যাচ্ছে। আগে অজ্ঞান করা হতো, এখন টেনেহিঁচড়ে নিয়ে হত্যা করে, গুলি করে হত্যা করে, কুপিয়ে রক্তাক্ত করে। যশোরে ডাকাতেরা বাসযাত্রীদের টাকাকড়ি নিয়েছে, কুপিয়েও গেছে; সম্পূর্ণ বিনা উসকানিতে। নোয়াখালীতে দুটি বিদেশি ফুটবল ক্লাবের দেশীয় ভক্তরা মারামারি করে চারজনকে গুলিবিদ্ধ করে ছেড়েছে। এগুলো স্বাভাবিক আচরণ নয়।
রাজনৈতিক সংঘাত এখন পাশবিক হিংস্রতার অপর নাম। সামান্য কারণে মানুষ শুধু মানুষকেই নয়, আপন মানুষকে—স্বামী স্ত্রীকে, ভাই ভাইকে, সহযোদ্ধা সহযোদ্ধাকে হত্যা করছে। অনেক সংঘাতে হয়তো রক্ত ঝরে না, কিন্তু বিবাদীরা পরস্পরের প্রতি যে ঘৃণা দেখায়; কামড়ে-চিবিয়ে খাওয়ার সঙ্গেই তার তুলনা চলে। হলিউডের জোম্বি ছবিগুলোয় মরা মানুষ জ্যান্ত মানুষদের খেয়ে ফেলে। বাস্তবে জোম্বি বলতে আমরা মনুষ্যত্বহীন মানুষদেরও বুঝতে পারি, অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে যাদের মধ্যে সমবেদনার বদলে জাগে হিংসা। এ দেশেও কি এ রকম জোম্বিদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে না?
লু শ্যুনের গল্পের চরিত্রটি দেখতে পায়, চারপাশের সবাই নরমাংসখেকো হয়ে উঠছে। তার আপন ভাই, গ্রামের দরদি চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবাই যেন সবাইকে খাওয়ার পাঁয়তারা করছে। গল্পকার এখানে নষ্ট সমাজে মানুষের প্রতি মানুষের বিদ্বেষের বিকারকেই মানসিক রোগীর চোখ দিয়ে দেখিয়েছেন। কিন্তু পাগল হলেও লোকটার দেখায় সত্য ছিল। বিপ্লবের আগের চীনের সমাজ এ রকমই হিংসাত্মক আর অধঃপতিত হয়ে উঠেছিল।
পেশাদার অপরাধী সব সময়ই ছিল। কিন্তু স্বাভাবিক সাংসারিক মানুষ কিংবা নেতা ও প্রশাসকের পদে বসে থাকা মানুষদেরও ভয়াবহ সব অপকর্মে জড়িত থাকতে দেখা যাচ্ছে। এটা সম্ভব হতো না যদি সমাজের স্তরে স্তরে, ক্ষমতার পরতে পরতে ভালো মানুষদের ছাপিয়ে খারাপ মানুষদের দাপট প্রতিষ্ঠিত না হতো। কীভাবে সাধারণ সজ্জন মানুষ হিংস্র হয়ে ওঠে, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। একদল বলে থাকে, সমাজে অন্যায়-অবিচার বেড়ে গেলে, বহুল উত্তেজনা ও আশঙ্কায় মানুষ অস্থিরমতি হয়ে উঠলে হিংসাত্মক আচরণে সেসবের প্রকাশ ঘটে। দেখা গেল, বাইরে মার খেয়ে কেউ বউ পেটাচ্ছে। কিংবা রাস্তায়, অফিস-আদালতে ভোগান্তির মধ্যে থাকা মানুষ সমস্যার গোড়ায় কিছু করতে না পেরে অন্য কারও ওপর চড়াও হয়। একে বলা হয় স্থানান্তরিত হিংসা।
স্কটিশ ঔপন্যাসিক রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ড. জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড উপন্যাসে আরেক আলামত দেখি। ড. জেকিল ওষুধের মাধ্যমে কিছু সময়ের জন্য তাঁর ভেতরের অশুভ মানুষটাকে বের করে আনছে, সে–ই পরিণত হচ্ছে নিজের উল্টো চরিত্রে। বাস্তবে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশেষ রকম সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি হলে ভালো মানুষও দুর্বৃত্তে পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ফিলিপ জি জিমবারদোর গবেষণায় এমন সিদ্ধান্তই উঠে আসে। তিনি ইরাকের সিআইএ নিয়ন্ত্রণাধীন আবু গারাইব কারাগারের মার্কিন সৈন্যদের অনাচারের ওপর গবেষণা করে দেখেন, প্রশিক্ষণ ও কারাগারের পরিবেশের যৌথ প্রভাবে সৈন্যদের ভেতরকার দানবগুলো বেরিয়ে আসে। তিনি দাবি করেন, পরিস্থিতির ফেরে পড়ে মানুষ এমন কাজ করে, যা সে কখনো কল্পনাও করেনি। তিনি বলেন, ‘শুভ ও অশুভর মধ্যকার পর্দাটি অত্যন্ত পাতলা...যে কেউই এটা ভেদ করে যেতে পারে...আমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও ঘৃণা দুটোই আছে...কে মাদার তেরেসা হবে আর কে হিটলার হবে, তা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর’।
পরিস্থিতিগুলো কী? ১. ছোট ছোট অপরাধ দমিত না হলে দেখা যায়, ওই সব কাজে জড়িত ব্যক্তিরা একদিন ভয়ানক অপরাধ করে বসে। ২. দায়িত্বে থাকা লোকদের যদি সঠিক মনে হয়, তাহলে তাদের অনুসারীরা তাদের নির্দেশে যেকোনো হিংস্রতা করতে পারে। ৩. যখন আইন-কানুন, নীতি-নৈতিকতা দ্রুত বদলাতে থাকে বা একেক ক্ষেত্রে একেকভাবে ব্যবহৃত হয়। ৪. যখন অন্যায় করাই টিকে থাকার উপায় হয়ে ওঠে। ৫. যখন জীবন অস্থির ও কঠিন হয়ে ওঠে। আমাদের দেশে এসব শর্ত তুমুলভাবেই বিরাজ করছে।
জিমবারদো বিশেষভাবে বলেন, ‘অন্যদের অমানুষ ভাবা এবং সেভাবে গালি দিতে দিতে অনেকে নিজেই অমানুষ হয়ে ওঠে।’ অনেক সময় হত্যাকাণ্ডকে তাদের কাছে মনে হয় ‘মহৎ সেবা’। যেমন ফেসবুকে বা রাজনৈতিক বক্তৃতায় কাউকে যদি বারবার ‘ঘৃণ্য’ বলা হতে থাকে, তাহলে একসময় বোধবুদ্ধি হারিয়ে অনেকেই সেই ব্যক্তিকে ঘৃণ্য ভাবতে শুরু করবে। তাদের কেউ হয়তো ঘৃণ্যকে হত্যা করতেও প্ররোচিত হবে। গত এক বছরে একজন ব্লগার ও একজন ইমাম বীভৎসভাবে নিহত হয়েছেন। অনলাইনে উভয়কেই তাঁদের প্রতিপক্ষ ‘ঘৃণ্য’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছিল। অনেক সময় স্বার্থের দ্বন্দ্ব ছাড়াই কেবল পরিস্থিতির ফেরেও পড়ে মানুষ অন্যায় করে বসে।
সুতরাং এই তত্ত্ব আর চলছে না যে অল্প কিছু খারাপ আপেল বেশির ভাগ আপেলকে পচিয়ে ফেলে। এ কথা বলে আর নিশ্চিন্ত থাকা যাচ্ছে না যে আমি তো ভালো, আমি কখনোই খারাপ কিছু করব না। বরং বেশির ভাগ আপেলই পচনশীল, খারাপ পরিবেশে তাদের সেই পচন আরও ত্বরান্বিত হয়। সমাজব্যবস্থা এবং নীতি ও আইন দিয়েই এই অসভ্যতার বিরুদ্ধে বাঁধ তৈরি করে রাখা হয়। যখন সেই বাঁধ দুর্বল হয় বা ভেঙে পড়ে, তখনই সমাজে মাৎস্যন্যায় বা জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা সৃষ্টি হয়।
একটি দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি যখন অপরাধনির্ভর হয়ে ওঠে, যখন বাস্তবতার টানাপোড়েনে মানুষে মানুষে সম্পর্ক ছিঁড়ে যায়, যখন অপরাধীরা শাস্তির বদলে পুরস্কৃত হয়, যখন হেরোইন-ইয়াবা ইত্যাদির মহামারি লেগে যায় এবং যখন ভালো মানুষেরাও বুঝে না-বুঝে অন্যায়কে সমর্থন করে; তখনই অন্ধকার নেমে আসে। একটি সমাজ ধ্বংস হয় তখনই, যখন খারাপ আর ভালোর প্রভেদ ঘুচে যায়।
যেমন আত্মহত্যা করে নিঃসঙ্গ মানুষ, তেমনি অপরাধ করে অসামাজিক মানুষ। গণনিঃসঙ্গতার শাস্তিপ্রাপ্ত অধিকাংশ নগরবাসীই এ রকম বিপর্যয়ের মুখে। রাস্তাঘাটে-বাসে প্রায়ই দেখি বিড় বিড় করে কথা বলছে বা উন্মত্ত আচরণ করছে কেউ। একদিন পাশের সিটে বসা লোকটা চিৎকার করে উঠলেন, ‘আঁই তোরে মারি হালাইয়াম।’ খুব বেচারা গোছের মানুষটার মনে এত রাগ! প্রতিকারহীন কষ্ট মানুষকে এমন বেপরোয়া করে তোলে। তখনই ড. জেকিলের মনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মি. হাইড নৈতিকতা ও আইনের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়ে।
অপরাধ ও হিংস্রতার মড়ক দেখে দারোগার মন ভাববে পুলিশি অভিযানের কথা। কিন্তু সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক থেকে শুরু করে নেতা ও নীতিনির্ধারকদের ভাবা উচিত, সামষ্টিক জীবনে, রাষ্ট্র পরিচালনে কোথায় গলদ থেকে গেল, কোথায় ক্যানসার বেড়ে উঠছে। তাহলেই হয়তো তারা শুনতে পাবেন লু শ্যুনের সেই ডাক: সেভ আওয়ার চিলড্রেন। পরিণত মানুষেরা খুনি বা খুনের শিকার যাই হোন, সবখানেই আক্রান্ত হয় শিশু। তাদের কেউ স্বজন হারায়, কেউ হয়ে ওঠে ধ্বংসাত্মক আর কেউ হয় হিংস্রতার শিকার।
পাগলাঘণ্টি বেজেই চলেছে, শুনতে কি পাও?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
রাজনীতি হিংস্র হয়ে উঠেছে এ আমরা জানি। রানা-তাজরীনের মতো লাগামছাড়া মুনাফা তৃষ্ণাতেও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু আমরা ভুলিনি। এসব দেখে যদি বলি সমাজটাই হিংস্র হয়ে উঠছে; সেই সত্য এড়িয়ে যাবেন কী করে? আগে ছিনতাইয়ের কবলে পড়লে বড়জোর টাকা-পয়সা যেত, এখন জীবনও যাচ্ছে। আগে অজ্ঞান করা হতো, এখন টেনেহিঁচড়ে নিয়ে হত্যা করে, গুলি করে হত্যা করে, কুপিয়ে রক্তাক্ত করে। যশোরে ডাকাতেরা বাসযাত্রীদের টাকাকড়ি নিয়েছে, কুপিয়েও গেছে; সম্পূর্ণ বিনা উসকানিতে। নোয়াখালীতে দুটি বিদেশি ফুটবল ক্লাবের দেশীয় ভক্তরা মারামারি করে চারজনকে গুলিবিদ্ধ করে ছেড়েছে। এগুলো স্বাভাবিক আচরণ নয়।
রাজনৈতিক সংঘাত এখন পাশবিক হিংস্রতার অপর নাম। সামান্য কারণে মানুষ শুধু মানুষকেই নয়, আপন মানুষকে—স্বামী স্ত্রীকে, ভাই ভাইকে, সহযোদ্ধা সহযোদ্ধাকে হত্যা করছে। অনেক সংঘাতে হয়তো রক্ত ঝরে না, কিন্তু বিবাদীরা পরস্পরের প্রতি যে ঘৃণা দেখায়; কামড়ে-চিবিয়ে খাওয়ার সঙ্গেই তার তুলনা চলে। হলিউডের জোম্বি ছবিগুলোয় মরা মানুষ জ্যান্ত মানুষদের খেয়ে ফেলে। বাস্তবে জোম্বি বলতে আমরা মনুষ্যত্বহীন মানুষদেরও বুঝতে পারি, অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে যাদের মধ্যে সমবেদনার বদলে জাগে হিংসা। এ দেশেও কি এ রকম জোম্বিদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে না?
লু শ্যুনের গল্পের চরিত্রটি দেখতে পায়, চারপাশের সবাই নরমাংসখেকো হয়ে উঠছে। তার আপন ভাই, গ্রামের দরদি চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবাই যেন সবাইকে খাওয়ার পাঁয়তারা করছে। গল্পকার এখানে নষ্ট সমাজে মানুষের প্রতি মানুষের বিদ্বেষের বিকারকেই মানসিক রোগীর চোখ দিয়ে দেখিয়েছেন। কিন্তু পাগল হলেও লোকটার দেখায় সত্য ছিল। বিপ্লবের আগের চীনের সমাজ এ রকমই হিংসাত্মক আর অধঃপতিত হয়ে উঠেছিল।
পেশাদার অপরাধী সব সময়ই ছিল। কিন্তু স্বাভাবিক সাংসারিক মানুষ কিংবা নেতা ও প্রশাসকের পদে বসে থাকা মানুষদেরও ভয়াবহ সব অপকর্মে জড়িত থাকতে দেখা যাচ্ছে। এটা সম্ভব হতো না যদি সমাজের স্তরে স্তরে, ক্ষমতার পরতে পরতে ভালো মানুষদের ছাপিয়ে খারাপ মানুষদের দাপট প্রতিষ্ঠিত না হতো। কীভাবে সাধারণ সজ্জন মানুষ হিংস্র হয়ে ওঠে, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। একদল বলে থাকে, সমাজে অন্যায়-অবিচার বেড়ে গেলে, বহুল উত্তেজনা ও আশঙ্কায় মানুষ অস্থিরমতি হয়ে উঠলে হিংসাত্মক আচরণে সেসবের প্রকাশ ঘটে। দেখা গেল, বাইরে মার খেয়ে কেউ বউ পেটাচ্ছে। কিংবা রাস্তায়, অফিস-আদালতে ভোগান্তির মধ্যে থাকা মানুষ সমস্যার গোড়ায় কিছু করতে না পেরে অন্য কারও ওপর চড়াও হয়। একে বলা হয় স্থানান্তরিত হিংসা।
স্কটিশ ঔপন্যাসিক রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ড. জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড উপন্যাসে আরেক আলামত দেখি। ড. জেকিল ওষুধের মাধ্যমে কিছু সময়ের জন্য তাঁর ভেতরের অশুভ মানুষটাকে বের করে আনছে, সে–ই পরিণত হচ্ছে নিজের উল্টো চরিত্রে। বাস্তবে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশেষ রকম সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি হলে ভালো মানুষও দুর্বৃত্তে পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ফিলিপ জি জিমবারদোর গবেষণায় এমন সিদ্ধান্তই উঠে আসে। তিনি ইরাকের সিআইএ নিয়ন্ত্রণাধীন আবু গারাইব কারাগারের মার্কিন সৈন্যদের অনাচারের ওপর গবেষণা করে দেখেন, প্রশিক্ষণ ও কারাগারের পরিবেশের যৌথ প্রভাবে সৈন্যদের ভেতরকার দানবগুলো বেরিয়ে আসে। তিনি দাবি করেন, পরিস্থিতির ফেরে পড়ে মানুষ এমন কাজ করে, যা সে কখনো কল্পনাও করেনি। তিনি বলেন, ‘শুভ ও অশুভর মধ্যকার পর্দাটি অত্যন্ত পাতলা...যে কেউই এটা ভেদ করে যেতে পারে...আমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও ঘৃণা দুটোই আছে...কে মাদার তেরেসা হবে আর কে হিটলার হবে, তা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর’।
পরিস্থিতিগুলো কী? ১. ছোট ছোট অপরাধ দমিত না হলে দেখা যায়, ওই সব কাজে জড়িত ব্যক্তিরা একদিন ভয়ানক অপরাধ করে বসে। ২. দায়িত্বে থাকা লোকদের যদি সঠিক মনে হয়, তাহলে তাদের অনুসারীরা তাদের নির্দেশে যেকোনো হিংস্রতা করতে পারে। ৩. যখন আইন-কানুন, নীতি-নৈতিকতা দ্রুত বদলাতে থাকে বা একেক ক্ষেত্রে একেকভাবে ব্যবহৃত হয়। ৪. যখন অন্যায় করাই টিকে থাকার উপায় হয়ে ওঠে। ৫. যখন জীবন অস্থির ও কঠিন হয়ে ওঠে। আমাদের দেশে এসব শর্ত তুমুলভাবেই বিরাজ করছে।
জিমবারদো বিশেষভাবে বলেন, ‘অন্যদের অমানুষ ভাবা এবং সেভাবে গালি দিতে দিতে অনেকে নিজেই অমানুষ হয়ে ওঠে।’ অনেক সময় হত্যাকাণ্ডকে তাদের কাছে মনে হয় ‘মহৎ সেবা’। যেমন ফেসবুকে বা রাজনৈতিক বক্তৃতায় কাউকে যদি বারবার ‘ঘৃণ্য’ বলা হতে থাকে, তাহলে একসময় বোধবুদ্ধি হারিয়ে অনেকেই সেই ব্যক্তিকে ঘৃণ্য ভাবতে শুরু করবে। তাদের কেউ হয়তো ঘৃণ্যকে হত্যা করতেও প্ররোচিত হবে। গত এক বছরে একজন ব্লগার ও একজন ইমাম বীভৎসভাবে নিহত হয়েছেন। অনলাইনে উভয়কেই তাঁদের প্রতিপক্ষ ‘ঘৃণ্য’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছিল। অনেক সময় স্বার্থের দ্বন্দ্ব ছাড়াই কেবল পরিস্থিতির ফেরেও পড়ে মানুষ অন্যায় করে বসে।
সুতরাং এই তত্ত্ব আর চলছে না যে অল্প কিছু খারাপ আপেল বেশির ভাগ আপেলকে পচিয়ে ফেলে। এ কথা বলে আর নিশ্চিন্ত থাকা যাচ্ছে না যে আমি তো ভালো, আমি কখনোই খারাপ কিছু করব না। বরং বেশির ভাগ আপেলই পচনশীল, খারাপ পরিবেশে তাদের সেই পচন আরও ত্বরান্বিত হয়। সমাজব্যবস্থা এবং নীতি ও আইন দিয়েই এই অসভ্যতার বিরুদ্ধে বাঁধ তৈরি করে রাখা হয়। যখন সেই বাঁধ দুর্বল হয় বা ভেঙে পড়ে, তখনই সমাজে মাৎস্যন্যায় বা জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা সৃষ্টি হয়।
একটি দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি যখন অপরাধনির্ভর হয়ে ওঠে, যখন বাস্তবতার টানাপোড়েনে মানুষে মানুষে সম্পর্ক ছিঁড়ে যায়, যখন অপরাধীরা শাস্তির বদলে পুরস্কৃত হয়, যখন হেরোইন-ইয়াবা ইত্যাদির মহামারি লেগে যায় এবং যখন ভালো মানুষেরাও বুঝে না-বুঝে অন্যায়কে সমর্থন করে; তখনই অন্ধকার নেমে আসে। একটি সমাজ ধ্বংস হয় তখনই, যখন খারাপ আর ভালোর প্রভেদ ঘুচে যায়।
যেমন আত্মহত্যা করে নিঃসঙ্গ মানুষ, তেমনি অপরাধ করে অসামাজিক মানুষ। গণনিঃসঙ্গতার শাস্তিপ্রাপ্ত অধিকাংশ নগরবাসীই এ রকম বিপর্যয়ের মুখে। রাস্তাঘাটে-বাসে প্রায়ই দেখি বিড় বিড় করে কথা বলছে বা উন্মত্ত আচরণ করছে কেউ। একদিন পাশের সিটে বসা লোকটা চিৎকার করে উঠলেন, ‘আঁই তোরে মারি হালাইয়াম।’ খুব বেচারা গোছের মানুষটার মনে এত রাগ! প্রতিকারহীন কষ্ট মানুষকে এমন বেপরোয়া করে তোলে। তখনই ড. জেকিলের মনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মি. হাইড নৈতিকতা ও আইনের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়ে।
অপরাধ ও হিংস্রতার মড়ক দেখে দারোগার মন ভাববে পুলিশি অভিযানের কথা। কিন্তু সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক থেকে শুরু করে নেতা ও নীতিনির্ধারকদের ভাবা উচিত, সামষ্টিক জীবনে, রাষ্ট্র পরিচালনে কোথায় গলদ থেকে গেল, কোথায় ক্যানসার বেড়ে উঠছে। তাহলেই হয়তো তারা শুনতে পাবেন লু শ্যুনের সেই ডাক: সেভ আওয়ার চিলড্রেন। পরিণত মানুষেরা খুনি বা খুনের শিকার যাই হোন, সবখানেই আক্রান্ত হয় শিশু। তাদের কেউ স্বজন হারায়, কেউ হয়ে ওঠে ধ্বংসাত্মক আর কেউ হয় হিংস্রতার শিকার।
পাগলাঘণ্টি বেজেই চলেছে, শুনতে কি পাও?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
No comments